দিনগুলো ভালই ছিল। দুধের সরের মত কুয়াশা পড়ত সন্ধে বেলা। গরিব মানুষগুলো শুকনো লতাপাতা আর গাছের বাকল দিয়ে আগুন জ্বালাত। চারদিকে গোল হয়ে বসে ওম্ পোয়াতো ওরা। খেলার মাঠ থেকে বাড়ি ফিরতাম আমি। বাতাসে ভেসে আসত কাঠ পোড়া মিষ্টি গন্ধ। দূরে কোনও হিন্দু বাড়িতে কাঁসার শব্দ। সন্ধ্যাপূজা দিচ্ছে। মোড়ের চায়ের দোকানে বিশাল এক কেতলিতে চা তৈরি হচ্ছে। চার-পাঁচটা কাচের ঢাউস সাইজের বয়াম। তাতে বাসি বিস্কুট। দু’তিনজন বুড়ো বসে আছে। গলায় চেক কাটা মাফলার। হ্যাজাকের আলোতে হনুমানের মত লাগছে তাদের। পিচ্চি একটা রেডিও বাজছে। মনোযোগ দিয়ে শুনছে সবাই।
এক পাশে রাস্তায় বসে আলুর চপ, পিঁয়াজু, বেগুনী ভাজছে বিশাল মোটা আর কালো এক লোক। বিশাল ভুঁড়ির জন্য হাতাকাটা স্যান্ডো গেঞ্জিটা কুঁচকে বুকের উপর উঠে গেছে। শীতের বিকেলে চমৎকার ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে ভাজাগুলো।
পিচ্চি এক ছোকরা, এক গাদা সোনালী হলুদ ভুট্টা নিয়ে বসে আছে। ভুট্টাগুলো দাঁত বের করে হাসছে। ছোট্ট মাটির এক মালশাতে গনগনে কয়লা। তাতে টুশটাশ করে ভুট্টা পুড়ছে। মাত্র এক টাকা। সাথে তেঁতুলের ঝাল একটা সস। বিশাল দুটো ঝাঁকড়া কড়ই গাছ। তাতে হিজিবিজি পাতা। কালো পীচের রাস্তাটা চলে গেছে আমার বাসার দিকে। শুকনো কয়েকটা সোনালী পাতা পড়ে আছে কালো পীচের রাস্তাতে। মনে হচ্ছে রূপকথার কোনও দেশে হাঁটছি আমি। যেখানে রূপার গাছে সোনার পাতা হয়। আর ডালে বসে গান গায় হীরামন পাখি। হীরামন দেখতে কেমন হয় কে জানে! হয়তো মাছরাঙার মতই।
বিশাল লোহার ট্রাংক্ থেকে শীতের কাপড় বের করে আনে মা। ন্যাপথালিনের গন্ধ ভরা। ঠিক এ রকম বিশাল ট্রাংকে সোনার মোহর ভর্তি করে জ্যামাইকা দ্বীপের বালুর সৈকতে লুকিয়ে রাখত জলদস্যুরা।
আমার ছোট শহরটা শীতে সন্ধ্যাতেই নিঝুম হয়ে যেত। রান্নাঘরে সব ভাইবোনেরা এক সাথে বসে চা বিস্কুট খেতাম। তারপর সেই একঘেয়ে বীজ গণিত। সম্পাদ্য, উপপাদ্য, ইংরেজিতে অনুবাদ করো—ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগীটি মারা গেল।
বাইরে সাঁই সাঁই শীতের বাতাস। রাতের খাবার লাল টমেটো, সবুজ সীম দিয়ে বিঘত খানেক বড় কৈ মাছ। প্রশান্ত সাগরের পান্নার মত মটরশুঁটি ভর্তি তাতে। আর শৈবালের মত ধনে পাতা। জুঁই ফুলের মত ভাত। দানবের চোখের মত নতুন লাল আলু। ফুলকপির বড়া। বাঁধাকপি ভাজা। তাতে অচেনা মসলার মন-মাতানো ঘ্রাণ। রাতে ঘুমের নগরীতে তলিয়ে যেতাম। ক্লান্ত মেষবালকের মত ঘুম। ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখতাম কাঠের ঠ্যাঙ নিয়ে হাঁটছে এক জলদস্যু সর্দার। তার কাঁধে একটা তোতাপাখি। হেঁড়ে গলায় গান গাইছে কয়েকজন নাবিক—‘সিন্দুকটা মরা মানুষের—চড়াও হলো পনেরো নাবিক।’
গানের শেষ লাইনে আরেক বোতল রাম নিয়ে আসার কথা। এটা নাকি খুব মজার। ঘুমের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম বড় হয়ে রাম খেতে হবে।
বর্ষার দিনগুলোতে ঘুম ভাঙত তুমুল বৃষ্টির শব্দে। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ। পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রুতিমধুর কনসার্ট। মোজার্ট, বেথোভেন ওরা পারবে এমন একটা শব্দ কম্পোজ করতে? অন্য কোনও গ্রহেই কি পাওয়া যাবে এমন পাগল করা ঐক্যতান।
আকাশ ভর্তি কালো মেঘ। পাগলা হাতির মত হুড়মুড় করে দৌড়াচ্ছে ওরা। উঠান ভর্তি জল। ইসকুলে যেতে হবে না। কাগজের নৌকা বানিয়ে উঠানে ভাসানো। বিকেলের দিকে বৃষ্টিটা একটু ধরে এলেই বন্ধুর বাড়িতে দৌড়। বই আনতে হবে। প্রবাল দ্বীপ, রবিনসন ক্রুসো, হাকলবেরী ফিন। বৃষ্টির পানিতে ভিজে সবকিছু আরও বেশি সবুজ হয়ে গেছে। মাঠের ঘাসগুলো একদিনেই ইঞ্চি খানেক লম্বা হয়ে গেছে। চোঁ-চোঁ শব্দ করে মাটি থেকে জল চুষে খাচ্ছে সবুজ ঘাসেরা। আমি কান পেতে শুনছি।
ডোবার ব্যাঙগুলো খামোখাই বেশ হৈ হল্লা করছে। থৈ থৈ জলে পদ্মপুকুর থেকে পথ ভুলে মাঠে চলে এসেছে বাচ্চা একটা মাগুর মাছ। ও বাড়ি ফিরে যেতে চায়। মা-বাবার কাছে। পথ ভুলে গেছে। ভাঙা ছাতা নিয়ে বসে আছে জুতা পালিশওয়ালা। ওর দিনটা মাটি। বাদলার দিনে কে জুতো পালিশ করাবে?
