ইস্টুপেন্ট্রা

ঘরে ঢুকে দেখি ব্যাটা এখনও যায়নি।
সেই সকাল আটটায় যেমন দেখে গেছি, এখনও দেখছি তেমনি সোফায় পাটকাঠির মত পা গুলো ঝুলিয়ে বসে আছে। আমাকে দেখে হুরমূর করে উঠতে গিয়ে পড়লো উল্টে!
ব্যাপারটা দেখে ভয়ানক হাসি পেলেও আমি কোনমতে মুখটা সিরিয়াস করে রাখলাম। মনে মনে একটা ধমক লাগাব কিনা ভাবলাম। ব্যাটা বড় জ্বালাতন শুরু করেছে ।

ঘটনার শুরু গতকাল সন্ধ্যায়। গলি রাস্তা ধরে বাসায় ফিরছিলাম। হঠাৎ করে মনে হল কে যেন পেছন পেছন আসছে। থেমে দাড়িয়ে পেছনে তাকাতে দেখি কি যেন একটা অদ্ভুত একটা প্রাণী আমার ঠিক দু ফিট দুরে হাসি হাসি মুখ করে দাড়িয়ে আছে।
লাইট ফেলতেই চমকে উঠলাম। বিরাটাকার মাথা,লম্বা নাক আর সে নাকের উপরে প্রায় ঝুলে থাকা এক জোড়া চোখ।  হাড় হিরহিরে কালো কুচকুচে শরীর, আর মস্ত একটা মুখ হা করে মায়াবী বানাতে গিয়ে বরং আর বিদঘুটে করে তুলেছে।  প্রথমে একটু ভয় ভয় লাগলেও, প্রানীটার স্বাস্থ গতর দেখে বেশ নিরিহই মনে হলো>
তাই বেশ একটু তাতিয়ে হেঁড়ে গলায় বললাম,
– কেরে ব্যাটা তুই?
প্রাণীটা মনে হলো বেশ একটু বিব্রত হল। একটু দুঃখিতও। ওকে না চিনতে পাড়ায় যেন ব্যাচারা ভয়ানক অপমানিত বোধ করছে।তারপর একটু কেশে উত্তর দিল,
– আমি একটা এলিয়েন! আমার নাম ইস্টুপেন্ট্রাকাসটুকস!
-ইস্টুপেট……

উচ্চারণ করতে গিয়ে বুঝলাম অমন নাম উচ্চারণ করা আমার কম্ম নয়। সুতরাং এলিয়েন বলে স্মবোধন করাটাই যুক্তি সঙ্গত মনে করলাম।
– তা এলিয়েন সাহেব, আমার পেছন পেছন আসছেন কেন আপনি?

বেচারাকে মনে হলো আবারো বিব্রত করে দিলাম। কিন্তু এবার কি কারণে বিব্রত হল ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। এলিয়েনটা গাইগুই করে দু তিনবার কি বলতে গিয়ে যেন থেমে গেল।
তারপর দেখি কাঁধে ঝুলানো মস্ত একটা ব্যাগ   থেকে খাতা কলম বের করছে। ব্যাগটা ওর শরীরের কমপক্ষে দুই গুন তো হবেই। মাটিতে লেগে ময়লায় একসার হয়ে আছে। এরই মধ্যে ব্যাগ থেকে বের করা  খাতার কগজে কি যেন একটা লিখল বেশ মনযোগ দিয়ে। তাঁরপর বেশ কয়েকবার নিজে চোখ বুলিয়ে নিয়ে  আমার হাতে ধরিয়ে দিল সেটা।
তারপর খানিকটা দুরে সরে গিয়ে হাসি হাসি মুখ করে দাড়িয়ে রইল।

পুরো ব্যাপারটার আকস্মিকতায় আমি তখন প্রায় বিমুঢ়! আর না হয়েই বা কি করব। এমন অদ্ভুত দৃশ্য দেখব কেউ ভেবেছেকি কখনও!
গল্পে, সিনেমায় অনেক যেসব এলিয়েনের কথা শুনেছি। তারা অদ্ভুত অদ্ভুত সব ডিভাইস ইউস করে বলে জানতাম। কিন্তু কোন এলিয়েন কে কাগজে কলম চালাতে এই প্রথম দেখলাম।
যাহোক আমি লাইট জ্বেলে কি লিখেছে সেটা পড়ায় মনযোগ দিলাম।
এক গাদা কাটাকুটি আর ভুল বানানে ব্যাটা যা লিখেছে তা হচ্ছে, ও ওর কয়েকজন বন্ধুর সাথে পৃথিবীতে বেড়াতে এসেছে। তো দোকান থেকে এলিয়েন নিয়ে লেখা একটা গল্প পড়ে ওর বড্ড ইচ্ছা যে ওকে নিয়েও কেউ অমন একটা গল্প লিখুক।

