মস্ত বড়ো সমুদ্বের মধ্যে অনেক, অনেক দূরে জল যেখানে অপরাজিতার মতো নীল আর স্কটিকের মতো স্বচ্ছ, যেখানটা এতই গভীর যে হাজারটি উচু-চুড়া মন্দির পর-পর সা্জালে তবে উপর থেকে একেবারে তলায় গিয়ে ঠেকে__সেখানে সাগর রাজার দেশ।
তোমরা বুঝি ভেবেছিলে জলের নিচে বালি ছাড়া কিছু নেই? তা নয়, মোটেই তা নয়। আশ্চর্য সুন্দর সেখানকার গাছপালা, এত হালকা তার ডালপালা যে জল একটু কেঁপে উঠল কি তারা নেচে উঠল শিরশিরিয়ে__হঠাৎ দেখলে তাদের জীবস্তই মনে হয়। ডালের ফাঁক দিয়ে-দিয়ে কত রকমের ছোট-বড়ো মাছ ছুটোছুটি করে বেড়ায়-_ঠিক যেমন আমাদের গাছে-গাছে ওড়ে পাখির ঝাক।
জল যেখানে সবচেয়ে গভীর সেখানে সাগর-রাজার প্রাসাদ। দেয়ালগুলো তার একালের, উচু জানলাগুলো পান্না-বসানো, আর শঙ্খের কাজ-করা ঢেউ_খেলানো ছাদ ঢেউয়ের দোলায়-দোলায় এই খুলছে, এই বুজছে। কী যে সুন্দর হয় দেখতে, প্রতিটি শছ্খের বুকে ঝকঝকে উজ্জ্বল একটি মুক্তো, তার যে-কোনো একটি পেলে উপরকার দেশের যে-কোনো রাজা ধন্য হয়ে যায়।
সাগর-রাজার স্ত্রী মারা গেছেন অনেকদিন, তার বুড়ি-মা ঘরসংসার দেখেন। এই বুড়ির ুদ্ধিসুদ্ধি নেহাৎ মন্দ নয়, কিন্তু সাগরসমাজে তারাই যে সবচেয়ে বড়ো ঘর, এ নিয়ে বেজায় দেমাক তার। তার লেজে কিনা বারোটা ঝিনুক বসানো, সেটাই বড়ো ঘরের মার্কা, অন্যদের বড়জোর ছটা। এ ছাড়া তার আর সবই ভালো, সবার মুখেই তার সুখ্যাতি। রাজার ছয় মেয়ে, ছটি ফুটফুটে ছোট্র রাজকন্যা। বুড়ি তার নাতনিদের প্রাণের চেয়েও ভালোবাসেন। সবাই সুন্দর তারা, সবচেয়ে সুন্দর একেবারে ছোট্রটি। তার গায়ের রং গোলাপের পাপড়ির মতো তেমন নরম, সমুদ্রের মতো নীল তার চোখ; অবিশ্যি অন্য সব জলকন্যার মতো তারও পা নেই, পায়ের মাছের মতো লম্বা লেজ__তা কী কোমল আর কত উজ্জ্বল !
সমস্ত দিন মেয়েরা প্রাসাদের বড়ো-বড়ো ঘরে খেলা করে; সেখানে চারদিকের দেয়ালে ফোটে নানারঙের নানারকমের সুন্দর ফুল। পান্নার জানলাগুলো একটু খুলেছ কি মাছেরা সাতরে এল ঘরে, যেমন আমাদের জানলা দিয়ে চড়ুইপাখি উড়ে আসে। কিন্তু মাছেদের সাহস চড়ুইপাখির চেয়ে অনেক বেশি, তারা সোজা রাজকন্যার কাছে এসে গা ধেষে খেলা করে, খায় তাদের হাত থেকে, আদর করলে আর যেতেই চায় না, গায়ের সঙ্গে লেগে ঘুরে বেড়ায়।
প্রাসাদের সামনে মস্ত বাগান ভরে গাছের সারি, কোনোটা আগুনের মতো লাল, কোনোটা মেঘের মতো ঘন_নীল, গাছের ফল সোনালি রঙে ঝলোমলো, জ্বলত্ত সূর্যের মতো উজ্জ্বল গাছের ফুল। আমাদের বাগান হয় মাটিতে; ওখানের বাগান বালিতে, উজ্জ্বল নীল রঙের বালি, গন্ধক-জ্বলা আগুনের যতো নীল। সমস্তটার উপরে অদ্ভুত সুন্দর একটা নীল রগ্ডের ছোপ; সেখানে গেলে মনে হবে যেন অনেক উঁচুতে উঠে গেছি, আকাশ মাথার উপরে, আকাশ পায়ের নিচে; সমুদ্রের তলায় যে আছি তা মনেই হবে না। জল যখন শাস্ত, তখন সূর্য তাকিয়ে থাকে যেন বেগুনি রঙের একটা প্রকাণ্ড ফুল, তার ভরা পেয়ালা থেকে পৃথিবীর সমস্ত আলো যেন উপচে পড়ছে।
বাগানের এক-এক অংশ এক-এক রাজকন্যার দখলে; সেখানে তারা যার যা খুশি করে। একজন তার বাগান সাজিয়েছে তিমির চেহারা করে, আর একজনেরটা ঠিক জলকন্যার মতো; কিন্তু সবচেয়ে ছোট কন্যার যেটা, সেটা একেবারে সূর্যের মতো গোল; আর সূর্ধটা তার চোখে কিনা লাল দেখাত–সেইজন্যে তার ফুলগুলোও সব টকটকে লাল রঙের। এই মেয়েটি কিছু অদ্ভুত গোছের, ভারি চুপচাপ, একা বসে-বসে কী যেন ভাবে। হয়তো একদিন উপরে এক জাহাজ ডুবেছে : তার নানারকম রগচঙে সুন্দর জিনিস নিয়ে মেতেছে তার বোনেরা, কিন্তু শিশু-কোলে-করা শ্বেতপাথরের একটি বালক-মূর্তি ছাড়া আর-কিছু এই মেয়ে চায় না। মূর্তিটি নিয়ে সে তার বাগানে রাখল, রোপণ করল তার পাশে একটি লাল ফুলের গাছ। গাছটি তাড়াতাড়ি বেড়ে উঠল, তার লম্বা ডাল নুয়ে পড়ল মাটির উপর-_সেখানে চির-চঞ্চল বেগুনি রঙের ছায়ায় যেন
ডালে-মুলে জড়াজড়ি।
এই জলকন্যা সবচেয়ে ভালোবাসত মানুষদের কথা শুনতে, সমুদ্রের উপরে যাদের দেশ। ঠানদিকে খুচিয়ে-খুঁচিয়ে সব গল্প শুনত সে__জাহাজের আর মানুষের আর ডাঙার প্রাণীর যত গল্প তিনি জানতেন, সব। ওখানকার ফুলে নাকি গন্ধ আছে-_কী ভালো লাগত তার এ-কথা শুনে, তাদের সমুদ্রের ফুলগুলো সব তো গন্ধহীন_ওখানকার বনের রঙ সবুজ, আর তার ডালপালায় মাছ যত ছুটে-ছুটে বেড়ায় সব নানা রঙের, আর কী মিষ্টি গলায় গান করে তারা ! ঠানদির মনে ছিল অবিশ্যি পাখিদের কথা, কিন্ত বলবার সময় মাছই বলেছিলেন : নাতনিরা-তো আর কখনো পাখি দেখেনি, বললে কি
কিছুই বুঝত তারা?
