ওয়াইন

ওয়াইন শব্দটা বেশ পুরানো।
তবে ইংরেজি শব্দ না। সম্ভবত মেডিটেরিয়ান শব্দ থেকে এসেছিল। আদি ইতিহাস আমরা
জানি না। খুঁজে পাইনি। যীশুর জন্মের ৬০০০ বছর আগে অর্থাৎ ব্রোঞ্জ যুগে জর্জিয়া
আর ইরানের লোকজন আঙুর পচিয়ে এই মদিরা বানাত সেটার প্রমান পাওয়া গেছে।
প্রায় একই সময় চাইনিজরা চাল পচিয়ে ওয়াইন বানাত। আজও চাইনিজ মার্কেটে রাইস
ওয়াইন নামে বিচ্ছিরি জিনিসটা পাওয়া যায়। বাচ্চাদের প্রস্রাবের মত স্বাদ।
ইউরোপের মধ্যে গ্রিসের লোকজনই প্রথম ওয়াইনের স্বাদ পায়। এত বছর পরও
ইউরোপের ওয়াইন পৃথিবীর সেরা।
আরজেন্তিনা,চিলি আর ক্যানারি আইল্যানডের ওয়াইন চেখে দেখেছি। খারাপ না।
সাউথ আফ্রিকার ওয়াইন বাজার ধরার চেষ্টা করছে। ওখানের টেবিল মাউনটেনের
আশেপাশে নাকি দারুন আঙুর হয়।
কালচে সবুজ রঙের বোতলে ওয়াইন ভাল থাকে। বটল গ্রিন শব্দটা আমরা ওখান থেকেই
গায়েব করেছি। Kenelm Digby (1603-1665), নামে এক ইংরেজ ভদ্রলোক এই ওয়াইন
বোতলের প্রবতক।
বোতলের ছিপিকে বলে কর্ক।
কর্ক বানানো হয় ওক গাছ থেকে। পর্তুগালে সবচেয়ে বেশি ওক গাছ জন্মে ।
আগে মনে করত কর্ক ছাড়া ওয়াইন ভাল থাকে না। আজকাল অনেক ওয়াইন কোম্পানি
টিনের বা অ্যালুমিনিয়ামের ছিপি দিয়েও ওয়াইন বাজারে ছাড়ছে। না। স্বাদ বা গন্ধের
কোন হেরাফিরি হচ্ছে বলে মনে হয় না। খারাপ কি ?
ওয়াইন পরিবেশনের জন্য গ্লাস আলাদা ধাঁচের। ওয়াইন গ্লাস বলে। লম্বা -সরু তবে শ্যাম্পেনের
গ্লাসের চেয়ে খানিক বেঁটে।
বেলুনের মত ফোলানো ওয়াইন গ্লাসও আছে।
ভাল স্বাদ এর ঘ্রান পেতে হলে ভাল গ্লাস নির্বাচন করতে হবে।
কফি মগে খেয়ে দেখুন। একদম ফালতু লাগবে। একই ভাবে লাচ্ছি খাবার গ্লাসে ওয়াইন
খেয়ে দেখুন। বিচ্ছিরি-তাই না ?
দেখা গেছে একই ওয়াইন বিভিন্ন গ্লাসে স্বাদ বিভিন্ন রকমের হয়।
কোন গ্লাস এর চনমন করা মাতাল ঘ্রাণটা নষ্ট করে ফেলে। কোন গ্লাস স্বাদটা নষ্ট করে ফেলে।
প্রায় সময় দামি ওয়াইন ফালতু গ্লাসে ঢাললে মনে হয় সস্তা ওয়াইন খাচ্ছি।
কাজেই ভাল গ্লাস কিনতে হবে বারের জন্য।
ও ভাল কথা স্বচ্ছ গ্লাস সবচেয়ে সেরা।
সবুজ বা নীল কাঁচের গ্লাস-খুব মোটা বা ভারি গ্লাসে ওয়াইন পরিবেশন করবেন না।
ভিন্ন ফলের সৌরভ নিয়ে কিছু ওয়াইন বের হয়েছে বাজারে।
কলা, ব্ল্যাক বেরি, কিউয়ি, ভ্যানিলা, চেরি। কৃত্রিম ভাবে এই সৌরভ যোগ
করা হয়।
কোন ধরনের খাবারের সাথে কোন ওয়াইন ভাল যায় ?
