– ওরে সোহাম, জলদি ওঠ। তোর ফারুক চাচারে মাইরা ফাটাইয়্যা ফালাইছে।
আম্মার চিৎকার শুনে লাফিয়ে খাট থেকে উঠল সোহাম। হরতালের দিনে এ আবার কোন তাল? কি আরাম করে ঘুমটাই না দিয়েছিল সে! তার আরাম হারাম করে দিল ফারুক চাচা। কে বলেছিল তাকে বাইরে যেতে? অনেক কষ্টে সময় নষ্ট না করে ঘুমঘুম চোখেই সোহাম ছুট লাগাল বাজারের উদ্দেশ্যে। বাজারে চাচার দেখা না পেলেও বৃষ্টির দেখা পেল সে। বৃষ্টি নামের মিষ্টি মেয়েটার নয়, মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে সারাদিন ঝরঝর করে ঝরতে থাকা বৃষ্টি কি যে অনাসৃষ্টি করে রেখেছে বলার মত নয়। কাদা জলে মাখামাখি হয়ে সোহাম পুরো বাজার ঘুরেও চাচার দেখা পেল না। পেল কিছু ফ্রি উপদেশ আর যন্ত্রণা অশেষ। ফারুক চাচার খবর নিতে গিয়ে সোহাম যা যা শুনল, এবং মনে মনে যা বলল-
– বৃষ্টির মধ্যে ছাতা ছাড়া বের হয়েছ কেন? ঠাণ্ডা লাগবে তো? (আমার ঠাণ্ডা লাগলে আপনার কি? আপনার কাছে তো ঔষধ চাইতে যাব না।)
– তোমার চাচার মাথা ফেটে গেছে? এখান কি করছ? হাসপাতালে খোঁজ নাও। কোন হাসপাতালে নিচ্ছ, আমাকে জানাইয়ো। (সাথে একটা রিক্সাও ঠিক করে নিয়ে আসব। সেই সাথে কিছু ফলমূল। আপনি চাচাকে দেখতে যাবেন।)
– হরতালে বাইর হইছ? ঘটনা কি? পিকেটিং করতে যাও না তো? তোমার তো হাতের টিপ মাশাল্লা। পাথরের সাথে প্রেমপত্র বাইন্ধা আমার মাইয়ার জানালায় প্রতিদিন প্রাকটিস কর শুনছি। (কি যে বলেন শশুর আব্বা, আমি কেন পিকেটিং করব?)
– আহা, কি দারুণ একটা দৃশ্য। ফারুক্যারে যে মাইরটাই না দিল। দেইখা দারুণ মজা পাইছি। (আমার চাচায় মাইর খাইল। আর তুই মজা দেখলি! এখন তোরে যদি সেম ইস্টাইলে মাইর দেয়া হয় …..)
– আরে, ফারুক কে মারছে সংসদ ভবনের সামনে। এখানে খুঁজিতেছ কেন? (হ, তোরে কইছে? ফারুক চাচা সংসদ ভবন যাবে কোন দুঃখে?)
একটু আধটু খবর শূনে সোহামের মাথায় বৃষ্টি হয়ে আকাশ ভেঙ্গে পড়ছে। চাচায় এ কি করছে? কে তাকে হরতালের মধ্যে সংসদ ভবন যেতে বলেছে? কে বলেছে বাসে ঢিল ছুড়তে? পুলিশ কে গালি দিতে? বাংলাদেশের পুলিশ, পালিশ করায় ওস্তাদ। চাচাকে কেমন পালিশ করেছে কে জানে?
