প্রথম মহাকাশজয়ীর রহস্যময় মৃত্যু

উপরে তাকালে নীল আকাশ। তার উপরে কি আছে? রাতের আকাশে যখন হাজারো তারা ঝলমল করে উঠে মানুষের মন আকুপাকু করে তারাদের হাতছানিতে। আকাশ তো জয় হয়েছে অনেক আগেই, এবার মানুষের স্বপ্ন আকাশ পেরিয়ে বাইরে যে বিশাল একটা দুনিয়া, সে মহাকাশকে জয় করা। সেই স্বপ্নও একদিন বাস্তবে পরিণত হলো। প্রথম মানুষ হিসেবে মহাকাশে ঘুরে এলেন নভোচারী ইউরি গেগারিন। ফিরে এসে শুনালেন সে অবারিত রহস্যময় মহাকাশের কথা। মানুষ চোখ গোলগোল করে সে কথা কেউ শুনলো আবার কেউবা পড়লো। কিন্তু তাতে কি পিপাসা মিটে।এটাতো সবে তো শুরু। ঐ যে রাতের আকাশের চাঁদ, আর সৌরজগৎ এর গ্রহমণ্ডলী আর জানা অজানার আর কতকিছু সেসব কিছু এখনও বাকি।
যাহোক মূল আলোচনায় ফিরে আসি। বলছিলাম নভোচারী ইউরি গেগারিনের কথা। মহাকাশ জয় করার বছর সাতেক পর হঠাৎ এক প্লেন দুর্ঘটনায় মারা যান তিনি। প্রথম দিকে এটাকে নিছক একটা দুর্ঘটনা মনে হলেও ধীরে ধীরে মানুষের মনে জাগতে থাকে নানা প্রশ্ন। সেসব প্রশ্ন এই দুর্ঘটনাকে ক্রমেই জটিল এবং রহস্যময় করে তুলে।
এই নিয়ে যেমন অনেক যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন উঠে তেমনি গড়ে উঠে কিছু গাল গপ্পোও। অবশ্য হবেই বা না কেন?
গেগারিন তখন বলতে গেলে সোভিয়েত ইউনিয়নের গর্বের প্রতীক। ইতিহাস সৃষ্টিকারী এই নভোচারী প্রায় ১০৮ মিনিট মহাকাশে অবস্থান করতে পেরেছিলেন। এই সময়ে তিনি মহকাশযানে চড়ে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করেন। এমন কিছু পর্যবেক্ষণ করেন যা তার আগে আর কেউ দেখেনি। তার সেই সাফল্যে যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে চলমান নীরব সংঘাতে বলে গেলে প্রায় এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নকে।

