সীজার সালাদ

প্রায় শ’খানেক বিভিন্ন জাতের সালাদ বানাই আমি সপ্তাহে। কিন্তু লিখতে গিয়ে প্রথমে কেন সীজার সালাদের কথা টেনে আনলাম ?
কারণ শুধুমাত্র এই একটা সালাদ বানাতে পারলেই পৃথিবীর অনেক দেশের বড় বড় হোটেল বা রেস্টুরেন্টে ভাল কাজ পেয়ে যাবেন আপনি। এবং অতি সহজেই। অথচ এটা খুবই সহজ একটা রেসিপি। আর জনপ্রিয়তার কথা বলতে গেলে বলতে হয় হলিউডের নামকরা এক পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, ‘আমেরিকার খাবারের ইতিহাস সীজার সালাদ গত পঞ্চাশ বছরের রেসিপি ।’
আমি নিজে গত পনের বছরে কত টন সীজার সালাদ যে বানিয়েছি তা অনুমান করেও বলতে পারব না। বাতাসার মত বেচা হয়ে যায় জিনিসটা।
একবার আমার দোকানে সালাদ বানানোর লোক দরকার হওয়াতে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিলাম। নির্দিষ্ট দিনে দশজন ছেলে মেয়ে হাজির হলো ইন্টারভিউ দিতে। এরা সবাই মাত্র সিডনী শহরের নাম করা সব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রান্নাবান্নার উপর পাস করে বেরিয়েছে।
একজন একজন করে ইন্টারভিউ নিলাম। দুটো কমন প্রশ্ন সবাইকেই করলাম।
সীজার সালাদ বানাতে পারো ? কে সীজার সালাদ আবিষ্কার করেছিল ? প্রথম প্রশ্নের উত্তরে সবাই বলল- হ্যাঁ। দ্বিতীয়টার উত্তর জুলিয়াস সীজার। অর্থাৎ সবাই আন্দাজে ঢিল মেরেছে। অনেকটা সেই কৌতুকটার মত, শিক্ষক শ্রেণী কক্ষে সাধারণ জ্ঞানের পরীক্ষা নিচ্ছিলেন। একজনকে বললেন, ‘বলতো খোকা যে খেলাধুলা করে তাকে কী বলে?’
উত্তরে খোকা জবাব দিল, ‘উনি খেলোয়ার’।
শিক্ষক খুশি। দ্বিতীয় ছাত্রকে বললেন, ‘বল তো বালক যে সব কিছু জানে তাকে কী বলে?’
বালক জবাব দিল, ‘স্যার জানোয়ার’।
অর্থাৎ সহজ সূত্রে সমাধান করার চেষ্টা। সীজারের নামটা মনে হলেই ইতিহাস বিখ্যাত জুলিয়াস সীজারের নামটা প্রথমেই মনে পড়ে। আর সেই জন্যই সবার ধারনা জুলিয়াস সীজারই সীজার সালাদ আবিষ্কার করেছেন। ছোটবেলায় আমি যেমন ভাবতাম পানি পথের যুদ্ধ হয়েছিল স্থল পথের সমস্যার জন্য। বা রোমানরা যা কিছু করতো সবই রোমান্টিক।
সেই দশজন চাকরি প্রার্থীর মধ্যে আমি কাকে নিয়েছিলাম বা কাকে বাদ দিয়েছিলাম সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়। বিষয় হচ্ছে- সীজার সালাদ কে বানিয়েছিল আর কেন বানিয়েছিল ?