খুব কমন প্রশ্ন।
অবশ্যই খাবারের সাথে ওয়াইনের ভূমিকা বেশ বড় রকমের।
কল্পনা করুন না- সামনের প্লেটে গ্রিল করা মাছ। লবণ, মাখন আর লেবুর পাগল করা ঘ্রাণ।আর
এক পাত্র ভর্তি সাদা ওয়াইন।
এটাই খেলায় রাখবেন। হোয়াইট মিটের সাথে হোয়াইট ওয়াইন ।আর রেড মিটের সাথে রেড
ওয়াইন। মানে-মুরগি, মাছ আর সী ফুডের সাথে সাদা ওয়াইন। আর গরু বা শুয়োরের মাংসের
সাথে লাল ওয়াইন।
ওয়াইন সংরক্ষণের উপর এর স্বাদ , মূল্য অনেক কিছু নির্ভর করে।
পুরানো ওয়াইন ভাল। এমনটা শুনেছেন হয়তো। ঠিক মত ওয়াইন সংরক্ষণ না
করলে এর কোয়ালিটি ,স্বাদ, ঘ্রান নষ্ট হয়ে যায়। সময়ের সাথে সাথে এর রঙ আর সৌরভ দুটোই
হারিয়ে যায়।
বাইরের দেশে প্রায় সবাই সেলারের মধ্যে ওয়াইন স্টক করে। বার বা হোটেল চালানোর
জন্য ও বেশ বড় মাপের ওয়াইন সেলার থাকা দরকার। তেমনটা না থাকলে মোটামুটি
ছায়া আর অন্ধকার আছে এমন জায়গা নির্বাচন করা দরকার। সরাসরি আলো এসে যেন
বোতল বা সেলারে না পরে। তা হলেই শেষ।
ওয়াইনের বোতল হাতে নিয়ে প্রথমেই বোতলের গায়ে সাঁটা লেবেল ভাল করে পড়ুন।
বোতলের লেবেলে মোটামুটি ভাল রকমের তথ্য থাকে। যা আপনার জানা দরকার।
বইয়ের ব্যাক কভার পড়ার মতই আরকি।
কি ধরনের ওয়াইন, কোন দেশের তৈরি,কোয়ালিটি, এলকোহলের পরিমাণ,কোন কোম্পানির
তৈরি এই রকম দরকারি প্রায় সব তথ্যই থাকে বোতলের লেবেলে।
ওয়াইন প্রেমিক যারা তারা বোতলের লেবেলের লেখা দেখেই
মোটামুটি চিৎকার করে বলতে পারে-পাইছি।
যারা শখের বশত ওয়াইন কেনে বা প্রিয়জনকে উপহার দেয়ার জন্য তাদের ও
লেবেল পড়া জরুরী। ঝাঁ চকচকে বোতল আর রঙচঙ্গা লেবেল মানেই ভাল
ওয়াইন না।
Federal Bureau of Alcohol এর মতে ওয়াইনের বোতলে ৫ ধরনের ইনফরমেশন
থাকতেই হবে।
ব্র্যান্ড নেইম। কি ধরনের ওয়াইন(লাল/সাদা/বারবল)। এলকোহলের পরিমাণ। মোট
ওয়াইনের পরিমাণ ।আর বোতলজাত করার ইনফরমেশন ।
মোটামুটি অনেক প্যাঁচাল পাড়লাম।
আসল কথা বলি। ওয়াইন টেস্ট। বিশেষজ্ঞ হবার দরকার নেই।
কিন্তু ব্যবসা চালাতে গেলে ওয়াইনের স্বাদ সম্পকে না জানলে তো মুশকিল।
নিধারিত ওয়াইন গ্লাসে সামান্য ওয়াইন ঢালুন।
ভাল করে এর রঙ আর স্বচ্ছতা খেয়াল করুণ।
গ্লাসের রিমের উপর দিয়ে দেখুন। সাইড থেকে দেখুন। কেমন লাগছে ?
