হেডস্যার অমিত লাল

ইংরেজির শিক্ষক মি. অমিত লাল। নিয়ম করে হাতের লেখা দেখেন তিনি। কেউ যদি একদিনের জন্যও লেখা দেখাতে না পারে, তাহলে তাকে গুনে গুনে পাঁচ ঘা বেতের আঘাত হজম করতে হয়! তাও আবার যে সে বেত নয়, একেবারে জালি বেত দিয়ে পেটান তিনি। বাচ্চারা তাই দুনিয়া উল্টে গেলেও ওনার ক্লাসে হাতের লেখা আনতে ভুল করেনা। কারণ প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে ফুল কুঁড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণিতে এটাই রীতি হিসেবে চলে আসছে এক যুগ ধরে।

প্রতিদিনের ন্যায় আজও যথাসময়েই ক্লাসে এলেন অমিত লাল। এসেই ডাকতে শুরু করলেন হাজিরা। যেন একটু জিরোবারও প্রয়োজন বোধ করলেননা তিনি। বয়স হলে কি হবে- সময়ের মূল্যটা এখনো ওনার চেয়ে বেশি আর কেউই দিতে জানেননা। স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে এ যেন তার আবশ্যিক দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে।

যাই হোক, হাজিরা ডাকার ফাঁকে ক্লাস ক্যাপ্টেন টোটন বাহাদুর একটা একটা করে উপস্থিত সবার খাতা তুলে জমা দিয়ে দিয়েছে স্যারের টেবিলে। স্যার হাজিরা ডাকা শেষ করে প্রতিদিনের মত আজও উপস্থিতির সাথে খাতা গুলো মিলিয়ে নিলেন। কিন্তু আজ একটা খাতা কম জমা পড়েছে। প্রথমে এ ব্যাপারে কাউকেই কিছু বললেননা তিনি। এক এক করে সিগন্যাচার করে গেলেন সব কয়টা জমা খাতায়।

এরপর ক্লাস ক্যাপ্টেন খাতা গুলো সবার হাতে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য এগিয়ে আসতেই টেবিলে রাখা বেতটা হাতে নিয়ে ভীষণ বড় বড় চোখ করে তাকালেন অমিত লাল। স্বচ্ছ চশমাটার গ্লাসের মধ্য দিয়ে যা কারোরই দেখতে তেমন কষ্ট হলনা। কিন্তু কেউ বুঝতে পারছিল না যে কে হাতের লেখা জমা দেয়নি। সে যেই হোক, আজ তার নিস্তার নেই, এটা ঠিক বুঝতে পারছিল সবাই! কারণ ও বেতের আঘাত একবার যে খেয়েছে সেই বুঝতে পেরেছে পৃথিবীতে ওর চেয়ে বেদনাদায়ক আর দ্বিতীয় কিছু নেই!

স্যারকে ওরকম ভয়ানক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে টোটন তার সুউচ্চ মাথাটা তত্ক্ষণাত্ নিম্নগামী করে ফেলেছে। বোধ হয় সে-ই আজ খাতা জমা দেয়নি। আর এজন্য এখনি তাকে হজম করতে হবে পাঁচ খানা নগদ বেতের টনটনে আঘাত। তাই মাথা নিচু করেই ডান হাতটা এগিয়ে ধরল স্যারের বেতের দিকে। যেন সাজা নিতে সে পুরোপুরি প্রস্তুত হয়েই আছে!

অমিত লাল কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন টোটনের দিকে। এরপর নরম স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, “হাতের লেখা জমা দিসনি কেন?” টোটন কিছু বললনা- কেবল চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল বিল্ডিং ঘরের অনড় খাম্বাটার মত। অমিত বাবু এবার হাতের লাঠিটা টেবিলে রেখে টোটনের মাথায় হাত ভোলাল। আর কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই টপ টপ করে দুচোখ থেকে পানি পড়ে তলিয়ে গেল টোটনের দুচোখের নিন্মাংশ থেকে বুক পর্যন্ত। তবুও কোন কথাই বের হচ্ছেনা তার মুখ থেকে। যেন ক্লাসের সেরা ছাত্রটি আজ খাতা জমা না দেয়ার অপরাধবোধ থেকে ভীষণভাবে লজ্জিত হয়ে পড়েছে।

অমিত বাবু আর কথা বলার জন্য জোরাজুরি করলেননা তাকে। শুধু বললেন, “যা, জায়গায় গিয়ে বস।” এরপর কি একটা কাজ আছে বলে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি। যাওয়ার আগে বলে গেলেন, “এ ক্লাসটা আজ আর হবেনা।”

স্যারের এরকম কান্ড দেখেতো সবাই অবাক। যিনি হাতের লেখা জমা না দিলে পিটিয়ে তকতা করে ফেলেন, সেই তিনিই কি না আজ টোটনকে কিচ্ছু বললেননা! ধরে নেয়া যেতে পারে ক্লাস ক্যাপটেন বলে এবং ভাল ছাত্র হওয়ার সুবাদে টোটনকে ওনি ক্ষমা করে দিয়েছেন। কিন্তু ক্লাসও নিলেননা কেন, এ কথা উপস্থিত কারোর মাথায়ই তেমন ঢুকলনা।

