মায়া তোরঙ

অনে-ক দিন আগে। এক দেশে ছিল এক সওদাগর | সওদাগরের ধন-রত্নের শুমার নেই, টাকা পয়সার গোণাগুনতি নেই। রুপোর টাকায় মস্তো একটা রাস্তা আগা-পাছতলা বাধিয়ে দেয়া যায়, তবুও সে টাকা ফুরোবে না__ এত টাকা সেই সওদাগরের। কিন্তু তাই কি করে নাকি কেউ? তাই সওদাগরও টাকা দিয়ে পথ না বেঁধে, টাকা-পয়সা আরো বাড়িয়ে চলে।
সেই সওদাগরের দশ নয় পাচ নয়, একটি মাত্তর ছেলে। তাই সওদাগর-পুত্বুরের হেসে-খেলে দিন যায়। |
সওদাগরের কোষাখানায় যেমন ধন-রত্র-মণি_-মাণিক্যের পাহাড়, তেমনি মাথা ভরা রহস্য রোমাঞ্চের নেশা।
এমনি করে দিনের পিঠে দিন যায়, আর সওদাগরের ধন-দৌলত বেড়ে ওঠে।
তারপর,
একদিন সওদাগর চোখ বোজেন।
সওদাগর চোখ বোজেন, আর সওদাগর-পুত্তুর সব কিছুর মালিক হয়ে বসে। মালিক হয়ে তো বসে, কিন্ত হেসে-খেলে তার দিন কেটেছে, কাজ-কম্মো জানে না। তার ওপরে আবার ঘটে নেই একরক্তি বুদ্ধি! তাই নতুন সওদার বেসাত বন্ধ, গদিঘরে তালা। তা, টাকায় টাকা আনবে কি, সওদাগর-পুত্তুরের পুরীতে আমোদ-আল্লাদের বান ডাকে, ইয়ার-বন্ধুর হাট বসে।
এমনি করে দিন যায়, জমা-কড়িতে টান পড়ে !
তবু, সওদাগর-পুতুরের হুশ নেই। নোট দিয়ে ঘুড়ি বানায়। সওদাগর-পুত্ুর সেই ঘুড়ি মনের সুখে আকাশে ওড়ায় ! সোনা-দানা দিয়ে একা-দোকা খেলে।
ওঠে তো ওঠে,_দালানকোঠা আকাশছোয়া তালগাছের মতো চিমনি তলায় ফেলে, মেঘ ছাড়িয়ে আরো ওপরে ওঠে। উঠে,___নগর-_বন্দর, ঘাট-মাঠ, খাল-বিল, পাহাড়-পর্বত পেছনে ফেলে মায়া-তোরঙ উড়ে চলে।
উড়ছে তো, উড়ছেই। থামার নাম নেই, নামবার লক্ষণ নেই। সওদাগর-পুত্বুরের চোখ ছানাবড়া। ভয়ে এই মুঙ্ যায়, তো সেই মুঙ্ছা যায়। সদাই শঙ্কা, বাক্‌সো বুঝি এই পড়ে এই পড়ে, সওদাগর-পুতুর ভয়ে মরে।
তোরঙটা পক্ষীরাজের মতো উড়ে চলেছে। নগর-বন্দর, খাল-বিল, তেপান্তরের মাঠ আর সাত সমুদ্দুর তেরো নদী পেরিয়ে শো শো করে উড়ে চলেছে। সওদাগর-পুতুর মনে মনে মাথা খোড়ে, হে ভগবান এবারকার মতো বাচিয়ে দাও! কিন্তু কে শোনে কার কথা।
উড়তে উড়তে উড়তে, মায়া-তোরঙ এসে থামে তুর্কিদের দেশে । আকাশ ছেড়ে তোরঙ মাটিতে নামে, সওদাগর-পুতুর হাফ ছেড়ে ধাচে। তোরঙ থেকে নেমে চারদিক চায়। দেখে পাশে এক গহীন বন। সওদাগর-পুতুর তখন সেই বনে শুকনো লতা-পাতার তলায় তোরঙ লুকিয়ে রেখে শহরের পথে বেরিয়ে পড়ে।
সওদাগর-পুত্বুরের পরনে আওরাখা, পায়ে চটি, দেখতে ঠিক তুর্কিদের মতো। ভিনদেশী সওদাগর-পুত্তুরকে কেউ বিদেশী বলে বুঝতে পারে না, কেউ সন্দো করে না। দিব্যি হাটতে, হাটতে, হাটতে শহরে এসে পৌছোয়।
নতুন শহর ! সওদাগর-পুত্তুর এটা-ওটা চেয়ে চেয়ে দেখে। দেখতে দেখতে ওর চোখে পড়ে, শহরের ওই প্রান্তে আকাশ-ছোয়া এক পুরী। পুরী দেখে সওদাগর-পুত্ুরের চোখে ধাধা লাগে, অবাক হয়ে চেয়ে থাকে। ভাবে, এ পুরী কার?