গল্প শেষ করে ঠানদি বলতেন, “তোমাদের যখন পনেরো বছর বয়েস হবে তখন দেখবে জাহাজ যাচ্ছে, বুঝবে কাকে বলে শহর, আর কাকে বলে মানুষ ।”
পরের বছর সবচেয়ে বড়োটির পনের হল। আর আর বোনেরা-_আহা বেচারারা ! মেজোটি বড়োটির এক বছরের ছোট, সেজোটির মেজোর ছোট এক বছরের, এমনি ক’রে-করে সবচেয়ে ছোটটির কপালে আরো প্াচ-পাচ বছর বসে থাকা ! তখন আসবে সেই শুভদিন_সে-ও উঠতে পারবে সমুদ্ধের উপরে, দেখতে পারবে উপরকার পৃথিবীর সব কাণ্ড । যা-ই হোক বড়োটির যখন যাবার সময় হল সে কথা দিল, ফিরে এসে বোনদের কাছে সব গল্প বলে বুড়ো ঠানদি বিশেষ কিছু বলতেই পারেন না, আর তারা যে কত জানতে চায় তার তো অন্তই নেই।
কিন্তু ছেলেবয়েসের এই বাধা থেকে ছাড়া পাবার আগ্ুহ সবচেয়ে ছোটটির মতো আর কারুরই তেমন তীব নয়। সবচেয়ে বেশি দেরি তারই_আর চুপচাপ একা বসে কী ভাববে সে? কত রাত খোলা জানলা দিয়ে স্বচ্ছ নীল জলের দিকে সে তাকিয়ে রয়েছে, চারদিকে মাছেরা ছুটোছুটি করে খেলা করছে, দেখেছে সে সূর্য আর চাদ, স্লান তাদের আলো; উপরে কেমন দেখায়-_তার চেয়ে হয়তো অনেকটা বড়ো, অনেকটা উজ্জ্বল। যদি হঠাৎ কালো ছায়া পড়েছে_-একটা তিমি বুঝি, না কি মানুষে বোঝাই একটা জাহাজ ভেসে চলে গেল। সে-সব মানুষ ভাবলে না যে তাদের অনেক, অনেক \”দিনের ছোট এক জলকন্যা জাহাজের হালের দিকে ব্যাকুল আগ্রহে দিয়েছে লম্বা হাত দুটো বাড়িয়ে।
তারপর সেই দিন এল। বড়ো মেয়েটির বয়েস হল পনেরো, উঠল সে সমুদ্রের উপরে।
ওঃ, ফিরে এসে তার হাজার গল্প ! সবচেয়ে ভালো লেগেছে তার টাদের আলোয় বালির উপর বসে মস্ত শহরটার দিকে তাকিয়ে থাকতে, সেখানে তারার মতো ঝিলিমিলি কত আলো আর কত গানবাজনা। দূর থেকে সে শুনেছে মানুষের আর গাড়ির শব্দ, দেখেছে মন্দিরের উচু চুড়ো, শুনেছে ঘণ্টার শব্দ; আর ওখানে যেতে পারবে না বলেও ও-সব জিনিসের জন্যে তার আরো বেশি মন-কেমন করছে।
এ-সব গল্প শুনতে-শুনতে ছোটটির নিঃশ্বাস পড়ে না। এর পর রাত্রে তার খোলা জানলায় যখন সে দীড়ায়, জলের ভিতর দিয়ে উপরে তাকিয়ে সে সেই বিরাট শব্দময় শহরের কথা ভাবতে-ভাবতে এমন তয় হয়ে যায় যে তার মনে হয় সে বুঝি মন্দিরের খবণ্টার শব্দ শুনতে পাচ্ছে।
পরের বছর দ্বিতীয় বোনটি পেল ছাড়া । সে যখন ভেসে উঠল সমুদ্রের উপর সূর্য তখন অস্ত যায়-যায় আর তা দেখে এত ভালো লাগল তার যে সে ফিরে এসে বলল, জলের উপরে যা কিছু তার চোখে পড়েছে, এত সুন্দর আর কিছুই নয়।
“সমস্ত আকাশ একেবারে সোনায় সোনা” সে ফিরে এসে বলল । “আর মেঘগুলো কী যে সুদর তা আমি বলে দেখাতে পারব না__এই লাল, এই বেগুনি, এই কাজল-কালো, ভেসে মিলিয়ে গেল আমার মাথার উপর দিয়ে। কিন্তু আরো তাড়াতাড়ি উড়ে এল জলের উপর ৯ ১ তাদের দিকে, সূর্য অস্ত গেল; সমুদ্বের ঢেউয়ে-ঢেউয়ে আর মেঘের ধারে-ধারে যে-গোলাপি আভা, তা-ও গেল আস্তে-আস্তে মিলিয়ে।
তৃতীয় বোনের উপরে যাবার সময় হল। সবচেয়ে বেশি সাহস তারই, সে চলল এক নদীর স্লোত ধারে-ধারে। নদীর দুধারে ছোট ছোট সবুজ পাহাড়; সেখানে গাছ-পালা, সেখানে আঙুর-খেত, ফাকে-ফাকে ঘর, বাড়ি, প্রাসাদ। সে শুনল পাখির গান; আর সূর্যের তাপে তার মুখ প্রায় পুড়ে গেল, থেকে_থেকে তাই তাকে জলে ডুব দিয়ে নিতে হল। এক জায়গায় একদল ছেলে-মেয়ে লাফালাফি করে সান করছে; তার খুব ইচ্ছে হল ওদের সঙ্গে গিয়ে খেলে, কিন্তু ওরা ছুটে পালাল বিষম ভয় পেয়ে, আর ছোট কালো একটা জানোয়ার তাকে দেখে এমন ঘেউ-ঘেউ করতে লাগল যে অগত্যা সে-ও ভয় পেয়ে ফিরে এল সমুদে। তবু সে ভুলতে পারে না সেই সবুজ বন, আর নীলায়িত পাহাড়। আর ফুটফুটে ছেলে-মেয়েরাই-বা কী, পাখনা নেই, তবু কেমন নির্ভয়ে নদীতে সাতরে বেড়ায়!
চতুর্থ বোনটির অত সাহস হল না, সে খোলা সমুদ্রেই রইল; ফিরে এসে বলল, অত সুদর আর কিছুই হতে পারে না। শাদা-পাল-তোলা জাহাজ দূর দিয়ে ভেসে গেছে,_ এত দূরে যে মনে হয়েছে যেন এক ঝাক গাংচিল; জলে খেলা করছে ফৃর্তিবাজ শুশুকের দল; বিরাট তিমি এক নিম্বাসে হাজারটা ফোয়ারা তুলে দিয়েছে আকাশে ।
পরের বছর পঞ্চম বোনটির পনেরো বছর হল। তার জন্মদিন পড়ল শীতকালে; সমুদ্রের তখন সবুজ রঙ, প্রকাণ্ড সব বরফের পাহাড় জলে ভাসছে। সে বলল সেগুলো ঘুক্তোর মতো শাদা দেখতে__অবিশ্যি মানুষের দেশের মন্দিরগুলোর চেয়ে ঢের বেশি বড়ো। এরই এক পাহাড়ের চুড়োয় বসে সে বাতাসে তার চুল দিলে খুলে, জাহাজ গুলো তাড়াতাড়ি পাল তুলে দিয়ে যত শিগৃগির পারল ছুটে পালাল।
সন্ধেবেলায় সমস্তটা আকাশ পালে-পালে ভরে গেল; বরফের বিরাট পাহাড়গুলো এই উঠছে, এই ডূবছে, নীল-লালচে একটা আভায় উঠেছে ঝিকঝিকিয়ে, আর মেঘ চিরে বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল, গুম্গুম্ করে বাজের আওয়াজ চলল গড়িয়ে। তক্ষুনি নামানো হল সব জাহাজের পাল, সবাই সেখানে ভয়ে জড়োসড়ো; শুধু রাজকন্যা চুপচাপ বসে আকাবাকা বিদ্যুতের দিকে শাস্তচোখে তাকিয়ে রইল।
এরা সকলেই প্রথমবার উঠে নানারকম নতুন সুন্দর জিনিস দেখে গেল মুগ্ধ হয়ে, কিন্ত সে নতুনের মোহ শ্রিগ্গিরই কেটে গেল। কিছুদিনের মধ্যেই উপরের র চাইতে নিজের বাড়িই তাদের ভালো লাগতে আরম্ভ করল-_আর কোথাও কি সবকিছু এমন মনের মতো পাওয়া যায়?
প্রায়ই সন্ধেবেলায় পাচ বোন হাতে হাত রেখে গভীর জল থেকে উঠে আসত! অপরূপ জরে বোর চনুজেআারেজারা রানির তারা যেত সাতরে-__গান গাইত কী মধুর, কী অপরূপ মধুর সুরে ! সে-গান যেন বলত,_ জলের নিচে আমাদের কী যে আনন্দ তা কি দেখবে না ওগো নাবিক, ভয় করো না; এস, নিচে নেমে এস আমাদের কাছে।
নাবিকরা অবিশ্যি সে-কথা বুঝতে পারত না; তারা ভাবত এ শব্দ বুঝি শুধু জলের শিস, এমনি করে তারা সমুদ্রের লুকানো এম্বর্য ছাড়িয়ে আসত কেননা জাহাজ সবাই তো মরবে, আর মৃত মানুষ ছাড়া সাগর-রাজের প্রাসাদে কেউ কখনো | একা স্তব্ধ হয়ে মুখ উচু করে তাকিয়ে কাদতে ইচ্ছে করে তার, কিন্তু জলকন্যারা তো কাদতে পারে নাঃ সেইজন্যে, তাদের যখন মন খারাপ হয়, মানুষের মেয়েদের চাইতে কত বেশি যে কষ্ট পায় তারা, তার অস্ত নেই।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে ভাবে, “কবে হবে আমার পনেরো বছর ! আমি ঠিক জানি, উপরের পৃথিবী আর সেখানকার মানুষদের খুবই ভালো লাগবে আমার\”
শেষ পর্যস্ত এত আশার সেই সময় এল।
ঠানদি বললেন, “নে, এবার তোর পালা। আয় তোকে তোর বোনেদের মতো করে সাজিয়ে দিই, বলে তিনি তার চুলে জড়ালেন সাদা শাপলার মালা, আধখানা মুক্তো দিয়ে তৈরি তার এক-একটা পাপড়ি: তারপর আটটা বড়ো-বড়ো ঝিনুককে হুকুম করলেন তার লেজের সঙ্গে লাগতে__তাতে বোঝা যাবে সে কত বড়ো ঘরের মেয়ে !