আমি একবার চোখ তোলে তাকালাম। বেচারার মুখ দেখে মনে হচ্ছে বেশ আশা নিয়ে দাড়িয়ে আছে। কিন্তু আমার বেচারাকে নিরাশই করতে হল। একে, আমি তেমন ধাঁচের কোন লেখক নই। মাঝে মাঝে বাচ্চাদের জন্য মা, দাদীদের কাছ থেকে ধার করা গল্প নিয়ে দু একটা রুপকথা লিখি। আর সবচেয়ে বড় কথা এলিয়েন কে নিয়ে রুপকথা লেখা যায়না, লিখতে হয় সায়েন্স ফিকশন। সায়েন্সের বড় বড় টার্মগুলোর কথা না হয় বাদই দিলাম, আজকাল এক চিলতে ক্লাস টু এর বাচ্চার বৈজ্ঞানিক যুক্তি পর্যন্ত আমার মাথার উপর দিয়ে সো…সো করে চলে যায়।
আমি বললাম,
– এলিয়েন সাহেব, আমি তো সায়েন্স ফিকশন লিখতে জানিনা। আপনি বরং অন্য কারো সাথে যোগাযোগ করুন। এই যে দেখুন, আপনি ইস্টু ফিস্টু কি যেন একটা নাম বললেন আপনার নাম আমি উচ্চারণই করতে পারলাম না!

বেচারা এলিয়নের হতাশ মুখটা দেখার ইচ্ছা হলোনা আমার। তাই দ্রুত ওর হাতে কাগজ খানা গুজে দিয়ে হাটা ধরলাম। খানিকটা পথ ভদ্রতা কিংবা নিজের সাহস জারি করার ইচ্ছা যে কারণেই হোক ঢিমে তালে হাটলেও, শেষমেষ যখন বাড়িতে পৌঁছলাম তখন দৌড়াতে  দৌড়াতে   আমার গলা শুকিয়ে কাঠ।
কোন রকমে খাবার দাবার সেরে নিয়ে দরজা জানালা ভালো করে আটকে যখন বিছানায় কাঁথার নিচে সেধোলাম তখনও আবার বুক ধরফর একটুও কমেনি।
পরদিন সকালবেলা সবকিছু ঠিকঠাক দেখে কিছুটা শান্ত হলো মন। এলিয়েন ব্যাটা নিশ্চয় তার গ্রহে গোষ্ঠি সমেত ফিরে গেছে। প্রাতক্রিয়া সেরে বেশ ফুরফুরে মনেই অফিসের পথে রওয়ানা দিলাম। গলির মুখে ভিখারি বসে প্রতিদিন, রোজ আমি যাওয়ার সময় তাঁর মায়বী সুরে ভিক্ষা চাওয়া অবহেলা করে অনায়াসে পেরিয়ে যাই। আজকে কি মনে করে তাক পুরো একটা দশ টাকা নোট দান করে দিলাম।

কিন্তু তখনও কি জানতাম যে , অমন সহজ সরল মুখের নিরিহ এলিয়েনটা আঠার মত সেটে গিয়ে আমার জীবনটা দুর্বিষহ করে তুলবে!

সেদিন সারা দিন খাটা খাটুনি কম যায়নি। সুতরাং বাসায় এসে বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে শোতে না শোতেই একরাশ ঘুম ঝেকে ধরলো আমাকে।
মাঝ রাতে ঘুম ভেঙ্গে উঠে দেখি কি যেন পেটের উপর বসে বিড়বিড় করে কি যেন আওড়াচ্ছে। ঘর অন্ধকার ছিল। তাও বুঝতে দেড়ি হলোনা কে এটা,
ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায় মেজাজটাই বিগরে গিয়েছিল। ধমক লাগালাম,

-কিরে ইস্টু পিস্টু, হতচ্ছাড়া আবার কি চাস?