এদিক-ওদিক চায়, কাকে শুধোয়, কার এমন অবাক-করা পুরী !
সওদাগর-পুতুরের মন মানে না কাকে শুধোয়, কাকে শুধোয়। এমন সময় তার চোখে পড়ে মাঠের ধারে এক দাসী। সেই দাসীর কোলে ফুটুফুটে এক কৃমার। কুমার নিয়ে দাসী বেরিয়েছে হাওয়া খেতে। সওদাগর-পুত্বুর ভাবল, ওকেই শুধোই পুরীর খবর।
তেবে,
এক পা এক পা করে এগিয়ে যায় দাসীর কাছে। শুধোয়, হ্যাগা, ভালো মান্ষের মেয়ে, ওই আকাশ-ছোয়া, অবাক-করা পুরী কার বলতে পার? আর ওই পুরীর জানালাগুলো অত উচুতে কেন?
প্রশ্ন শুনে দাসী অবাক মানে। মনে মনে ভাবে, কোন দেশে এর বসত গো, রাজ্যির লোকে যে পুরীর খবর জানে, ও শুধোয় কিনা সেই পুরীর খবর
সওদাগর-পুত্ুরের পোশাক তুর্কিদের মতো, চেহারা তুর্কিদের মতো। দাসী ভিনদেশী বলে বুঝতে পারে না। সন্দো করে না। বলে, ওটাই তো আমাদের রাজকন্যের পুরী গো, ভালো মানুষের ছেলে। রাজকন্যের খবর তুমি বুঝি কিছু জানো না? শোনো তা হলে। একদিন এক গণন্কার এসে রাজকন্যের হাত দেখে বলে মহারাজ, এ কন্যের কপালে অনেক দুঃখু আছে। কন্যের সাথে ভিনদেশী কুমারের দেখা হবে। আর, সেই দেখাই হবে কন্যের কাল। কুমারকে ভালোবেসে রাজকন্যের সারা জীবনে সুখ হবে না, চোখের জলে বুক ভাসবে।
রাজার এত আদরের একমাত্র কন্যে, তার কপালে কিনা_ জীবন ভোর চোখের জল।
গণকারের কথা শুনে রাজা ভাবনায় পড়েন। ভেবে ভেবে, শেষে, আকাশ-ছোয়া পুরীএমনি করে দিন যায়। কোষাখানা খালি খালি।
রোজগার-পত্তর নাই এক কড়া, খরচের বেলা শতেক হাত। উড়িয়ে দিলে কারুণের ধনও ফুরিয়ে যায়, রাজরাজড়া-সওদাগরের ধন তো কোন কথা। দেখতে দেখতে ফাটা শিমুল তুলোর মতো সওদাগর-পুত্বুরের সব ধন-দৌলত উড়ে যায়।
তারপর,_
তারপর আর কী? সওদাগর-পুতুরের মাথায় হাত। ঘরে থাকার মধ্যে আছে মাত্র একটা আংরাখা, একটা রুপোর টাকা আর এক জোড়া চটি। সওদাগরের অমন অঢেল ধনের কোষাখানা, তা, একেবারে ফাকা-_একদম ফক্িকার।
এখন উপায়?
