হুর

আজ এই প্রথম কলেজ জীবনের সাথে পরিচিত হতে যাচ্ছে কতগুলো নবীন প্রাণ। তাই সবার মাঝে একটা বাড়তি উচ্ছ্বাস লক্ষণীয়। ক্লাসে ঢুকেই যে যার মত করে পরিচয় পর্ব সেরে ফেলেছে। তবে একজনকে দেখা গেল অন্যরকম। ঠিক যেন ভীন গ্রহের মানুষ সে।

পরনে লম্বা কালো বোরখা। তার উপর স্কার্ফ, মুখে হিজাব আর হাত পায়ে মোজা লাগানো। শরীরের এক রত্তিও দেখার সৌভাগ্য হয়নি কারোর। তাই মেয়েটির প্রতি সবারই একটা কৌতূহল রয়ে গেল। সবাই এক প্রকার ধরে নিলো নিশ্চয়ই কোন বড় মৌলানা ঘরের মেয়ে হবে। তাই ছেলেদের কেউ আর কাছে ঘেঁষার সাহস দেখালোনা। মেয়েরাও ইতস্তত বোধ করল।

ক্লাসে তাকে নিয়ে এতসব কানা ঘুঁসা হচ্ছে বোধ হয় সবই বুঝতে পারছে মেয়েটি। কিন্তু তবুও কারো সাথে একটা টু শব্দও করলোনা। ক্লাসে ঢুকে মেয়েদের সারির প্রথম বেঞ্চের কর্নারে সেই যে বসেছে, এখনো ঠায় সেভাবেই বসে আছে। এদিকে স্যার ক্লাসে এসে পড়েছেন। তাই সবাই শোরগোল থামিয়ে একেবারে বোবা বনে গেছে।

কলেজ জীবনের প্রথম ক্লাস। সবারই কম বেশি বুক ধড় ফড় করছে। হঠাৎই স্যার জিজ্ঞাসা করে বসলেন, “তোমাদের মধ্যে আশফিয়া নওরিন হুর কে?” শিক্ষার্থীরা একে অন্যের মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগলো। এসময় সবার মাঝখান থেকে উঠে দাঁড়ালো বোরখা পড়া আজব মেয়েটি। স্যার জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমিই কি হুর?” মেয়েটি মাথা নাড়িয়ে ইতিবাচক ইঙ্গিত দিলে স্যার তাকে বসে যেতে বললেন।

এরপর সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “তোমরা কি জানো আমি কেন এ মেয়েটিকে দাঁড় করালাম?” সবাই একসাথে না বলে উঠলো। স্যার বললেন, “এই সে মেয়ে, যে এবছর সারা দেশের মধ্যে মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে!” কথাটা শোনার পর ক্লাসের সব ছাত্র ছাত্রীরা একেবারে হতবাক হয়ে গেলো!

ভালো ছাত্রী হওয়ার সুবাদে কদিনের মধ্যেই ক্লাসের সব মেয়েদের সাথে হুরের ভাব হয়ে গেলো। মেয়েরা প্রথমে মনে করেছিল ও খুব অহংকারী। কিন্তু এখন দেখা গেলো একদম তা নয়। অহংকারের ছিটে ফোঁটাও নেই তার মাঝে। সবার সাথে অত্যন্ত আন্তরিক সে। তবে ছেলেদের ব্যাপারে বেশ সংযত। প্রয়োজনের বাইরে একটা কথাও বেরুয়না মুখ থেকে।

ছেলেরা তার সাথে বন্ধুত্ব করতে চাইলেও মোটেও সুবিধা করে উঠতে পারেনি কেউই। কারণ মেয়েটি খুবই ইসলাম মনা। ফলে একে একে সবাই সরে দাঁড়িয়েছে। তবে ব্যতিক্রম ঘটেছে কেবল একজনের ক্ষেত্রে। তার নাম আরেফিন রাইহান নূর। সে এখনো মনে মনে কামনা করে যে, একদিন না একদিন সে হুরকে তার হৃদয়ের রানী বানাবেই।

