কুচ্ছিৎ প্যাঁকারু

অনুবাদঃ বুদ্ধদেব বসু

সারা দেশ কী অপরূপ মনে হচ্ছে! গরমের সময় গমের ক্ষেত হলুদবর্ণ হয়ে আছে, মানারাত তারার রোজা রানে লম্বা লম্বা ঠ্যাং নিয়ে ঠুক্ঠুক্‌ করে হেঁটে বেড়াচ্ছে আর কথা বলছে মিশরি ভাষায়-_মাদ্র কাছ থেকে তারা এ-ভাষাই রপ্ত করেছে কিনা তাই। সামনের মাঠ আর ক্ষেতের একদিক দিয়ে সবুজ বনানীর সারি চলে গেছে দিগন্ত ছুঁয়ে এ বনের মধ্যে এক গভীর স্থচ্ছ সরোবর ! সত্যিই, চারদিকে কী অপরূপ শোভা ! অনেক পুরনো একটা বাড়ি, সূর্যালোকে বড়ো চমৎকার দেখাচ্ছে, বাড়িটার চারদিক ঘিরে খাল চলে গেছে। প্রাচীর থেকে খালের কিনারা পর্যন্ত এক ধরনের বুনো লতাপাতার গাছ, বার্ডক লতা ভর্তি হয়ে আছে; ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এ লতা’পাতার জঙ্গলে খেলা করে, দোলনা বানিয়ে দোলে, তার মধ্যে লুকোচুরি খেলে অনায়াসে। এই জায়গাটা এমন বুনো আর চুপচাপ যে একে এ দিগন্তছোয়া বনভূমির গভীরে কোনো স্থান বলে ভ্রম হয়। আর ঠিক সেজন্যই একটা পাতিহাস ওখানটায় তার বাসস্থানের উপযুক্ত ভেবে বাসা তৈরি করেছে। হাসটি তার ডিমের উপরে বসে ছিল। বেশ কিছুদিন ধরে সে এখানে আছে, ফলে আজকাল তার আর মোটেই ভালো লাগছে না এখানে থাকতে। কেননা, বন্ধুবান্ধব পাড়াপড়শিরা কেউই প্রায় আজকাল দেখাসাক্ষাৎ করতে আসে না-_এই খালের এরকম পিছল নির্জন স্থানে এসে তার সাথে ফিসফাস গুজগাজ করার চেয়ে বরং খালের পানিতে সাতরানো অনেক বেশি আনন্দকর বলে তারা মনে করে।
কিন্ত কী আর করা যাবে? হাস বেচারা দিনের পর দিন ডিমে তা দেওয়ার জন্যে বসে রইল। অবশেষে সেই সময় এসে গেল যখন ফাটল ধরল ডিমে তার, একটা-একটা করে নতুন মুখ ডিমের ভিতর থেকে উকি দিতে লাগল। “প্যাক প্যাক্‌__প্যাক প্যাক’ : তাদের গলা থেকে মিহি মিষ্টি আওয়াজ বেরুচ্ছে, সাধ্যমতো চলতে ফিরতে চেষ্টা করছে সবাই, সবুজ লতাপাতার ফাক দিয়ে কেউ কেউ বাইরে উকিব্ুকিও মারতে লাগল।
“ঈশ্‌, দুনিয়াটা কত্তো বড়ো!” ছোট্ট একটি বাচ্চা হাস অবাক হয়ে বলে উঠল।
“ওমা, বলে কী দেখ! দুনিয়াটা বুঝি এটুকুই ভেবেছিস?” পাতিহাসগুলোর মা উত্তর দেয়, “এই পৃথিবীটা অনেক অ-নে-ক বড়ো। এই বাগানের ওদিকে যে-মাঠ, তা ছাড়িয়েও অনেক দূর–। অবশ্য আমি কখনো অদ্দূুর যাইনি।* তারপরেই হেকে উঠল, “বলি, বাছারা, তোরা সব ঠিকঠাক আছিস তো? এদিক-ওদিক আবার চলে যাস ন! যেন।” একথা বলে উঠে দীড়াল সে। “নাঃ, আমি তো এখনো আমার সব কণ্টিকে পাইনি। সবচেয়ে বড়ো ডিমটা আমার এখনো বাকি। কবে যে ফুটবে আল্লাই মালুম! আর ছাই ভালো লাগছে না, বিরক্ত ধরে গেল” আবার সে বসে পড়ে সেখানে ।
এক বুড়ি হাস বেড়াতে এসেছে। বান্ধবীকে একটু দেখে যাবে আর কী। সে জিজ্ঞেস করল, “কি দিদি, কেমন আছিস লো?”
“আর বলো না বাপু, এই একটা ডিম নিয়ে বড়ো মুশকিলে পড়েছি। না এটা ভাঙে, না আমি একটু ঘুরেফিরে বেড়াতে পারি। কিন্তু তুমি আমার বাচ্চাগুলোকে দেখেছ তো দিদি? ৯৭,০১০ -১৬১। দেখিনি।”
“শোন, শোন, কী বলছিস তুই? তাহলে নির্ঘাৎ এটা একটা টার্কির ডিম। আমিও একবার ঠিক এমনিভাবেই ; বাচ্চাদের নিয়ে তোর মতোই সেবার যন্ত্রণার একশেষ হয়েছিল। তাছাড়া এই টাকিগুলো পানি দেখলেই এত ভয় পায় যে পানির ধারেকাছে খেষবে না। আমি কতো ডেকেছি, মারব-ধরব করেছি, কিন্তু যে কে সে-ই, কোনো কাজ হয়নি। আচ্ছা দেখি, ডিমটা দেখা তো। হু, ছু, ঠিক যা ভেবেছি___, টার্কিরই ডিম। বাদ দে এইসব; তুই বরং এই বাচ্চাগুলোকেই সাতার শেখা গে।”
“না গো, আর কয়েকটা দিন দেখি না, দিদি,” হাস জবাব দেয়, এদ্দিনই যখন তা দিলাম, আর দু-এক দিনে কীই-বা ক্ষতি হবে?”
