মহাজাগতিক ব্ল্যাকহোলের প্রথম ছবি

আজীবন অদেখাতেই থেকে যাবে ব্ল্যাক হোল! এমন চিন্তার অবসান ঘটালো জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানীরা। ব্ল্যাক হোলের ফার্স্ট লুক প্রকাশ পেলো। যে ব্ল্যাকহোল নিয়ে এতো মাতামাতি তা এখন জনসাধারণের সামনে উন্মুক্ত।

Event Horizon Telescope -এ ধরা পড়ে ব্ল্যাকহোলের এই ছবিটি

ব্ল্যাকহোল হচ্ছে মহাবিশ্বের সেই সব স্থান যার ঘনত্ব, ভর অনেক বেশি এবং ব্যাসার্ধ খুবই কম। কোন বস্তুর ক্ষুদ্র ব্যাসার্ধের মধ্যে ঘনত্ব,ভর অনেক বেশি হলে তার মহাকর্ষ বল অনেক শক্তিশালী হয়ে থাকে। ব্ল্যাকহোলের ক্ষেত্রে সেই ব্যাসার্ধ হতে হয় শোয়ার্জশিল্ড ব্যাসার্ধের সমান (R=2GM/c^2)। যেখানে, M বস্তু বা নক্ষত্রটির ভর। G মহাকর্ষিয় ধ্রুবক। C আলোর বেগ। এই ব্যাসার্ধ পরিমাপের সূত্রটির মান শোয়ার্জশিল্ড রেডিয়াস, পদার্থবিজ্ঞানী কার্ল শোয়ার্জশিল্ড এই সূত্র আবিষ্কার করেছিলেন ১৯১৬ সালে। তাঁর নাম অনুসারে এর নাম রাখা হয়। মহাবিশ্বের এমন কিছু তারকা বা নক্ষত্র আছে, যারা এমন শক্তিশালী মহাকর্ষ বল তৈরি করে যে এটি তার কাছাকাছি চলে আসা যেকোন বস্তুকে একেবারে টেনে নিয়ে যায়, হোক তা কোন গ্রহ, ধুমকেতু বা স্পেসক্রাফট- সেটাই হচ্ছে ব্ল্যাক হোল। পদার্থবিজ্ঞানী জন হুইলার এর নাম দেন ‘ব্ল্যাক হোল’।

যুগ যুগ ধরে এই ব্ল্যাকহোল নিয়ে বহু বিজ্ঞানীরা বহু গবেষণা করে আসছেন। এতদিন চাঁদের মাটিতে মানুষের হাঁটা বা মঙ্গলে রোবোটের পদচারণা মহাজাগতিক ক্ষেত্রে মানুষের উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ বলেই ধরা হতো। সেই পথকে আরও একটু এগিয়ে মানবচক্ষু চলে গেলো পঞ্চান্ন মিলিয়ন আলোকবর্ষ (৫২.০৩ লক্ষ কোটি কিলোমিটার) দূরের মেসিয়ের ৮৭ (সংক্ষেপে এম৮৭) গ্যালাক্সির কেন্দ্রের ব্ল্যাক হোলে, বিজ্ঞানীদের মতে যার আয়তন সূর্যের ৬৫০ কোটি গুণ। ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সালে লাইগো সংগঠন মহাকর্ষীয় তরঙ্গের প্রথম প্রত্যক্ষ সনাক্তকরণের ঘোষণা দেয়, যা ছিল দুটি ব্ল্যাকহোলের একত্রীভবনের প্রথম পর্যবেক্ষণ। ডিসেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত ১১ টি মহাকর্ষীয় তারঙ্গিক ঘটনা পর্যবেক্ষিত হয়েছে যার মাঝে ১০ টি ঘটনা ব্ল্যাকহোলের একত্রীভবনের ফলে এবং ১ টি ঘটনা দ্বৈত নিউট্রন তারা একত্রীভবনের ফলে সৃষ্ট। ২০১৭ সালে ইভেন্ট হোরাইজোন টেলিস্কোপ দ্বারা মেসিয়ে ৮৭ ছায়াপথের কেন্দ্রে অবস্থিত অতিভারী ব্ল্যাকহোল পর্যবেক্ষণের পর দীর্ঘ বিশ্লেষণ শেষে রিসেন্টলি অর্থাৎ ১০ এপ্রিল ২০১৯ সালে প্রথমবারের মত একটি ব্ল্যাকহোল ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের প্রত্যক্ষ চিত্র প্রকাশিত হয়। জোতির্বিজ্ঞানিরা ৬টি সংবাদ সম্মেলন করে বিশ্বের কাছে ব্ল্যাক হোল বা কৃষগহ্বরের প্রথম ছবি প্রকাশ করেন। ছবিতে ব্ল্যাকহোলের অর্ধচন্দ্রাকার নিঃসরণ বলয় এবং কেন্দ্রীয় ছায়া দেখা যায় যা এর ইভেন্ট হোরাইজোন বা ঘটনা দিগন্তের যথাক্রমে ফোটন বলয় এবং বন্দী ফোটন বিশিষ্ট অঞ্চলের মহাকর্ষীয়ভাবে বিবর্ধিত দৃশ্য। ব্ল্যাক হোলের ঘূর্ণনের ফলে এই অর্ধচন্দ্রের মত আকার সৃষ্টি হয়; এবং এই কেন্দ্রীয় ছায়ার ব্যাস ইভেন্ট হোরাইজোন বা ঘটনা দিগন্তের ২.৬ গুণ। ছবিতে যা দেখা গেছে, তা সুর্যের ভরের চেয়ে ৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন গুণ বেশি। উল্লেখ্য, একে ফ্রেমবন্দি করার জন্য পরীক্ষা চালানোর প্রস্তাব করেন নেদারল্যান্ডের র‌্যাডবোউড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হেইনো ফালকে। এই প্রকল্পের পরিচালক এবং কেমব্রিজের হার্ভার্ড-স্মিথসোনিয়ান সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী শেফার্ড ডোলম্যান বলেছেন, “মানুষ যেটাকে দেখা অসম্ভব বলে ভেবে এসেছে, আজ তা-ই দেখেছি আমরা; শুধু দেখিইনি, এর ছবিও তুলেছি।”

