দ্য পিয়ানিস্ট

[su_box title=”চলচ্চিত্রের তথ্য” style=”soft”]

  • দৈর্ঘ্যঃ ১৫০ মিনিট
  • রঙঃ রঙিন
  • দেশঃ ফ্রান্স, পোল্যান্ড, জার্মানি, যুক্তরাজ্য
  • ভাষাঃ ইংরেজি
  • পরিচালনাঃ রোমান পোলানস্কি
  • প্রযোজনাঃ রোমান পোলানস্কি, রবার্ট বেনমুসা, আলিয়ান সার্ডে, জিন গোটস্কি
  • চিত্রনাট্যঃ রোনাল্ড হারউড, ল্যাডিস্ল জিপিম্যান (মূল গ্রন্থ)
  • অভিনয়ঃ আদ্রিয়ান ব্রডি, টমাস ক্রেতসম্যান, ফ্রাঙ্ক ফিনলে, মাউরিস লিপম্যান, এমিলিয়া ফক্স, মাইকেল জেবোরস্কি
  • সঙ্গীতঃ বোৎসেখ কিলার, ফ্রেড্রিখ চপিন
  • চিত্রগ্রহণঃ পাভেল এডেলম্যান
  • সম্পাদনাঃ হের্ভে দে লুজে

[/su_box]

 

কাহিনী সংক্ষেপঃ

স্প্লিলম্যান একজন পিয়ানিস্ট। পিয়ানো বাজানো তার কাছে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের মত প্রয়োজনীয়। ওয়ারশ রেডিও স্টেশনে সে নিয়মিত বাজিয়ে থাকে। মানুষ তাকে একনামে চেনে। এই আইডেন্টিটি নিয়ে সে একটা সুস্থ সমাজে সুস্থ জীবনযাপন করছিল। কিন্তু ১৯৩৯ সালে এসে সব পাল্টে গেল। জার্মান নাৎসি সেনা পোল্যান্ডে অনুপ্রবেশ করল ও বোম মেরে রেডিও স্টেশন তথা ওয়ারশ শহরের দফারফা করে দিল। তখন আর স্পিলম্যান ‘পিয়ানোবাদক’ রইল না। সে আর তার পরিবার হয়ে গেল ‘পোলিশ-ইহুদী’। নিয়ম হয়ে গেল সমস্ত ইহুদীকে জামার হাতায় ইহুদীদের চিহ্ন ‘স্টার অফ ডেভিড’ লাগাতে হবে আর সবাইকে একটা ইহুদী ঘেটোতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। হাজার হাজার ইহুদী একটা ছোট্ট অঞ্চলে গাদাগাদি করে পশুর মত থাকতে শুরু করল। চারদিকে উঁচু পাঁচিল ঘেরা। সমস্ত জীবনযাপন ঐটুকু অমানবিক অসুস্থ পরিসরে। নাৎসি দেনাদের ইয়ারকি ঠাট্টা করার, টাইম পাস করার এলিমেন্ট হল ইহুদীরা। ভালো করে চলতে পারে না যে বৃদ্ধ – তাকে রাস্তায় বেমক্কা নাচতে বলা হল, জাস্ট ইচ্ছে হল বলে যার মাথায় খুশি বুলেট ঠুসে দেওয়া হল, হুইলচেয়ারে বসা পঙ্গুকে চারতলার ব্যাল্কনি থেকে নীচে ফেলে দেওয়া হল। মানুষ ছাড়া অন্য কোনও প্রাণীগোষ্ঠীর মধ্যে এই নিষ্ঠুরতা থাকা সম্ভব কী? ওয়ারশ থেকে প্রত্যেকদিন মালগাড়িতে ঠাসাঠাসি করে ইহুদী তুলে দরজা বন্ধ করে সেই মালগাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হত ট্রেবলিঙ্কা গ্রামের দিকে (যা আসলে বিশাল কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প ছিল)। স্পিলম্যানের দুই বোন, এক ভাই, বাবা-মাও তাদের মধ্যে। তাদের কি হত কেউ খবর দিতে পারে না। শুধু দেখা যেত ইহুদী ভর্তি মালগাড়ি রোজ ঐ লাইনে চলে যাচ্ছে আর ফাঁকা ডাব্বা ফিরে আসছে। কোনও খাবারের গাড়ি কেউ ওদিকে যেতে দ্যাখেনি। স্পিলম্যান এখন ইহুদী হয়ে পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায়। তার পিয়ানিস্ট সত্তা পিয়ানো বাজাতে না পেরে হাঁপিয়ে ওঠে।

