বন্ধু

আকাশের মন ভাল নেই। অনেক দিন মায়ের সাথে দেখা হয় না। মা’কে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। মায়ের কোলে শুয়ে গল্প শুনতে ইচ্ছে করছে। কতদিন মায়ের হাতের রান্না খাওয়া হয় না। নিজের অজান্তেই দু ফোটা অশ্রু ঝড়ে পরে তার স্টেনগানের উপর। আকাশ শক্ত হাতে অস্ত্রটা ধরে শার্টের কোনা দিয়ে চোখের পানি মুছে ফেলে। সে একজন যোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধা। মা আর মাটিকে মুক্ত করতে সে যুদ্ধ করতেছে। তার চোখে অশ্রু মানায় না। তার চোখে থাকবে আগুন। সেই আগুনে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিবে মাতৃভূমির উপর আঘাত হানা পাক সেনাদের। তাদের দোসর রাজাকার বাহিনীর।

ঠক ঠক ঠক…………..। দরজায় মৃদু শব্দ হচ্ছে। আকাশের আম্মা খাট থেকে নেমে আলো জ্বালায়। দরজার পাশে গিয়ে ভয়ে ভয়ে বলে,
– “কে?”
– মা, আমি। ওপাশ থেকে ফিসফিস করে আওয়াজ আসে।
আকাশের মা চমকে উঠে দরজা খোলে। আকাশ হালকা ধাক্কা দিয়ে মাকে দরজা থেকে সরিয়ে দিয়ে ঘরে ঢুকেই ঝট করে দরজা ও লাইট দুটোই বন্ধ করে দেয়। অন্ধকারে দুটো প্রাণী, আকাশ আর তার মা। দুজন দুজনকে ধরে কাঁদছে। এই কান্নার যেন শেষ নেই।
– এত দিন পরে মাকে মনে পরল? আকাশের মায়ের কান্না থামে না।
– মনে পরে মা। প্রতি মুহূর্তে তোমার কথা ভাবি। কতদিন তোমার হাতের রান্না খাই না। কিন্তু কি করব মা? আমি যে আমার দেশ মায়ের দায়িত্ব পালন করছি।
আকাশের মায়ের কান্না আরো বেড়ে যায়। ঝাপসা চোখে অন্ধকারে ছেলের মুখ দেখার চেষ্টা করে।

স্টোভের আগুনের ছায়া পরেছে আকাশের চোখে। আকাশের মা মুগ্ধ চোখে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। দেখে লজ্জা পায় আকাশ।
– কি দেখছ মা?
– তোর চোখের আগুন। আকাশের মা হেসে জবাব দেয়।
– কি রান্না করছ?
– কড়া করে আলু ভাজি। তোর আর ইমনের প্রিয় খাবার।
ইমনের নামটা শুনেই মন খারাপ হয়ে যায় আকাশের। ইমন তার বন্ধু, সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। ছোট বেলা থেকে এক সাথে বড় হয়েছে দুজন। এক জন আর একজনের প্রাণ বলা চলে। একসাথে স্কুলে যাওয়া, এক সাথে দুষ্টামি করা, এক সাথে মজা করে মায়ের হাতের রান্না খাওয়া – আরো কত স্মৃতি ভেসে আসে তার মনে। আকাশ যখন যুদ্ধে গেল তখন ইমন যায় নি। বলেছিল “কিছু মানুষকে তো গ্রাম পাহারা দিতে হবে। সবাই চলে গেলে গ্রাম পাহারা দিবে কে?” আকাশ কথা বাড়ায় নি। একাই চলে গেছে। সেদিনের পরে আর দেখা হয় নি প্রিয় বন্ধুর সাথে। খুব দেখতে ইচ্ছে করছে তাকে। আকাশের বিষণ্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হসে মা।
– ইমনের কথা মনে পরেছে?
– হু, ছোট্ট করে জবাব দেয় আকাশ।
– আমি খবর পাঠিয়েছি। খুব শীঘ্রই চলে আসবে। আকাশের মুখটা খুশিতে আলো ঝলমল হয়ে ওঠে।
– ভাত হয়ে গেছে। খেতে চল। মা তাড়া লাগায়।
– না, ইমন আসুক। কতদিন দুজন একসাথে খাই না।
আকাশের মা মুচকি হসে। পাগল ছেলে। বন্ধুকে কেউ এত ভালবাসে?
দরজায়  আবার ও ঠক ঠক শব্দ হয়। আকাশ চাদরের নিচে থাকা স্টেনগানটা শক্ত করে ধরে। আকাশের মা, “কে?” বলে দরজা খুলতে এগিয়ে যায়।
– খালাম্মা, আমি ইমন। বাইরে থেকে শব্দ আসে।
– আমি খুলছি।
ছুটে গিয়ে মায়ের আগেই দরজা খোলে আকাশ। দরজায় ইমন দাড়িয়ে। পেছনে কয়েকটা বন্দুকের নল লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে।