একটি গোলাপের জন্য

“যদি আমি লাল গোলাপ এনে দিতে পারি তাহলে মেয়েটি আমার সাথে নাচবে”, তরুণ ছাত্রটি মনে-মনে বলতে থাকে, “কিন্তু সারা বাগানে আমার একটিও গোলাপ নেই।»
হোম-ওক গাছের ওপরে বুলবুলের বাসা; সে তার ঘর থেকে ছেলেটির কথ্য শুনতে পেল । লতাপাতার ফাক দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে সে অবাক হয়ে গেল। সে দেখল___ছেলেটি বলছে, “সারা বাগানে আমার একটিও গোলাপ নেই”, আর পানিতে ভরে যাচ্ছে তার সুন্দর চোখ। ছেলেটি বলছে, “হায়রে, কী অল্প (জিনিসের উপরই না আদাদের শাস্তি নির্ভর করে? জ্ঞানী-গুণীরা যা-কিছু লিখেছেন সবই আগি পড়েছি, দর্শনশাস্ত্রের সব গৃঢু তত্ব আমার জানা; তবু একটি মাত্র গোলাপের জন্যে আমার জীবন দুর্বিষহ হয়ে গেছে।’
বুলবুল সমস্ত কথ শুনতে পেল, তারপর নিজের মনেই বলে উঠল, “এতদিনে আজ আমি একজন খাটি প্রেমিকের সাক্ষাৎ পেলাষ। যদিও তখন একে আমি চিনতাম না, রাতের পর রাত আমি গান গেয়ে-গেয়ে এর কথাই তো বলেছি; রাতের পর রাত তারাদের কানে-কানে এর গল্পই তে। আমি করেছি ;_-আর এতাঁদন পরে আজকে এর দ্বেখা পেলাম। হায়াপিম্থের ফুলের মতো তার চুল, আর ঠোট তার বাসনার গোলাপের মতোই রক্তিম; কিন্তু আবেগে- উত্তেজনায় সারা মুখ তার ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, দুঃখ ওর কপালে বাসা বেধেছে।”
তরুণ ছাত্রাট তখনো বিলাপ করছে, “রাজকুমারী আগামীকাল রাত্রে বল্নাচের অনুষ্ঠান করবে, আমি যে_মেয়েকে ভালোবাসি সেও নাচের আসরে আসবে। একটি গোলাপ তাকে দিলেই সকাল অবধি সে আমার সাথে নাচবে বলেছে। যদি একটি গোলাপ দিতে পারি তাকে, তার হাতে হাত রেখে আমি নাচতে পারব, তার মাথা আমার কাধে এলিয়ে পড়বে, হাত তার আমার হাত আকড়ে ধরে থাকবে । কিন্তু হায় ! আমার বাগানে যে একটিও গোলাপ নেই; তাই একা বসে থাকতে হবে আমাকে আর সে আগার পাশ দিয়ে যাওয়া-আসা করবে। আমাকে তখন সে চোখেই দেখবে না; আমার বুক ভেঙে যাবে তাহলে ।
“সত্যিই, এই হল আসল প্রেমিক, বুলবুল মনে-মনে বলল । “এখন আমি যা-ই গাইব ও কষ্ট পাঝে আমার কাছে যা আনন্দ, ওর কাছে তা-ই যন্ত্রণা। ভালোবাসা সত্যিই এক অত্যান্চর্য বন্তু। ভালোবাসা পান্নার চেয়েও মুল্যবান, উপল মণির চেয়েও প্রিয়তর। মণিমুক্রো দুর্লভ বস্ত। কোনোকিছু দিয়ে তাকে কেনা সম্ভব নয়, বাজারের মধ্যে একে বিক্রিও করা যাবে না। কোনো সওদাগরের কাছ থেকে তাকে কিনতে পাওয়া যাবে না, আর সোনা দিয়েও তো ভালোবাসাকে ওজন করা খায় না৷” তারযন্ত্র বাজাবে, আর সে বীণার শব্দে, বেহালার সুরে-সুরে নাচবে। মেঝেতে তার পা পড়বে না এমন হালকাভাবে সে নাচতে থাকবে, ঝকঝকে পোশাক-পরা রাজকর্মচারী সভাসদবর্গ সকলে তার চারপাশে এসে ভিড় জমাবে। কিন্তু হায়! আমার সঙ্গে সে তো৷ নাচবে না, আমি- যে তাকে একটিও লাল গোলাপ দিতে পারি নি।’ ছেলেটি ৰাগানের ঘাসের উপর আছাড় খেয়ে পড়ল, দু-হাতে মুখ ঢেকে কাদতে লাগল।
সেখান দিয়ে একট! সবুজ গিরগিটি যাচ্ছিল, হাওয়ায় সে তার লেজ লাড়ছে। সে জিজ্ঞেস করল, “আরে ও কাদছে কেন?”