চাচাকে খুঁজতে হরতালের মধ্যেও সংসদ ভবনের সামনে হাজির হল সোহাম। তার এখন একটাই কাজ, চাচাকে রক্ষা করতে হবে আজ। সেই লক্ষে কিছুটা পথ হেটে, কিছুটা ছুটে, কিছুটা রিক্সায় কিছুটা বাসে গাঁটের টাকা গচ্চা দিয়ে জীবনের রিস্ক নিয়ে সংসদ ভবনের সামনের রাস্তায় এসেছে সে। চারিদিকে খালি পুলিশ আর পুলিশ। নিরাপত্তার কোন অভাব নাই। খুশি মনে পুলিশের সামনে হাজির হল সোহাম। তারপর গলা ছেড়ে ডাক দিল, “ফারুক চাচা, তুমি কই?” শুরু হল চারদিক হইচই।
পুলিশ ভাবল “চাচারে পিটাইছি। এইবার ভাইস্তারে পাইছি।”
পিকেটাররা ভাবল, “হালায়, আমগোরে নেতারে ব্যাঙ্গ করে! কে আছিস, ধর ওরে…….”
আর সোহাম! “চাচাকে বাঁচানোর আশা বাদ ‘দিয়ে চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’ প্রবাদের সার্থকতা প্রমাণ করতে দিল দৌড়।
সোহাম এখন ফারুক নামটা শুনলেই ক্ষেপে যায়। ফারুক চাচার সাথে জয়নাল আবেদিন ফারুকের নামের মিল তার পিঠে কিছু ঢিল ফেলেছে। সে ফিল করেছে, জনতার তাড়া কাকে বলে। সেই দৃশ্য এখনও মনে হলে, তার গা জ্বলে। তাছাড়া সে হল নব্য আওয়ামীলীগার। সে কেন খাবে জয়নাল আবেদন ফারুক এর জন্য মার?
” এই যে হরতাল, মানে হরর তাল। জন জীবন বেতাল। সেই সাথে ফারুক মিয়া বেসামাল” বাসের মধ্যে কথাটা শুনতেই চমকে উঠল সোহাম। আরে, লোকটা দেখি ফারুক্যার বদনাম করে। আমিও করি। যা ভাবা তাই কাজ, সোহাম কে থামায় কে আজ? মুহূর্তের মধ্যেই বাসের সব যাত্রী দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে গেল। কেউ বলে ফারুক খারাপ, কেউ বলে ভাল। কেউ কারো কথা শেনে না, কেউ কারো কথা বোঝে না। যে যার মত, চেঁচায় পারে যত। ফারুক সাহেবকে নিয়ে শুরু হল মাতামাতি। অতঃপর হাতাহাতি। সবাই জিগায় কি থেকে কি? কিছু লোক বিরস বদনে বলে, ” আর কি? লীগ আর বিএনপি?”
কয়েক ঘন্টা পর-
মারামারি চলছে। ইতিমধ্যেই দুইটা বাস ভেঙ্গে পুরিয়ে দেয়া হয়েছে। ৩ টা প্রাইভেট কারের মালিক কিছু বোঝার আগেই তাদের গাড়িতেও আগুন দেয়া হয়েছে। পুলিশ ব্যাপক লাঠিচার্য করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে। সোহাম সুযোগ বুঝে বাসের সেই লোকটার সাথে পালিয়েছে। নিজের এলাকার কাছাকাছি এসে লোকটা বলল, “আপনি তো ভাই আমাদেরই লোক। চলেন, এক কাপ চা হোক।” খুশি হয়ে সোহাম চা খেয়ে দাম দিতে গিয়ে বলল, “যাই বলেন ভাই। এই মাইরটা যদি ফারুক্যারে দিতে পারতাম! মনে সুখ পাইতাম।” অচেনা লোকটা মুখ ব্যাজার করে বলল, “আমার ও খুব শখ। এক দিন যদি বাণিজ্য মন্ত্রীরে সামনে পাইতাম!” শুনে সোহাম চমকে উঠল। তারপর বলল, “আপনি কোন ফারুকের কথা বলছেন? ফারুক খান? আমি তো ভাবলাম জয়নাল আবেদিন ফারুক!” অচেনা লোকাটা সার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে বলল, “ওই, কে আছিস! জলদি আয়। এতক্ষন ভুল লোকরে পিটাইছি।”