“বড়ো অসুবিধে লাগে এতে\”, ছোট্ট রাজকন্যা আপত্তি করল।
“সুন্দর দেখাতে হল এক-আধটু অসুবিধে গায়ে না মাখলে চলে না ভাই”, ঠানদি হেসে বললেন।
এত জীক-জমক কিন্তু রাজকন্যার বড়ো পছন্দ হল না; মাথার ভারি মুক্টটা বদলে তার বাগানের লাল ফুল পরতে পারলে সে খুশি হত, তাতে তাকে মানাতও ঢের ভালো। কিন্তু সে সাহস পেল না; ঠানদির কাছে বিদায় নিয়ে সমুদ্ধের উপর ভেসে উঠল সে, ফেনার মতো হালকা।
যখন জলের উপর জ্বীবনে প্রথম সে দেখা দিল, সূর্য ঠিক দিগন্তে নেমে গেছে। মেঘেরা জ্বলছে লাল-সোনালি আলোয়, সন্ধ্যাতারা ফুটেছে পশ্চিমের আকাশে, ঝিরঝিরে হাওয়া বইছে, আর সমুদ্রটা মস্ত একটা আয়নার মতো নিশ্চল পড়ে। তিনটে মাস্ত্বলওলা এক জাহাজ ঠাণ্ডা জলের উপর চুপ করে শুয়ে একটি পাল শুধু তুলে দেয়া, সেটাও কিন্ত নড়ছে না, হাওয়ার বেশি জোর নেই। নাবিকেরা সিঁড়িতে চুপচাপ বসে। ডেক থেকে আসছে গান_বাজনার শব্দ। তারপর অন্ধকার হল, হঠাৎ একসঙ্গে হাজার আলো জ্বলে উঠল, জাহাজে উড়ল অগুনতি নিশান।
ছোটো জলকন্যা কাণ্তেনের ঘরের কাছে গেল সাতরে। জাহাজটা জলের দোলানির সঙ্গে সঙ্গে আস্তে ওঠা-নামা করছে, একবার সে উকি মেরে কাচের জানলা দিয়ে তাকাল। ভিতরে অনেক জমকালো পোশাক-পরা মানুষ” তাদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর এক রাজপুত্র। খুব অল্প বয়েস তার, বড়ো জোর ষোলো; বড়ো-বড়ো কালো তার চোখ। তারই জন্মদিনের উৎসব আজ । নাবিকেরা ডেকের উপর নাচছে, আর রাজপুত্র তাদের সামনে বেরিয়ে আসতেই একশো হাউই আকাশে লাফিয়ে উঠল, রাত হয়ে গেল দিন। জলবন্যা তাতে এতই ভয় পেলে যে খানিকক্ষণ সে চুপ করে রইল জলে ডুবে।
আবার যখন সে তার ছোট মাথাটি তুলল, তার মনে হল যেন আকাশের সব তারা তার গায়ের উপর ঝরে পড়ছে। এমন সে আর কখনো দেখেনি; সে কখনো শোনেওনি এমন আশ্চর্য ক্ষমতা মানুষের আছে! তাকে ঘিরে ঘুরছে যেন বড়ো বড়ো সূর্য, বাতাসে সাতরে বেড়াচ্ছে জলজলে মাছ, আর সমুদের শান্ত জলে পড়ছে তার পরিক্ষার ছায়া। জাহাজে এত আলো যে স্পষ্ট সব দেখা যায়। কী সুখী এই রাজপুত্র, কী সুখী! সে নাবিকদের অভিনন্দন গ্রহণ করল, একটু হাসি-ঠাট্রা করল তাদের সঙ্গে, এদিকে গানের মধুর সুরগুলো রাত্রির নীরবতায় গেল মিলিয়ে।
রাত বাড়ল; কিন্ত এই জাহাজ আর এই সুন্দর রাজপুত্রকে ছেড়ে সে যেন নড়তে পারছে না। ঢেউয়ের দোলা-লাগা কেবিনের ফুটো দিয়ে সে তাকিয়েই রইল। জল ফেনিয়ে উঠছে, জাহাজ বুঝি ছাড়ল। ওই তো তুলে দিয়েছে পাল, উচু হয়ে উঠছে ঢেউ, মোটা-মোটা মেঘে আকাশ ছেয়ে গেল, দূর থেকে শোনা গেল বাজের আওয়াজ ।
নাবিকেরা যেই দেখতে পেল ঝড় আসছে, অমনি তারা আবার পাল দিল নামিয়ে। ঝড়ের সমুদ্ধে মস্ত জাহাজটা হালকা এতটুকু নৌকোর মতো দুলছিল; ঢেউগুলো অসম্ভব উচু হয়ে জাহাজের উপর দিয়ে গেল গড়িয়ে-__একবার সে নিচে ডুবে যায়, একবার সে মাথা তুলে ওঠে।
এ-সব ব্যাপারে জলকন্যার অবিশ্যি খুবই মজা লাগল, কিন্ত নাবিকদের সবাই একেবারে ভয়ে জড়োসড়ো। জাহাজ গেল ফেটে, মোটা মাস্তুলগুলো ঢেউয়ের দাপটে পড়ল নুয়ে, জোরে জল ঢুকতে লাগল। জাহাজ একটুখানি এদিক-ওদিক দুলল, তারপর বড়ো মাস্তুলটা বাশের কঞ্চির মতো গেল ভেঙে; জাহাজ উল্টিয়ে গিয়ে জলে ভরে উঠল। জলকন্যা এতক্ষণে নাবিকদের বিপদ বুঝতে পারল; কেননা ভাগ্ডা জাহাজের মোটা-মোটা কাঠ ঢেউয়ে-ঢেউয়ে ভেসে পাছে তার গায়েই লাগে, সেজন্যে তাকে সাবধানও হতে হল।
কিন্তু ঠিক তখনই একেবারে ঘুটঘুটি অন্ধকার হয়ে এল, চোখে আর কিছু দেখা যায় না। একটু পরেই ভয়ংকর এক বিদ্যুতের চমকে সে সমস্তটা ভাঙা জাহাজ দেখতে পেল। জাহাজ যেন তলিয়ে গেল জলের নিচে-_তার চোখ রন রাজপুরকে। প্রথমটা সে খুশিই হল; ভাবলে, এখনত সে আমার বাড়িতেই আসবে। কিন্তু একটু পরেই তার মনে পড়ল যে জলের নিচে তো মানুষ ধাচে না; কাজেকাজেই রাজপুত্র যি-বা কখনো তার প্রাসাদে ঢোকে, ঢুকবে মৃত মানুষ হয়েই।
“না না, রাজপুত্র মরবে না, মরবে না! নিজের বিপদের কথা ভুলে ভাঙাচোরা টুকরোর ভিতর দিয়ে সে সাতরে গেল, শেষ পর্যন্ত খুজে পেল রাজপুত্রকে। সে একেবারে তখন অবসন্ন হয়ে পড়েছে, অতি কষ্টে জলের উপর রেখেছে মাথা তুলে। হাত-পা ছেড়ে দিয়ে সে চোখ বুজে ছিল-_নিশ্চয়ই ভুবে মরত যদি-না ঠিক সেই মুহূর্তে জলকন্যা এসে তাকে ধাচাত। সে তাকে দুহাতে জলের উপর তুলে ধরল, স্রোতে ভেসে চলল দুজনে ।
সকালের দিকে ঝড় ঠাণ্ডা হল, কিন্তু জাহাজটার কোনো চিহৃই পাওয়া গেল না। সমুদ্রের ভিতর থেকে সূর্য উঠল আগুনের মতো, তার আলোয় রাজপুত্রের গালের আভা ফিরে এল যেন। কিন্তু চোখ তার তখনো বোজা। রাজকন্যা তার উচু কপালে চুমু খেল, ভিজে চুল সরিয়ে দিল মুখ থেকে। সে যেন তার বাগানের শ্বেতপাথরের মূর্তির মতোই দেখতে। সে আর-একবার চুমু খেয়ে মনে মনে প্রার্থনা করল রাজপুত্র শিগগির যেন ভালো হয়ে ওঠে।
তারপর সে দেখতে পেল শুকনো ডাঙা, পাহাড়গুলো বরফে চিকচিক করছে। পাড়ের ধার দিয়ে-দিয়ে চলেছে সবুজ বন, আর বনে ঢোকবার মুখে একটা মঠ কি মন্দির__কী যে ঠিক বোঝা গেল না। ঢোকবার পথটির দুধারে সারি-সারি খেজুর, পাশের বাগানে লেবুগাছের ভিড়। এখানে ছোটো একটি উপসাগর, জল গভীর হলেও খুব শান্ত, পাহাড়ের নিচে শুকনো শক্ত বালি। এখানে ভেসে এসে লাগল জলবন্যা। মরো-মরো রাজপুত্রকে নিয়ে, মাথা উঁচু করে তাকে শোয়াল গরম বালুতে, সূর্যের দিকে ফেরাল তার মুখ।
মন্দিরে ঘণ্টা বাজল ঢং ঢং করে, একদল মেয়ে বাগানে ব্রিয়ে এল বেড়াতে । জলকন্যা তাড়াতাড়ি সরে গিয়ে কতগুলো পাথরের পিছনে লুকোল, ফেনায় ঢাকল মাথা, তাতে তার ছোট মুখটি কেউ আর দেখতেই পেল না। কিন্তু আড়ালে থেকে সে চোখ রাখল
রাজপুত্রেরই ওপর ।
একটু পরেই একজন মেয়ে এগিয়ে এল । রাজপুত্রকে দেখে সে যেন ভয় পেয়েই গেল, সে মনে করল ও মরে গেছে। নিজেকে সামলে নিয়ে সে ছুটে গিয়ে তার বোনদের ডেকে আনল। জলকন্যা দেখল, রাজপুত্র তাজা হয়ে উঠেছে, মেয়েরা সব তার মুখের উপর মুখ নিচু করে হাসছে। কিন্তু রাজপুত্র চোখ মেলে অবিশ্যি তাকে না, সে তো আর জানে না কে তাকে বাচিয়েছে ! আর তাকে যখন মন্দিরের ভিতরে নিয়ে যাওয়া হল, এত খারাপ লাগল জলকন্যার মন যে তৎক্ষণাৎ ঝুপ করে জলে ডুব দিয়ে ফিরে গেল তার বাপের প্রাসাদে ।