ব্ল্যাক হোলে রয়েছে শক্তিশালী মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র। প্রত্যেক ব্ল্যাক হোলের চারদিকে একটি সীমা আছে যেখানে একবার ঢুকলে আর বের হওয়া যায় না। এইভাবেই মহাকাশের মহাবিস্ময় হয়ে বেঁচে আছে ব্ল্যাক হোল। সূর্যের চেয়ে কমপক্ষে দশগুণ বড় নক্ষত্রদের জ্বালানি শেষ হয়ে গেলে এরা সঙ্কুচিত হতে হতে অতি খুদ্র অন্ধকার বিন্দুতে পরিণত হয়। এই ধরণের ব্ল্যাক হোলকে বলা হয় স্টেলার মেস ব্ল্যাক হোল। বেশীরভাগ ব্ল্যাক হোলই এধরণের। কিন্তু নক্ষত্রের সঙ্কুচিত হয়ে ব্ল্যাক হোলে পরিণত হওয়ার পরও ব্ল্যাক হোলে নক্ষত্রের সমান ভর ও অভিকর্ষ টান থাকে। আরেক ধরণের ব্ল্যাক হোল হচ্ছে সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল। তাদের এক মিলিয়ন তারার ভর এমনকি এক বিলিয়ন তারার ভরও থাকতে পারে। সুপার মেসিভ ব্ল্যাক হোল কোন গ্যালাক্সির মিলিয়ন বা বিলিয়ন তারাকে একত্রে ধরে রাখে। আমাদের গ্যালাক্সিতেও কিন্তু একটি সুপার মেসিভ ব্ল্যাক হোল আছে। সেটির নাম ‘স্যাজিটারিয়াস এ’, যা আবিষ্কৃত হয়েছিল ৪০ বছর আগে।ব্ল্যাক হোলকে ভাগ করা হয় তার মাঝে থাকা ভর, আধান, কৌণিক ভরবেগের উপর ভিত্তি করে। ভরের উপর ভিত্তি করে ব্ল্যাক হোল চার ধরনের। যেমন-
১. সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল
২. ইন্টারমিডিয়েট ব্ল্যাক হোল
৩. মাইক্রো ব্ল্যাক হোল
৪. স্টেলার ব্ল্যাক হোল
সাধারণত কোন ব্ল্যাক হোল তৈরি হতে হলে কোন তারার ভর পাঁচ সৌর ভর এর বেশি হতে হয়। মূলত, ব্ল্যাকহোলের ভর অনেক বেশি থাকার কারনেই তার মহাকর্ষ বল এতো বেশি হয়ে থাকে এবং তার এস্কেপ ভেলোসিটি হয় আলোর বেগের চেয়েও বেশি। তাই কোন বস্তু একবার ব্ল্যাক হোলে পতিত হলে পরবর্তীতে তা মহাকর্ষ বলকে অতিক্রম করতে পারে না। এমনকি আলো পর্যন্ত ব্ল্যাক হোলের মহাকর্ষ বল এর কারণে আটকা পড়ে। ফলে সেই বস্তুটি তাৎক্ষনিকভাবে সেখানেই হারিয়ে যায়। আর যেহেতু কোন বস্তু থেকে আলো না আসলে আমরা সেই বস্তুকে দেখতে পাই না সেহেতু ব্ল্যাকহোল থেকে আলো না আসায় আমরা সেটিকে কালো দেখি।

ব্ল্যাক হোল অবশেষে জনস্মমুখে উন্মোচিত হলো! ছবি উন্মোচনের প্রেস কনফারেন্সে বিজ্ঞানী ম্যাকনামারা বলেন, ব্ল্যাক হোলের সরাসরি ছবি তোলার মাধ্যমে আলবার্ট আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের ধারণা প্রমাণিত হলো। প্রেস কনফারেন্সে বলা হয়, এটি সবচেয়ে ভারী ব্ল্যাক হোল। এটা আদতে একটা দৈত্য বা মনস্টার। আইনস্টাইন কিংবা স্টিফেন হকিং বেঁচে থাকলে হয়তো তারাই আজকে সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন। যাই হোক, ব্ল্যাকহোলের ছবি উন্মোচিত হলো, এবার ধীরে ধীরে এর রহস্য ভেদ করার পালা!