“জানি না, বাপু। এটা তোমার ব্যাপার, তুমি বোঝো গে-_” বুড়ি হাস উত্তর দিল, তারপর হেলেদুলে থুপথুপ করে চলে গেল নিজের কাজে।
বড়ো ডিমটা, যাক, শেষকালে ভাঙল] পি পি-_আওয়াজ বেরুল ডিমটার ভিতর থেকে, আর সে-_ছোট্ট পোনা হাস-_হুড়মুড় করে ডিম ভেঙে বেরিয়ে এল বাইরে। এহ্‌-হে, কী কদাকার ! কী বিরাট দেখতে ! মা তার এই শিশুটির দিকে তাকিয়ে রইল। “দেখতে বেশ বড়োসড়ো, আর শক্তসমর্থ মনে হচ্ছে,” মনে মনে বলতে থাকে সে, “আমার কোনো বাচ্চাই তো এরকম নয়। তাহলে কি সত্যিই এটা একটা টার্কির ছানা? ঠিক আছে, শিগ্গিরই বুঝতে পারব। পানিতে তো নামতেই হবে সকলকে, বাছাকে আমার ঠেলেঠুলে নিয়ে যাবই; তারপর দেখব কী হয়।”
পরদিন আবহাওয়া বড়ো সুন্দর ছিল। সবুজ লতাপাতায় সোনালি সূর্য ঝিকমিক করছে। হাসটি তার সব বাচ্চাকে নিয়ে খালের ধারে গেল। ঝপাৎ! ঝাপ দিয়ে পড়ল সে পানিতে। “প্যাক-গ্যাক, গ্যাক-গ্যাক-_” সে ডাকতে থাকে তার বাচ্চাগুলোকে, আর একটার পর একটা পোনা হাস ঝাপ দিয়ে পড়তে লাগল পানির বুকে। ঝাপিয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে পানিতে ডুবে গেল, কিন্তু পরক্ষণেই পানির ভিতর থেকে মাথা তুলে ধরল আর কী সহজভাবেই-না স্সাতার কাটতে লাগল। সব কটি পোনা হাসই সেখানে রয়েছে, এমনকি কুচ্ছিৎ মেটে রংয়ের পোনাটিও অন্যগুলোর সঙ্গে কী আনন্দে সাতার কাটছে।
“নাহ, তাহলে এ তো টার্কি নয়।” তাদের মা হাফ ছেড়ে বাচল; “দেখ, দেখ, কী সুন্দর পা ফেলাচ্ছে, মাথাটি কেমন উচু করে ধরে রেখেছে পানির ওপরে । আমারই বাচ্চা তো, হবে না কেন! আর ভালো করে তাকিয়ে দেখলে মোটামুটি সুন্দরই তো দেখতে। দেখাই গে তোদের। দেখিস, আমার কাছেপিঠে থাকিস সবসময়, বেতালে যেন কেউ মাড়িয়ে না দ্যায় আর খবরদার বিড়াল থেকে কিন্তু সাবধান।” তারা হাটতে হাটতে খামারবাড়ির হাসপট্রিতে এল। দুটো পাতিহাস পরিবার একটা বাইন মাছের মাথা নিয়ে ঝগড়া করছে। মাছটার আবার লেজ নেই, সেটা একটা বিড়াল নিয়ে পালিয়েছে। “দেখেছিস? দুনিয়ার হালচাল দেখতে পাচ্ছিস কী রকম?” মা হাসটি হাসপরিবার দুটোর ঝগড়া দেখে বলে উঠল বাচ্চাগুলোকে। তারপর ঠোটটা পরিষ্কার করল ভালোভাবে; ঝলসানো বাইন মাছ তারও খুব প্রিয়। “বাছারা, তোরা শোন”-__মা ফের হাক দিয়ে ওঠে, “এখন পায়ের ব্যবহার শিখে নে দেখি। পা দুটো লাগিয়ে জোড় পায়ে দাড়াও হ্যা, ঠিক আছে,_এইবার মাথা নুইয়ে সালাম করো বুড়ি দিদিমাকে। এই এলাকায় ইনিই সবচেয়ে অভিজাত, হিস্পনি রক্ত যে তার শরীরে বইছে তা চেহারা চাল-চলন আর ব্যবহার দেখলেই সকলে বোঝে। আর ভালো মতো নজর দিয়ে দেখে নে তোরা-_এর পায়ে একটা লাল ফেটি বাধা, এটা তার বিশেষ খান্দানির পরিচয় দ্যায়, একটা পাতিহাসের জন্যে এর চেয়ে সম্মানের আর কিছু নেই”
অন্যান্য হাস যারা খামারে চরে বেড়াচ্ছিল তারা এবার তাকিয়ে দেখল এদের, চেচাতে লাগল, “আরে দেখ, দেখ, নতুন একদল পোনা হাস এসেছে।” তারপর ওর দিকে চোখ পড়তেই চেচিয়ে উঠল, “ঈশ্‌, কী জঘন্য ! এই পোনাটা কী বিচ্ছিরি রে দেখতে ! আমরা একে দলে নেব না।” আর এ-কথা শেষ হবার সাথে সাথে একজন উড়ে গেল ওর দিকে, গিয়েই ঘাড় কামড়ে ধরল বেচারা কুচ্ছিৎ প্যাকারুর
“আহা-হা, ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও। ও তো কোনো ক্ষতি করেনি তোমাদের” মা বেচারা ধমকে ওঠে তাদের।
“তা বটে! কিন্তু কী রকম বিরাট ঢ্যাপসা আর কুচ্ছিৎ ওটা দেখতে !”
পায়ে লাল ফেট্টি বাধা বৃদ্ধা হাসটি বলে উঠল, “খুব সুন্দর বাচ্চা তো এগুলো। একটাই যা সামান্য একটু দেখতে খারাপ, ফলে সবাই একটু ট্যার্চা চোখে একে দেখবে বটে, তবে আমার মনে হয়-_এদের মা ইচ্ছে করলেই একে মেজেঘষে খানিক সুন্দর করে তুলতে পারে।” পাতিহাসগুলোর মা জবাব দিল, “ঠিকই বলেছ তুমি, বুড়ি মা। আমার এই পোনাটা দেখতে সুবিধের হয়নি, কিন্তু তা হলে কী হয়-_এ আমার বড়ো লক্ষী ছেলে, এত সুন্দর সাতার দিতে পারে যে কী বলব! সকলের চেয়ে এই তো ভালো সাতার দ্যায়। আমার ধারণা, আরেকটু বয়েস হলে দেখতে অন্যদের মতোই হবে, আর হয়তো তখন একটু ছোটোই দেখাবে একে ।” এই বলে সে তার বাচ্চার ঘাড় আদর করে চুলকে দিতে লাগল, উচু হয়ে থাকা এলোমেলো পালকগুলো মোলায়েম করে আচড়ে দিল। তারপর বলল, “তা ছাড়া, এ তো মেয়ে নয়, খোকা। একটু শক্তসমর্থ হওয়াই দরকার। বেশ জোয়ানমর্দ হয়ে সারা জীবন সংগ্রাম করে যাবে, আমি তা-ই চাই।”

“আচ্ছা, বাছারা, তোমরা এখন এস।” বুড়ি দিদিমা ঠ্যসটি উপদেশ দেয় সকলকে । “তোমার বাচ্চাগুলো বড়োই সুন্দর হয়েছে দেখতে। ভালো কথা, যদি বাইন মাছের মাথা দেখতে পাও কেউ, নিয়ে এসো আমার কাছে, কেমন ?”
অতএব এখন সকলে তারা ঘরে ফিরে চলল।
আহা, বেচারা ছোট্ট পোনা হাস, বেচারি গ্যাকারু ! ডিম ফুটে সবচেয়ে শেষে বেরিয়েছে, দেখতে বেচারাকে সব হাস আর মুরগি মিলে যখন-তখন ঠোকরাচ্ছে, খোচাচ্ছে, সবসময় করে তুলছে। আর একটা টার্কি মোরগ__তার পায়ে আবার নখের আঙটা। এতেই তার এত দেমাগ যে সে নিজেকে লাটবেলাট ভাবে: রাস্তা হাটে ফুলেফুলে, যেন ভরা পাল জাহাজ একটা ভেসে যাচ্ছে। সে রাগে লাল হয়ে ঠক্ঠক করতে করতে বেচারা পোনা প্যাকারুর পানে তেড়ে যায়। আর সে? বুঝতেই পারে না এ রকম অবস্থায় কী করা উচিত বা কী করতে হয়; তার বদখৎ চেহারার জন্যে সর্বদা সে মনমরা হয়ে পড়ে থাকে।
প্রথম দিনটা তো এভাবেই কাটল, আর তার পর থেকে যত দিন যেতে লাগল ব্যাপারটা খারাপের দিকেই গেল। নিজের আপন ভাইবোনগুলো পর্যন্ত তার সাথে যাচ্ছেতাই নিষ্ঠুর ব্যবহার করে, প্রায়ই গালমন্দ করে অভিশাপ দ্যায় : “হোদলকুৎকুৎ, তোকে বিল্লীতেও দেখতে পায় না?” আর প্যাকারুর মা, তারও মনে কি শাস্তি আছে? সে ভাবে, এমন বিশ্রী ছেলে তার না হলেই ভালো ছিল। অন্যান্য হাসগুলে৷ যখন-তখন মন গেলেই সমানে মারধোর করছে, মুরগিগুলো ঠুকরে দিচ্ছে, আর যে-মেয়েটা হাস-মুরগিদের খেতে দ্যায় সে সারাক্ষণই লাখি-ঝাটার ওপরে রেখেছে তাকে।
মারধোরের হাত থেকে বাচবার জন্যে একদিন সে লুকোতে গেল। একটা ঝোপঝাড় দেখে যেই সে ঢুকেছে অমনি কতকগুলো পাখি ভয় পেয়ে কিচিরমিচির করতে করতে উড়ে পালাল।”“ঈশ্‌, আমি দেখতে এতই খারাপ যে এরা পর্যস্ত ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল”-_ ভাবল সে। মন খারাপ হয়ে গেল তার, তখন সে ঝোপ থেকে বেরিয়ে সোজা এক দিকে-_ যে দিকে দু’চোখ যায়-_ হাটতে শুরু করে। মনের দুঃখে সে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই, যাচ্ছে, যাচ্ছে, যাচ্ছে….। অবশেষে এসে থামল এক জায়গায়, দেখল, সামনেই একটা বিল। অনেক বুনো হাস সেখানে । সারা রাত সে পড়ে থাকল বিলের মধ্যে, শোকেদুঃখে তখন সে খুবই ক্লান্ত! সকালে বুনো হাসের দল যখন আকাশে উড়ল তখন দেখতে পেল যে, তাদের এক নতুন সঙ্গী এসেছে। “কে হে বাপু তুমি?” জিজ্জেস করে তারা। প্যাকারু খুবই বিনীতভাবে আলাপ করল তাদের সাথে।
অবশেষে বুনো হাসগুলো বলল, “তোমার চেহারাটা দেখতে খারাপ বটে ! তবে তাতে কী? তুমি আমাদের বংশে বিয়ে-া না করতে চাইলেই হল।”
বলে কী! বিয়ে-থা? সে তো এ সব ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করে না। তার কেবল ইচ্ছা : এই বিলের শাপলা-কলমিদাষের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে শুয়ে থাককে, এই বিলের স্বচ্ছ তরল জল পান করবে। পুরো দুটো দিন প্যাকারু রইল এই জলাশয়ে। তৃতীয় দিনে কোথা থেকে উড়ে এল দুই বুনো বালিহাস-_না, বালিহাস ঠিক বলা চলে না, বয়েস খুবই কম তাদের, বরং বলা চলে বালিহাসের পোনা। ডিম ফুটে বের হয়েছে তারা বেশি দিন হয়নি, আর তাইতেই ছেলে-ছোকরাদের চ্যাতডামি তাদের স্বভাবে তখনো রয়ে গেছে।
“হে-ই!” বুনো বালিহাসের পোনা দুটো তাকেই ডাকছে যেন। তারা বলছে, “ওহে, এদিক পানে একটু শুনে যাও তো বাপু। দেখতে তুমি বড়োই বদখৎ, আর সে জন্যেই তোমাকে খুঁউ-ব ভালো লাগছে আমাদের। তুমি আমাদের সঙ্গে আসবে নাকি? এখান থেকে সেখান অবিরাম ঘুরে বেড়াবে আমাদের সাথে? এ দিকে আরেকটা বিল আছে, এখান থেকে বেশি দূরে নয়। সেখানে খুব চমৎকার কিছু বুনো পাতিহাস আছে, এত সুন্দর যে কী বলব! তারা কেবলই শিস্‌ দ্যায় স্স্-স্ স্স্্‌স্‌ করে। তুমি তো বাপু ইচ্ছে করলেই ওখান থেকে টুকটুকে একটা বৌ বিয়ে করে আনতে পার; তুমি যে-রকম বিদঘুটে দেখতে, তাতে আবার তোমার ভাগ্যও খুলে যেতে পারে 1”
গুড়ুম ! খ্যা, এ কী হল? বন্দুকের শব্দ ! আর, আহা রে, বাচ্চা বালিহাস দুটো ছটফট করতে করতে মরে গেল কলমিদামের মধ্যে! আবার এ-_গুড়ুম ! বুনো হাসের ঝাক উড়ল শ্যাওলা, কচুরিপানা আর দামের ভিতর থেকে। চারদিকে দারুণ একটা হৈ চৈ বেধে গেল, বন্দুকের আওয়াজ হচ্ছে ক্রমাগত
শিকার করতে এসেছে কারা। বেশ বড়োসড়ো শিকারি দল। ঝোপে-ঝাড়ে বিভিন্নজন লুকিয়ে আছে। কেউ কেউ আবার গাছের উপরে উঠেছে, সে-সব গাছের শাখাপ্রশাখা আবার বিলের উপর ঝুলে আছে। শিকারি কুকুরগুলো কাদা, পানি সমানে ছিটোচ্ছে; পানিতে ভুবে-থাকা আগাছা, শ্যাওলা, দাম সরিয়ে সব দিক খুঁজছে। ওহ, কী ভয়টাই না পেয়েছে বেচারি পোনা গ্যাকারু ! ছোট্ট মাথাটা কোথায় যে রাখবে সে ভেবেই পাচ্ছে না। শেষকালে মাথাটা ঘুরিয়ে নিয়ে ডানার তলায় গুজে দিল, আর ঠিক তখনই এক বাঘা কুকুর-__জিভ এ্যাত্তোখানি মুখ থেকে ঝুলছে, গোল গোল চোখ যেন আগুনের ভাটা-_ধোৎ করে তার পাশ দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল। বিরাট চোয়াল, হা করে আছে-_যেন এক্ষুনি গিলে খাবে; কুকুরটা নাক কুচকে প্যাকারুর গা শুঁকল, ফর্সা তীক্ষ দাত খিচিয়ে উঠল, কিন্তু তারপর কী ভেবে ছপাৎ ছপাৎ করে জল ছিটিয়ে চলে গেল, কিচ্ছুটি করল না, গায়ে একটু আচড়ও দিল না তার, একেবারে ভালোমানুষটির মতো চলে গেল।
“উঠ, বাব্বাঃ, বাচলাম। করুণাময়ের অশেষ কৃপা।” সে মনে মনে ধন্যবাদ জানায় বিধাতাকে, “আমি দেখতে এতই জখন্য যে কুকুরটা আমাকে কামড়াল না পর্যস্ত।”
এরপর প্যাকারু ঠিক এঁ জায়গাতেই হয়ে শাপলার দামে মুখ খুঁজে পড়ে রইল। ওদিকে তখনো শিকারিদের হৈ-হল্লা পূর্বের মতোই উদ্দাম। বেলা গড়িয়ে বিকেল হয়ে এলে ওদের হট্টগোল হৈ চৈ কমল, কিন্তু তখনো বেচারা ভয়ে টু শব্দ করল ন! একটুও আরো ঘণ্টা কয়েক অপেক্ষা করার পর সে ঘাড় তুলে উকিঝুঁকি মেরে দেখল চারদিক, আর তারপরে সেখান থেকে যত তাড়াতাড়ি পারে দৌড়। দৌড়, দৌড়, দৌড়। মাঠ পেরিয়ে, জমি পেরিয়ে, খানাখন্দ পার হয়ে সে দৌডুচ্ছে; বাতাসের বেগ খুব__দমকা হাওয়া বইছে শৌ শৌ, যেতে কষ্ট হচ্ছে তার, তবু সে দৌডুচ্ছে।