সওদাগর-পুতুর চোখে আধার দেখে। ইয়ার-বন্ধকুদের হাট ভাঙে, পথে দেখা হলে চিনতেও চায় না, সামনে পড়লে মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
সওদাগর-পুত্ুরের দুঃখের দিন কাটে না, নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, এ-বেলা চলে তো ও-বেলা চলে না। সন্ধ্যা কাটে-তো রাত কাটতে চায় না। দুঃখের নিশি হাজার মণ ভারী হয়ে বুকের ওপরে চেপে বসে। ভাবনায়-চিন্তায় সওদাগর-পুতুরের দুচোখের পাতা এক হয় না। রাতের ঘ্বুম চোখে নামে না, ঘুমপাড়ানি মাসি-পিসি ফিরে যায়।
টা রে রাজ একজন ছিল সত্যিকারের বন্ধু। সে ভাবল-_সুখের দিনে খেয়েছি-পরেছি, নিয়েছি-থুয়েছি আর দুহাতে উড়িয়েছি। এখন দুঃখের দিনে সরে যাব? ভেবে, বন্ধুর আর যাওয়া হয় না।
থেকে তো যায়, কিন্তু সওদাগর-পুত্বুরের যদি উপকারেই না এল তবে সে থাকায় লাভ কী। লাভের মধ্যে লাভ, বোঝা বাড়ানো। তাহলে? তার আবার ভাড়ার-ঘরে ছুঁচোর কেত্তন, কানা-কড়ি সঞ্চয় নাই। দুঃখী বলতে দুঃখী__জনম দুঃখী, সাত কাগালের এক কাঙাল। সাহায্য করবে কী দিয়ে।
বন্ধু উপায় ভাবতে বসে। ভেবে ভেবে কুল-কিনারা মেলে না। তখন, মনে পড়ে, ঘরে ছে লোহা তোরঙই দিয়ে দাও। বেচে দিলে কিছু না হোক, এক বুড়ি সাত কড়া কড়ি নিশ্চয়ই মিলবে। ওতে এক বেলা তো চলুক। এই সব সাত-পাচ ভেবে, বন্ধু, সওদাগর-পুতুরকে তার বাড়িতে ডেকে নিয়ে তোরঙটা দিয়ে দিল। বলল, আর তো কিছুই নাই, এই দিলাম। বেধে-ছেঁদে নিয়ে যাও।
নিয়ে তো যাও, কিন্তু কেমন করে? ঘরে কুটোটিও নেই। ধেধে নেয়া দূরস্থান, এক কোণা ঢেকে দেওয়ার সংস্থান নাই। সওদাগর-পুত্তুর তোরঙ্ের উপরে চেপে বসে গালে হাত দিয়ে ভাবে।
এখন হয়েছে কী, বন্ধুর দেয়া সাত-পুরুষের ভাঙা তোরউটা আসলে মায়া তোরঙ__ মন্তর-করা বাকসো। তালায় একটু জোরে চাপ দিলে হু হু করে আকাশে ওঠে। সওদাগর-পুত্তুর তোরগ্ের আজব গুণের কথা জানবে কোথেকে। তাই, তোরঙের ওপর বসে গালে হাত দিয়ে ভাবে আর আপন মনে এটা ওটা নাড়া-চাড়া করতে থাকে। এমনি নাড়াচাড়া করতে করতে হঠাৎ একবার তালায় পড়ে চাপ।