দ্যা পিয়ানিস্ট চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য

একদিন এক বন্ধুর সহায়তায় একটা ফাঁকা ফ্ল্যাট পায় সে, যে ঘরে পিয়ানো রাখা থাকে। বন্ধু বাইরে থেকে লক করে চলে যায়, কারণ ভিতরে ইহুদী আছে জানলেই বিপদ। স্প্লিলম্যানকে বলে দেখো বাপু, কোনও আওয়াজ কোরো না। পোলানস্কি দেখান আমাদের, স্পিলম্যান পিয়ানো বাজাতে আরম্ভ করে দিয়েছে ধুলোমাখা ঢাকনা সরিয়ে। আমি তো দর্শক হিসেবে আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। এই বিপদের মধ্যে বাজানো কী খুব দরকার ছিল? তারপর ক্যামেরা ক্লোজ আপে নিয়ে গেলে অবাক হয়ে দেখি ও পিয়ানো বাজাচ্ছেই বটে, কিন্তু কীবোর্ড থেকে কয়েক আঙুল ওপরে অদৃশ্য কীবোর্ডে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। ওর চোখে একটাই স্বপ্ন, এই বোমা, যুদ্ধ, অমানবিক হত্যালীলা একদিন ঠিক শেষ হবে। আবার একদিন ওয়ারশ রেডিও স্টেশন খুলবে। সে আবার পিয়ানোর সুরে যুদ্ধের অসুরকে হারিয়ে পোল্যান্ডকে সুস্থ জনজীবনে ফিরিয়ে দেবে।

ঘটনাচক্রে একদিন এক জার্মান সেনা অফিসারের পাল্লায় পড়ে সে। সামনে মৃত্যু হাজির। অফিসার জিজ্ঞেস করে – কি করো তুমি? সে জবাব দেয়, আমি পিয়ানিস্ট। অফিসার বলে, তাহলে কিছু বাজিয়ে দেখাও। স্পিলম্যান ‘Chopin’s ballade in G minor’ বাজিয়ে শোনায়। সঙ্গীতরসিক অফিসার মুগ্ধ হয়ে যায়। স্পিলম্যানকে লুকিয়ে রেখে রোজ খাবার পাঠিয়ে দিতে থাকে। এর কিছুদিনের মধ্যেই ১৯৪৫এর জানুয়ারিতে সোভিয়েতের লাল বাহিনী পোল্যান্ডে ঢুকে পড়ে জার্মানদের পাড়া ছাড়া করে। অফিসার শেষ যাবার বেলায় স্পিলম্যানের নামটা জেনে নিয়ে যায় আর বলে হয়তো পরে কখনো তোমার পিয়ানো বাজানো শুনবো।

 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ একদিন শেষ হয়ে যায়। সিনেমার একদম শেষে আমরা জানতে পারি স্পিলম্যান আবার পোলিশ রেডিও স্টেশনে বাজাতে আরম্ভ করেন। ২০০০ সালে মৃত্যুর আগে অব্দি ওয়ারশতেই কাটিয়েছেন। আর ঐ অফিসার সোভিয়েত ক্যাম্পে ১৯৫২ সালে মারা যান। এভাবে একজন ‘ইহুদী’ আবার ‘পিয়ানিস্ট’ হয়ে ওঠেন। আর একজন ‘সঙ্গীতরসিক’ ‘জার্মানসেনা’ হয়ে ক্যাম্পে মারা যান।