‘তাই তো। কেন” জিজ্ঞেস করে উঠল প্রজাপতি। সূর্যের আলোয় সে নেচে বেড়াচ্ছিল।
“তাই তো। কেন?” পাশের বাড়ির ডেইজি ফুল হাল্কা নরম সুরে জিজ্ঞেস করে উঠল।
বুলবুল বলল, “ও কাদছে একটি লাল গোলাপের জন্যে।’
‘একটা লাল গোলাপের জন্যে” তারা সবাই একসঙ্গে অবাক হয়ে চেঁচিয়ে উঠল, “কী মজার কথা!” আর ছোট্ট গিরগিটি-_তার বেজায় নাক উচু সে তো হো-হো করে হেসেই উঠল।
বুলবুল কিন্তু ছাত্রটির মনের দুঃখ ঠিক বুঝেছিল। সে চুপচাপ তার ওকগাছের বাসায় বসে রইল আর ভালোবাসার রহস্যের কথা ভাবতে লাগল।
তারপর কী’ ভেবে হঠাৎ বুলবুল তার খয়েরি ডানা মেলে ধরল বাতাসে, বাতাস কেটে- কেটে উড়ে চলল। লতাপাতা-ঘেরা কুপ্রের উপর দিয়ে ছায়ার মতো ভেসে গেল সে, ছায়ার মতোই বাগানের একপ্রাস্ত থেকে অনাপ্রাস্তে ভেসে গেল!
বাগানের শেষে ওদিকটাতে সবুজ ঘাসে-ভরা এক-ফালি জমি। তার মাঝখানে মাথা উচু করে দাড়িয়ে আছে সুন্দর একটি গোলাপগাছ। বুলবুল তাকে দেখতে পাওয়া মাত্র সেখানে উড়ে গেল এবং তার সুন্দর ডালে গিয়ে বসল।
বলল, “আমাকে একটা গোলাপ দাও-না, আমি তাহলে আমার সবচেয়ে যে ভালো! গান সেটি তোমাকে শোনাব ”
গাছটি কিন্তু মাথা নাড়ল।
“আমার গোলাপ তো শাদা রঙের” উত্তর দিল সে, “সমুদ্রের ফেনার চেয়েও শাদা, পাহাড়ছুড়োর বরফের চেয়েও শাদা। বরং তুমি আমার ভাইয়ের কাছে যাও। সূর্য-ঘড়ির পাশে সে থাকে। হয়তো তুমি যা চাও, সে তা দিতে পারবে।
বুলবুল আবার উড়ল। উড়ে গেল সূর্য-ঘড়ির ওখানে, যার চারপাশে অনেক গোলাপগাছ।
বলল, “আমাকে একটা গোলাপ দাও-না, আমি তাহলে আমার সবচেয়ে যে ভালো গান সেটি তোমাকে শোনা?