যেই-না তালায় চাপ পড়া, আর যাবে কোথায় ! সওদাগর-পুুরকে পিঠে নিয়ে হু হু করে তোরঙ ওঠে আকাশে ওঠে তো ওঠে,_দালানকোঠা আকাশছোয়া তালগাছের মতো চিমনি তলায় ফেলে, মেঘ ছাড়িয়ে আরো ওপরে ওঠে। উঠে,___নগর-_বন্দর, ঘাট-মাঠ, খাল-বিল, পাহাড়-পর্বত পেছনে ফেলে মায়া-তোরঙ উড়ে চলে।
উড়ছে তো, উড়ছেই। থামার নাম নেই, নামবার লক্ষণ নেই। সওদাগর-পুত্বুরের চোখ ছানাবড়া। ভয়ে এই মুঙ্ যায়, তো সেই মুঙ্ছা যায়। সদাই শঙ্কা, বাক্‌সো বুঝি এই পড়ে এই পড়ে, সওদাগর-পুতুর ভয়ে মরে।
তোরঙটা পক্ষীরাজের মতো উড়ে চলেছে। নগর-বন্দর, খাল-বিল, তেপান্তরের মাঠ আর সাত সমুদ্দুর তেরো নদী পেরিয়ে শো শো করে উড়ে চলেছে। সওদাগর-পুতুর মনে মনে মাথা খোড়ে, হে ভগবান এবারকার মতো বাচিয়ে দাও! কিন্তু কে শোনে কার কথা।
উড়তে উড়তে উড়তে, মায়া-তোরঙ এসে থামে তুর্কিদের দেশে । আকাশ ছেড়ে তোরঙ মাটিতে নামে, সওদাগর-পুতুর হাফ ছেড়ে ধাচে। তোরঙ থেকে নেমে চারদিক চায়। দেখে পাশে এক গহীন বন। সওদাগর-পুতুর তখন সেই বনে শুকনো লতা-পাতার তলায় তোরঙ লুকিয়ে রেখে শহরের পথে বেরিয়ে পড়ে।
সওদাগর-পুত্বুরের পরনে আওরাখা, পায়ে চটি, দেখতে ঠিক তুর্কিদের মতো। ভিনদেশী সওদাগর-পুত্তুরকে কেউ বিদেশী বলে বুঝতে পারে না, কেউ সন্দো করে না। দিব্যি হাটতে, হাটতে, হাটতে শহরে এসে পৌছোয়।
নতুন শহর ! সওদাগর-পুত্তুর এটা-ওটা চেয়ে চেয়ে দেখে। দেখতে দেখতে ওর চোখে পড়ে, শহরের ওই প্রান্তে আকাশ-ছোয়া এক পুরী। পুরী দেখে সওদাগর-পুত্ুরের চোখে ধাধা লাগে, অবাক হয়ে চেয়ে থাকে। ভাবে, এ পুরী কার?
এদিক-ওদিক চায়, কাকে শুধোয়, কার এমন অবাক-করা পুরী !
সওদাগর-পুতুরের মন মানে না কাকে শুধোয়, কাকে শুধোয়। এমন সময় তার চোখে পড়ে মাঠের ধারে এক দাসী। সেই দাসীর কোলে ফুটুফুটে এক কৃমার। কুমার নিয়ে দাসী বেরিয়েছে হাওয়া খেতে। সওদাগর-পুত্বুর ভাবল, ওকেই শুধোই পুরীর খবর।
তেবে,
এক পা এক পা করে এগিয়ে যায় দাসীর কাছে। শুধোয়, হ্যাগা, ভালো মান্ষের মেয়ে, ওই আকাশ-ছোয়া, অবাক-করা পুরী কার বলতে পার? আর ওই পুরীর জানালাগুলো অত উচুতে কেন?