বিশেষত্বঃ

যুদ্ধ এবং সঙ্গীত, পরস্পর বিপরীত ধারার এই দুটি জিনিসকে একই প্লাটফর্মে রেখে তৈরি করা হয়েছে এই সিনেমা। রোমান পোলানস্কির এই চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে ব্রিটেন, পোল্যান্ড ও জার্মান-এর যৌথ প্রযোজনায়। মানবতাবাদী এই সিনেমা অস্কারে সেরা পরিচালক, সেরা অভিনেতা এবং সেরা রূপান্তরিত চিত্রনাট্যের পুরস্কার পেয়েছিলো। কান ফিল্ম ফ্যাস্টিভ্যালে পাম ডি’ অর পুরস্কার এবং বাফটায় সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কার পেয়েছিলো। ফরাসী সিজার এওয়ার্ডে এই সিনেমা- সেরা চলচ্চিত্র, সেরা পরিচালক এবং সেরা অভিনেতার পুরস্কার পায়। এ ছবিতে নায়ক কোনো বীরত্ব দেখায় না, বরং নায়ক স্পিলম্যান ক্রমাগত যুদ্ধ থেকে পালিয়ে বেড়ায়। এ বিষয়ে বিখ্যাত সমালোচক রজার এবার্ট উল্লেখ করেন যে, নায়ক এখানে যুদ্ধ করে তথাকথিত নায়ক হয়নি, বরং প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সৌভাগ্য ও সহানুভূতির মাধ্যমে নিজেকে টিকিয়ে রেখেছে; এটিই তাঁর মহত্ব।

 

বিশেষ তথ্যঃ

  • এ ছবির গল্পের সঙ্গে রোমান পোলানস্কির ব্যক্তি জীবনের মিল রয়েছে। ছোটবেলায় তিনি নিজেও ক্র্যাকো গ্যাটো থেকে মায়ের মৃত্যুর পরে পালিয়েছিলেন। যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত এক পোলিশ কৃষকের খড়ের গাদায় লুকিয়ে ছিলেন তিনি। তাঁর বাবা ক্যাম্পে মরতে মরতে বেঁচে যান এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফিরে আসেন।
  • স্পিলম্যানের চরিত্রে জোসেফ ফিয়াসেকে চেয়েছিলেন রোমান পোলানস্কি। কিন্তু ফিয়াসে একটি থিয়েটারের সাথে আগে থেকে অঙ্গিকারবদ্ধ থাকায় এ ছবি করতে পারেননি। লন্ডনে এক অডিশনে ১৪০০ অভিনেতা স্পিলম্যান চরিত্রের জন্য প্রতিযোগিতা করে। কিন্তু কাউকেই পোলানস্কির পছন্দ হয়নি। অবশেষে প্যারিসে পরিচিত হওয়া আদ্রিয়ান ব্রডিকে তিনি এই চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ করে দেন। আদ্রিয়ান তাঁর জীবনের সেরা অভিনয় করে এ সিনেমার মাধ্যমে অস্কারসহ একাধিক বিশ্বসেরা অভিনেতার পুরস্কার জিতে নেন। মাত্র ২৯ বছর বয়সে অস্কার জিতে তিনি পৃথিবীর কনিষ্ঠতম অস্কার বিজয়ী অভিনেতা হন। ব্রডি এ সিনেমায় অভিনয়ের জন্যই দীর্ঘদিন পিয়ানো বাজানো শিখেন। ব্রডি চরিত্রের প্রয়োজনে ছয় সপ্তাহে ১৪ কেজি ওজন কমান। শুধু তাই নয়, স্পিলম্যান চরিত্রের অনুভূতির সাথে একাত্ম হওয়ার প্রয়োজনেই নিজের এপার্টম্যান্ট ছেড়ে দেন, গাড়ি বিক্রি করে দেন এবং টিভি দেখা বন্ধ করে দেন।
  • ক্রাকোতে  শ্যুটিং-এর সময় পোলানস্কি এক ব্যক্তির দেখা পান যিনি তাঁর পরিবারকে  যুদ্ধের সময় সাহায্য করেছিলেন।
  • এটিই প্রথম ছবি যা ফ্রান্সের অস্কার বলে পরিচিত সিজার এওয়ার্ড পায় সেরা চলচ্চিত্র হিসেবে, অথচ এ ছবিতে একটিও ফরাসী সংলাপ নেই।
  • অ্যাসোসিয়েট প্রযোজক রাইনার স্ক্যাপারের মৃত্যুতে একদিন শ্যুটিং বন্ধ রাখা হয় এবং সিনেমাটি তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়।
  • স্পিলম্যানের আপন নাতি এই সিনেমায় ক্যাম্পের একটি বালকের চরিত্রে অভিনয় করেছে।

 

দ্য পিয়ানিস্ট চলচ্চিত্র থেকে কিছু স্থিরচিত্রঃ