সন্ধে হয়ে এল প্রায়। তখনো ছুটছে গ্যাকারু। দম নিতে যেই একটু থেমেছে, সামনে দ্যাখে একটা ঝুঁড়েঘর। একেবারে ভাঙাচোরা, শরীরে তার কিচ্ছু নেই, কোন্‌ দিকে হেলে ভেঙে পড়বে ঠিক করতে না পেরেই যেন দীড়িয়ে আছে এখনো। সে দেখল, একটা কবজা ভেঙে যাওয়ায় দরজার পাল্লাটা হুমড়ি খেয়ে পড়ছে দেয়ালে; যে অল্প একটু ফাক ছিল ঢুকতে পারে প্যাকারু। বাইরে হাওয়ার গর্জন বাড়ছে ক্রমশ। কী করবে এখন সে? ভয়ে ভয়ে হামাগুড়ি দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ল পোনা প্যাকারু।
ঘরের মধ্যে এক বুড়ি বাস করত। আর ছিল তার. পোষা বিড়াল টম, আর একটা মুরগি। পৃথিবীতে কেউ ছিল না বুড়ির, তাই বিড়ালটাকে সে ছেলে জ্ঞান করত। আর টম পুষি বুড়ির ঘুরে বেড়াত। তার লোম ধরে বেয়াড়া ধরনের ঠাট্টা করলে সে নখ দিয়ে আচড়ে দিতেও চেষ্টা করত। মুরগিটার পা দুটো আবার বড়োই ছোট্ট, বুড়ি সেজন্যে তাকে \”ঠুটো তিতি, বলে ডাকে। খুব সুন্দর ডিম পাড়ে “ঠুটো তিতি\” তাই বুড়ি একেও তার মেয়ের মতো মনে করত। পরদিন সকালে তারা প্যাকারুকে দেখতে পেল। টম পুধি হিউ মিউ করে নতুন অতিথিকে অভ্যর্থনা জানাল আর ‘ঠুটো তিতি’ কক্‌ কক করে ডেকে উঠল। “ব্যাপার কী?” বুড়ি এদিক-ওদিক তাকিয়ে বিড়বিড় করে ওঠে। তার চোখ খারাপ হওয়ায় পোনা গ্যাকারুকে সে ভালো করে দেখতে পেল না। তার মনে হল, একটা মোটা ধাড়ি হাস পথ ভূলে এখানে চলে এসেছে। বুড়ি তো খুব খুশি ; “বাহ, ভালো জিনিস বাগানো গেছে,” সে বলে ওঠে আনন্দে, “আমি এখন হাসের ডিম পাব রোজ। কী মজা! অবশ্য এটা যদি হাসা না হয়। দেখা যাক কী দীড়ায় শেষ তক্‌।” অতঃপর বুড়ি তিন সপ্তাহ ধরে রেখে দিল পোনা গ্যাকারুকে। কিন্তু হায়, একটা ডিমও তো সে পাড়ল না। এখন বিড়াল হল বাড়ির কর্তা আর ঠুটো’ তিতি বাড়ির গিন্নি। কথা বলতে গেলেই তারা বলত “আমরা আর এই দুনিয়া\”; তারা মনে করত, দুনিয়ায় তারাই একমাত্র লোক, আর কেউ গণনার মধ্যেই নয়। গ্যাকারু অবশ্য ভাবত যে, অন্য কোনো মতও তো থাকতে পারে এ ছাড়া, কিন্তু তার মতামত শ্রীমতী তিতি গ্রাহ্যের মধ্যেই আনত না।
সে জিজ্ঞেস করত গ্যাকারুকে, “তুমি কি ডিম পাড়তে পার?”
“উন্ত।”
“তাহলে চুপ মেরে থাক, বক্‌ বক কর না।”
আর টম পুষি বলত, “এইভাবে পিঠ ফোলাতে পার? এরকম গর্র্‌ গর্র্‌ করতে পার আমার মতন?”
“না।”
“ব্যস, তাহলে আবার অতো কথা কী? বুঝদার লোকেরা যেখানে কথা বলে সেখানে তোমার কথা কওয়াই উচিত নয়।”
তখন কী আর করে গ্যাকারু? ঘরের এক কোণে মনমরা হয়ে বসে থাকে। খোলা দরজা দিয়ে যুক্ত বাতাস আর সূর্যের আলো এসে পড়ছে ঘরের ভিতর। এসব দেখে তার আরো খারাপ লাগে, বাইরে ঘরে আসতে ইচ্ছে যায়, সাতার কাটতে বাসনা হয়। শেষ পর্যস্ত আর থাকতে না পেরে ঠুটো তিতিকে মনের কথাটা খুলেই বলল সে।
“তোমার অসুবিধেটা কী হে বাপু?” শুনে তো তেড়ে এল মুরগি, “কাজকাম নেই তো, তাই এরকম নানান রঙিন স্বপ্ন দেখছ। ঠিক আছে, শোনো, একটা কাজ করো-_তুমি ডিম পাড়তে চেষ্টা করো দেখি। না হয় গর্র্‌ গর্র্‌ করতে পার কিনা দ্যাখো,__-তাহলেই এসব কৃচিস্তা বেমালুম ভূলে যাবে। বুঝেছ?”