নূর কারো কাছেই তার হৃদয়ের গোপন কথাটি শেয়ার করেনা। কেননা সেও যথেষ্ট ধর্ম পরায়ণ। সে জানে ইসলাম বিয়ের আগে কোন যুবক যুবতির প্রেম ভালবাসাকে সমর্থন করে না। তাই মনের কথা মনে চেপে রেখে সে শুধু আল্লাহর কাছে এই ফরিয়াদ করে-

“হে আল্লাহ! আমার কপালে যদি তুমি কোন জীবন সঙ্গিনী রেখে থাকো তাহলে সে যেন হুরই হয়। কেননা তুমি জানো আমি তাকে তোমার খাতিরেই পছন্দ করি। সে যদি দেখতে একেবারে কুৎসিতও হয় তবুও জীবন সঙ্গিনী হিসেবে আমি কেবল তাকেই চাই। সুতরাং আমার জন্য কল্যাণকর হলে তুমি আমার দোয়া কবুল করো!”

এভাবেই দেখতে দেখতে কলেজ জীবন পাড়ি দিয়ে হুর আর নূর দুজনেই এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রেখেছে। সৌভাগ্য ক্রমে দুজনে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে। তাও আবার একই ডিপার্টম্যান্ট আর সেকশনে। যদিও দুজনে আগে থেকেই একে অপরকে চিনে কিন্তু তাদেরকে দেখে কেউ জোর গলায় বলতে পারবেনা যে এরা একে অপরের পরিচিত।

এদিকে একের পর এক মেধার দ্যোতি ছড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে সকলের নয়ন মনি হয়ে উঠেছে হুর। অথচ কারো সৌভাগ্য হয়নি আজ পর্যন্ত হুরের বাহ্যিক অবয়ব এক পলকের জন্য হলেও দেখার। নূরও কখনো দেখেনি ওকে। তাই যে যার মত করে হুরের অবয়ব কল্পনা করে নিয়েছে।

হুরের নাম শুনলেই সবার চোখের সামনে ভেসে উঠে তার কল্পিত রূপের শুভশ্রী। শিক্ষক ছাত্র সবাই চেষ্টা করেছে অন্তত এক পলকের জন্যে হলেও তার মুখখানি দেখার। কিন্তু কিছুতেই দেখতে পায়নি। তাই কল্পিত রূপের অপূর্ব সুধা পান করেই তৃপ্ত থাকতে হয়েছে সবাইকে।

কেমন করে যেন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনও হুট করে ফুরিয়ে গেলো। তাই যার যার ঠিকানায় ফিরে যেতে হলো সবাইকে। অনেক দিন হয়ে গেলো হুরের কোন খোঁজ খবর জানেনা নূর।এ খন সে একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ি। নিজের পায়ে দাঁড়াতে পরিপূর্ণ সক্ষম হয়েছে ও। তাই মনে হলো এখনি প্রকৃত সময় হুরকে চিরদিনের জন্য নিজের করে নেয়ার।

অনেক কষ্ট করে হুরের এক বান্ধবীর কাছ থেকে ওদের বাড়ির ঠিকানাটা যোগাড় করে এক বিকেলে রওনা দিলো নূর।মনে তার অনেক স্বপ্ন। কিন্তু বিন্দু মাত্রও ভয় নেই। তার দৃঢ় বিশ্বাস হুরের জন্ম কেবল তারই জন্য। এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে হুরদের বাড়ির পাশের রাস্তাটায় এসে পড়েছে টেরই পায়নি সে।

কারো একজনের কাছ থেকে বাড়িটা চিনে গাড়িটা সুবিধা মত জায়গায় রেখে ঢুকে পড়লো বাড়ির উঠোনে। একজন অচেনা লোককে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হুরের বাবা বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। মুরুব্বি বয়সের কেউ একজনকে বেরিয়ে আসতে দেখে নূর সালাম করে ধীরে ধীরে সবকিছু খুলে বললো ওনাকে।