মহাকাশে যাওয়ার আগে সোভিয়েত বিমান বাহিনীতে পাইলট হিসেবে অভিষিক্ত ছিলেন ইউরি গেগারিন। মহকাশ থেকে ফেরার কিছুদিন পর তিনি আবার পুনরায় তার পুরনো পেশায় ফিরে যান। দিনটা ছিল মার্চের ২৭, ১৯৬৮। সেদিন ইউরি গেগারিনের কাজ ছিল মিগ-১৫ বিমানের তিনটি প্রশিক্ষণমূলক ফ্লাইট চালানো। প্রথম ফ্লাইটি তিনি তার সাথে প্রশিক্ষক ভ্লাদিমির সেরেগিন এর সাথে বেশ সফলভাবেই সমাপন করেন।
প্রথম প্রশিক্ষণমূলক ফ্লাইট শেষ করে তিনি কিছুটা সময় বিরতি নেন। এই সময়ে তিনি কিছু নিয়মমাফিক ব্যায়ামও করে নেন নিজেকে পরবর্তী ফ্লাইটের জন্য তৈরি করার জন্য। এবার তিনি দ্বিতীয় ফ্লাইটের জন্য বিমানে চড়ে বসেন। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু উড্ডয়নের কিছুক্ষণ পরেই কন্ট্রোল রুমের সাথে বিমানটির সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।
উদ্ধারকারী দল যখন প্লেনটিকে খুঁজে পায়, দেখা যায় দাউ দাউ করে আগুনে পুরে ভস্ম হয়ে যাচ্ছে প্লেনটি। এই ধরনের কোন দুর্ঘটনার পর বিমানের কোন আরোহীদের বাচা প্রায় অসম্ভব ছিল। ফলশ্রুতিতে, ইউরি গেগারিন যে আর বেচে নেই এটা প্রায় নিশ্চিতই হয়ে যায় উদ্ধারকারী দলের কাছে। যদিও তখনও অবদি অনেকের মনে আশা ছিল যে গেগারিন হয়তো বিমান বিধস্ত হওয়ার আগে বেরিয়ে যেতে পেরেছিলেন। কিংবা হয়তো কোথাও নেমেও থাকতে পারেন প্যারাসুটে চড়ে।
কিন্তু সে আশাটিও নিভে যায় এর পরের দিন, যখন বিধস্ত হয়ে যাওয়ার বিমানের বিমানের ভেতর থেকে গেগারিনের দেহবশেষ পাওয়া যায়।
তদন্ত বসে এই ঘটনার। তদন্তে বেড়িয়ে আসে বিমানটি বিধস্ত হয়েছিল মূলত ইউরি গেগারিনের ভুলেই। কিন্তু ইউরি গেগারিনের মতো একজন দক্ষ পাইলট কিভাবে এই ধরনের মারাত্মক রকম ভুল করতে পারেন সেটাও অনেকের প্রশ্নের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
এই নিয়ে দেখা দেয় অনেক যুক্তি তর্ক। কারো কারো মতে গেগারিন মদ্যপ অবস্থায় হয়তো বিমানে চড়েছিলেন। কেউ আবার আর এক কাঠি সরস এই দিক থেকে। তাদের মতে, গেগারিনের বিমানটি মূলত একটি UFO এর সাথে ধাক্কা খেয়েছিল, ফলশ্রুতিতে এই দুর্ঘটনাটি ঘটে।
তবে সবচেয়ে ভয়াবহ রকমের যে গুজবটি ছড়ায় সেটি হচ্ছে, গেগারিনের বিমান দুর্ঘটনাটি নিছকই একটি দুর্ঘটনা নয়, মূলত এটি ছিল একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।
অবশ্য এমনটা ভাবারও কিন্তু বেশকিছু কারণ আছে। আগে থেকেই অনেকের বিশ্বাস ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের তৎকালীন একজন বেশ প্রভাবশালী নেতা, লিউনিড ব্রেজনেভ এর সাথে ইউরি গেগারিনের মধ্যে একটা বেশ ভালো রকমের দ্বন্দ রয়েছে। অনেকের কাছে এই কুকীর্তিটি লিউনিড ব্রেজনেভেরই। অবশ্য এই ঘটনার সাথে লিউনিড ব্রেজনেভের হাত রয়েছে এর সপক্ষে কোন ধরনের শক্ত প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
এই তত্তটি নাকচ হয়ে যাওয়ার পরে আরেকটি তত্ত বেশ শোরগোল তুলে। সেখানে বলা হয় যে, গেগারিন আসলে মারাই যায়নি, তিনি আসলে বেচে আছেন। যেহেতু গেগারিন মানুষের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন, তিনি হয়তো চাইছিলেন এই জনপ্রিয়তার ব্যাপারটিকে এখানেই শেষ করতে। তাই তিনি নিজেই একটা মিথ্যা দুর্ঘটনা সাজিয়ে মানুষকে জানিয়ে দেন যে তিনি মৃত।

এই ধরনের আর শত শত তত্ত্ব উঠে আসে মানুষের কথায়। এবং যথারীতি প্রায় সবগুলো তত্ত্বই বাতিল হয়ে যায় উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে। তদন্তের পর সেই পুরনো সিধান্তই ঘুরে ফিরে আসে। ইউরি গেগারিন নিজে অথবা অন্য কোন কিছু বিমানটি মাথাটিকে নিচের দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিল। যারা ফলেই বিমানটি খুব দ্রুত নিচের দিকে নেমে যায় এবং মাটিতে আছরে পরে বিধস্ত হয়।
তবে ইউরি গেগারিন নিজে ভুলক্রমে বিমানের মাথাকে হুট করে নিচের দিকে নামিয়ে দিয়েছিলেন এটা মানতে অনেকেই নারাজ। তাদের মধ্যে একজন হচ্ছেন আরেক নভোচারী লিওনোভ। তিনিও এটিকে দুর্ঘটনার পরিবর্তে হত্যাকাণ্ড হিসেবেই মনে করেন। কেননা, ইউরি গেগারিনের বিমানটি যেখানে উড়ছিল তার আশেপাশেই আরেকটি বিমান ছিল। যেটি একসময় ইউরি গেগারিনের খুব কাছাকাছি চলে আসে এবং খুব সম্ভবত সেটার সাথে সংঘর্ষ এড়াতে গিয়েই এই দুর্ঘটনাটি ঘটে।

ঘটনাটির পর আজ বহু বছর কেটে গেছে। এখনও মানুষ নানাভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে এই ব্যাপারটিকে, বের করার চেষ্টা করে উত্তর না পাওয়া প্রশ্নের। কিন্তু ঠিক কি ঘটেছিল সেদিন, এটা কি নিছকই কোন দুর্ঘটনা ছিল কিনা সেটা আজও অজানা। হয়তো আসল ঘটনা আর জানা যাবেনা কোনদিনও।