ভদ্রলোকের নাম সীজার কারডিনি। জন্ম ইটালিতে। ১৮৯৬ সালে। পেশায় নাম করা বাবুর্চি। নিজের দেশে অনেকগুলো বছর কাজ করার পর মাত্র ২৮ বছর বয়সে অর্থাৎ ১৯২৪ সালে মেক্সিকোতে নিজের একটা হোটেল খোলেন তিনি। নাম টিজুনা।
তো ভালই চলছে হোটেলটা। কয়েক মাস পর ১৯২৪ সালের জুলাই মাসের ৪ তারিখের ঘটনা। হঠাৎ করে এক দল সরকারি কর্মচারী এসে হাজির হয় সন্ধ্যার খাবার খেতে। মজার ব্যাপার হচ্ছে সেই দুপুরেই জিনিসপত্রের স্টক শেষ হয়ে গিয়েছিল হঠাৎ করেই। ভাঁড়ার ঘর প্রায় শূণ্য। খদ্দেররা সালাদ খেতে চাইছে। বিপদে মাথা গরম করলেন না সীজার সাহেব। হাতের কাছে মালমসলা যা ছিল তাই দিয়েই বানিয়ে ফেললেন বিরাট আকারের একটা সালাদ।
খদ্দেররা খুশি সেই সালাদ খেয়ে। ওরশের খিচুরির মত শেষ হয়ে গেল জিনিসটা কয়েক মূহুর্তের মধ্যে। পরদিন আরও কিছু খদ্দের এসে খেতে চাইল সেই নতুন সালাদটা। যেটা গত সন্ধ্যায় অনেকে খেয়ে গেছে। বলছে জিনিসটা দারুন। আর এটাই সীজার সালাদ জন্মের ইতিকথা। অন্তত সীজারের মেয়ে রোজ তার স্মৃতিকথাতে এই কাহিনী বলেছেন।
বাজারে গুজব সীজারের ছোট ভাই আলেক্স বানিয়েছে এই জনপ্রিয় সালাদটা। ছোট ভাই নিজেও দাবি করেছে এই কথা। তার সালাদের নাম ছিল- অভিটোস সালাদ। বড় ভাইয়ের সালাদের সাথে তার সালাদের পার্থক্য হচ্ছে সে সালাদের ড্রেসিং-এ এনকোভি (Anchovy) নামের পিচ্চি হেরিঙ জাতীয় একটা তৈলাক্ত মাছ ব্যবহার করত। এই মাছটা আটলান্টিক, প্রশান্ত আর ভারত মহাসাগরে প্রচুর ধরা পড়ে।
ভাল কাজের ভাগীদার সবাই হতে চায়। সীজারের দোকানের এক কর্মচারী লিভিও সানটিনির দাবি এই সালাদের রেসিপি তার মায়ের বানানো। লিভিও আঠারো বছর বয়সে সীজারের হোটেলে কাজে লাগে। সেই ১৯২৫ সালে এই সালাদটা মায়ের কাছ থেকে শিখে হোটেলে বানায়। আর সীজার এটা নিজের বলে চালিয়ে দিয়েছে।
আরও বেশ কয়েকজন লোক বুক ঠুকে দাবি জানাচ্ছে তারাই এই সালাদের আবিষ্কর্তা। ভাব দেখে মনে হচ্ছে আমিও দাবি করে বসব কী না। বেশ কয়েকজন নাম করা বাবুর্চি এ নিয়ে বেস্টসেলার কিছু বইও লিখে ফেলেছে । যার যার মত ব্যাখ্যা করেছে। বইগুলও দারুন রোমাঞ্চকর ।
সব কথার শেষ কথা সীজারের নামেই চলছে এ সালাদ। শেক্সপিয়ারের অনেক নাটক যেমন তিনি নিজে লেখেন নি কিন্তু তাঁর নামে চলছে এরকমই বোধহয়। কে জানে !