সবকিছু শুনে ওনি নূরকে ঘরের ভিতরে নিয়ে বসতে দিয়ে একটু চা বিস্কুটের ব্যবস্থা করলেন। এরপর খাওয়া শেষ হলে নরম সুরে তিনি তাকে বললেন, “এটা কখনোই হতে পারেনা!” একথা শুনার পর নূরের হৃদয় যেন ভেঙে চূড়ে একাকার হয়ে যেতে চাইলো। চোখ দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইলো অবিরাম জলধারা। তবুও অতি কষ্টে তা সংবরণ করে বিনয়ের সাথে কারণ জানতে চাইল সে।

এবার মুখ খুললেন হুরের বাবা। বললেন, “আমার মেয়ে দেখতে ভীষণ কুৎসিত। তাই ওর বিশ্বাস কেউ তাকে ঘরের বউ করে মেনে নিতে পারবেনা। আর সে জন্যেই এ বিয়ে সম্ভব নয়।” নূরের যেন এতক্ষণে প্রাণ ফিরে এলো। প্রাণবন্ত ভাবে বলে উঠলো সে-

“যত কুৎসিতই হোক আমি তাকেই বিয়ে করবো। কেননা আমি তার বাইরের রূপে নয় ভিতরের সৌন্দর্যে মোহিত। তার ইসলাম প্রীতির একনিষ্ঠ ভক্ত। কাজেই আপনারা বিয়ের আয়োজন করুন।” এরপর উভয়ের সম্মতিক্রমে বিয়ে অনুষ্ঠান সমাপ্ত হলে নূর বর বেশে প্রবেশ করল বধুবেশি হুরের ঘরে।

এই প্রথম হুরকে বোরখা ছাড়া দেখতে পেলো নূর। কিছুটা ইতস্তত করে পাশে এসে বসে বলল, “তোমাকে প্রথম দেখাতেই আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। এখন আপন করে পেয়ে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাচ্ছি।” এরপর যখন আস্তে আস্তে হুরের লম্বা ঘোমটা খুলে তার দিকে তাকালো, অকস্মাৎ চমকে উঠে ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেল সে।

ভাবতে লাগলো, “একি! এযে অপরূপ সুন্দরি আর রূপসী মেয়ে তার ঘরে! যাকে দেখতে সত্যিই বেহেশতি হুরের মত!” অনেক ভেবেও কিছুই বুঝতে পারলোনা নূর। সবকিছু পরিষ্কার করতে যে আবার ঘরে ঢুকবে তাতেও মন সায় দিচ্ছেনা। তাই বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলো সে।

রাতও একেবারে কম হয়নি । বাড়ির অন্যসব লোকেরা এখন গভীর ঘুমে মগ্ন। সুতরাং তাদের কারো কাছ থেকেও এর কারণ ভেদ করা যাবেনা। তাহলে? কি করবে নূর? এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে! নাকি ঘরে ঢুকে যাবে! এ মুহূর্তে কোন সিদ্ধান্তই যেন নিতে পারছেনা সে। তার সমস্ত বিবেক বুদ্ধি যেন কোথায় পালিয়ে গেছে।

ওদিকে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরেও নূরকে আর ঘরে ঢুকতে না দেখে হুর এর কারণ বুঝতে পারলো। তাই সেও ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে নূরের ঠিক পেছন দিকটায় দাঁড়ালো। তারপর একরকম শব্দ করে নূরকে তার আগমনের ব্যাপারটা জানান দিলো। নূর এবার আরো আপসেট হয়ে গেলো। সে কি করবে কিছুই বুঝতে পারলোনা।

নূরের এরকম অবস্থা দেখে হুরই প্রথমে বলে উঠলো, “আসলে আমার বাবা ঠিকই বলেছিলেন। সত্যিই আমি খুব কুৎসিত আর বাজে দেখতে ছিলাম। “হুরের মুখ থেকে এসব কথা শুনে নূরের কৌতূহল এবার চরমে পৌঁছে গেলো। তাই তার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইলো ও।