স্কুল ঘর থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত টোটনদের বাড়ি। বেশিক্ষণ লাগেনা পৌঁছুতে। হেঁটে গেলে বিশ মিনিটের মত লাগে। বাড়িতে টোটন আর তার মা ছাড়া কেউ থাকেনা। সেই কবে কীভাবে তার বাবা মারা গেছে, সে কথার কিছুই জানা নেই টোটনের। শুধু এটুকু জানে যে, তার বাবা না কি এলাকার বাহাদুর ছিলেন। অনেক জমি জমাও ছিল তাদের। কিন্তু সবই হারিয়েছে তারা কপালের ফেরে।

এদিকে একলা ঘরে টোটনের মা রাশেদা বানু জ্বরের ঘোরে ফুঁপিয়ে যাচ্ছে অনবরত। তবুও এ মুহূর্তে কেউ নেই তার দেখা শোনা করার। একমাত্র ছেলে টোটনই তার সেবা যত্ন করে। এটুকু বয়সেই তাকে কাজ করতে হয় সংসার চালানোর জন্যে। বাজারে দত্তদের দোকানে ফোট ফরমাশ খাটে সে। বিনিময়ে কিছু টাকা পায় পারিশ্রমিক হিসেবে। সে টাকায় কোন রকমে চলে যায় তাদের। টোটনের পড়ার খরচ তার মায়ের চিকিত্সা- সব এ টাকা থেকেই হয়।

দত্তরা বড় ভাল লোক। টোটনটাকে পড়া শোনার সুযোগ করে দিয়েছে। নইলে সারা জীবন অক্ষর জ্ঞানহীন হয়েই থাকতে হত তাকে। তাই দত্তদের ভাল চেয়ে সবসময়ই দোয়া করে যান রাশেদা বানু। স্বপ্ন দেখেন ছেলে তার বড় হয়ে ডাক্তার হবে। এরপর সমাজের গরীব লোকদের বিনা পয়সায় চিকিত্সা করে সুস্থ করবে সে। কিন্তু সেই সুখের দিন বুঝি দেখে যাওয়ার আর সৌভাগ্য হবেনা তার।

এসব ভেবে ভেবে যখন দুচোখ থেকে অঝোরে পানি ঝরিয়ে যাচ্ছে রাশেদা বানু, ঠিক এসময় কে যেন বাইরে থেকে ডেকে ওঠল টোটনের নাম করে। একই রকমভাবে কয়েকবার ডাকতেই বুঝা গেল হেড স্যার এসেছেন। হয়তো টোটনটা আজ স্কুলে যায়নি। তাই খোঁজ নিতে বাড়ি ছুটে এসেছেন তিনি। কিন্তু জ্বরটা যেভাবে ঝেঁকে বসেছে, তাতে বাইরে বের হওয়ার সাধ্য প্রায় নেই বললেই চলে রাশেদা বানুর। তবুও নিজের সাধ্যের সাথে একপ্রকার যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েই শোয়া থেকে ওঠে কাঁথাটা কোন রকমে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল সে।

টোটনের মাকে আসতে দেখেই অমিত বাবু দুহাত জোড় করে বলে ওঠল, “আদাব বৌঠান। শরীটা আপনার সুস্থ আছেতো? আসলে, টোটন আজ ক্লাসে হাতের লেখা জমা দেয়নি। লক্ষ্য করেছিলাম, আগের দিনই তার খাতা শেষ হয়ে গিয়েছিল। বোধ করি নতুন খাতা কেনা হয়নি তার। তাই আজ হাতের লেখা জমা দিতে পারেনি! কিন্তু টোটনকেতো আমি চিনি, পয়সার জন্য ও খাতা না কিনে থাকবেনা। হয়ত অন্য কিছু হয়েছে। আর তাই জন্য ছুটে এলাম আপনাদের বাড়ি! এখন আমাকে বলুনতো বৌঠান আসলে কি ঘটেছে?”

অমিত বাবুর কথাটা শেষ হতে না হতেই রাশেদা বানু ধপ করে মাটিতে পড়ে গেল। যেন কোন শিকড় কাটা কলা গাছ উপড়ে পড়েছে। তত্ক্ষণাত্ বৌঠান বলে অবস্থা বুঝতে চাইল অমিত লাল। এরপর পাশের বাড়ি থেকে আরো কয়েকজনকে ডেকে নিয়ে হসপিটালের দিকে ছুট লাগালেন তিনি। এসময় বার বার করে তার চোখের সামনে ভেসে ওঠছিল নিষ্পাপ চেহারার টোটনের অশ্রুসিক্ত মুখখানা। যে মুখের ভাষা আর কেউ বুঝতে না পারলেও ঠিকই বুঝেছিলেন অমিত লাল।