শুনে মন আরো খারাপ হয়ে গেল তার। আমতা-আমতা করে বলল, “কিন্তু, বুঝলে কিনা দিদি, সাতার কাটতে যে কী আনন্দ। কী আনন্দ__ঝপ্পাৎ করে ঝাপ দিয়ে পড়ব পানির বুকে, উপর দিয়ে পানি ঢেউ খেলাবে আর একেবারে পানির তলায় পাতালে চলে যাব সাতার কাটতে কাটতে. . .”
“যত্তো সব বিদঘুটে সখ”, তিতি ব্যাজার মুখে জবাব দিল, “মনে হচ্ছে, মাথায় তোমার কিঞ্চিৎ ছিট আছে হে বাপু। আমার কথা না-হয় বাদই দিচ্ছি, এই পুষির কথাই ধর না কেন-_আমার জানাশোনার মধ্যে এত বড়ো জ্ঞানী তো আর কেউ নেই; তা জিজ্ঞেস করো দেখি পুষিকে যে তার সাতরাতে ইচ্ছে যায়, না ডুবসাতার দিয়ে একেবারে পানির তলায় পাতালে যেতে মন যায়, জিজ্ঞেস করো। আর তা না হলে-_ বুড়ি মা-কেই শুধোও না, তার চেয়ে তো আর কেউ বেশি চালাক নয়। তুমি কি ভাব তিনি সাতার কাটতে কি ডুবসাতারে ডুব মেরে থাকতে পছন্দ করবেন?”
“তোমরা বুঝতেই পারছ না ছাই আমি কী বলতে চাইছি”, অগত্যা প্যাকারু না বলে আর পারল না।
“কী? কী বললে হে? আমরা তোমাকে বুঝতে পারছি না? বটে! তার মানে_ তুমি তাহলে টম পুষির চেয়ে, বুড়ি মার চেয়ে, আমার কথা না-হয় বাদই দিলাম, এদের চেয়ে বেশি পণ্ডিত ভাব নিজেকে ! বাছা, এত আন্লাদ ভালো নয়। তোমাকে যথেষ্ট দয়া দেখানো হয়েছে, তাতেই সন্তষ্ট থাকো, বুঝলে হে! একটা সুন্দর গরম ঘর দেয়া হয়েছে তোমাকে থাকবার জন্যে, তা ছাড়া এরকম মহৎ পরিবেশে কত কী শিখতে পাচ্ছ তুমি, তা খেয়াল আছে? নাঃ তুমি বড্ডো বক্বক্‌ করো, তোমার কচ্কচানি শুনতে শুনতে কানে তালা লেগে যায়। বিশ্বাস করো, আমি তোমার ভালোই চাই। হ্যা, আমি তোমাকে প্রায়ই অপ্রিয় সত্যিকথা বলি বটে, কিন্তু সেটাকেই কি লোকে খাটি বন্ধুর লক্ষণ বলে না? যাক গে, এখন এসো তো বাপু: একটু চেষ্টা করে দ্যাখো যদি একটা ডিম পাড়তে পার আমার মতো; আর তা না পারলে, পুঁষির মতো একটু গর্র্‌ গর্র করো তো দেখি।”
“আমার মনে হচ্ছে, বাইরেটা কিছুক্ষণের জন্যে ঘুরে আসা দরকার, নয় কি? দিদি, দুনিয়ার হালচাল যদি একটু দেখতে পেতাম তবে বড়ো ভালো লাগত আমার”, আর একবার বেহায়ার মতো চেষ্টা করল প্যাকারু।
“ধুত্বোর, ইচ্ছে হলে যাও গে। আমি কিছু জানি না”__বলে তিতি চলে গেল।
তখন পোনা গ্যাকারু আবার বেরুল। দিঘি পেতে তার কষ্ট হয়নি। পানির উপরে বহুক্ষণ ধরে সাতার কাটল সে, ডুব দিয়ে পৌছে গেল একেবারে দিঘির তলদেশে। পাশ দিয়ে কত জীবজস্ত চলে গেল, বিস্ত কেউই একবার চোখ ফিরিয়ে তাকে দেখল না, এতই কদাকার সে।
হেমস্তকাল এসে গেল। গাছের পাতা হলদে হয়ে যাচ্ছে, শুকিয়ে লালচে হয়ে যাচ্ছে। বাতাস বইতে শুরু করেছে, গাছের পাতা উড়িয়ে নিয়ে নাচতে নাচতে যাচ্ছে সে। বাতাস হিম; আকাশে জমাট মেঘ বরফ আর শিলাবৃষ্টি সিসের মতো ভারি হয়ে আছে। একটা ঝোপের মাথায় একটা প্াড়কাক বসে আছে, থেকে থেকে ডাকছে অশুভ কা-কা রবে। সব কিছু মিলিয়ে প্যাকারুর কেমন যেন ঠিক সুবিধের মনে হচ্ছে না।



সেদিন সন্ধ্যাবেলা। সূর্য মাত্র পাটে বসেছে। ছোটো নিচু একটা ব্রাশউড ঝোপ থেকে এক ঝাক পাখি উড়ল। গ্যাকারু তো অবাক ! এত অপরূপ পাখি সে জীবনে কোনো দিন দ্যাখে নি : তাদের ডানার পালক সব সাদা, তাদের ঘাড় চিকন-সরু আর দীর্ঘ। তারা মরাল। মুখ থেকে কেবল সামান্য একটু শব্দ বেরুল তাদের ; তারপর লম্বা, বিরাট, অপূর্ব ভানা মেলে ধরল তারা আকাশে, বাতাস কেটে কেটে উড়ে চলল সমুদ্র পার হয়ে, ঠাণ্ডা হিম ভূখণ্ড পেরিয়ে উষ্ণ কোনো দেশে । আকাশে