দ্বীপটার নাম গোয়াম।
প্রশান্ত মহাসাগরের স্বৰ্গ দ্বীপগুলোর একটা।
সারা বছরই বসন্ত। মাতাল হাওয়া আর শান্ত নীল জল। নারকেল গাছের জঙ্গল। পাহাড়। লাল চিনির মত সৈকতের বালি।
দুই গপ্লোবাজ পাহাড়ের ঢালে বসে বিয়ার গিলছিল। সাথে ঝলসানো শুয়োর। অনেক রাত হয়ে গেছে। বাড়ি ফেরার তাড়া নেই ওদের। আড্ডাও শেষ হচ্ছে না। আকাশ থেকে গল গল করে গড়িয়ে পড়ছে জোছনা। হঠাৎ মনে হলো পেছনের জঙ্গলে কী যেন নড়াচড়া করছে। ইঁদুর নাকি?
নাহ। আরও বড় কিছু। ইঁদুরের শব্দ এমন না। হতে পারে বুনো শুয়োর। জঙ্গলের ভেতরে প্রায়ই দেখা যায়। বন মুরগিও হতে পারে।
কথা বন্ধ করে জঙ্গলের দিকে চোখ রাখল দুই গপ্লোবাজ। হঠাৎ করে তাদের মনে পড়ল, জায়গাটা ভাল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এখানে প্রচুর জাপানি সৈন্য মারা গেছে। রাত বিরাতে নাকি দু’একজনকে আজও দেখা যায়-পুরোদস্তুর ইউনিফর্ম পরে পুরনো আমলে বন্দুক নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। মাথায় সবুজ লোহার হেলমেট। কিন্তু মুখটা কংকালের খুলি, মাংস নেই।
হ্যাঁ, জঙ্গলের ভেতর থেকে হামাগুড়ি দিয়ে কী যেন বের হয়ে আসছে। পিচ্চি কোনও বাচ্চা নাকি? আরে না। এ তো একজন জাপানি সৈনিক। হায় হায়। আতঙ্কে চিৎকার করে উঠেই দৌড় দিল দুই বন্ধু, পড়ে রইল ঠান্ডা বিয়ার আর সুস্বাদু মাংস।
দৌড়। দৌড়।
কিছুটা দূরেই ছিল এক সরাইখানা। প্রায় বন্ধ হচ্ছিল। ম্যানেজার বসে হিসেব করছিল। ধোয়ামোছা করছে দুই কর্মচারী। এক কোণে মদ খেয়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে এক খদ্দের। ভীষণ মোটা লোকটা। নাক ডাকছে বিকট শব্দে।
দড়াম করে দরজা খুলে দৌড়ে ভেতরে ঢুকল দুই দৌড়বাজ। বিরক্ত হলো ম্যানেজার। শালারা মরার সময় পেল না। এখন যদি বসে মদ গিলতে চায়? সরাইখানা বন্ধ করবে কখন? বাড়িই যাবে কখন? বান্ধবী অপেক্ষা করছে। রাতটা জম্পেশ ছিল।
“দুঃখিত, স্যর!” গলায় কয়েক লিটার অতিরিক্ত বিনয় ঢেলে বলতে গেল ম্যানেজার যে, এই মুহূর্তে কোনও পানাহার করা যাবে না।
তার আগেই হব হব করে দুই আগম্ভক জানাল-জাপানি ভূত দেখেছে তারা। সৈনিকের ভূত।
হাঁ হয়ে গেল কামরার সবাই। দ্রুতগতিতে বন্ধ হয়ে গেল সরাইখানা। এক কর্মচারী প্রস্তাব দিল গিয়ে দেখে আসা যাক ঘটনা সত্যি কিনা! খামোকাই ধাতানি খেরো বেচারা।
যেখানে ভূত দেখেছে তার উল্টেদিক দিয়ে ঘুরে হেঁটে অনেক পথ পাড়ি দিয়ে যে যার বাড়ি ফিরল সে রাতে।
পরদিন সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল সৈনিকের ভূতের কথা। কেউ বিশ্বাস করল। কেউ করল না।
এ রকম অভিজ্ঞতা আরও অনেকের হয়েছে। বেশ কিছুদিন ধরে চলল জাপানি সৈনিক ভূতের গল্প। তারপর একটু থিতিয়ে গোল ব্যাপারটা।
বেশ কিছুদিন কেটে গেল।
১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি।
টোলা ফুফু নদীর ধারে চিংড়ি ধরছিল আদিবাসী দুজন জেলে। দিনের বেলা জাল পেতে যায়। আররাতে সেগুলো গুটিয়ে নিলেই ধরা পড়ে ইয়া বড় বড় গলদা চিংড়ি। বরফ ভর্তি কাঠের বাক্সে করে চালান করে দিলেই নগদ টাকা।
হঠাৎ করেই দেখল ওরা। হ্যাঁ, জঙ্গলের ভেতর থেকে চুপি চুপি হেঁটে আসছে এক জাপানি সৈন্য। অপেক্ষাকৃত সাহসী ছিল আদিবাসী জেলে দুজন। ঘাপটি মেরে পড়ে রইল ওরা। দেখা যাক ভূতটা কী করে! জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে সৈকতে দাঁড়াল ভূতটা। তারপর পরম যত্নের সাথে কুড়াতে লাগল শামুক আর ঝিনুক। হাতে একটা ঝুড়ি টাইপের কী যেন। তাতেই রাখছে সংগ্ৰহ করা জিনিসগুলো।
ভূতটার গায়ে কোনও সৈনিকের ইউনিফর্ম নেই। তার বদলে রয়েছে নারকেল গাছের বাকল দিয়ে বানানো কিম্ভুত ফতুয়া। আদিবাসী দুজন বুঝে ফেলে এটা কোনও মৃত সৈনিকের আত্মা বা ভূত না। জীবিত একজন বুড়ো জাপানি!