ফিরে এসে সে যেন আগের চেয়েও বেশি শাস্ত, বেশি চুর্প-চাপ হয়ে গেল। বোনেরা জিজ্ঞেস করলে সে উপরের পৃথিবীতে কী-কী দেখে এল, কোনো জবাব দিল না সে।
যেখানে রাজপুত্রকে রেখে এসেছিল সেখানে কত সন্ধ্যায় সে গিয়ে উঠত। সে দেখত পাহাড়ের বরফ গলছে, বাগানে পেকে উঠছে ফল; কিন্তু রাজপুত্রকে কখনো দেখত না, ফিরে যেত স্নান মুখে সমুদ্রের তলায়। বাগানে বসে-বসে রাজপুত্রের মতো সেই পাথরের মূর্তির দিকে তাকিয়ে থাকা হয়ে উঠল তার একমাত্র আনন্দ। ফুলগুলোর জন্যে তার আর লম্বা-লম্বা লতাগুলো গাছের ডালে ডালে এমন করে জড়িয়ে ফেলল যে সমস্ত বাগান যেন একটি কুঞ্জবন হয়ে গেল।
তারপর আর সে তার মনের দুঃখ চেপে রাখতে পারল না। বলে গোপন কথাটা এক বোনকে, সে বলল অন্য বোনেদের, তারা বলল তাদের কোনো-কোনো বন্ধুকে। তাদের মধ্যে এক জলকন্যা রাজপুব্রের কথা শুনেই বুঝতে পারল,__জাহাজের উৎসব সে দেখেছিল নিজের চোখে রাজপুত্র কোন্ দেশের, কে সেখানকার রাজা, সব জানা ছিল তার।
“আয় বোন, বলে জলকন্যারা তাকে জড়িয়ে ধরল। একসঙ্গে হাতে হাত ধরে তারা ভেসে উঠল ঠিক সেই রাজপুত্রের প্রাসাদের সামনে উঠে গেছে। মাথায় সোনার গম্বুজ; বিরাট থামগুলোর ফীাকে-ফীকে শ্বেতপাথরের মূর্তিগুলো হঠাৎ দেখলে সত্যিকারের মানুষ বলেই মনে হয়। উচু জানলাগুলোর পরিষ্কার কাচের ভিতর দিয়ে দেখা যায় মখমলের পরদা-ঝোলানো শিলার ঘর, দেয়ালে জমকালো ছবি। সাগ্রর-রাজার মেয়েদের পক্ষে এমন অপরূপ দৃশ্য দেখা মস্ত একটা ফুর্তির ব্যাপার; সবচেয়ে বড়ো একটা ঘরের জানলা দিয়ে তাকিয়ে তারা দেখল মাঝখানে এক ফোয়ারা খেলছে, তার জল উঠছে ছিটিয়ে উপরের ঝকমকে গম্বুজ পর্যন্ত; ফাক দিয়ে সূর্যের আলো ঝিলকিয়ে পড়ে নাচছে জলে, চিকচিক করছে চারদিকের সুন্দর গাছপালা |
এখন জলকন্যা জানল কোথায় থাকে তার প্রিয় রাজপুত্র এখন থেকে প্রায় রোজ সন্ধ্যায় সে সেখানে যায়। সাহস করে বাড়ির যতটা সে যায়, অতটা যায় না আর-কোনো বোন; শ্বেতপাথরের বারান্দার তলা দিয়ে যে-ছোটো খাল গেছে, একদিন সে তা দিয়েও সাতরে গেল খানিকটা। এখানে, উজ্জ্বল জোছনার র্যত্রে বসে-বসে সে বাজপুত্রকে দেখে, রাজপুত্র তো তাকে দেখতে পায় না, সে’জানে নিজে সে একা-একা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।
কখনো রাজপুত্র বেড়াতে বেরোয় রঙ-করা শৌখিন নৌকোয়, উপরে ওড়ে নানারঙের নিশান। জলকন্যা লুকিয়ে থাকে পাড়ের সবুজ বাশ-বনে, কান পেতে শোনে তার কথা;
তার রুপোলি ঘোমটা মাঝে মাঝে হালকা হাওয়ায় উড়ে যায়, তার খসখসানি নৌকোর কেউ যদি শোনে, মনে করে ঝুঝি একটা হাসের ডানা-ঝাপটানি কেঁপে গেল।
কোনো-কোনো রাত্রে জেলেরা মশালের আলোয় মাছ ধরে; রাজপুত্রের কথাই বলাবলি করে তারা, কত তার মহৎ কীর্তি। সে-সব কথা শুনতে-শুনতে জলকন্যার মন সুখে ভরে ওঠে, ঢেউয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে সে-ই তো তাকে বাচিয়েছিল, আর সে শুয়েছিল তার হাতের উপর অবশ মাথা রেখে__কিস্ত সে তো তা জানে না, কিছুই জানে না, স্বপ্নেও ভাবতে পারে না।
সব মানুষ জলকন্যার ক্রমেই প্রিয় হয়ে উঠতে লাগল। আহা, সে যদি মানুষ হত ! কত বড়ো মানুষের পৃথিবী, সমুদ্রের উপর দিয়ে জাহাজে করে তারা উড়ে যায়, মেঘ-মাড়ানো জলকন্যার চোখ যায় না।
অনেক জিনিসের মানে সে বুঝতে চায়, কিন্তু তার বোনেরা ভালো করে জবাব দিতে পারে না। যেতে হল আবার তাকে বুড়ি ঠানদির কাছে__তিনি তো “সমুদ্বের উপরের দেশের’ অনেক খবর রাখেন।
“যে-সব মানুষ ডুবে মরে না তারা কি চিরকাল বাচে? আমরা যারা সমুদ্রের তলায় থাকি__আমাদের তো তারাও কি মরে না?
ঠানদি উত্তর দিলেন, “মরে বই কি। আমাদের মতো মরতে হবে তাদেরও, তাদের জীবন আমাদের চাইতে অনেক ছোট । আমরা বাচি তিনশো বছর, তারপর মরে সমুদ্রের ফেনা হয়ে ভেসে বেড়াই। অমর আত্মা নেই আমাদের, নেই পুনর্জন্ঘ; একবার কেটে ফেলা ঘাসের মতো আমরাও চিরকালের মতো যাই শুকিয়ে। কিন্তু মানুষের বেলায় শরীর ধুলো হয়ে গেলেও আত্মা থাকে ধেঁচে; আমরা যেমন মানুষের বাড়ি-ঘর দেখবার জন্যে জল থেকে উঠি, তারা ওঠে উপর-আকাশের অজানা অপরূপ রাজ্যের দিকে, যাকে বলে তারা স্বর্গ–আমরা তা দেখতে পারি না।’
“আমাদের আত্মা নেই কেন? ছোট্ট জলকন্যা জিজ্ঞেস করল। “আমি তো অনায়াসে তিনশো বছরের আয়ু ছেড়ে দিতে পারি, যদি একদিনের জন্যেও মানুষ হয়ে বাচতে পাই, যদি পাই স্বর্গের সেই বাড়ির খোজ !»
ঠানদি বলল, “এ-সব কথা ভূলেও মনে আনিস না। ঢের ভালো আছি আমরাই; কত বেশিদিন বাচি, কত সুখে থাকি ! চুরমার করে ভেঙে উড়িয়ে দেবে হাওয়ায়, আর কখনো মাথা তুলে শুনব না সমুদ্রের গান, কখনো দেখব না সুন্দর ফুলগুলো আর এই উজ্জ্বল সূর্য। আচ্ছা ঠানদি, অমর আত্মা কি দি
পাগল! এ সত্যি কথা যে যদি কোনো মানুষ তোকে এত ভালোবাসে যে তার বাপ-মার চেয়েও তুই প্রিয় হয়ে উঠিস, যদি সে সমস্ত প্রাণ দিয়ে তোকেই চায়, আর বিবাহের মন্ত্র পড়ে, শপথ করে বলে যে চিরকাল তোকেই ভালোবাসবে স্; তাহলে অবিশ্যি তার আত্মা উড়ে আসবে তোর মধ্যে, মানুষের সার্থকতা তুই, জানবি। কিন্তু তা কি কখনো হতে পারে? আমাদের চোখে আমাদের শরীরের সবচেয়ে সুন্দর অংশ যেটা, সেই লেজটাই তো তাদের চোখে পরম কুৎসিত, তারা ওটাকে মোটেই সহ্য করতে পারেনা। শরীরের সঙ্গে দুটো বিদঘুটে খুঁটি না-থাকলে নাকি ওদের চোখে সুন্দর দেখায় না_ যাকে ওরা বলে পা।
দীর্ঘবাস ফেলে জলকন্যা নিজেই শরীরের দিকে তাকাল : এমন সুন্দর, এমন নরম-__কিন্ত এ তো একটা আশওয়ালা লেজ !
ঠানদি বললেন, “সুখী তো আমরাই! তিনশো বছর আমরা হেসে খেলে, লাফিয়ে-সাতরে বেড়াব__সেটা অনেক কাল- তারপর মরব নিশ্চিত হয়ে। আজ রাত্রে সভায় একটা নাচ আছে যো?”