উড়ছে তারা, উচ্ভতে, আরো উচুতে। প্যাকারুর মনে নানারকম অদ্ভুত অনুভূতি জাগতে লাগল এদের দেখে। ওদের দেখবার জন্য সে পানির উপরে ঘুরপাক খেয়ে ঘাড় উচু করে তুলে ধরছিল; তার মুখ দিয়ে অজান্তেই অকস্মাৎ এক তীক্ষ অদ্ভুত শব্দ বেরিয়ে এল; __সে ভয় পেয়ে চমকে উঠল নিজের কণ্ঠস্বরে। আহ, সে তো সারা জীবন এদের ভুলতে পারবে না__কী অপরূপ পাখি, কী সুখী বিহঙ্গ ! তার জানা নেই এদের নাম কী, সে জানে না তাদের গন্তব্যস্থল। তবু সে ভালোবেসে ফেললো ওদের, এত ভালো আর কাউকে সে কখনো বাসেনি। তার মোটেই হিংসে হয়নি ওদের . দেখে। একবারও তার মনে হয়নি যে, ও-রকম রূপ যদি তারও থাকত। হাসপট্রির পাতিহাসগুলো তাকে সঙ্গী করে নিলেই সে তৃপ্ত থাকতে পারে, মনে হল তার।
শীত এসে গেছে। কী দারুণ ঠাণ্ডা! পাছে হিমে জমে যায় তাই পাকার পানিতে কেবলই সাতার কাটে। কিন্তু দিন-কে-দিন সাতারের স্থান যে তার সঙ্কুচিত হয়ে আসছে; রাত পোহালেই রোজ সে দেখতে পায় যে, গতকাল যে-পানিটুকুতে সে সাতার কেটেছিল তার কিছুটা জমে বরফ হয়ে গেছে। শেষকালে তার সাতরাবার কোনো জায়গাই যখন আর রইল না, তখন যেটুকু স্থান তখনো বরফে জমে যায়নি সেখানেই সে অবিরাম পা ছুঁড়ে ছুঁড়ে সাতার কাটতে লাগল যাতে এ জায়গাটুকু অন্তত জমে না যেতে পারে। কিন্তু এর ফলে শিগ্গিরই সে খুব অবসন্ন ও ক্লান্ত হয়ে নেতিয়ে পড়ল; অবশেষে এক সময়ে ওখানেই সে হিমে সিঁটিয়ে ঠাণ্ডা হয়ে পড়ে রইল।
তখন সকাল হয়েছে সবেমাত্র। এক চাষি দিঘির পাড় দিয়ে হেটে যাচ্ছিল। সে দেখল, একটা পোনা হাস বরফের মধ্যে আটকা পড়ে জমে আছে। তার পায়ে ছিল কাঠের খড়ম, তা দিয়ে সে পিটিয়ে পিটিয়ে বরফের চ্যাঙড় ভেঙে টেনে তুলল প্যাকারুকে, তারপর বাড়ি নিয়ে গিয়ে তার বৌয়ের হাতে তুলে দিল।
শেষ পর্যস্ত বেচে উঠল প্যাকারু। বাড়ির ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তার সাথে খেলা করতে পছন্দ করত, কিন্তু সে ভাবত যে ওরা তাকে নাজেহাল করতে চায়। ভয় পেয়ে সে দুধের গামলার উপর হুড়মুড় করে গিয়ে পড়ত, আর দুধ ছিটকে ঘরময় হয়ে যেত। বাড়ির গিল্লি বেশ ভালোমানুষ ছিল বলতে হবে__সে চেঁচিয়ে উঠত, হাততালি দিত। তখন সে তারপর সেখানে থেকে বেরিয়ে দে ছুটু।
মহিলাটি চেঁচামেচি করে ছড়িটড়ি কিছু একটা ছুঁড়ত তার দিকে! বাচ্চারা হৈ চৈ করে তাকে ধরার জন্যে দৌড়-ঝাপ লাগাত, আনন্দে হেসে কুটিকুটি হত আর চেঁচাত। ভাগ্য তার ভালো বলতে হবে__সদর দরজা খোলা থাকত সাধারণত। সে একছুটে গিয়ে ঢুকত ঝোপঝাড়ে__নতুন বরফ পড়ে সেটা তখন একেবারে ঢেকে গেছে সেখানেই সে গিয়ে শুয়ে থাকত যেন কোন স্বঙ্নের ঘোরে।
সেই শীতে তাকে যে-সব জ্বালাযস্ত্রণা আর কষ্ট সহ্য করতে হয়েছিল তার লম্বা ফিরিস্তি দিয়ে কোনো লাভ নেই। আবার যখন সূর্যের তেজ দেখা দিল, গরম পড়তে আরম্ত করল, সে তখন বনে-বাদাড়ে ঝোপ-ঝাড়ে গিয়ে শুয়ে থাকত। লার্ক পাখি গান গাইতে শুরু করেছে ততদিনে, বসন্ত এসে গেল ফের পৃথিবীতে ।
ডানা দুটো সে বেশ ভালো করে ঝেড়ে নিল। আগের চেয়ে বেশ জোরদার হয়েছে, মনে হল তার এর ফলে আরো দ্রুততর ভাবে সে এখন যেতে পারে। সে বেশ বুঝতে পারল যে, এখন সে একটা বিশাল বাগানের মধ্যে আছে। সেখানে আপেল গাছ ফুলে ফুলে একাকার, সিরিংগা ফুলের গন্ধে চারদিক ম-ম করছে, আকাবাকা খালের উপরে তারা তাদের সবুজ ডালপালা ছড়িয়ে দিয়েছে। আহ্‌, সব কিছু এত সুন্দর, বস্তের টাটকা সৌরভে ভরে আছে সব। .