বলতে না বলতেই ব্যাটা আরেকটা কাগজ এগিয়ে দিল আমার দিক। আমি লাইট জ্বালালাম। অবশ্য তার আগে ঝারি দিয়ে পাজিটাকে পেটের উপর থেকে সরিয়ে দিলাম। বেচারা সারা ঘর খোঁজে ওর সাইজে জুত করে বসার মত কিছু না পেয়ে শেষ মেষ অনেক কসরত করে গিয়ে সোফার উপর উঠে বসলো।

আমি কাগজে চোখ বুলালাম। এবার ব্যাটা ইংরেজিতে বড় করে প্লিজ  লিখে এনেছে। তাতে আবার পি লিখতে গিয়ে বি লিখে ফেলেছে। আমি রাগী রাগী চোখে এলিয়েনটার দিকে তাকালাম। বললাম,
– আমাকে প্লিজ কি হাতুরি দিয়ে পিটলেও সায়েন্স ফিকশন বেরোবে না। সুতরাং অন্য জায়গায় তদবির করলে অনেক দ্রুত কাজ হয়ে যাবে !

কথাটাতে এমন ম্যাজিকের মত কাজ হবে  ভাবিনি। আমার কথা শেষ হতে না হতেই হাত থেকে কাগজটা ছিনিয়ে নিয়ে জানালা দিয়ে বেড়িয়ে যেতে যেতে বিড়বিড় করে বোধ হয় গালাগালিই করে গেল। বেচারা মনে হয় এবার সত্যিই আমার উপর হতাশ হয়ে পড়ল। কোন লেখার জন্য কেউ আমার কাছে এতোকরে কখনও তদবির করেনি কখনও। তাই মানুষ না হোক, এলিয়েনের কাছ থেকে হলেও খানিকটা আদর আবদার আমারও খারাপ লাগছিলোনা। বেচারা এভাবে এক কথায় চলে যেতে দেখে কষ্টই লাগছিলো তখন।  কিন্তু  আপদ চুকল ভেবে পরোক্ষনেই আবার  মনে সস্তি ফিরে পেলাম।

কিন্তু সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে তো আমার চোখ চড়ক গাছ! ব্যাটা দিব্বি সোফায় পা তুলে বসে। এবার যেন খানিকটা গম্ভীর করে রেখেছে মুখটা। হাবভাব দেখে মনে  হলো সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠায় এবার যেন  বাঁকা আঙ্গুলের কোন কৌশল বাতলে এসেছে। মনে মনে কিছুটা দুঃশ্চিন্তা কাজ করলেও, সামলে নিলাম। একেতো দিন, ভয় দেখিয়ে কিছু করতে পারবে না, তাঁর উপর ব্যাটার যা লিকলিকে হাত পা,  আমাকে তেড়ে মারতে আসলে উলটা নিজেই আছরে পরে হাত পা ভেঙ্গে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
কোন আজব যন্তর মন্তরও যে তাঁর দখলে নাই সেটাতো আগেই জেনে গিয়েছিলাম।

তাই ওরকম হাবভাবকে আমিও তেমন পাত্তা দিলাম না। যেন দেখতেই পাইনি এমন ভাব করে সোজা রেডী হয়ে অফিসে চলে গেলাম।

অফিস ফেরত বাড়ি ফিরেও দেখি ব্যাটার যখন কোন নড়াচড়ার লক্ষণ দেখলাম না, তখন এক রকম বাধ্য হয়েই বললাম,
আন দেখি তোর খাতা!

লাফাতে লাফাতে ব্যাটা তৎক্ষণাৎ তার ব্যাগ থেকে বের করে আনলো সেই খাতা আর কলম।
আমি লিখতে বসলাম। জিজ্ঞেস করলাম,

  • তা তোর নামটা বল তো আবার।
  • ইস্টুপেন্ট্রাকাসটুকস!
  • এ তো বড় জটিল নাম। ছোটখাট কোন নাম নেই।
    ব্যাটা মাথা নেড়ে জানালো, নেই!
  • ঠিক আছে আমি তোর নাম ছোট করে নিচ্ছি। তোর নাম নতুন নাম দিলাম, ইস্টুপেন্ট্রা!

ইস্টুপেন্ট্রাকে দেখলাম গম্ভীর মুখ করে বসে আছে। নতুন নামে খুশি হলো কিনা বুঝা গেলনা।
– তা, ইস্টুপেন্ট্রা! তোর গ্রহের নাম কি?

ইস্টুপেন্ট্রা এবার এমন একটা শক্ত নাম বলল যে, আমি লেখা তো দূরের কথা দ্বিতীয়বার ভাবারও চিন্তা করলাম না।

বললাম, কোন এডভেঞ্চার হয়েছে পৃথিবীতে এসে?