গাছটি কিন্তু মাথা নাড়ল।
“আমার গোলাপ যে হলদে রঙের”, সে উত্তর দ্যায়, “সমুদ্রের মধ্যে স্ফটিকের আসনে যে- মৎস্যকন্যা* বসে থাকে, তার চুলের চেয়েও বেশি হলুদ আমার গোলাপ, সামনের মাঠে যে ড্যাফোডিল ফোটে, তার রঙও এত হলুদ নয়। তৃমি বরং আমার ভাইয়ের কাছে যাও। সে এ ছাত্রটির জানালার নিচে থাকে। তুমি যা চাও তা হয়তো সে দিতে পারবে ।”
বুলবুল আবার উড়ে চলল সেই গোলাপের কাছে, ছাত্রটির জানালার নিচে যার ঘর। এখানেও সেই একই প্রার্থনা জানাল সে। বলল, “আমাকে তোমার একটি গোলাপ দাও, আমি তাহলে আমার সবচেয়ে ভালো গান তোমাকে শোনাব।’
কিন্তু মাথা নাড়ে গোল!পগাছ।
“আমার ফুল লাল”, বলল সে, ‘ঠিক পায়রার পায়ের মতো লাল। সাগরের নিচে যে প্রবালের পাখা সাগরের গুহায় তরঙ্গ তোলে, তার চেয়েও বেশি লাল। কিন্তু শীতে আমার সমস্ত শিরা-উপশিরা জমে গেছে, তৃষার আমার সমস্ত কুঁড়িগুলো মেরে ফেলেছে, ঝড় এসে সব ডালপালা ভেঙে দিয়েছে; এ-বছর আমার ডালে একটিও গোলাপ ফোটেনি।”
“কেবল একটিমাত্র গোলাপ আমার দরকার’, বুলবুল অনুনয় করতে থাকে,”শুধু একটি মাত্র গোলাপ ! কোনও উপায় কি নেই যাতে আমি পেতে পারি”
উপায় অবশ্য আছে”, গোলাপগাছ বলল, “কিন্ত তা এত ভীষণ-যে তোমাকে বলতে আমার সাহস হচ্ছে না।’
‘না, তুমি বলো। আমি ভয় পাব নাঃ, উত্তর দিল বুলবুল।
গাছটি তখন বলতে লাগল, “তুমি যদি একটি লাল টকটকে গোলাপ চাও, তাহলে জোছনা-রাতে গান গেয়ে তাকে ফোটাতে হবে আর তোমার বুকের লালরক্তে সেই গোলাপে রঙ ধরবে। তুমি আমার গাছের কাটার উপরে বুক পেতে রেখে আমাকে গান শোনাবে। সারারাত ধরে তুমি গান গাইবে আর আমার কাটা তোমার বুকের মধ্যে একটু- একটু করে হবে এবং তা আমার রক্ত হয়ে যাবে।’
“একটি গোলাপের জন্য মৃত্যু অবশ্য বড্ড বেশি দাম”, বুলবুল জবাব দিল, “আর জীবন তো সকলের কাছেই বড় প্রিয়। সবুজ গাছগাছালির উপর বসে থাকতে কী আরাম! সূর্য তার সোনার রথ চালাবে, আর চাদ তার মুক্তোর রথ_কী আনন্দ এ সব দেখতে। হর্ন ফুলের গন্ধ, পাহাড়ি উপত্যকায় ঘাসের ফাকে-ফাকে লুকিয়ে-থাকা ব্লু বেল,,আর পাহাড়ের উপরে খুশি ঝল্মল্‌ হিদারের গন্ধ কী মিষ্টি! কিন্তু তবু, ভালোবাসা তো জীবনের চেয়ে বড়, আর একজন মানুষের হৃদয়ের সঙ্গে কি একটা পাখির হৃদয়ের কোনো তুলনা চলে !”