বিকেল না হতেই ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে আসে। বাদলার দিনে এটাই নিয়ম। ঘরে মা বসে আছে আমার জন্য। প্রিয় খাবার নিয়ে। বাড়িওয়ালী খুব খুশি। আজ দশ টাকা করে ইলিশ পাওয়া গেছে। সন্ধ্যা বেলা মা বলত ভয়াল সব ভূতের গল্প। মার স্টকে চমৎকার সব ভূতের গল্প আছে। সংখ্যায় প্রচুর।
গরমের দুপুরগুলো হত অন্য রকম। বাইরে নিলুয়া বাতাস। ঝিম ধরা দুপুর। দূরে কোথাও কোনও বাড়ির ছাদ পেটানো হচ্ছে। এক ফেরিওয়ালা অনেকক্ষণ ধরে হেঁকে যাচ্ছে, ‘পুরান বই খাতা, শিশি বোতল, লোহালক্কড় থাকলে বিক্রি করতে পারেন।’
কানা এক ফকির আসে মাঝে মধ্যে। গান গেয়ে ভিক্ষে করে। একটাই গান জানে বেচারা। বাইরে অলস দুপুর। হাতে আমার পেপার ব্যাকের বই, মন অচেনা দূর দেশে। অ্যাপাচি রেড ইন্ডিয়ানদের সাথে লড়াই করছে দুর্ধর্ষ কোনও বন্দুকবাজ। সমুদ্রের ধারে ছোট্ট একটা বন্দর। তাতে কাঠের এক সরাইখানা। ভেতরে বসে তাস খেলছে নিষ্ঠুর চেহারার কয়েকজন তিমি শিকারি। টেবিলের উপর ছুরি গাঁথা। রান্নাঘরে ঝলসানো হচ্ছে বিশাল কোনও সামুদ্রিক মাছ।
বিকেলে হাঁটতে যেতাম দূরের মাঠে। দীঘল ঘাস বাতাসের সাথে ফিসফিস করে গল্প করছে। দূরের ইস্টিশনের গুমটি ঘরটা লাল রঙের। বাইরে অচেনা এক গাছ। পাতাগুলো দেখতে তেজপাতার মত। টায়ার পুড়িয়ে ভাত রান্না করছে দুঃখিনী মা। দু’তিনটে ন্যাংটো বাচ্চা ধুলোর মধ্যে খেলাধুলা করছে। মাঝে মধ্যে দৌড়ে এসে দেখছে মার রান্না কতদূর হলো। মা আশ্বাস দিচ্ছে—আর বেশিক্ষণ লাগবে না। এই হয়ে গেল বলে।
ইস্টিশনের পাশেই এক জলাশয়। কালো জল। থৈ থৈ করছে। আমার মনে হয় এটাই বুঝি আটলান্টিক। দূরের শহরটাই নিউ ইয়র্ক। পথের দুই ধারে বন তুলসী আর ঢোল কলমির ঝোপ। কয়েক কেজি প্রজাপতি ছন্নছাড়াভাবে উড়ছে। ভুলে দুই একটা ঢুকে যেতে চাইছে জামার পকেটে।
সন্ধে বেলায় আবার খেলার মাঠ থেকে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরতাম। বাড়ি ফেরার পথে নিঝুম এক গলিতে এসে চমকে উঠতাম মাঝে মধ্যে। বিশাল এক ঝুপসি কড়ই গাছের নীচে জমে আছে এক গাদা মরা মানুষের খুলি। ভয়াল। মায়ের কাছে গল্প শুনেছিলাম, নীল কমল আর লাল কমল যখন তেপান্তরের মাঠে যায় তখন তারা দেখতে পায়, এরকমই বাড়ির পাহাড়, সোনার পাহাড় আর মরা মানুষের খুলির পাহাড়। কিন্তু এখানে এ রকম শহরতলির নিঝুম পথে এল কী করে এগুলো! ভয়ে ভয়ে সামনে গিয়ে দেখি অন্য কিছু। কিছু দূরে বসে তালের শাঁস বিক্রি করে কিশোর এক ছোকরা। দিনের শেষে শাঁসশূন্য তালের খোসাগুলো ফেলে দিয়ে যায় এখানে। শাঁসবিহীন শূন্য তালের খোসাগুলোই আমার কাছে মরা মানুষের খুলি বলে মনে হত। কল্পনাপ্রিয় মন আমার।
তারপর?
একদিন শৈশবের শেষ ইস্টিশনে সময়ের ট্ৰেনে চেপে চলে গেলাম দূর ভবিষ্যতে। মাঝে মাঝে পেছনে ফিরে তাকাই। দু’এক ঝলক দেখি এক ফালি শৈশব।
দিনগুলো ভালই ছিল। দুধের সরের মত কুয়াশা পড়ত তখন।
এক ফালি শৈশব
Loading books...