সীজার সালাদের মূল জিনিস হচ্ছে এর ড্রেসিং। বাকি সব ফক্কা। ড্রেসিং ভালো হলে সালাদটা ভালো হবে।
ড্রেসিঙের জন্য যা যা লাগবেঃ
এক টেবিল চামচ ওয়েস্টার শেয়ার সস, তিন টেবিল চামচ লেবুর রস, এক চিমটে লবন, দুই তিন কোয়া রসুন, আধা টেবিল চামচ গোলমরিচের গুঁড়ো, এক টেবিল চামচ ডিজন মাস্টার, ১-৩ কাপ জলপাইয়ের তেল, একটা আস্ত ডিম। কাঁচা।
সালাদের জন্য লাগবে দুইটা আস্ত রোমেইন (Romaine) লেটুস। বিপদে পড়লে অন্য লেটুস দিয়েও হবে। তত মজার হবে না। আর ১-৩ কাপ পারমিসান চিজ গুঁড়ো করে নিতে হবে।
প্রথম ধাপ: ড্রেসিঙের সবগুলো জিনিস মিক্সার মেশিনে দিয়ে মেশাতে হবে। তার আগে ফুটন্ত পানিতে ডিমটাকে ছেড়ে দিতে হবে মাত্র ৪৫ সেকেন্ডের জন্য। পানি একবারে টগবগ করে ফোটার সময় ডিমটাকে ছাড়তে হবে। আগে না। এবার ডিমটাকে উদ্ধার করে খোসা ছাড়িয়ে দিয়ে দিতে হবে মিক্সারে। অল্প কিছু চিজও দিন তাতে। ভালোভাবে মিক্স করুন। এটাই সেই ইতিহাস সৃষ্টিকারী সীজার ড্রেসিং।
দ্বিতীয় ধাপ: লেটুসগুলো পানিতে ভাল করে ধুয়ে নিতে হবে। এবার বেশ কিছুটা সময় নিয়ে পানি ঝরাতে হবে। আধ ইঞ্চি টুকরো করে কাটতে হবে এবার। বড় একটা বাটিতে করে টুকরোগুলো নিয়ে বাদ বাকি কুচানো চিজগুলো এবং অর্ধেক পরিমান ড্রেসিং নিয়ে মেশাতে হবে যত্নের সাথে।
তৃতীয় ধাপ: এই জিনিসটার নাম ক্রুটন(Crouton)। ভালো হয় এটা যদি আগে বানিয়ে রাখেন। আর কিছু না। এক স্লাইস পাউরুটি ৩-৪ ইঞ্চি কিউব করে কাটতে হবে। ২-৩ কোয়া রসুন থেঁতলে নিয়ে তিন টেবিল চামচ জলপাই তেল দিয়ে ফ্রাইং প্যানে ভেজে ফেলতে হবে রুটির টুকরোগুলো। এবার ঠান্ডা করুন।
পরিবেশনঃ
সালাদ তৈরি আপনার। এবার পরিবেশনের পালা। সীজার সালাদ শুধু নয়, যে কোনও সালাদই ঠান্ডা চিলড প্লেটে পরিবেশন করা ভালো। দ্বিতীয় ধাপে যে লেটুসের মিক্স বানিয়েছেন সেটা প্লেটে সুন্দর ভাবে সাজাতে হবে। উপর ছড়িয়ে দিতে হবে ক্রুটনগুলো। আবার অল্প একটু ড্রেসিং দিন। এবং একটু চিজের গুঁড়ো। তবে সুন্দর দেখায় বড় এক টুকরো চিজ নিয়ে আলুর খোসা ছাড়ানোর পিলার (Peeler)দিয়ে কয়েক ফালি চিজ কেটে উপরে সাজিয়ে দিলে,একে বলে শেভস চিজ। দাঁড়ি গোঁফ শেভ করার মত বলে বোধহয়। এটাই রেস্টুরেন্টের ভাষা।
সালাদ তৈরি। এবার ইচ্ছে মত বা মেনু অনুযায়ী সালাদের উপর দিতে পারেন সেদ্ধ ডিমের টুকরো,মাছ ভাজা, চিংড়ি মাছ সেদ্ধ বা ভাজা, গ্রিল করা মুরগির ফালি। বেশ কিছু হোটেলে বেকন ভাজা দেয়। হার্ডরক ক্যাফেতে কালো জলপাইও দেয়। কেউ আপত্তি করবে না। যাই দিন না কেন। এবার আপনি আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন হোটেলে চাকরি পাবার জন্য।
ধরে নিন হয়ে গেছে।