তাই আবার সে তার খয়েরি ডানা বাতাসে মেলে ধরল, বাতাস কেটে-কেটে উপরে উঠতে লাগল। সারা বাগানের উপর দিয়ে ছায়ার মতো সে ছুটে গেল, কুঞ্জের ভিতর দিয়ে ছায়ার মতো সাতার কেটে গেল।
বুলবুল যেখানে দেখে গিয়েছিল, তরুণ ছাত্রটি তখনো সেখানে ঘাসে শুয়ে ছিল। তার

সুন্দর চোখ থেকে তখনো পানির দাগ শুকিয়ে যায় নি।
বুলবুল তাকে বলল, “সুবী হও, তুমি সুখী হও | লাল গোলাপ তুমি পাবে । আমি জোছনা- রাতে গান গেয়ে আমর বুকের রক্তে সেই গোলাপ ফোটাব। এর বদলে তোমার কাছ. থেকে আমি কেবল এ-ই চাই যে, তুমি যথার্থ প্রেমিক হবে, কেননা দর্শনের চেয়ে ভালোবাসা বেশি জ্ঞানী, আর দক্ষতার চেয়েও ভালোবাস অনেক বেশি শক্তিশালী। ভালোবাসার সারাশরীর যেন আগুনের রঙ, তার দুটি ডানাও আগ্নিবর্ণ, তার ঠোট মধুর মতো মিষ্টি আর তার নিশ্বাস তো! ধূপের সুরভি ।’
ছাত্রটি ঘাসের উপর থেকে “বাথ তুলে উপরের দিকে তাকাল এবং চুপ করে শুনল, কিন্তু সে বুঝতেই পারল না বুলবুল কী বলছে। কেননা, ছেলেটি তার বইপত্রে যা লেখা আছে তার বাইরে আর কিছুই বুঝত না।
কিন্ত ওকগাছ সব বুঝল, তার মন খারাপ হয়ে গেল। বুলবুলকে খুব ভালোবাসত সে ! বুলবুল তার ডালে বাসা বেধে ছিল বলে।
সে ফিসফিস করে বলল, “ভাই, আমাকে তোমার শেষ গানটি শোনাও। তুমি চলে গেলে আমার বড় একা একা লাগবে ।
বুলবুল ওকগাছকে গান শোনাতে লাগল। তার গলা যেন রুপোলি পাত্রে জলবুদ্দুদের শব্দের মতো।
গান যখন শেষ হয়েছে তখন ছাত্রটি উঠে দাড়াল, পকেট থেকে একটা নোটৰই আর পেন্সিল বের করল।
“মেয়েটির গড়ন বড় সুন্দর–এটা না-মেনে উপায় নেই, কিন্ব কোনো অনুভূতি কি তার আছে? নিজের মনে বলতে লাগল ছাত্রটি, “আমি কিছু পরোযা। করি না। আসলে মেঘেটি শিল্পীদের মতো : তার কেবল ভঙ্গিই আছে, এঁকান্তিকতা নেই। সে অপরের জন্যে কখনো নিজেকে উৎসর্গ করবে না। সে কেবল গান-বাজনা সম্পর্কেই ভাবে, আর কে না জানে_ সমস্ত শিল্পই বড় স্বার্থপর । তবু, একথা মানতেই হবে যে মেয়েটির গলায় খুব সুদ্রর সুরের কাজ আছে। কিন্তু হায়রে, তার এ-সব গুণের তো কোনো মানেই হয় না, কোনো লোকের এতটুকু উপকারও তা দিয়ে কখনো হবে না” তারপর ছেলেটি তার ঘরে ফিরল, মাদুর পাতা বিছানার উপর শুয়ে-শুয়ে তার ভালোবাসার কথা ভাবতে লাগল । আরো কিছুক্ষণ পরে ঘুমিয়ে পড়ল সে।
সেদিন রাত্রে সারা আকাশ টাদের আলোয় ভরে গেছে। স্সিচ্ধ উজ্জবলতায় টাদ আকাশের মাঝখানে দাড়িয়ে। বুলবুল ঘর থেকে বেরিয়ে ছুটে গেল গোলাপগাছের কাছে, একটা কাটার উপরে বুক পেতে রেখে সে বসে রইল তার ভালে । কাটায় বুক রেখে সারারাত ধরে সে গান গাইল, স্ঘটিকের ন্যায় স্বচ্ছ চাদ সে-গান শুনতে ঝুঁকে পড়ল মাটির দিকে, চাদ গান শুনতে লাগল। সারারাত গান গাইল বুলবুল, আর গোলাপের কী্ঠা একটু-একটু করে তার বুকের ভিতরে বিধে ঘেতে লাগল। তার দেহের সমস্ত রক্ত গোলাগগাছের দেহে চলে যাচ্ছিল।
