Site icon খিচুড়ি

উৎসবের আগের রাত

উৎসবের আগের রাত এক মায়াবী রাত।
আচমকা শহর ফাঁকা হয়ে যায় , ফেরেস্তাদের ইশারায়।
সবাই চলে গেছে । মায়ার চাদরে জড়ানোর জন্য। অপেক্ষায় থাকে সবার প্রিয়জন।
শেষ ইফতার বিক্রি করে দোকান পরিষ্কার করতে থাকে দোকানি। আসছে বছর আবার হবে।
দারুন একটা রুটিনে এসে গিয়েছিল একটা মাস। দুপুরে এসে মোড়ের কাছে বসতো সে । গ্যাসের স্টোভ জ্বেলে বুদ বুদ উঠা গরম তেলে বেগুনি, আলুর চপ , পিয়াজু ভাঁজত। দারুন একটা সৌরভে কাটতো সময়টা।
আহা।
একটা বেগুন কয় ফালি করে যে বেগুনি বানাত নিজেও ভুলে গেছে। আসছে বছর আবার হবে।
সবার কেনাকাঁটা আগেই হয়ে গেছে। শেষ মুহূর্তে যারা টাকা যোগার করতে পেরেছে তারা এখন মার্কেটে ঘুরছে। ঘোর লাগা স্বপ্নিল চোখে ওরা কেনাকাঁটা করছে।জামা, জুতা সব হাতে করে প্রিয়জনের চেহারা মনে করছে। জুতোর মাপটা ঠিক হবে তো ? না হলেই মুশকিল।
পাঞ্জাবি কিনতে গিয়ে টলমল করে উঠছে যুবকের চোখ। গত ঈদে বাপ বেঁচে ছিল । এই বার নেই। লাইন দিয়ে সবাই দুনিয়ায় আসে। বাবা- মা- বড় ভাই -ছোট বোন। বিদায়ের সময় কোন লাইন থাকে না। ছেলে চলে যায় বেহেস্তের বাগানে । বাপ বেঁচে থাকে। দরদী কেন এমন নিঠুর ?
কত বড় হয়ে গেছে টুনটুনি ? মায়ের জন্য বাতের ব্যাথার একটা মলম নেয়া যেতে পারে ফুটপাথের ওষুধ বিক্রেতার কাছ থেকে ?একটা চিরুনি আর খানিকটা চুল বাধার ফিতে, মনের মানুষের জন্য। সস্তা সৌরভের শিশি।
মোড়ের বড় রাস্তাটা আজ যেন ইস্তাম্বুল বা তুরস্ক হয়ে গেছে ।
এক গাদা ফেরিওয়ালা বিক্রি করছে কিসমিস, লবঙ্গ, দারুচিনি, এলাচি আর হরেক পদের মশলা। কমলা রঙের নগ্ন আলো ঝুলছে দোকানের সামনে।
সারা মাস শহরে ভিক্ষা করেছে দাদু নাতি। ফিতরার টাকা পাওয়ার জন্য দূরের গ্রাম থেকে শহরে এসেছিল ওরা। আজ চলে যাচ্ছে। নাতিটা চোখ বড় বড় করে শেষ বারের মত শহর দেখছে । বাপরে কত মানুষ।
গ্রামে ফিরে সবাইকে গল্প শোনাবে।
দাদু মিহি গলায় বলছে- “কি রে দুজ্ঞা মশলা কিন্মু নি। তর মায় গোস্ত রানবো নে।”
ওরা খানিক কিসমিস কিনে নেয়। এক বাসা থেকে খানিক সেমাই পাওয়া গেছে।
মসজিদের পাশে ভিক্ষা করছে পিচ্চি এক মেয়ে। লাল চুল। ময়লা ফ্রক। নামাজ শেষে এক ভদ্রলোক বিশ টাকার এক নোট দিয়েছে।বিহ্বল পিচ্চি বলছে- পুলিথিনের ব্যাগ নাই? এত টেকা নিমু কেমনে ?
কুড়ি টাকা ওর কাছে – “এত টেকা” ।
মসজিদের বড় হুজুর পবিত্র গ্রন্থ হাতে ভাবছেন – ইফতারের সময় এত মানুষ আসে কিন্তু নামাজের লাইন এত ছোট হয় কেন মাবুদ ? আমরা কেন তোমার নেয়ামত অস্বীকার করি ? ব্লু বেরি ফলের মত নীল আকাশে শুকনো খেজুরের ডালের মত চাঁদের দিকে চেয়ে হাহাকার করে উঠলেন তিনি।
ছোট হুজুর টিনের বালতি ভর্তি শরবত নিয়ে গ্লাস ভর্তি করে বিলিয়ে দিচ্ছেন পথশিশুদের। গোলাপের সৌরভ আর আনারের মত মিষ্টি সেই শরবত। তিন গ্লাস গিলে ন্যাংটা এক পিচ্চি বলল- ‘ হুজুর আমি শরবৎ পাই নাই । আমারে দ্যান এক গেলেস।’
হাসি মুখে হুজুর গ্লাস আগিয়ে দিয়ে বললেন-’ নে খা। তয় গ্লাসে কইলাম তর নাকের হিঙ্গাইল বড়াইস না। আরও মাইনসে খাইব।’
বাসগুলো ঠেসে ভরেছে যাত্রী দিয়ে।
সাগরেদ ষড়যন্ত্র করছে- “ওস্তাদ আরও পেসেঞ্জার হান্দামু ? কোন হালায় উদিস পাইব না। ঠিকই জামুগা কেঞ্জাল বাঁচাইয়া। ’
বন্ধ হয়ে যাচ্ছে চায়ের দোকান, মার্কেট।মনিহারি বিপণী। সাজঘর।
লোক কমে যাচ্ছে রাস্তায়।
নিঃসঙ্গ এক বুড়ী ধনীর বাড়ির উঠানে রাতের ঘুমানোর আয়োজন করছে।
কি ভেবে হাপুস নয়নে কাঁদছে।
যদি জানতে পারতাম…।
উৎসবের আগের রাতে শহরটা মায়াবী হয়ে যায়।
আচমকা ফাঁকা হয়ে যায় বিরাট এই শহর ।
ফেরেস্তাদের ইশারায়।

যে বইগুলো কিনতে পারেন ডিস্কাউন্ট রেটে থেকে:

Loading books...
Exit mobile version