স্বামীকে এভাবে চেয়ে থাকতে দেখে হুর আবার বলতে শুরু করলো, “আমার বাবা-মা আসলে দীর্ঘকাল ব্যাপী নিঃসন্তান ছিলেন। তাদের কোন সন্তানাদি না থাকায় তারা মোটেও সুখী ছিলেননা। একটা সন্তান লাভের আশায় কি না করেছেন তারা! কিন্তু কিছুতেই কিছু ফল লাভ হচ্ছিলোনা।

হঠাৎ একদিন বাবার মনে পড়ে গেলো আল্লাহর নবী হযরত জাকারিয়া (আ.) এর সন্তান লাভের কথা। যা পবিত্র কুরআনের সূরা আল ইমরানে সুন্দরভাবে বর্ণিত আছে। তাই সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে আমার বাবা-মা নবী জাকারিয়া (আ.) এর মত মহান আল্লাহর দরবারে একটা সন্তান লাভের জন্য একরাতে অনেক কাকুতি মিনতি করে যখন ঘুমিয়ে পড়লেন, তখন স্বপ্নে দেখতে পেলেন কেউ একজন তাদেরকে একটা কন্যা সন্তান লাভের সুসংবাদ দিচ্ছেন।

তবে শর্ত দিলেন তাদের দুজনকেই এখন থেকে পরিপূর্ণভাবে ইসলামের অনুসরণ করতে হবে এবং মেয়েকেও পরিপূর্ণ ইসলামি শিক্ষা দিয়ে গড়ে তুলতে হবে। এছাড়া এও বললেন যে, তাদের ঘরে জন্ম নেয়া মেয়েটি দেখতে খুবই কদাকার হবে। তবে কোনদিন যদি কোন ধার্মিক পুরুষ তাকে এরকম কদাকার খারাপ দেখতে জেনেও স্বেচ্ছায় বিয়ে করতে সম্মত হয়, তবে তার স্বামী তাকে ছোঁয়ার আগেই সে পরমা সুন্দরী হিসেবে পরিবর্তিত হয়ে যাবে।

কিন্তু এরকম ঘটার আগে কিছুতেই যেন তার শরীরের কোন অংশ বাবা মা ছাড়া অন্য কোন মানুষ এক পলকের জন্যেও দেখতে না পারে এ শর্তও দেয়া ছিল। যদি কেউ কোনদিনও দেখে ফেলে তবে আর কখনোই সে রূপসী হয়ে উঠবেনা। চিরকাল তাকে কুৎসিতই থাকতে হবে ।

তাই সব সময় আমি ইসলামি পর্দাপ্রথার অতিরিক্ত হিসেবে দুহাতের কব্জি, মুখমণ্ডল ও দুপায়ের পাতা মোজা দিয়ে ঢেকে রাখতাম।” এতক্ষণ হুরের মুখে সব ঘটনা শুনে নূরের চোখ দিয়ে কফোঁটা পানি চলে আসলো। এই ভেবে যে, আল্লাহ কত মহান! তিনি চাইলে কি না পারেন? অথচ তবুও আমরা তাকে ভুলে থাকি! আমরা কতই না দুর্ভাগা।

এরপর চোখের পানি মুছে হুরকে নিয়ে মহানন্দে ঘরে ঢুকে গেল নূর। ঘরে ঢুকেই ওযু সেরে উভয়ে দুরাকাত নফল নামায পড়ে নিলো শুকরিয়া হিসেবে। আল্লাহর কাছে দু হাত তুলে মোনাজাত করলো, তিনি যেন চিরদিন তাদেরকে সুখে শান্তিতে সংসার জীবন কাটিয়ে যাওয়ার জন্য অনুগ্রহ করেন এবং তাদেরকে আর তাদের সন্তান-সন্ততিদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করেন।