উত্তরে ও আমাকে একটা গোবরে পোকার সাথে যে যুদ্ধের কাহিনী বলল, তাতে বুঝলাম ওর এডভেঞ্চারের দৌড় কতদূর!

শেষ মেষ নিজেই একটা রুপকথা টাইপ গল্প লিখে দিলাম ওকে নিয়ে।  মহা উৎসাহ নিয়ে লাফাতে লাফাতে বেড়িয়ে গেল ইস্টুপেন্ট্রা। যাবার আগে অবশ্য ধন্যবাদ দিতে ভুললোনা।

 

এর পরে আর বেশ কয়েকদিন ইস্টুপেন্ট্রার কোন সাক্ষাৎ পেলাম না। ভাবলাম দলবল সমেৎ পৃথিবী ছেড়ে ভেগেছে মনে হয়। প্রায় ভুল গেছি, এমন সময় একদিন এসে হাজির। হাতে একটা ঝুরি। তেমনি সোফায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে। আমি দেখে খুশিই হলাম,
বললাম, কিরে ইস্টুপেন্ট্রা! কি খবর?
হাসি হাসি মুখ করে ইস্টুপেন্ট্রা আমার দিকে তাকালো সে।  জানালো আমার গল্পটা পড়ে নাকি  গ্রহে ওর যত্ন আত্নি বেশ বেড়ে গেছে। তাঁকে জাতীয় বীর পদকেরও নাকি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কিন্তু একটা সমস্যা হয়ে গেছে। পদক দেয়ার আগে তাকে এটা প্রমাণ করতে হবে যে, সে সত্যি সত্যিই কোন গোবরে পোকার সাথে যুদ্ধ করেছে। আর সে জন্য এবার সে এসেছে কয়েকটা গোবরে পোকাকে বন্দি করে নিয়ে যেতে। আমার দিকে ঝুরিটা এগিয়ে দিলো সে। অনুরোধ করে বললো, দয়া করে যদি দু একটা গোবরে পোকা ধরে দেই তাঁকে।
আমি বললাম, সেতো তুই নিজেই ধরে নিতে পারিস!
আমার কথায় কেমন মিইয়ে গেলো সে। হাসি হাসি মুখটা কেমন গোমরা হয়ে গেলো। তারপর জানালো, বীর পদক পাবে এই আশায় সে খুব  আনন্দে আছে। এখন অযথা গোবরে পোকার সাথে যুদ্ধে গিয়ে প্রাণটা খোয়াতে চায়না। তাই যদি আমিই কাজটা করি দেই তাহলে খুব ভালো হয় ওর জন্য।
হাসি পেলো বেচারার অসহায় অবস্থা দেখে। কিছুটা অবশ্য বিরক্তও হলাম। আমি এখন গোবরে পোকা খুজি কোথায় গিয়ে?
কিন্তু ওর যা স্বভাব না করলেও শুনবে। আঠার মতো পিছে পড়ে থাকবে। তাই খানিকটা বাধ্য হয়েই এদিক সেদিক ঘুরে তিন চারটা গোবরে পোকা ধরে দিলাম ওকে। কি জানি ওষুধ দিয়ে গোবরে পোকাগুলোকে অজ্ঞান করে  ইস্টুপেন্ট্রা বিদায় নিলো।

এই ঘটনার ছমাস পরে। একদিন বাইরে তুমুল শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলো আমার। জানালার দিকে মুখ বাড়াতেই দেখলাম ইস্টুপেন্ট্রা আবার হাজির। এবার একা নয়, সঙ্গে বেশ দলবল নিয়ে এসেছে।
আমি হাকলাম, কিরে ইস্টুপেন্ট্রা, আবার কি হয়েছে?
কথা শেষ হবার আগেই জানালা দিয়ে বেড়ালের মতো গা গলিয়ে আমার ঘরে ঢুকে পড়েছে ওরা। হৈ চৈ করে নিজেরদের মধ্যে কি যেন গাই গুই আলোচনা চালালো। তারপর ইস্টুপেন্ট্রা এগিয়ে এসে আমার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিলো।
কাগজে লাল কালিতে বড় বড় করে লেখা, “খুব বিপদ! “।
আমি জিজ্ঞেস  করলাম, বিপদটা কি?
ইস্টুপেন্ট্রা হা পা নেড়ে কোন রকমে আমাকে যা বুঝালো তাতে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। সেই যে তিনটে গোবরে পোকা ধরে দিয়েছিলাম ওদের? সেই তিনটে নাকি এখন ওদের পুরো গ্রহ দখল করে নিয়েছে!