অসম সাহসের সাথে দৌড়ে এসে জাপটে ধরে ওরা ভূত ওরফে বুড়ো জাপানিটাকে।
ধরা পড়ার পর বুড়ো জাপানি প্ৰথমে যে কথা বলে তা হচ্ছে, “আমি সার্জেণ্ট, ইউকাইয়ো। আমি যুদ্ধ করতে চাই না। যুদ্ধ কি শেষ হয়েছে?
এর পরই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে বুড়ো সৈনিক।
ঠিক আটাশ বছর পরে খুঁজে পাওয়া গেল হারিয়ে যাওয়া জাপানি সৈন্য সার্জেন্ট ইউকাইয়োকে।
১৯৪১ সালে শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। গোয়াম এবং এর আশপাশের সবগুলো দ্বীপ ছিল জাপানিদের দখলে। সার্জেন্ট ইউকাইয়োর বয়স মাত্র ছাব্বিশ। গোয়ামের পাশে মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জে প্রথম ছিল সে যুদ্ধরত অবস্থায়। পরে বদলি হয়ে গোয়ামে আসে। যুদ্ধ ভাল লাগছে না তার। জাপানে রয়ে গেছে তার পরিবার। বিষণ্ণ লাগছে।
চোখের সামনে মারা যাচ্ছে সব বন্ধুবান্ধব। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, এ যুদ্ধে জাপান হারবে। আর তা হলে ‘হারাকিরি’ করে আত্মহত্যা করতে হবে। কিন্তু মরতে চায় না বেচারা। জাপানে তার পরিবার রয়েছে। মা কি সুন্দর শেওলার সূপ বানায়। বাড়ির সামনে কয়েকটা চেরী গাছ আছে। শীতের শেষে কত ফুল ফোটে। পরিবারে সবাই বসে চা খেতে খেতে কত আড্ডা হত। দিনগুলো কি আর ফিরে আসবে না?
১৯৪৫ সালের সেপ্টেম্বরের ২ তারিখে জাপান আত্মসমর্পণ করে। শেষ হয় রক্তক্ষয়ী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের। দল বেঁধে আত্মহত্যা করে অসংখ্য জাপানি সৈন্য।
কিছু ধরা পড়ে যায় যদ্ধবন্দী হিসেবে। সৈনিকের তালিকা মিরিয়ে দেখা যায় অসংখ সৈনিক নিরুদেশ। হারিয়ে গেছে। জীবিত না মৃত কে জানে?
১৯৪৪ সালের মাঝামঝি কোনও এক সময় থেকে সম্পূর্ণ অন্তর্ধান হয়ে গেছে সার্জেন্টি ইউকাইয়ো।
কোথায় কে জানে!