রানি-মা ফে-নাচের কথা বললেন, অমন জমকালো ব্যাপার পৃথিবীতে অবিশ্যি কখনো দেখা যায় নি। সবার দেয়ালগুলো সব স্ফটিকের, যেমন পুরু তেমনি স্বচ্ছ। তাদের গায়ে সারে-সারে হাজার-হাজার শঙ্খ বসানো, কোনোটার গোলাপি রং ঘাসের মতো সবুজ কোনোটা; কিন্তু সবগুলোরই ভিতর থেকে তীবু আলো বেরিয়ে আসছে, তাতে সমস্তুটা ঘর তাতে ঝলমল করে উঠছে লাখ-লাখ মাছের আশ_-কোনোটা লাল, কোনোটা বেগুনি, কোনোটা সোনালি কি কপোলি, একটা ছোট, একটা-বা বড়ো।
সভার মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে স্বচ্ছ উজ্জ্বল একটা গ্রোতি, তারই উপর নাচছে দলে-দলে জলপুরুষ আর জলবন্যা, তাদেরই নিজেদের অপরূপ কষ্ঠশ্বরের তালে-তালে; অমন মধুর নাচের ভঙ্গি পৃথিবীতে কখনো দেখা যায়নি। তারি মধ্যে ছোট রাজকন্যাটির গলায় যেন সুরের ফোয়ারা, তেমন তো আর-কারো নয় ! হাততালি দিয়ে তাকে ধন্যবাদ জানাল সবাই।
এতে সে খুশিই হল। সমুদ্রে কি পৃথিবীতে তার চেয়ে অপরাপ স্বর কোনোখানেই নেই, এ সে ভালো করেই জানে। একটু পরেই সে উপরকার পৃথিবীর কথাই ভাবতে লাগল; সুন্দর রাজপুত্রকে ভুলতে পারে না সে, তার যে অমর আত্মা নেই এ_দুঃখ সামলাতে পারে না সে। পিতার প্রাসাদ থেকে পালিয়ে এল স্ ভিতরে যখন বয়ে চলেছে উৎসবের স্রোত, তার ছোট্ট উপেক্ষিত বাগানে গিয়ে বসে রইল সে চুপ করে।
হঠাৎ সে শুনল শিঙার ফুঁয়ের শব্দ জলের উপর দিয়ে কাপতে কাপতে দুর-দুরাস্তরে মিলিয়ে গেল। মনে মনে বলল সে, “এই বুঝি সে বেরুল শিকারে__যাকে আমি বাপ-খার চেয়েও বেশি ভালোবাসি, সবসময় ভাবি যার কথা, যার মধ্যে আমার জীবনের সব আনন্দ জমে রয়েছে। সব, সব বিপদ আমি নেব__তাকে যদি পাই, আর পাই সেই সঙ্গে অমর আত্মা। আমার বোনেরা নাচুক রাজসভায়, আমি যাব সেই ডাইনির কাছেই__চিরকাল তাকে নিদারুণ ভয় করেই এসেছি কিন্তু এখন সে ছাড়া আমার তো উপায় নেই আর !*
গেল সে বাগান ছেড়ে। ফেনিয়ে-ওঠা যে ঘুর্ণি ছাড়িয়ে ডাইনির বাসা, গিয়ে দাড়াল তার ধারে। এপথে সে আগে কখনো আসেনি। এ-পথে ফোটে না ফুল, সাগর-ঘাস মাড়াতে হয় না। পার হয়ে আসতে হল ধু-ধু ধূসর বালিরাশি, তারপর ঘুর্ণি। তার জল রেল-গাড়ির চাকার মতো ফৌসফৌস করে ঘুরছে-_যা-কিছু কাছে পায়, টেনে ছিড়ে নিয়ে যায় অতল পাতালে। সে জায়গা দিয়েই যেতে হল তাকে। ডাইনির দেশে যাবার আর পথ নেই যে। তারপর পার হতে হল একটা ডোবা । লিকলিকে পিছল কাদাুলো টগবগ করে ফুটছে। ডাইনি এটাকে নাকি বলে তার খেলার মাঠ। এরপরে একটা বনের মধ্যে তার বাসা__ বাসাখানাও অদ্ভুত।
চারদিকে যত গাছ আর ঝোপঝাড় সব ফণিমনসার জাত : যেন লক্ষমুণ্ড এক-একটা সাপ ফণা উচু করে াড়িয়ে : ডালগুলো ঠিক লম্বা লিকলিকে হাতের মতো, আঙুলগুলো জ্যান্ত পোকা। মূল থেকে মাথা পর্য্ত প্রতি অঙ্গ সমস্ত দিকে অবিশ্রাস্ত নড়ছে, বাড়িয়ে দিচ্ছে নিজেকে। যা-কিছু তারা ধরে, এমন করেই আকড়ে ধরে যে জন্মেও সে সব আর ছাড়ানো যায় না।
নি রাজ াজে লক দাড়িয়ে রইল। ভয়ে টিপটিপ করতে লাগল তার বুক। নিশ্চয়ই সে তখনই ফিরে যেত, যদি-না তার মনে পড়ত রাজপুত্রের কথা আর অমরতা! কথাটা ভেবে তার সাহস বেশ বেড়ে গেল। সে বেধে নিল তার লম্বা চুল, যাতে ফণিমনসায় আটকে না যায়। বুকের উপর হাত দু-টি চেপে ধরে মাছের মতো দ্রুতবেগে জলের ভিতর দিয়ে শো করে চলে গেল সে; পার হয়ে এল বিদঘুটে গাছগুলো, খামকাই তারা পিছনে ব্যগ্র হাত বাড়াল।
এটা অবিশ্যি সে লক্ষ না করে পারলে না যে প্রত্যেকটি গাছের মুঠোর মধ্যে কিছু-না-কিছু আকড়ে ধরা, হাজার ছোট ছোট হাত লোহার বেড়ির মতো শক্ত হয়ে চেপে বসেছে। সমুদ্রে ডুবে মরে কত মানুষ এই পাতালে তলিয়ে গেছে; তাদের সাদা-সাদা কক্কাল এই ফণিমনসার মুঠোর মধ্যে থেকে বিকট প্লাঁত বার করে হাসছে। তারা জড়িয়ে রয়েছে ডাঙার জন্তদের কত-কত মুণ্ডু বুকের গাজর, আর আস্ত কঙ্কাল। নানা জিনিসের মধ্যে একটি জলকন্যাও দেখা গেল; তাকে তারা আঁকড়ে ধরে গলা টিপে মেরেছে। কী ভীষণ দৃশ্য বেচারা ছোট্ট রাজকন্যার চোখের সামনে !
যাই হোক, এই আতঙ্কের বনের ভিতর দিয়ে সে নির্বিদ্বে পার হল। তারপর পিছল কাদা-ভরা একটা জায়গা, মস্ত মোটা মোটা শামুকেরা সেখানে সুড়সুড় করে বেড়াচ্ছে, আর তারই মাঝখানে ডাইনির ঝাড়ি__যত দুর্ভাগা জাহাজ ডুবে মরেছে, তাদের হাড় দিয়ে তৈরি। এখানে বসে ডাইনি কুচ্ছিৎ একটা কোলাব্যাংকে আদর করছিল, আমরা যেমন পোষা পাখিকে আদর করি। বিকট মোটা মোটা শামুকগুলোকে সে পায়রা বলে ডাকে__তারা তার সারা গায়ে অনায়াসে হাত-পা ছড়িয়ে বেড়ায়।
ডাইনি বলল, কী চাও তুমি আমার কাছে তা আমি জানি। তুমি আস্ত একটা বোকা, কিন্তু তুমি যা চাও তা-ই হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভয়ানক বিপদে পড়বে তুমি–_ওগো ফুটফুটে রাজকন্যা, এ তোমাকে আগেই বলে দিচ্ছি। লেজটা তোমার পছন্দ হচ্ছে না__ এই তো? চাও তুমি তার বদলে মানুষের মতো দুটো ঠ্যাং_এই তো? তাহলে রাজপুত্র তোমাকে ভালোবাসবেন, তুমি পাবে অমর আত্মা। তা-ই নয় কি?
এ-কথা বলে ডাইনি এত চেচিয়ে উঠল যে তার পোষা শামুক-ব্যাংগুলো চমকে লাফিয়ে তার সারা গা থেকে পড়ল ঝরে।
“ঠিক সময়ে তুমি এসেছ, ডাইনি বলতে লাগল। “যদি সূর্যাস্তের পরে আসতে তাহলে আর এক বছরের মধ্যেও তোমার জন্যে কিছু করবার সাধ্যি থাকত না আমার। তোমাকে দেব খানিকটা মন্ত্রপড়া জল,তা নিয়ে তৃমি সাতরে ডাঙায় যাবে, তীরে বসে সেটা খাবে। পা। কিন্তু মনে রেখো-_ভীষণ লাগবে, ভীষণ কষ্ট পাবে; মনে হবে তোমার শরীরের ভিতর দিয়ে কেউ ধারাল একটা ছুরি চালিয়ে নিয়ে গেল। এই রূপান্তরের পর যে যে দেখবে তোমাকে, সেঁই বলে উঠবে তুমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী কন্যা; থাকবে তোমার ভঙ্গির লাবণ্য, এত হালকা পা কোনো নর্তকীর নয়; কিন্তু প্রতিবার পা ফেলতে তোমার অসহ্য . যন্ত্রণা হবে__হাটছ যেন খোলা তরোয়ালের ধারের উপর দিয়ে, রক্ত পড়বে স্ত্রোতের মতো। পারবে তুমি এত কষ্ট করতে? যদি পারো, তাহলেই তোমার প্রার্থনা মঞ্তুর করি।’
“পারব, .পারব, ক্ষীণস্বরে বলল রাজকন্যা । মনে পড়ল তার রাজপুত্রকে, এত দুঃখে তাকেই তো পাবে সে-_আর পাবে অমর আত্মা।
ডাইনি বলতে লাগল,_“ভেবে দেখো__একবার মানুষ হয়েছ কি আর কোনোদিন জলকন্যা হতে পারবে না। পারবে না কখনো বোনদের কাছে ফিরতে, যেতে পারবে না বাপের বাড়ি। আর যদি এমন হয় যে রাজপুত্র তোমাকে এমন একাত্ত ভালোবাসল না যে তোমার জন্যে সে বাপ-মাকে ছাড়তেও প্রস্তুত হতে পারে, খদি তুমি তার সমস্ত ভাবনায় তাহলে যে অমরতা তুমি চাও তা কখনো পাবে না, কখনো না। যে-রাতে রাজপুত্র অন্য একজনকে বিয়ে করবে, সে-রাত্রি ভোর হতেই তোমার মৃত্যু দুঃখে তখন ভেঙে যাবে তোমার বুক, সমুদ্ের ফেনা হয়ে ভাসবে তুমি।’
মুমূর্ুর মতো গ্লানমুখে বলল জলবন্যা, “তবুং তবু আমি সাহস করব\”
“আর-একটা কথা। আমাকেও তোমার কিছু দিতে হবে তো-__-এত কাণ্ড করা কি সহজ কথা! সমুদ্রের তলায় তোমাদের সকলের কণ্ঠই মধুর, তার মধ্যে সবচেয়ে মধুর তোমার কণ্ঠ! তা-ই দিয়ে রাজপুত্রকে মুগ্ধ করবে ভেবেছ তো? কিন্তু তোমার এই কষ্ঠস্বরই আমি চাই। তোমার মধ্যে সবচেয়ে যেটা ভালো জিনিস, তা-ই এই মন্ত্র-পড়া জলের দাম; নিজের রক্ত মিশিয়ে সেটা তৈরি করব আমি,_খোলা তলোয়ারের মতো ধার হবে তো তার সেই জন্যেই।\”
জলকন্যা বলল, “আমার কণ্ঠই যদি কেড়ে নিলে তাহলে আমার আর রইল কী? কী দিয়ে রাজপুত্রকে মুগ্ধ করব £
‘রইল তোমার অঙ্গের লাবণ্য, তোমার ভঙ্গির শ্রী, তোমার কথাভরা দৃষ্টি। এ সব জিনিস নিয়ে মানুষের তরল চিত্তকে মুগ্ধ করা সহজই হবে। বেশ! সাহসে কুলোবে তা? জিভ বার করো-_ওটা কেটে নিয়ে আমি নিজে রাখব। মন্ত্র-পড়া জলের এই দাম।’
“তা-ই হোক !’ বলল রাজকন্যা ।
ডাইনি তখন ফুটন্ত কড়াইয়ে সেই বিষ তৈরি করতে লাগল। আগে সে কড়াইটা ব্যাং শামুক দিয়ে বেশ ভালো করে মুছে নিলে; বললে, “বিশুদ্ধভাবে সব করতে হয়। তারপর তার বুকে একটু আঁচড় কাটল, কালো-কালো রক্ত গড়িয়ে পড়ল কড়াইতে আলকাতরার মতো। সঙ্গে-সঙ্গে অনেকরকম মশলা ঢালা হল তারপর কড়াই থেকে পেঁচিয়ে-পেঁচিয়ে ধোয়া উঠতে লাগল এমন বিকট বীভৎস মূর্তিতে যে দেখল ভয়ে মুদ্ যেতে হয়। তার ভিতর থেকে আবার কঁকানি-গোঙানির শব্দ আসছে-_অনেকটা কুমিরের কান্নার মতো। অনেকক্ষণ পরে মন্ত্র-পড়া জল পরিষ্কার জলেরই মতো টলটলে দেখা গেল-_ তৈরি হয়েছে।
ডাইনি বলল জলকন্যাকে, “তবে, এই নাও।’ সঙ্গে-সঙ্গে তার জিভটা টেনে কেটে ফেলল। বোবা হয়ে গেল ছোট্ট জলকন্যা-_না-পারে সে কথা বলতে, না-পারে গাইতে। যাবার সময় ডাইনি বলে দিলে, \”যদি ফণিমনসারা তোমাকে ধরতে আসে, এই জলের একটুখানি ছিটিয়ে দিয়ো__তাদের ডানাগুলি হাজার টুকরো হয়ে ছিড়ে যাবে?
