চলচ্চিত্র পর্যালোচনাঃ লাইভ ফ্রম ঢাকা

[su_box title=”লাইভ ফ্রম ঢাকা” style=”soft”]
চলচ্চিত্রঃ লাইভ ফ্রম ঢাকা
চিত্রনাট্যঃ সম্পাদনা ও পরিচালনাঃ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ
প্রযোজকঃ শামসুর রহমান আলভী
চিত্রগ্রহনঃ তুহিন তামিজুল
শিল্প নির্দেশনাঃ উজ্জ্বল আফজাল
অভিনয়ঃ মোস্তফা মনোয়ার(সাজ্জাদ), তাসনোভা তামান্না(রেহানা), তানভির আহমেদ চৌধুরী(মাইকেল) মীর মোশাররফ হোসেন(মীর), শিমুল জয়(শাহেদ) সময়ঃ ৯১ মিনিট
ভাষাঃ বাংলা। [/su_box]

ছোট বেলায় একটা গল্প পড়েছিলাম হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা। ঐ বাঁশিওয়ালার মত ঢাকা শহরেরও একটা অদ্ভুত পোশাক আছে আর আছে অদ্ভুত মায়া। যেই মায়ায় হয়তো কোটি খানেক মানুষ শুধু ভেসে বেড়ায় একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে প্রতিদিনন। হাজার রকম মানুষ, হাজার চিন্তা আর হাজারটা সাজ্জাদ। আমার কাছে বরাবরই অসম্ভব সুন্দর আর রঙ্গিন লাগে এই দেশ, এই শহর। তা এই ভিন্ন চিন্তা,উদ্দেশ্য, আনন্দ, বেদনা এক টিফিন ক্যারিয়ারে নিয়ে ঘোরা মানুষগুলোর জন্যেই। যদিও সুন্দর এর সংজ্ঞা এখন অনেকটা প্রচলিত কিছু সিনেমার হিরোর মত আজীবন একই রকম থাকার অবিচ্ছেদ্যতা ও ছাঁচের আদলের মত দাঁড়িয়েছে।
কিন্তু সুন্দর যে কেবলই আপেক্ষিক এই নিয়ে আর কথা বাড়ালাম না। কিন্তু এই হিরো এমন কেন?? এ আবার কোন ধরনের ছবি বানালো রে ভাই। আরে ধুর ধুর। এইসব শোনার দিন খুব কমই আসে আমাদের দেশের সিনেমা পাড়ায়। এই মানুষগুলোকে তো বহুদিন ধরে চিনি এরা ছবি তুলে এডিট করা ছাড়া পাসপোর্টেও দেয় না, থাক তো প্রকাশ্যে আনবে। এদের সত্য কথা আর ঠিকঠাক চেহারা দেখালে তেতো কথা বলবেই।

দোকানদারঃ কেন ভাই করলা ভালোতো ?
ক্রেতাঃ হ্যাঁ ভালো… কিন্তু আধা কেজির বেশি দিয়েন না।

 

সুতরাং সেই দিক থেকে আবদুল্লাহ আল সাদ ভাই আপনি কাজ টা মোটেই ঠিক করেন নি। এই মানুষ গুলোকে এত পরিষ্কার আয়না দেখানো উচিত হয়নি। এরা ভয় পায়। তবুও তো দোকানে করলা রাখে কেউ কেউ তো আছে যারা ভালোটা বোঝে, কিন্তু আমাদের দেশের সিনেমা হল গুলো রাখে না। বাংলাদেশের অধিকাংশ সবজি বিক্রেতাই যথাযথ শিক্ষিত নয় আর হল মালিকরা………। যাই হোক আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ একটা সত্য গল্প বলার জন্য, একটা ভালো সিনেমা বানানোর জন্য, এই শহর কে এত সুন্দর করে মনে রাখার জন্য। মানুষ দুইটা জিনিস সারাজীবন মনে রাখে এক যা সে সব চেয়ে বেশি ঘৃণা করে আরেক যা সে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে দুইটাই মনের ভেতর থাকে।