ভাল লাল ওয়াইন হলে রঙটা মেরুন বা রুবির মত হবে। অথবা ডালিমের দানার
মত। পোড়া ইটের মত বা হালকা বাদামি -জমাট বাঁধা রক্তের মত হতেও পারে।
ভাল সাদা ওয়াইন হলে বর্ণহীন বা জারুল ফলের মত হলদে হতে পারে। খোসা ছাড়ানো
আলুর মত রঙ হতে পারে। হালকা সবুজ হতে পারে।
গ্লাসটা ধরে আস্তে করে ঘূর্ণা দিন।
নড়ে চড়ে উঠুক ভেতরের মদিরা।
আবার দেখুন। কোন রকম গাদ দেখা যাচ্ছে তলানিতে।কর্কের কোন মিহি কুঁচি?
পুরানো সাদা ওয়াইন একটু ঘন দেখাবে।
গ্লাস সামনে এনে ১০ থেকে ১২ সেকেন্ড ওয়াইনের সৌরভ নিন।গ্লাসটা নাড়াচাড়া করুণ।
কিসের ঘ্রান ? কর্কের? বেরি ফলের ? ফুল ? ভ্যানিলা ? আঙুর ? লেবু ?
নাকি শুধু কাঁচের গ্লাসের ঘ্রাণটাই বেশি শক্তিশালি ?
হালকা চুমুক দিয়ে মুখের ভেতরে ওয়াইন নিন।
সাথে সাথেই গিলে ফেলবেন না। জিভ নাড়াচাড়া করুণ।
প্রথম ধাক্কায় অ্যালকোহলের ঝাঁঝ শুধু পাবেন।
পরের মুহূর্তে ফলের সৌরভ, কাঠের পিপের ঘ্রান আর পরিচিত গুল্ম বা অচেনা মসলার মত ঘ্রান
পাবেন।
তৃতীয় মুহূর্তে ভাল লাগার অনুভূতি হবে।
এবার গিলে ফেলুন।
দারুন না ? কি মনে হয় ?
রোষ্ট করা রুটি আর পনিরের সাথে চলে ? কিংবা এক মুঠো কালো জলপাইয়ের
সাথে ?
যদি হ্যাঁ মনে হয়- তবে এটা ভাল ওয়াইন।
রান্নায় ওয়াইন ব্যবহার সাধারন একটা ঘটনা।
বিশেষ করে পাস্তা বা স্প্যাগেটি কিংবা ভেড়ার মাংসের ঝোল।
অনেকে মনে করে সস্তা ওয়াইন বোধ হয় রান্নার জন্য ভাল।
মোটেই না। পান করার জন্য যে ওয়াইন কিনবেন সেটাই রান্নায় ব্যবহার করবেন।
রেগুলার বোতলে ৭৫০মিলি ওয়াইন থাকে। মিডিয়াম বোতলে ৩৭৫মিলি।
ওয়াইনের রঙ কি হবে সেটা নির্ভর করে আঙুরের বৈচিত্রের উপর।
আর আঙুরের কোয়ালিটি কেমন হবে সেটা নির্ভর করে মাটি আর জলবায়ুর উপর।
আরও একটা ব্যাপার আছে- কারখানায় কি কায়দা করে ওয়াইন বানানো হবে সেটার
উপর ও ওয়াইনের রঙ নির্ভর করে।
লাল আঙুর যদি দ্রুত গতিতে পিষে ওয়াইন বানানো হয় তবে সেটা সাদা রঙের ওয়াইন হবে।
অদ্ভুত হলেও সত্যি।
তাই তো হলুদ আর কমলা রঙের ওয়াইন ও বাজারে দেখা যায়।
রেস্টুরেন্টে তিন ধরনের ওয়াইন পরিবেশন করা হয়।
সাদা, লাল আর গোলাপি যেটা রোজ ওয়াইন বলে।
সাদা আর রোজ ওয়াইন ঠাণ্ডা পরিবেশন করতে হয়।
লাল ওয়াইন ১৪ থেকে ১৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা মানে রুম টেম্পারেচারে