কিন্তু এউপদেশের কোনো দরকারই ছিল না। চকচকে শিশিটা তার হাতে তারার মতো ঝলমল করছে-_তা-ই দেখেই ভয়ে মরে গেল ফণিমনসারা । পার হয়ে এল সে ভীষণ বন, পার হয়ে এল ডোবা, ছাড়িয়ে এল ফেনাল ঘূরণি।
এইবার সে পিতার প্রাসাদের দিকে তাকাল। নিবে গেছে সভার আলো, সবাই ঘুমিয়েছে। ভিতরে সে কেমন করে যাবে__গেলে তো কোনো কথাই বলতে পারবে না! শেষবারের মতো ছেড়ে যেতে হচ্ছে এই বাড়ি__কষ্টে তার বুক প্রায় গেল ভেঙে। লুকিয়ে সে গেল বাগানে, প্রতি বোনের কুঞ্জ থেকে একটি করে ফুল নিল ছিড়ে নিজেরই হাতে, চুমো খেল অনেকবার; তারপর জলের ভিতর দিয়ে ভেসে উঠল সে, উপরের পৃথিবীতে
তখনো সূর্য ওঠেনি। রাজপুত্রের প্রাসাদে পৌছিয়ে পরিচিত সাদা সিড়ি দিয়ে সে উঠে এল । আকাশে তখনো টাদ জ্বলছে, ছোট্ট জলকন্যা শিশিতে ভরা মন্ত্র-পড়া জল ঢেলে দিল গলায়। ধারাল ছুরির মতো সেটা যেন তার ভিতরটাকে ছিড়ে দিয়ে গেল, যুষ্ছিত হয়ে পড়ল সে। সূর্য ওঠার সঙ্গে-সঙ্গে জাগল সে; তার সমস্ত শরীর অসহ্য যন্ত্রায় পুড়ে যাচ্ছে। যাক, পুড়ে যাক ! তবু তো সে পেল তার এত আরাধনার ফল, দেখতে পেল অপরাপ রাজপুত্রকে ঠিক তার সামনে, কয়লার মতো কালো চোখ মেলে তারই দিকে তাকিয়ে লজ্জা পেয়ে নিজের চোখ সে নামিয়ে নিল। এ কী! কোথায় তার মাছের মতো৷ লেজ? কোমল মসৃণ দুটি পা নেমে এসেছে যে! কিন্তু কোনো আবরণ নেই তার : বৃথাই সে চেষ্টা করলে তার লম্বা ঘন চুল দিয়ে নিজেকে ঢাকতে।
রাজপুত্র জিজ্ঞেস করল সে কে, কী করেই-বা এখানে এল। উত্তরে সে তার উজ্জ্বল নীল চোখ দুটো বড়ো করে মেলে তাকাল, একটু হাসল-_হায়, সে তো কথা বলতে পারে না! রাজপুত্র তাকে হাতে ধরে প্রাসাদের ভিতরে নিয়ে গেল। ডাইনি ঠিকই বলেছিল, তার এমন লাগল যেন খোলা তলোয়ারের ধারের উপর দিয়ে হাটছে সে, কিন্তু সে-কষ্টটা অনায়াসেই সহ্য করল, এগিয়ে গেল সে দখিন হাওয়ার মতো হালকা পায়ে; যে দেখল তাকে সে-ই অবাক হল তার লঘু লীলার লাবণ্য দেখে।
প্রাসাদে ঢুকল সে, তার জন্যে আনা হল রেশমের আর মসলিনের বাহারে কাপড়, সেখানে যারা থাকে, তার মতো সুন্দর কেউ নয়__কিন্তু সে না-পারে কথা বলতে, না-পারে গাইতে। রাজা-রানি আর রাজপুত্রের সামনে রোজ গান করে কয়েকজন দাসী, তাদের রেশমি কাপড়ে সোনালি বুটি তোলা; তাদের মধ্যে একজনের পরিষ্কার সুন্দর গলা শুনে রাজপুত্র খুশিতে হাত-তালি দিয়ে উঠলেন। তাতে জলকন্যার মনে বড়ো কষ্ট হল : সে তো জানে এর চেয়ে ঢের বেশি সুন্দর ছিল তার গান ! সে ভাবল, “হায়রে, তার জন্যে যে আমি আমার এমন কণ্ঠস্বর চিরকালের মতো খুইয়ে বসেছি তা তা সে জানেই না!
দাসীরা নাচতে শুরু করল। তখন উঠল আমাদের জলকন্যা; লীলায়িত শুত্র দুই বান বাড়িয়ে দিয়ে মৃদুভঙ্গিতে যেন হাওয়ায় সে ভেসে বেড়াতে লাগল। প্রতিটি ভঙ্গিতে ফুটে উঠল তার অঙ্গের নিখুত লাবণ্যের ছন্দ; তার উজ্জ্বল চোখের দৃষ্টিতে যে-কথা ঝলমল করে উঠল তা দাসীদের গানের চাইতে অনেক নিবিড় হয়ে মর্মে গিয়ে বাজল।
সকলেই মুগ্ধ হল। সবচেয়ে মুগ্ধ হল ও ! সে তাকে ডাকল, “আমার কুড়িয়ে-পাওয়া লক্ষ্মী! বার-বার নাচল সে, যদিও পা ফেলতে অসহ্য যন্ত্রণা হল তার। র বলে দিল সে সব সময় তার সঙ্গে-সঙ্গে থাকবে; তারই পাশের ঘরে
মখমলের মসলিনের বিছানা পাতা হল জলকন্যার।
রাজপুত্র তাকে পুরুষের পোশাক তৈরি করিয়ে দিলেন; ঘোড়ায় চড়ে সে যখন বেরোবে এই কুডিয়ে-পাওয়াও যাবে তার সঙ্গে। এক-সঙ্গে কত সুগন্ধি বনে তারা বেড়াল, সবুজ ডালপালা ছুঁয়ে-ছুয়ে গেল কাধ, নতুন পাতার বেড়ে লুকোনো পাখিদের গানের জলসায় কী কুর্তি! উঠল জলকন্যা তার সঙ্গে খাড়া পাহাড়ে, নরম পা ফেটে রক্ত বেরুল, অনুচরেরা ছুটে এল হাঁ-হা করে। কিন্ত মুচকি একটু হেসে সে উঠল রাজপুত্রের সঙ্গে আরো উচু; সেখানে দেখা যায় মেছেরা পায়ের নিচে হেসে-হেসে গড়াগড়ি যাচ্ছে; ছুটছে এ-ওর পিছনে, যেন একঝীাক পাখি দেশাস্তরে চলেছে উড়ে! ূ এসে জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকে; তখন তার মনে পড়ে জলের নিচে তার প্রিয়জনদের
এক রাত্রে, তখন সে সিড়িতে বসে পা ধুচ্ছে, তার বোনেরা সাতরে এল সেখানটায় একসঙ্গে, হাতে হাত ধরে, গান গাইতে-গাইতে। কী করুণ সে-গান! সে ডাকলে তাদের; বোনেরা তাকে দেখেই চিনতে পারলে; সে চলে আসায় তাদের বাড়িতে কত দুঃখ সে-কথা তাকে না-বলে পারলে না। এর পর থেকে বোনেরা রোজ রাত্রেই আসে; একবার সঙ্গে করে বুড়ি ঠানদিকেই নিয়ে এসেছিল__অনেকদিন জলের উপরকার দেশটি দেখেননি তিনি। একদিন সাগর-রাজাও এলেন, মাথায় তার সোনার মুকুট কিন্তু এরা দুজন ডাঙার খুব কাছে ভিড়তে সাহস পেলেন না, মেয়ের সঙ্গে তাই কোনো কথাই বলা হল না।
এদিকে ছোট্ট জলকন্যাটি ক্রমৈই রাজপুত্রের বেশি প্রিয় হয়ে উঠছে। কিন্তু তার কাছে সে কুড়িয়ে-পাওয়া লক্ষ্্রীই, তার বেশি কিছু নয় সে; ফুটফুটে মিষ্টি খুকুমণি__তাকে বিয়ে করবার কথা তার মাথায়ই এল না! কখনো । কিস্তু বিয়ে না-করলে কী করে সে পাবে অমর আত্মা? বিয়ে তাকে করতেই হবে-__নয়-তো ফেনা হয়ে যাবে সে, ছুটতে হবে তাকে চিরকাল, সমুদ্রের অশ্রাত্ত ঢেউয়ে-ঢেউয়ে ধাকা সয়ে। র