লাইভ ফ্রম ঢাকা চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য

প্রত্যেকের ব্যক্তিগত জীবনের গল্পে সে নায়ক, স্বভাবগত ভাবে হোক আর স্বার্থের জন্যই হোক জীবন যুদ্ধে সে আমৃত্যু পরাজিত হতে চায় না। সেই রকম একটা যুদ্ধের গল্প, বেঁচে থাকতে চাওয়ার গল্প লাইভ ফ্রম ঢাকা। অলি গলির কীটপতঙ্গ, অসুস্থ রাজনীতি, ধান্দাবাজি, দুর্গন্ধ, আর অনিয়মের খোঁড়া শহরের খোঁড়া এক চরিত্র সাজ্জাদ। যে গলি থেকে যাত্রা শুরু করে এক বিলুপ্তপ্রায় যানে চড়ে আবার দিন শেষে সেই গলিতেই ফিরে আসে। একটা আঁধারে, বাতি জ্বালতেই আরেকটা আঁধার এসে দরজায় বেল দেয় তাঁর পর আরেকজন অতিথি আপ্যায়ন। কেবল ক্যানভাস বদলায় কিন্তু রং সেই একই থাকে সাদা কালো। এই জন্যই হয়তো সিনেমার রঙ নির্ণয় সাদা-কালো। সাজ্জাদের এই সাদা-কালো জীবনেও আছে প্রেমিকা রেহানা , ড্রাগ অ্যাডিক্টেড ছোট ভাই মাইকেল। চিত্রনাট্যের ঘটন রৈখিক। পুরো চিত্রনাট্যে মূল চরিত্র এবং পার্শ্ব চরিত্রের আয়তনের মিশ্রণ ছিলো সমসত্ত্ব। কাউকে কোথাও মনে হয়নি যে বেশি বা কম রাখা হয়েছে। তবে কিছু অরৈখিক ব্যাপার ও আছে, যেমন তাঁর বাসায় বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পর যখন আসলো তখন চেয়ারে বসা সে মেয়ে কে বা কেন এই দৃশ্য ? তা পরিষ্কার নয়। কর্দমায় ভরা দুর্গন্ধের এই শহরে বমি করে করে আর কত দিন, কতদিন এই ড্রাগ অ্যাডিক্টেড ভাইয়ের যখন তখন আবদার এই দিকে প্রেমিকার ঘন নিঃশ্বাস নিয়ে আর কতক্ষণ বয়ে বেড়াবে সাজ্জাদ,এই ঘন নিশ্বাসের বাইরে রাশিয়ার তুষারপাত আর জ্যামে ভরা ধুলোর শহর থেকে মালয়েশিয়ার ঐ ঝকঝকে রাস্তায় সুন্দর জীবন কাটানোর প্রয়াস সাজ্জাদ বইকি যে কারো মাথায় আসতে পারে। যেমন স্বপ্ন দেখে এই শহরের প্রত্যেকটা মানুষ যে একদিন এই শহরের সব ঠিক হয়ে যাবে।

যদিও এই জ্যামে ভরা এই শহরের কোন দৃশ্য এই সিনেমায় ধারণ করা হয় নি। ভুলে ভরা এই শহরে নাম্বার প্লেট অনুযায়ী কোনটা কি গাড়ী কিংবা যে দেশে আমি আমার চেয়ে আপনাকে নিয়ে বেশি মাথা ঘামাই সে দেশে রেহানা কি ঔষধ কিনলো তা একটু সময় নিয়ে এত কাছ থেকে দেখানো তেমন চোখে লাগার মত কিছু না, বরং গল্পের ঢং অনুযায়ী ঠিকই মনে হয়েছে। ট্রাভেল এজেন্সির ঐ লোকের ম্যালোড্রামাটিক সংলাপ একটু কানে লাগলেও সত্য এই যে এই দেশে আপনি চাইলেই সবকিছু হয় না, তা ন্যায় হোক আর অন্যায়। আপনার চাওয়া কারো চাপানো চিন্তার নিচে চাপা থাকে। কিন্তু বাঁচতে তোঁ হবে, রাশিয়া না হোক মালয়েশিয়া তো যেতে হবে সাজ্জাদের। হাতড়াতে থাকা সাজ্জাদের বাচার রাস্তা যখন সবদিক আস্তে আস্তে বন্ধ হতে থাকে, একমাত্র অবলম্বন গাড়ি টাও রাস্তায় আন্দোলন করা লোক পুড়িয়ে ফেলে তখন হাতরে বাচার একমাত্র পথ হয় রেহানা।

সেই রেহানাই যখন বলে যে, সে তাঁর বাচ্চাকে নষ্ট করে নি সেই মুহূর্তে গল্পটি শেষ। এই শেষ যেন লুকিয়ে রেখেছে একটা নতুন সাজ্জাদের কিংবা পুরনো সাজ্জাদের নতুন অন্ধকার। সরাসরি ঢাকা থেকে সম্প্রচারিত একটা গল্পের এমন ইতি মোটেই অযৌক্তিক নয়। তুহিন তামিজুল অসাধারণ চিত্রগ্রহণে ছিলেন। গাড়ির ভেতরে দৃশ্য, মাঝে মাঝেই একটু ঘোলা হয়ে যাওয়া কোন কিছুই অকারণ বলে বোধ হয় নি। আর মোস্তফা মানোয়ার শরীরের গঠনের অসাধারণ পরিচয় দিয়েছেন একাই পুরো ছবিটি কাঁধে নিয়ে। মাইকেল মানে তানভীর আহমেদ চৌধুরীর অভিনয় ব্যাপ্তি অনুসারে ষোলআনা। তাসনোভা তামান্নার কিছু জায়গা ছাড়া বাকি সবই ঠিক বলে মনে হয়েছে। শিল্প নির্দেশনায় বোধয় আরো অনেক কিছু করা যেত যদিও জানি যে বাজেট স্বল্পতা বলে একটা চাদর ছিলো গায়। কিন্তু অর্থ আসলে শিল্প চর্চাকে কোথায় আটকাতে পারে বলে আমি মনে করি না।

বাস্তবতা সত্যের জন্য যুদ্ধ করে , সত্য সুন্দরের জন্য যুদ্ধ করে। আপনার এই সিনেমা তেমনই এক সুন্দরের বহিঃপ্রকাশ আবদুল্লাহ আল সাদ। আর সত্য এবং সুন্দর সর্বত্র পূজনীয় এইটা এই শহরের অলি গলি অবধি পৌছাতে আরো ছবি বানাতে হবে। সেই সুন্দরের অপেক্ষায় থাকলাম। শুভকামনা রইলো আপনার জন্য, লাইভ ফ্রম ঢাকা এবং এর সাথে জড়িত সকলের জন্য। আর এই কামনা করি যে বাংলাদেশের হল মালিকদের এই ধরনের চলচ্চিত্রের পৃষ্ঠপোষকতার শুভ বুদ্ধি উদয় হবে।

বাংলা সিনেমার জয় হোক।