তারপর সময়ের স্বাভাবিক নিয়মে সবাই সব ভুলে গেল। অনেকগুলো বছর পর ধরা পড়ল হারানো সৈনিক।
ইউকাইয়ো যুদ্ধের চরম পর্যায়ে পালিয়ে যায় গহীন অরণ্যে। একা। পাহাড়ের এক গুহাতে বানায় তার ঠিকানা। বাঁশের চলা দিয়ে ঢেকে দেয় গুহার মুখ। কারও সাধ্য নেই খুঁজে বের করার ।
কেউ তার বন্ধু নয়। জাপান হারলে তাকে মরতে হবে। জাপান জিতলেও ওরা তাকে মেরে ফেলবে। যুদ্ধ ফেলে পালিয়ে যাবার জন্য।
তা হলে? বাড়ি ফেরা হবে না কখনও? দেখা হবে না চেরী গাছগুলো? মায়ের হাতের খাবার জুটবে না? –
প্রথম কাজ লুকিয়ে থাকা। নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করা।
দিন গড়াতে লাগল। জঙ্গলের অপদেবতা বেতালের মত বনের মধ্যে লুকিয়ে রইল সে। গুহার মধ্যে দাগ দিয়ে সময়ের হিসেব রাখতে লাগল। দিনে গুহার মধ্যে কাটাত। রাতে বেরুত খাবার খুঁজতে। জঙ্গল থেকে রুটি ফল, পেঁপে, নারকেল, আম, বাদাম সংগ্ৰহ করত। সমুদ্র থেকে যোগাড় করত শামুক, ঝিনুক, চিংড়ি, ইল, কাঁকড়া। মাঝে মাঝে ফাদ পেতে, ধরত ইদুর, বুনো শুয়োর আর কবুতর। সমুদ্রের পানি শুকিয়ে বানাত লবণ। বৃষ্টি হলেই নানা কায়দা করে মিষ্টি পানি ধরে রাখত।
দিন কাটতে লাগল। বোঝা যাচ্ছে না যুদ্ধ: শেষ হয়েছে কিনা।
জামাকাপড় ছিড়ে গেলে নারকেল গাছে পাটের চটের মত এক ধরনের বাকল হয় তা দিয়ে ফতুয়া বানাতে লাগল।
পকেট ঘড়ির কাঁচ দিয়ে ম্যাগনিফাইং গ্লাসের মত কায়দা করে আগুন জ্বালাত। নারকেলের ছোবড়াতে আগুন জ্বলিয়ে সে আগুন জিইয়ে রাখত মেঘলা দিনগুলোতে। আর রাতে ঘুর ঘুর করত জঙ্গলে, পাহাড়ে, সৈকতে। যা কুড়িয়ে পেত সবই সংগ্ৰহ করত। পানির গ্যালন, বোতল, রান্নার কড়াই, চাকু। মাঝেসাঝেই পেত, বনে, সৈকতে ।
ধরা পড়লে চলবে না। বেঁচে থাকতে হবে। টিকে থাকতে হবে। এর মাঝে অনেক সময় চলে গেছে। বেচারা জানে না যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে কবেই।
মানুষ চাঁদে গেছে। নতুন যুগ এসে গেছে পৃথিবীতে। চারদিকে জীবনের জয়যাত্ৰা। জীবন তার সবটুকু আনন্দ নিয়ে হাজির আমাদের সামনে । বেচারা জানে না! শুধু জানে পালিয়ে থাকতে হবে!-
এর মাঝে হয়তো কেউ তাকে রাতে বিরাতে পাহাড়ে বা বনে দেখেছে। এই জন্যই হয়তো সৈনিক ভূতের গল্প চালু হয়ে গেছে মানুষের মুখে মুখে। এমনকী দুষ্ট শিশুরা পর্যন্ত জানত সৈনিক ভূতের গল্প।
ইউকাইয়ো ধরা পড়ার পর তুমুল উত্তেজনা হয় দ্বীপগুলোতে । জাপান সরকার যথেষ্ট সম্মান দিয়ে ফেরত নিয়ে যায় তাকে। গোয়ামের গভর্নরও তাকে যথেষ্ট সম্মান জানায়। তার ব্যবহৃত জিনিসপত্র সব মিউজিয়ামে রাখা হয়। যে গুহাতে সৈনিক থাকত সেটা পরিণত হয় গরম টুরিস্ট, স্পট হিসাবে। পৃথিবীর প্রায় সব সংবাদপত্রে ইউকাইয়োর ঘটনাটা ছাপা হয়।
এরপরও বুড়ো সৈনিক অনেক দিন বেঁচে ছিল। ১৯৯৭ সালের ২২ সেপ্টেম্বর বিকেল ৫টা ৭ মিনিটে মারা যায় সে। জাপানে নাগুয়া শহরের এক হাসপাতালে। মৃত্যকালে তার বয়স ছিল ৮২ বছর।
আমি তখন গোয়ামের পাশের দ্বীপ মারিয়াসা আইল্যান্ডে থাকি। যখান থেকে বেচারা জীবন শুরু করেছিল। অনেকে আমার কাছে জানতে চেয়েছিল বুড়ো সৈনিক কি তার পরিবারের দেখা পেয়েছিল?
আমি জানি না। অনেক চেষ্টা করেও জানতে পারিনি। তবে সে বাড়ি ফিরে গিয়েছিল, এতেই আমি খুশি।
তোমরা কি বল ?