কথা রয়ে যায়

এক
– সময় কিন্তু বেশি হয়নি। এখুনি যেতে হবে?
– বেশি হয়নি কে বলেছে? সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হতে চললো। এরপর বাড়ি না ফিরলে খবর আছে।
–  আরেকটু থাকো। একদিন না হয় এক আধটু খবরই হোক। রোজ রোজ বিরতিহীন ড্রামা তো ভালো লাগেনা।
– তোমার ওসব মন ভুলানো কথা ছাড়ো! কাব্যিকথা রোচেনা আর। 
–  আচ্ছা যাও। আর এসোনা।
– সত্যি আসবোনা?
– না! মিথ্যে এসোনা।

দুই
– আচ্ছা আমি লোকটা কেমন?
– হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?
– জানতে ইচ্ছে করছে। বলোনা কেমন?
– গর্দভ টাইপের!
– হুম! সেটাই ভাবছিলাম।  
– সেটাই ভাবছিলে?
– হ্যাঁ।  গর্দভ না হয়ে তোমাকে কিভাবে বিয়ে করলাম সেটাই কিছুতে মেলাতে পারছিলাম না। তোমার কথায় আশস্ত হলাম।
– চালাকি হচ্ছে?
– নাহ! বোকাদের সাথে কেউ চালাকি করে?
– আমি বোকা?
–  কে জানে। আসলে পৃথিবীতে বোকাদের দুই রকমের। এক হচ্ছে চালাক বোকা, আর বাকিরা হচ্ছে, বোকা বোকা।
– কি রকম?
–  যারা চালাক বোকা তারা নিজেরা যে বোকা সেটা বুঝতে পারে। আর যারা বোকা বোকা তারা সারাক্ষন “আমি বোকা? ” বলে মানুষ কে প্রশ্ন করে বেড়ায়।
– তুমি কি বুঝাতে চাইছো আমি দ্বিতীয় শ্রেণীর বোকা?
– কি জানি। এই দ্বিতীয় শ্রেণীর বোকারা কোন কথায় ঠিকমত বুঝতে পারেনা।
– আমি বুঝেছি। তুমি আমাকেই বলেছো।
– ও…
– তোমার কথায় আমি কিন্তু রাগ করেছি।
– সে আর এমনকি। বোকারাই কথায় কথায় রাগ করে।
–  রান্না বান্না বন্ধ আজকে। দেখি কি খাও।
– আচ্ছা সে বন্ধ থাক। দ্বিতীয় শ্রেণীর বোকাদের যে একটা ভালো গুণ আছে সেটা শুনো আগে।
– সেটা কি?
– সেটা হচ্ছে, তারা খুব ভালো রান্না করতে পারে। যাকে  বলে শৈল্পিক রান্না। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে তারা ভারী বোকা কীনা তাই প্রায়ই অন্যের কথায় রাগ করে নিজেদের এই শিল্প চর্চা বন্ধ রাখে!

 

তিন
– সম্পর্কটা আসলে একটা সুতোর মতো।
– সুতোর মতো?
– হ্যাঁ। সুতোটার একটা প্রান্ত তোমার হাতে, অপরটা আমার হাতে। এখন ধরো আমরা যদি খুব কাছাকাছি চলে আসি তাহলে কি হবে?
– কি হবে?
– সুতোর টান ঢিলে হয়ে যাবে। আর সে টান ঢিলে হলে ঝগড়া, রাগ, অভিমান, দুঃখ এগুলো খুব স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে পড়ে। বুঝেছো?
– হু… বুঝেছি।
– কি বুঝেছো বলতো দেখি?
– এই যে আমাদের মধ্যে আজকাল প্রায়ই ঝগড়া, রাগ, দুঃখ, অভিমান চলছে, এর কারণ আমাদের দুরে সরে যাওয়া নয় বরং খুব কাছাকাছি চলে আসা।
– তাহলে আর এই নিয়ে কখনো মন খারাপ করবে?
– না।


চার
– একটা ব্যাপার কোনভাবেই ধরতে পারছিনা।
– কি ব্যাপার?
– আমাদের মধ্যে অনেকদিন ধরে কোন ঝগড়া হচ্ছেনা। আমরা কি তাহলে ক্রমশ দুরে সরে যাচ্ছি? নাকি আমার সুতোর তত্ব ভুল।
– সুতোর তত্ব?
– সেকি! ভুলে গেলে? সেই যে বলেছিলাম  সম্পর্ক সুতোর মতো…
– ও… বয়েস হয়ে গেছে। আজকাল আর সবকথা ঠিক মনে থাকেনা।
– হুম! তত্বটা মনে হয় ঠিক আছে, বয়সটাই মনে হয় এখানে মূল সমস্যা।
– বয়স হয়ে যাওয়ার কারণে দূরত্ব বাড়ছে?
– না। দূরত্বও বাড়ছে। আদতে আমরা ঝগড়া করার স্পৃহা হারিয়ে ফেলেছি। রাগ, অভিমান, দুঃখ তেমনি আছে, শুধু সেটা প্রকাশ করার সামর্থ্যটা হারিয়ে গেছে।
– সে অবশ্য ঠিক বলেছো। তোমার সাথে রাগ করে কত বেলা যে অভুক্ত থেকেছি। এখন তো আর সেসব ভাবতেই পারিনা।
– কদিন ধরে ধরে মনটা কেমন হু হু করে। মনে হয় যেন কে ডাকে। কোথায় যেন যেতে বলছে।
– ওসব ভাববেনা তো। তোমার আর কি এমন বয়স হয়েছে!
– একটা কথা বলব?
– কি?
– “তব বিচ্ছেদে মম বিষণ্ণ স্বর্গবাস”
– বুড়ো হয়েও কাব্যি করার অভ্যেস গেলোনা তোমার!
– বুড়ো হলাম কোথায়? তুমিইনা বললে, “তোমার আর কি এমন বয়স হয়েছে”।
 

পাঁচ
– সময় কিন্তু বেশি হয়নি। এখুনি কি যেতে হলো?

ওপাশে তখন গভীর নিস্তব্ধতা!