রাজপুত্র যখন তাকে বুকে নিয়ে আদর করেন, তার চোখ যেন জিজ্ঞেস করে, তুমি কি আর-সকলের চেয়ে বেশি ভালোবাসো না আমাকে £
রাজপুত্র বলেন, “সব চেয়ে তোমাকেই তো ভালোবাসি–তোমার মতো ভালো আর কে? তুমিও তো আমাকে কম ভালোবাসো না একবার একটি মেয়েকে পলকে দেখেছিলাম, আর বোধ হয় কখনোই দেখব না__তুমি অনেকট! তার মতোও। ছিলেম একবার এক জাহাজে, ডুবল জাহাজ, ঢেউয়ের ঘা খেয়ে-খেয়ে ঠেকলাম গিয়ে তীরে এক মন্দিরের ধারে, সেখানে একদল মেয়ে পুজোআর্চা নিয়ে আছে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট্রুটি কুড়িয়ে পেল আমাকে, প্রাণ বাচাল আমার। একবার শুধু তাকে আমি দেখেছিলাম, কিন্তু তার ছবি আমার স্মৃতিতে আকা হয়ে গেছে, তাকে ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসতে পারব না। কিন্ত সে তো দেবতার সেবিকা, কী করে পাব তাকে? তুমি তার মতোই দেখতে, সেই জন্যেই বুঝি এসেছ আমাকে সান্তনা দিতে। আমাকে কখনো ছেড়ে যেয়ো না।,
জলবন্যা ফেলে ভাবল, হায় রে, সে তো জানে না আমিই তার প্রাণ বাচিয়েছিলাম! দুরন্ত ঢেউগুলোর উপর দিয়ে তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলাম বনের মধ্যে সেই মন্দিরের ধারে; বসেছিলাম পাহাড়ের আড়ালে লুকিয়ে__এক্চুনি কেউ এসে পড়বে, এই আশায়। তারপর দেখলাম সেই সুন্দর মেয়েটিকে এগিয়ে আসতে তাকেই সে ভালোবাসে আমার চেয়ে বেশি! সে আর_একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলল, জলকন্যা তো কাদতে পারে না ! “সে-মেয়ে নাকি দেবতার সেবিকা, মন্দির ছেড়ে কখনো আসতে পারবেনা, আর তো তাদের দেখা হবে না! আমি আছি সব সময় তার সঙ্গে-সঙ্গে, রোজ তাকে দেখি; আমি তাকে ভালোবাসব, সমস্ত জীবনটা উৎসর্গ করব তাকেই।”
এদিকে রাজ-অমাত্যরা বলাবলি করে, “প্রতিবেশী রাজার মেয়ের সঙ্গে আমাদের রাজপুত্রের তো বিয়ে! মস্ত জাহাজ সাজানো হচ্ছে সেই জন্যেই। সকলকে জানানো সৈন্য-সামস্ত বিস্তর যাবে সঙ্গে।’ এসব কথা শুনে জলকন্যা মুচকি হাসে; রাজপুত্রের মনের আসল ভাবখানা তার চেয়ে ভালো কে জানে !
একদিন রাজপুত্র তাকে বললেন, “আমাকে তো যেতে হচ্ছে। সুন্দরী রাজকন্যাকে দেখতে যেতেই হবে আমাকে, আমার মা-বাবার ইচ্ছে তা-ই। কিন্তু সেই মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে আনতেই হবে_-এমন কোনো জোর তারা করবেন না। অবিশ্যি আমার পক্ষে তাকে ভালোবাসাও অসম্ভব; মন্দিরের সেই মেয়ের মতো তূমি দেখতে বলে কি আর সে-ও তেমন হবে! যদি বিয়ে করতেই হয়, বরং তোমাকেই করব-_আমার কুডিয়ে-পাওয়া লক্ষ্মী, মুখে কথা নেই, চোখ-ভরা কথা! এই বলে সে তার চুলগুলো আঙুলে জড়িয়ে একটু আদর করল; সঙ্গে-সঙ্গে জলকন্যার মন মানুষের সার্থকতা আর অমর আনন্দের মধুর স্বপ্নে দোলা দিয়ে উঠল। জলকন্যাকে, জাহাজে তার পাশে গড়িয়ে, “লী খুকু, সমুদ্রে তোমার ভয় করে না তো? কত আশ্চর্ জিনিস যা ভূবুরিরা দেখে ! জলকন্যা একটু হাসল এ-সব কথা শুনে, সমুদ্রের তলায় কী আছে না আছে তা কি তার চেয়ে ভালো জানে পৃথিবীর কোনো মানুষ
রাত্রে টাদ উঠেছে আকাশে, জাহাজের সবাই ঘুমিয়ে, সমুদ্রের ভিতরে তাকিয়ে সে বসে রইল। জাহাজ চলেছে সমুদ্রকে চিরে, জল উঠছে ফেনিয়ে; সেদিকে তাকাতে-তাকাতে তার মনে হল সে যেন তার বাবার প্রাসাদ দেখতে পাচ্ছে, দেখতে পাচ্ছে তার ঠানদির রুপোলি মুকুট। তারপর দেখল তার বোনেরা জল থেকে উঠে আসছে, ভারি ম্লান তাদের মুখ, হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে তার দিকে । সে হাসল তাদের দিকে তাকিয়ে; সে যেমনটি চেয়েছিল ঠিক তেমনটি সব ঘটছে এই কথা তাদের বলতে যাবে, এমন সময় সেখানে এসে পড়ল একজন খালাসি। তাকে দেখেই বোনেরা হঠাৎ এমন ডুব দিলে জলের মধ্যে যে খালাসি ছোকরা মনে করল জলের উপর সে শুধু ফেনাই দেখছিল__আর-কিছু নয়। রোজই নতুন-নতুন আমোদ, নাচ-গান, খাওয়া-দাওয়া লেগেই আছে। কিন্তু রাজকন্যা সবরকম গুণপনা সেখানে তিনি আয়ত্ত করছেন। কিছুদিন পর তিনি ফিরলেন দেশে।
এই আশ্চর্য রাজকন্যাকে দেখতে ছোট্ট জলকন্যা কিছু উৎসুকই ছিল__যখন দেখল স্বীকার করতে বাধ্য হল-__সুন্দরী বটে, এত সুন্দর কোনো মেয়ে সে কখনো দেখেনি!
রাজকন্যার গায়ের চামড়া এমন শাদা আর নরম যে তার ভিতর দিয়ে নীল শিরাগুলো যেন স্পষ্ট ফুটে বেরিয়েছে; বাকা ভূরুর নিচে বকবক করছে কালো একজোড়া চোখ।
“চুল আমরা ডাইনিকে’, তারা বলল। “যাতে তোমাকে মরতে না-হয়, যাতে সে তোমার জন্যে কিছু করে। ডাইনি দিয়েছে এই ছুরিটা তোমার জন্যে, এই নাও। সূর্য উঠবার আগেই এটা দেবে রাজপুত্রের বুকে বসিয়ে; যেই তার গরম রক্তের ফৌটা তোমার পায়ের উপর পড়বে, তোমার লেজ আবার হয়ে যাবে। আবার হবে তুমি জলকন্যা, সমুদ্রের ফেনা হয়ে যাবার আগে বেঁচে নেবে পুরো তিনশো বছর। শিগরির করো, শিগ্রির ! সূর্যোদয়ের আগে হয় সে মরবে, কি মরবে তুমি
“বুড়ো ঠানদি আমাদের রোজই কাদে তোমার জন্যে, কাদতে কাদতে চোখ অন্ধ হয়ে গেছে তার, মাথার চুল সব পড়ে গেছে-_যেমন গেছে আমাদের চুল ডাইনির কাচিতে। মারো, মারো রাজপুত্রকে, এস আমাদের কাছে! এক্ষুনি! দেখছ-না পুবের আকাশে গোলাপি আতা, সূর্য উঠল বলে! সূর্য উঠলেই তো তোমার শেষ !
