সেদিন প্রচণ্ড শীত ছিল খুব বরফ পড়ছে। চতুর্দিক যেন অন্ধকার গ্রাস করে নেবে। বছরের শেষ দিন; শেষ সন্ধ্যা নামছে পৃথিবীতে । এই দুরত্ত শীত ও আধারে সে ধীরে ধীরে পথ হেটে . চলেছে-_এক দরিদ্র কিশোরী। তার পা একেবারে খালি, মাথাতেও কোনো গরম কাপড় নেই; অথচ কী কনকনে ঠাণ্ডা বাইরে। বাড়ি থেকে যখন সে বেরিয়েছিল তখন অবশ্য তার পায়ে জুতো ছিল একজোড়া, কিন্তু তারা কোনোই. কাজে এল না শেষ পর্যস্ত। চটিজোড়াটা ছিল তার মায়ের। রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়ার ভিড়ে পাশ কাটিয়ে দৌড়তে গিয়ে কোথায় যে ছিটকে পড়ল এক পাটি পা থেকে! অনেক খোজাখুজি করেও সে পেল না। আর অন্য পাটি জুতো রাস্তার এক ছেলে ছিনিয়ে নিয়ে দৌড় দিয়েছে
ছোট্ট মেয়েটি খালি পায়েই হাটছে, কীঁ আর করবে! ঠাণ্াতে তার খালি পায়ে কালশিরে পড়ে গেছে। পরনে জরাজীর্ণ রলাপড়, তাতে কয়েক বান্ডিল দেশলাই বেঁধে নিয়েছে, তার হাতেও ধরা আছে আরো বেশ কিছু দেশলাই। পাহাড়ে সারা দিন কেটে গেল, একটি জনপ্রাণীও তার কাছ থেকে একটাও দেশলাই কিনল না; একজনও তাকে একটা ফুটো পয়সাও দিয়ে যায় নি। অসম্ভব ক্ষিধে আর শীতে কোনোরকমে নিজেকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল সে, দুঃখের জ্বলত্ত প্রতিযূর্তি। তাতে। কিন্তু সে তো এখন তার দৈহিক রূপ সম্বন্ধে ভাবছে না, ঠাণ্ডা সম্পর্কেও না। রাস্তার দুপাশের বাড়িগুলোর জানলা দিয়ে আলো ঠিকরে এসে বাইরে পড়ছে। রাজহাস রোস্টের গন্ধ নাকে এসে ধাক্কা দিল। চারদিকে আজ উৎসবের ঢেউ, নববর্ষ এসে গেছে।
রাস্তার উপরে দুটো বাড়ি পাশাপাশি হ্লাড়িয়ে আছে। একটা অন্যটা থেকে বেশি লম্বা হওয়ায় দৃ’্বাড়ির সংযোগস্থলে একটি সুন্দর কোণ হয়ে আছে।
সেই কোণের ঘুপচিতে বেচারি বসে পড়ল, ক্ষুদে ক্ষুদে পা দুটোকে টেনে নিয়ে গুটিশুটি মেরে বসল,—কিন্তু হায় রে, বৃথা চেষ্টা; পা দুটোকে গরম করা গেল না। অথচ বাড়িতে ফেরার সাহসও তার উবে গেছে__এখন পর্যস্ত সে একটি দেশলাইও বিক্রি করতে পারে নি, এক পয়সাও রোজগার হয়নি তার, ফলে তার বাবা আজ তাকে নির্ঘাৎ মারবে। তাছাড়া, তাদের বাড়ি তো এমন কিছু ভালো নয়, রাস্তার মতোই সেটা ঠাণ্ডা কনকনে । কেন না এক বিরাট বাড়ির ছাদের নিচে তাদের ভাঙাচোরা ছাপড়া-_তার চালের মধ্যে অসংখ্য জায়গায় ফুটো; খুড়কুটো বা ছেঁড়া ন্যাকড়া দিয়ে যদিও সেগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে তবু হাড়-কীপানো হিম বাতাস তার ভিতর দিয়ে হিসহিস করে চলে আসে, দাপাদাপি করে সারা ঘরময়। ঈশ্, কী ঠাণ্ডা! তার হাত জমে যাচ্ছে যেন। সাহস করে দেশলাই জ্বালালে তার আগুনে হয়তো সে হাত-পা সেঁকে নিতে পারে, গরম করতে পারে একটু। একটা কাঠি বের করল সে, দেশলাই বাক্সে ঘষতেই ফস করে জ্বলে উঠল। কী উজ্জ্বল আলো, কী সুন্দর, ছোট্ট মোমবাতি জ্বালালে যেমন অল্প গরম লাগে ঠিক তেমনি। মেয়েটি তার কিশোর-কচি আঙুল মেলে ধরল এঁ আগুনের ওপর। তার মনে হল, সে যেন খুব কারুকাজ-করা এক পিতলের স্টোভের সামনে বসে আছে; আর সে-স্টোভে কী চমৎকার আগুনের শোভা ! একটু উষ্ণতার জন্যে সে তার দুপা টান-টান করে ছড়িয়ে দিল। কিন্তু হায় ! এক মুহূর্তের মধ্যে নিভে গেল আগুনের শিখা, স্টোভও মিলিয়ে গেল কোথায়, আর সেই কিশোরী মেয়ে কনকনে হিমে কী কষ্টেই-না বসে থাকল চুপচাপ, তখনো হাতে ধরে আছে নিভে যাওয়া দেশলাই-কাঠি। দ্বিতীয় একটা কাঠি নিয়ে আবার সে জ্বালাল। ফস করে পুনর্বার জ্বলে উঠে বড়ো মনোরম আলো দিতে লাগল তা । আর দেয়ালের যেখানে-যেখানে এ আলো পড়ল, কী অবাক কাণ্ড, দেয়াল কেমন স্বচ্ছ পাতলা হয়ে গেল মেয়েদের ওড়নার মতো । পাথরের দেয়াল যেন ফুরফুরে স্বচ্ছ ওড়না, তাই দেয়ালের ওদিকে ঘরের ভিতরটা এখনি অত্যত্ত স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে। সে দেখল-_ঘরেতে লম্বা ডিনার টেবিল পাতা হয়েছে, তার উপরে বরফের মতো সাদা টেবিল ব্লুথ আর তার উপর ঝকঝক করছে নৈশাহারের উ যাবতীয় দামি দামি বাসন-পত্র পেয়ালা চামচ ইত্যাদি। আপেল আর দিয়ে তৈরি হাসের রোস্ট রূয়েছে টেবিলের এক প্রান্তে, গরম ধোয়া উঠছে তা থেকে। কিন্তু এর পরে যা হল সেটাই আনন্দের; সে দেখল-__হাসটি, এখনো তার বুকে ছুরি-কাটাচামচ বিধে আছে, এক লাফে বাসন থেকে নেমে পড়ল মেঝেতে আর থুপথুপ করে হেলে দুলে তার কাছে চলে এল। আবার নিভে গেল দেশলাই-কাঠি, মেয়ে অনুভব করল পুরু কঠিন ঠাণ্ডা দেয়াল তার পাশে। তৃতীয় কাঠি আবার জ্বালাল সে। আগুন জ্বলে উঠল ফের। আর মনে হল, খুব সুন্দর এক ক্রিসমাস ট্রির নিচে সে বসে আছে; গতবারের ক্রিস্মাস সন্ধ্যায় এক সওদাগরের বাড়িতে যে একটা গাছ দেখেছিল কাচের জানলা দিয়ে, তার চেয়ে আরো বড়ো ও সুন্দরতর গাছ এটি। গাছের সবুজ ডালপালায় হাজার হাজার মোমবাতি জ্বলছে। ছোট্ট বামন রা-_-অবিকল যেমন একটা দোকানে দেখেছিল-_গাছ থেকে নিচে তার পানে আছে। কিশোরীটি হাত বাড়াল তাদের দিকে আর ঠিক তখনি নিভে গেল আলো । এবারে কিন্তু ক্রিস্মাস মোমবাতিগুলো নিভল না, জ্বলতেই লাগল, জ্বলতে জ্বলতে ক্রমেই উচুতে উঠে যেতে লাগল যতক্ষণ-না অনেক উঁচুতে আকাশের তারা হয়ে একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর হঠাৎ একটা খসে পড়ল তাদের মধ্য থেকে, আলোর পুচ্ছ পিছনে জ্বালাতে জ্বালাতে নিচের দিকে নেমে এল।