প্রথমে সে গাইল একটি বালক ও একটি বালিকার হৃদয়ের ভালোবাসার কথা। আর তখনই গোলাপগাছের সবচেয়ে উচু ডালে একটি অপূর্ব গোলাপ ধীরে ধীরে দেখা দিতে লাগল। গানের পর গান বূলবুল গেয়ে যাচ্ছে আর একটির পর একটি পাপড়ি চোখ মেলছে। প্রথমে তার রঙ বড় ফ্যাকাশে, নদীর উপরে কুয়াশা যেমন কুলে থাকে তেমনি তার রঙ, সকালবেলার পায়ের মতো বিবর্ণ, ভোরবেলাকার ডানার মতো রুপোলি। রুপোর আয়নায় গোলাপের যেমন সবচেয়ে উপরের ডালটিতে ফুটে উঠতে লাগল।
কিন্তু গাছটি বুলবুলকে আরো জোরে কাটার উপর তার বুক চেপে ধরতে বলল । “ছোট্ট বুলবুলি, আরো জোরে চেপে ধরো’, গোলাপগাছ তাকে বলে উঠল, “না হলে গোলাপে রঙ ধরবার আগেই-যে সকাল হয়ে যাবে 1”
বুলবুল কাটার উপরে তার বুক আরো জোরে চেপে ধরল, তীক্ষি হয়ে উঠল তার কণ্ঠস্বর। সে তখন একটি ছেলে আর একটি মেয়ের হৃদয়ে প্রেমের জন্মের গান গাইছিল।
আর তখনই গোলাপের পাপড়িতে হালকা লালচে আভার ছ্োয়াচ লাগল, ঠিক যেন লজ্জারাঙা নববধূর মুখ। গোলাপের কীটা কিন্তু তখনো বুলবুলের কল্জেতে গিয়ে ঠেকে নি, তাই গোলাপের বুক তখনো সাদা হয়ে আছে। বুলবুলের বুকের রক্তই একমাত্র গোলাপের বুক রাঙাতে পারে।
গোলাপগাছ আবার আরো জোরে কাটার উপর তার বুক চেপে ধরতে বলল। বুলবুলকে বলল সে, “ছোট্ট বুলবুলি, আরো জোরে চেপে ধরো, না হলে গোলাপে রঙ ধরবার আগেই সকাল হয়ে যাবে যো? হাৎপিণ্ডে গিয়ে ঠেকল। একটা ভয়ানক যন্ত্রণা সারাশরীরে ছড়িয়ে গেল তার। যন্ত্রণা ক্রমশ একটু একটু করে বাড়তে থাকে আর তা তীক্ষু থেকে তীক্ষুতর হয়। সে তখন ভালোবাসার গান গাইছিল যে-ভালোবাসা মৃত্যুতে পূর্ণতা পায়, মৃত্যুর পরেও যে-ভালোবাসা মরে না।
অপরূপ গোলাপ তখন লাল টুকটুকে হয়ে উঠেছে, সূর্যোদয়ের আকাশের যতো রাঙা তার রঙ। তার সমস্ত পাপড়ি লাল হয়ে গেছে, আর তার হৃদয় চুনির মতো রাঙা।
কিন্তু বুলবুলের কণ্ঠ ক্রমশই ক্ষীণ হতে লাগল, তার ছোট-ছোট দুটি ডানা কয়েকবার ঝাপটাল সে, চোখের উপর তার পরদার যতো কী যেন নেমে এল। তার গান মৃদুতর হয়ে আসছে, গলা যেন কে টিপে ধরেছে তার।
তখন শেষবারের মতো সে আরেকবার সুর তুলল। রুপোলি সাদা টাদ সে গান শুনে ভোরের কথা ভুলে গেল, আকাশের বুকে থমকে দাড়াল। লাল গোলাপ এই গান শুনল। তার সারাদেহ শিহরিত হল আনন্দে, সকালের ঠাণ্ডা বাতাসে সে তার পাপড়ি মেলে ধরল। তার গানের প্রতিধ্বনি পাহাড়ের গুহায় ছড়িয়ে পড়ল কেঁপে-কেঁপে, রাখালছেলেদের ঘুম ভেঙে গেল। নদীর বুকে কাপন তুলে ভেসে-ভেসে তার স্বর চলে গেল সাগরের দিকে।