এই বলে গভীর দীর্ঘ*্বাস ফেলে তারা গেল মিলিয়ে।
বর-বধূ যেখানে শুয়ে, ছোট্র জলকন্যা তার সোনালি পরদা সরিয়ে ঢুকল; তাকিয়ে আলো প্রতি মুহূতেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। রাজপুত্র ঘুমের মধ্যে অন্ফুট-স্বরে কী বলল_ তার বধূর নাম; তার স্বপ্র সে দেখেছে, শুধু তারই__এদিকে জলকন্যার হাতে কীপছে সেই সর্বনেশে ছুরি।
হঠাৎ সে দূরে সমুদে ফেলে দিলে মৃত্যুর সেই ধারাল জিহ্বা; জ্বলস্ত লাল ঢেউগুলো লাফিয়ে উঠল সবদিকে; ঢেউয়ের উপর দিয়ে নেচে চলল যেন এক পাগলি মেয়ে, মুকুট তার টাটকা রক্তে ছোপানো। তার প্রিয়তম রাজপুত্রের দিকে শেষবার ষে-চোখ মেলে জলকন্যা তাকাল তা ক্রমেই স্থির, ঘোলাটে হয়ে এল; তারপর সে জাহাজ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল সমুদ্রে, নিশ্চিত বুঝতে পারলে যে তার শরীর আস্তে আস্তে ফেনা হয়ে গলে যাচ্ছে।
জলের বিছানা থেকে উঠল সূর্য; এমন কোমল উষ্ণ হয়ে আলোর পাপড়িগুলো পড়ল তার সারা গায়ে যে জলবন্যা প্রায় বুঝতেই পারল না যে সে মরছে। এখনো সে দেখছে জ্যোতির্ময় সূর্যকে, তার মাথার উপর ভাসছে হাজার হাজার স্বচ্ছ সুন্দর ঘূর্তি, এখনো তার চোখে ভেসে উঠছে জাহাজের শাদা পাল, অরুণ উষার আলোর নাচ। মাথার উপরে সেই জরিনা রে রেকেপচজ রে জাজ রর ভাতা কানে সে শব্দ ধরাই পড়ে না, যেমন ধরা পড়ে না মানুষের চোখে তাদের মূর্তি। তাকে ঘিরে তারা ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়াল,_যদিও পাখা তাদের নেই-_নিজেদেরই লঘৃতা ইচ্ছার বেগে তাদের ঠেলে উড়িয়ে নিয়ে যায়। শেষটায় জলকন্যা দেখল যে তার শরীরও ওদের মতো হালকা হয়ে যাচ্ছে; মনে হল কেন যেন তাকে সমুদ্রের ফেনা থেকে আস্তে আস্তে ঠেলে তুলছে উপরের দিকে।
“কোথায় আমি? যাচ্ছি কোথায়?” সে জিজ্ঞেস করল। তার কণ্ঠস্বর বেরুল, শোনাল ঠিক এ আকাশ-কন্যাদের মতো। সে শব্দ অলৌকিক, শান্ত, সিলিগ্ধ। তার মধুর কোমলতা অন্তরের গহনতলে নিবিড় হয়ে ঝরে পড়ল।
আকাশ-কন্যাদের একজন বলল, “তুমি যে আমাদের মধ্যে এসে পড়েছ! আজ হতে তুমিও যে আকাশ-কন্যা ! জলকন্যার অমর আত্মা নেই; কোনো মানুষের ভালোবাসা পেলে তার আত্মা অমর হয়ে ওঠে। তার অনস্ত জীবন অপরের ওপর নির্ভর করে“এ যে সেই\” রাজপুত্র বলে উঠল তাকে দেখেই।“এ-ই তো আমার প্রাণ বাচিয়েছিল-_ মড়ার মতো যখন পড়ে ছিলাম সমুদ্রের ধারে! সলজ্জ বধূকে সে নিলে কাছে টেনে। তারপর বোবা কুড়িয়ে পাওয়া জলকন্যাকে বলল, \”আজ আমার সুখের সীমা নেই! যা আমি আশা করতে সাহস পাইনি তা-ই হয়েছে। আমার সুখে তুমিও কি আজ সুখী হবে না? আশেপাশের সকলের মধ্যে তুমিই তো আমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসো !,
বোবা জলকন্যা দুঃখে একবার রাজপুণ্রের হাত চেপে ধরল। এখনই কেন ভেঙে যাচ্ছে তার বুঝ; যদিও সেই বিয়ের রাত এখনো ভোর হয়নি,__তার মরণের দিন ! আবার মন্দিরে জ্বলল রুপোর আগুন, পুরোহিত সোনার ধূপতিতে ধুনো দিল, বর-বধূ হাতে ধরে পিছনে ্গাড়িয়েছে। কিন্তু না-দেখছিল তার চোখ সেই শুভ অনুষ্ঠান, না-শুনছিল সে গুরুগন্তীর বিবাহের বাজনা শুধু সে ভাবছিল তার আসন্ন অবসানের কথা; তার মনে হল পৃথিবী ও স্বর্গ দুই-ই সে হারাল।
সেই সন্ধ্যাতেই বর-বধূ জাহাজে গেল ফিরে। গর্জাল কামান, হাওয়ায় উড়ল নিশান, জাজিম পাতা হল–বর বধূ রাত্রে সেখানে শোবেন। অনুকূল হাওয়া উঠল; নীল জলের উপর দিয়ে জাহাজ হালকা ছন্দে চলল |
অন্ধকার হ্বার সঙ্গে সঙ্গেই রাশি মাল রি ভারে উল ছাদের উপর শুরু হল নাচ। জীবনে প্রথমবার সমুদ্র থেকে মাথা তুলে যে-দৃশ্য সে দেখেছিল জলকন্যার তা মনে পড়ে গেল।
এ দৃশ্যও তেমনি জমকালো-_তাকেও যোগ দিতে হল নাচে, জাহাজের তক্তার উপর পাখির হালকা পায়ে সে ঘুরে বেড়াতে লাগল। মুগ্ধ হয়ে গেল সবাই, এত সুন্দর সে কখনো নাচেনি। ভীষণ লাগল তার ছোট দুটি পায়ে; কিন্তু সে-কষ্ট যেন তার আজ লাগলই না__ অনেক বেশি কষ্ট যে তার মনে।
আজকের পরে দে আর তাকে দেখবে না__যার জন্য সে ছেড়ে এসেছে বাড়ি-ঘর, বাপ-মা, হারিয়েছে তার অপরূপ-কষ্ঠস্বর, রোজ সয়েছে অসহ্য যন্ত্রণা__আর সেই মানুষটি একফৌটা সন্দেহও করে না__তার জন্যেই তো সে এত সব করেছে ! আজই শেষ। এর পরে সে আর নিঃশ্বাসে সেই বাতাস টানবে না ফে-বাতাসে তার প্রিয়তমের জীবন্ঢ আর দেখবে না ঘন-নীল সমুদ্র, তারায় ছাওয়া আকাশ। আসছে চিরম্তন রাত্রি_সেখানে আর-কোনো ভাবনা নেই, কোনো স্বপ্নু নেই। জাহাজের উপর বয়ে চলেছে ফূত্তির স্রোত; সে-ও দুপুর রাত পর্যন্ত সকলের সঙ্গে হাসল, নাচল_ মনের মধ্যে তার নিঃশেষ হয়ে-যাওয়া মৃত্যুর ভাবনা। তারপর রাজপুত্র গেল তার সুন্দরী বধুকে নিয়ে জমকালো শামিয়ানার নিচে বিশ্রাম করতে।
এখন সব চুপচাপ, হাল ধরে একা একজন মাল্লা দাড়িয়ে। জাহাজের সিড়িতে শাদা হাত দুটি হেলান দিয়ে দাড়িয়ে পুবের আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল সে। কখন ভোর হবে? সূর্যের প্রথম আলোর রেখাই তো তার মৃত্যুর তলোয়ার! তার বোনেরা জল থেকে এল উঠে, মৃত্যুর মতো স্নান তাদের মুখ; এত সুন্দর লম্বা চুল তাদের ছিল, ঘাড়ের উপর দিয়ে ফুরফুর করে উড়ত_এখন আর নেই।
“অমর আত্মা আকাশ-কন্যাদেরও নেই; আমরা তা অর্জন করি নিজেদের ভালো হাওয়ার ঝাপটায় ধুকছে। আমাদের স্রিগ্ক নিশ্বাসে হাওয়ার বিষ চলে যায়, তাদের প্রাণ বাচে। বাতাসের মধ্যে আমরা ছড়িয়ে যাই প্রাণের শীতল হাওয়া, তাকে সুরভিত করে তুলি ফুলের মিষ্টি গন্কে, এমনি করে সমস্ত পৃথিবীতে বিলিয়ে যাই স্বাস্থ্য আর আনন্দ। তিনশো বছর ধরে এমনি সুকীর্তির জোরে আমরা অমরতা লাভ করি__মানুষের টিরস্তন সার্থকতার অংশীদার হই। আর তুমি ছোট্ট জলকন্যা__তুমি তোমার প্রাণপণ করে রাজপুত্রকে বাচিয়েছ, হৃদয়ের প্রেরণায় মানুষের প্রেমের জন্য এত করেছ; এত দুঃখ পেলে আমাদের মতো মানুষের সেবায়__এখন তুমি অপরূপ দেহ নিয়ে উঠে এসেছ পরীদের আকাশে; এখন তিনশো বছর ধরে সুকাজ করলে অমর আত্মা লাভ করতে পারবে। কোমল দুটো স্বচ্ছ দীঘল বান তারপর__জীবনে প্রথমবার জলে ভিজে উঠল তার চোখ।
এদিকে জাহাজে সবাই উঠেছে জেগে, আবার শুরু হয়েছে উৎসব। সে দেখল রাজপুত্র নববধূকে নিয়ে বসে আছে; তাকে খুঁজে না পেয়ে তাদের মন বড় খারাপ; ম্লান মুখে তারা তাকিয়ে আছে নিচুমুখে ঢেউয়ের ফেনার দিকে_যেন তারা জানে এ সমুদ্রের ঢেউয়ের মাঝে ঝাপ দিয়েছে সে। অদৃশ্য হয়ে জলকন্যা রাজপুত্রের কপালে চুমু দিলে, হাসল তার দিকে তাকিয়ে; তারপর আকাশ-কন্যাদের সঙ্গে উড়ে মিলিয়ে গেল জাহাজের উপর দিয়ে ভেসে-যাওয়া গোলাপি মেঘের মধ্যে, তাদের সঙ্গে-সঙ্গে ভেসে গেল দিগন্ত ছাড়িয়ে।
“তিনশো বছর পরে আমরাও যাব স্বর্গরাজ্যে”, সে বলল।
একজন কানে-কানে বলল, “আরো আগেই যেতে পারি। ফে-সব মানুষের বাড়িতে ছোট ছেলেমেয়ে আছে, তাদের ভিতর অদৃশ্য হয়ে আমরা উড়ে যাই; আর যখনই আমরা দেখতে পাই একটি ভালো ছেলে যে তার মা-বাবার বুক, মুখ উজ্জ্বল করেছে, তাদের স্নেহের পুতুল হয়ে দাড়িয়েছে, তখনই ঈশ্বর আমাদের এই প্রতীক্ষার সময়টা দেন”।