পরিবেশন করা হয়।
প্রথমে খদ্দেরকে ওয়াইন মেনু দিন। সময় দিন পড়ার জন্য।
অডার নিন।
প্রয়োজনে তাকে সাহায়্য করুণ কোনটা ভাল বা মন্দ।
বেশির ভাগ খদ্দরের নিজস্ব পছন্দ থাকে। সেটাই ভাল। গায়ে পরে পরামর্শ দেয়ার
দরকার নেই।
খদ্দের ওয়াইন পছন্দ করলে বার বা সেলার থেকে ওয়াইন নিয়ে আসুন। সাদা তোয়ালের
উপর বোতলটা রেখে খদ্দেরের সামনে ধরুন। বোতলের লেবেল যেন খদ্দের পড়তে
পারে। টেবিলে রাখবেন না।
খদ্দের পছন্দ করলে ওয়াইন স্ক্রু বের করুণ পকেট থেকে। প্রতেক ওয়েটার বা বারটেণ্ডার
অবশ্যই সাথে করে ওয়াইন বোতল ওপেনার সাথে রাখবে। অনেকে ওটাকে
বার কি(bar key) বা বার টুল(bar tool) বলে। পিচ্চি চাকু থাকে। ওটা
দিয়ে অ্যালুমিনিয়ামের ছিপি কেটে যত্ন করে কর্ক খুলে ফেলুন। কর্ক টেবিলে রাখবেন।
বোতলের মুখ তোয়ালে দিয়ে যত্ন করে মুছে ফেলুন।
যে ওয়াইন অডার দিয়েছে তার গ্লাসে আগে ওয়াইন দিন। গ্লাসের ৫ ভাগের এক ভাগ।
খদ্দের ওয়াইন চেখে পছন্দ করলে তাকে না দিয়ে পাশের অতিথির গ্লাস ভরে দিন। পুরো না। হাফ।
এবার টেবিলের অন্য অতিথিদের দিন। তবে লেডিস ফাস্ট। পুরো রাউনড
পরিবেশন করে শেষ করে এবার ফিরে আসুন যে অডার দিয়েছিল তার গ্লাসে। পরিবেশন করুণ।
বোতল টেবিলে রেখে চলে যান।
ওয়াইন রিফিল মানে গ্লাসে আবার ঢেলে দিতে গেলে টেবিলে বসা মহিলাকে আগে পরিবেশন
করবেন। নিয়ম। টেবিল রুল। কেউ গ্লাসের উপর হাত রাখলে বুঝতে পারবেন উনি আর
ওয়াইন চান না।
বোতল খালি হয়ে গেলে খদ্দেরকে জিজ্ঞেস করুণ নতুন আরেক বোতল চান কি না।
না চাইলে খালি বোতল সরিয়ে ফেলুন টেবিল থেকে।
আর কোন প্রশ্ন?
প্রতেকদিন এক বা দুই পাত্র ওয়াইন নিয়মিত পান করলে সেটা যে শরীররে জন্য
দারুন কাজ করে ডাক্তার বাবুরা কিন্তু সেই রকমই বলে।
রক্ত শূন্যতায় ভুগছে এমন মানুষকে রেড ওয়াইন পথ্য হিসাবে দেয়া হয়েছে।
কাজ হয়েছে দারুন।
মেডিকেল রিপোর্ট অনুয়ায়ি ওয়াইন খেলে বেশ কিছু উপকার পাওয়া যায়।
১। রক্তের কলোস্তরেল কমে।
২।ব্লাড প্রেসার কমে
৩। হাড়ের ক্ষয় কমে যায়
৪। কিডনিতে পাথর জমতে বাঁধা দেয়
৫। স্মরণশক্তি বাড়ে।
তবে অতিরিক্ত কোন কিছুই ভাল না।
ইতালিয়ানদের একটা প্রবাদ আছে- টাকা দিয়ে সুখ কেনা যায় না,যতক্ষণ না আপনি এক বোতল
ওয়াইন না কিনছেন।
তো চলুক না এক পাত্তর ? —