একটা ঝোপের আড়াল থেকে তিনটি চমত্কার রাজহাস বেরিয়ে এল। ডানার পালকগুলো গর্বভরে কী সুন্দর ছড়িয়ে দিল তারা ; হালকা-_যেন হাওয়ায় ভেসে তারা সাতার কাটতে লাগল বিলের জলে। এই অপরূপ পাখিটিকে যে চেনে প্যাকারু; কী এক অচেনা বিষ্ণ্রতায় তার মন ভরে গেল।
“ওদের কাছে বরং একটু উড়ে গিয়ে বসি। আহা, রাজপক্ষী আর বলে কাকে !” সে ভাবে। “অবশ্য ওরা আমাকে মেরেই ফেলবে, এমন বিদঘুটে চেহারা নিয়ে যে ওদের কাছে যাবার দুঃসাহস করেছি, তাই। কিন্তু তাতে কী? পাতিহাসদের এরকম মারধর, মুরগিদের হাতে মরাও ঢের ভালো; আর উ%, এই শীতকালটায় কী কষ্টরটাই-না পেলাম।” সে উড়ে গিয়ে বসল জলের বুকে, সাতার কেটে এ পাখিগুলোর কাছে চলে গেল। তারাও ততক্ষণে তাকে দেখতে পেয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে। “আমাকে আপনারা মেরে ফেলুন”, বেচারা প্যাকারু বলে উঠল, মৃত্যুর অপেক্ষায় মাথাটা নিচু ফরল। আর তখনি__আরে, এ সে কী দেখছে জলের বুকে? পানিতে সে তার নিজের চেহারা দেখতে পেল : এতো! কোনো হোঁৎকা বিচ্ছিরি পাশটে গ্যাকারু নয়, এ যে এক রাজহংসের ছবি।
আসল কথা—রাজহাসের কংশ যদি কারো হয়, তো সে পাতিহাসপট্রিতে জন্মালেও কিছু এসে যায় না।
বড়ো বড়ো রাজ হাসগুলো তার চারপাশে এসে ঘিরে ধরল তাকে, ঠোট দিয়ে ছুঁয়ে তাকে স্বাগত জানাল। নিজেকে খুব সুখী মনে হচ্ছিল তার।
ছোট ছোট কিছু ছেলেমেয়ে বাগানে দৌড়াদৌড়ি করে খেলা করছিল। তারা পানির বুকে ক্ষুদ আর রুটির টুকরো ছুঁড়ে দিতে লাগল। ওদের মধ্যে যে সবচেয়ে ছোট, সে অবাক হয়ে চেচিয়ে উঠল : “আরে, এ যে একটা নতুন দেখছি” অন্যেরাও চেঁচিয়ে উঠল, “তাই তো, একটা নতুন রাজহাস এসেছে!” আনন্দে হাততালি দিতে দিতে দৌড়ে গেল তারা বাবা-মার কাছে খবর দিতে। রুটি আর কেকের টুকরো সবাই ছুঁড়ে ফেলতে লাগল জলে, বলাবলি করল : “নতুনটাই সবচেয়ে সুন্দর, একেবারে কচি বয়েস, আর কী সুন্দর 1” আর পুরনো রাজহাসগুলো তাকে মাথা নুইয়ে সম্ভ্রম জানাল। এতে বড়ো লঙ্জা লাগল তার, ডানার মধ্যে মাথা গুঁজল সে। মন তার সুখে ভরে গেছে আজ; অথচ এতটুকুও অহংকার হল না তার–যার মন ভালো সে তো কখনো অহংকারী হয় না।
তার সব মনে পড়তে লাগল-_সবাই তার দিকে চেয়ে কী রকম হাসি_তামাশা করেছে, নির্দয় ব্যবহার করেছে তার সাথে, সব। আর এখন সে শুনছে যে সবাই বলছে, সে-ই না কি সমস্ত সুন্দর পাখিদের মধ্যেও সবচেয়ে সুন্দর। সিরিংগা তার ফুল্ল শাখাপ্রশাখা নুইয়ে ূ তার নির াদর পরাগ জেরার যারা জর দুটো একটু ঠিকঠাক করে ঝেড়ে নিল, বাড়িয়ে দিল তার সুদীর্ঘ পেলব গ্রীবা, আর প্রাণের আনন্দে বলে উঠল : “যখন আমি ছিলাম সকলের চক্ষুশুল কুচ্ছিৎ প্যাকারু, তখন তো কখনো এত সখের কল্পনাও আমি করিনি!”