মেয়েটি স্থির নেত্রে দেখল এ দৃশ্য । অস্ফুট মৃদু স্বরে বলে উঠল সে, “আহা ! কে যে মারা যাচ্ছে এখন!” ঝুড়ি দাদির মুখে গল্প শুনেছিল, যখন কোনো তারা খসে পড়ে তখন কোনো মানবাত্্া স্বর্গ পানে উড়ে যায়! একমাত্র এই বৃদ্ধ পিতামহীই তাকে ভালোবাসতেন; এখন আর তিনি জীবিত নন। কিশোরী মেয়ে আবার একটা কাঠি জ্বালাল, আলো ছড়িয়ে পড়ল তার চারদিক ঘিরে। তখন দেখল কী সে? উজ্জ্বল আলোকে সে তখন দেখতে পেল তার আদরের দার্দি-মা তেমনি প্রশান্ত স্রেহময়ী, কিন্ত জীবিতকালে কখনো সে তাকে এত সুখী আর আনন্দোজ্জ্বল দ্যাখেনি।
উত্তেজনায়, খুশিতে চেঁচিয়ে উঠল সে, “দাদি, আমাকে তোমার সাথে নিয়ে চল। এই দেশলাই-কাঠি নিভে গেলে তূমি আমাকে ফেলে চলে যাবে, আমি জানি। পিতলের গরম স্টোভ, নববর্ষের আনন্দভোজ আর এ সুন্দর ক্রিস্মাস ট্রির মতোই তুমিও মিলিয়ে যাবে।” এখন পাছে তার দাদি চলে যান তাই সে একটার পর একটা দেশলাই-কাঠি অতি ছ্রুতভাবে জ্বালিয়ে যেতে লাগল। আর কাঠিগুলো জ্বলতে লাগল অপূর্ব রক্তিম আভায়, মধ্যদিনে এত উজ্জ্বল হয় না। বুড়ি দাদিমাকে আর কখনো এরকম সম্ভ্রান্ত ও মনে হয়নি। ইতোপূর্বে কখনোই তাকে এত রূপসী ও দয়াবতী মনে হয়নি। তিনি তার ছোট নাতনিকে হাত বাড়িয়ে কোলে তুলে নিলেন, তারপর সুখে জ্বলজ্বল উড্ডীন হলেন দুজনে। পৃথিবীর অনেক উঁচুতে, আরো, আরো উচুতে তারা ভেসে ভেসে গেল; অবশেষে এসে পৌছুল সেখানে, যেখানে কনকনে ঠাশা নেই, ক্ষিধের কোনো বোধ নেই, কোনো জ্বালাযন্ত্রণার কথাও সেখানে কেউ কখনো শোনেনি : তারা পৌছে গেল ঈশ্বরের সামনে।
তখন সকাল হয়েছে সবেমাত্র। নিদারুণ শীত। সকলেই দেখল, গরিব মেয়েটি দেয়ালের এক কোণে হেলান দিয়ে আছে, তার সুকুমার গাল খুশিতে যেন চক্চক্ করছে, ঠোটের কোণে এখনো লেগে আছে হাস্সি গত রাত্রে__পুরনো বছরের শেষ রাত্রে সে মারা গেছে। নববর্ষের সূর্য মৃত কিশোরীর মুখে খেলা করতে লাগল; নিশ্চল বসে আছে সে, এখনো তার কোলে অনেক দেশলাইয়ের বান্ডিল, কেবল একটি বান্ডিল জ্বলতে-জ্বলতে নিঃশেষ হয়েছে।
কেউ কেউ বলল, “আহা, বেচারা নিজেকে একটু সেঁকে নেবার চেষ্টা করেছিল!” কিন্তু একজনও জানল না, কী অপূর্ব সব দৃশ্য দেখেছিল মেয়েটি; কেউ জানল না, দাদি-মাকে সঙ্গে নিয়ে সে কী জাকজমক করেই-না নববর্ষ উদ্যাপন করেছে।