গোলাপগাছ বলে উঠল, ‘দ্যাখো, দ্যাখো, ফুল ফোটা শেষ হয়েছে। কিন্তু বুলবুল কোনো জবাব দিল না সে-কথার। ঘাসের উপরে সে তখন মৃত পড়ে আছে, তার বুকের মধ্যে কাটা বেধা।
বেলা হলে ছাত্রটি ঘুম থেকে উঠল। জানালা খুলে তাকাল বাইরের দিকে। তারপরেই আনন্দে চেচিয়ে উঠল সে, ‘ইস্‌, আমার কী ভাগ্য ! একটা গোলাপ ফুটেছে। আমি সারা- জীবন এমন একটিও গোলাপ দেখি নি। কী সুন্দর ফুল; আমার নিশ্চিত ধারণা__এর একটা বিরাট লাতিন নাম আছে। সে হাত বাড়িয়ে জানালার বাইরে থেকে ফুলটি তুলে নিল। তারপর মাথায় টুপি চাপিয়ে হাতে গোলাপফচুল নিয়ে একদৌড়ে তার অধ্যাপকের বাড়ি গৌছুল।

অধ্যাপকের মেয়ে তখন দরজার কাছে বসে একটা গুলিতে নীল্রঙের রেশমি সুতো গোটাচ্ছে আর তার পায়ের কাছে শুয়ে আছে ছোট্ট একটি কৃকুর।
ছেলেটি তাকে দেখেই বলে উঠল, “তুমি বলেছিলে একটি গোলাপ দিলে আমার সঙ্গে নাচবে। এই দ্যাখো, পৃথিবীর সেরা গোলাপ তোমার জন্যে নিয়ে এসেছি। আজ রাত্রে খুকের ওপরে তুমি এটা পরে ঘখন আমার সাথে নাচবে তখন বুঝতে পারবে আমি কী রকম তোমাকে ভালোবাসি।’
মেয়েটির কব কিন্তু কঁচকে উঠল।
সে উত্তর দিল, “কিন্ত আমার ভয় হচ্ছে, আমার পোশাকের সঙ্গে এটা খাপ খাবে না। আর তা ছাড়া, চেম্বার্লেনেরঃ ভাইপো আমাকে কয়েকটা খাটি মণিমুক্তো পাঠিয়েছে। ফুলের চেয়ে মণিমুক্তোর দাম যে কত বেশি সবাই ত্য জানে!
“তুমি একটা আন্ত বেঈমান”, ছাত্রটি তখন রেগে টেঁটিয়ে ওঠে। গোলাপফুলটি রাস্তার উপরে ছুড়ে ফেলে দিল সে, আর তারপরেই একটা গাড়ির চাকা তার উপর দিয়ে চলে গেল।
মেয়েটি বলে উঠল, ‘তুমি একটা অকৃতজ্ঞ। বড় অভ্র তূমি। আর তমি এমন কে এসে গেছ, শুনি? মোটে তো একজন ছাত্তর! আমার তো মনে হয়-_চেম্বার্লেনের ভাইপোর জুতোয় রুপোর যে-আংটা আছে, তাও তোমার নেই।’ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়াল মেয়েটি, তারপর ঘরের ভিতরে চলে গেল।
ছাত্রটি ফিরে এল এরপর। “ভালোবাসা ব্যাপারটা কী বোকামি! পথ চলতে-চলতে বলতে লাগল সে, ‘যুক্তিবিদ্যার অর্ধেক উপকারও এ করতে পারে না, কেননা কিছুই প্রমাণ করা যায় না এ দিয়ে; তা ছাড়া যে-সব ব্যাপার কখনো ঘটবে না ভালোবাসা কেবল সেইসব কথ। বলে, যা তোমার বিম্বাস করার কথা নয় ভালোবাসা তাই তোমাকে বিশ্বাস করাবে। আসলে, ভালোবাসা বিন্দুমাত্র কোনো কাজে লাগে না, আর আজকাল যে-কোনো জিনিসের উপযোগিতাই হল সব। দর্শনশাস্ত্র আর অধিবিদ্যাই বর এখন থেকে চর্চা করব?
অতঃপর ছাত্রটি তার নিজের ঘরে ফিরে এল। ঘরে ফিরে সে একটা ধুলোভার্তি বিরাট বই টেনে বের করে পড়তে শুরু করে দিল।