প্রশ্ন শুনে দাসী অবাক মানে। মনে মনে ভাবে, কোন দেশে এর বসত গো, রাজ্যির লোকে যে পুরীর খবর জানে, ও শুধোয় কিনা সেই পুরীর খবর
সওদাগর-পুত্ুরের পোশাক তুর্কিদের মতো, চেহারা তুর্কিদের মতো। দাসী ভিনদেশী বলে বুঝতে পারে না। সন্দো করে না। বলে, ওটাই তো আমাদের রাজকন্যের পুরী গো, ভালো মানুষের ছেলে। রাজকন্যের খবর তুমি বুঝি কিছু জানো না? শোনো তা হলে। একদিন এক গণন্কার এসে রাজকন্যের হাত দেখে বলে মহারাজ, এ কন্যের কপালে অনেক দুঃখু আছে। কন্যের সাথে ভিনদেশী কুমারের দেখা হবে। আর, সেই দেখাই হবে কন্যের কাল। কুমারকে ভালোবেসে রাজকন্যের সারা জীবনে সুখ হবে না, চোখের জলে বুক ভাসবে।
রাজার এত আদরের একমাত্র কন্যে, তার কপালে কিনা_ জীবন ভোর চোখের জল।
গণকারের কথা শুনে রাজা ভাবনায় পড়েন। ভেবে ভেবে, শেষে, আকাশ-ছোয়া পুরী তৈরি করান, জানালা রাখেন অনেক উচুতে। যেন কন্যেকে কেউ না দেখে, কন্যে কাউকে না দেখে।
পুরী বানিয়ে রাজকন্যেকে ওখানে রেখে দেন। কন্যের পুরী ঘিরে কড়া পাহারা বসে। এক মাত্তোর রাজা-রানি ছাড়া পুরীতে কাক-পক্ষী যেতে পায় না, মশা-মাছি গলে না, এমনি কড়া পাহারা ।
সওদাগর-পৃত্ুর অবাক হয়ে রাজকন্যের কাহিনী শোনে। শুনে, দাসীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবার বনে ফিরে আসে।
বনে ফিরে, সওদাগর-পুতুর রাতের আশায় বসে থাকে। ধীরে ধীরে বিকেল গড়িয়ে সীঝ হয়, সাঝ গড়িয়ে রাত আসে। সওদাগর-পুতুর তখন, শুকনো পাতার গাদা থেকে মায়া-তোরঙ বের করে তার ওপরে চেপে বসে।
বসে, তালায় দেয় চাপ। আর, অমনি বাকসোটা সওদাগর-পুত্ুরকে নিয়ে পক্ষীরাজ ঘোড়ার মতো শো শো করে আকাশে ওঠে। সওদাগর-পুত্বুরকে নিয়ে উড়তে উড়তে এসে থামে রাজকন্যের আকাশ-ছ্টোয়া, অবাক-করা পুরীর সবার ওপর তলার ছাদে।
মায়া-তোরঙ এক কোণে লুকিয়ে রেখে সওদাগর-পুত্তুর ছাদ থেকে নামে। নেমে, পা টিপে টিপে, পা টিপে টিপে এগোয়। পুরীর বাইরে হাজার শান্ত্রির পাহারা। ভেতরে কাক-পক্ষী আসতে পায় না, মশামাছি গলে না, সেই পুরীতে বুক-ধুকপুক সওদাগর- পুত্ুর_-এঘর ওঘর করে।
পুরীত পুরী নয়, মায়াপুরী ! সওদাগর-পুত্তুর দেখে দেখে অবাক মানে।
দেখতে দেখতে, সওদাগর-পুতুর আসে রাজকন্যের ঘরের কাছে। উকি দিয়ে দেখে, ঘরের মধ্যে কে? না,_এক কন্যে ! সোনার পালজেক গ্রা এলিয়ে অঘোরে ঘুমোয় কন্যে। জানলা টপকে ঘরে ঢুকে সওদাগর-পুত্তুর, পায়েপায়ে, পায়েপায়ে, এগিয়ে যায়।
কন্যের দুধে-আলতো রঙ, সবেবা অঙ্গে পাগল করা রূপ যেন গলে গলে পড়ে। কন্যে তো কন্যে নয়-_ডানাকাটা পরী !
এত রূপ মানুষের হয় !
সওদাগর-পুত্তুর অবাক হয়ে চেয়ে থাকে।
চেয়ে চেয়ে আশ মেটে না, চক্ষে তার পলক পড়ে না। শুধু দেখে আর দেখে।
আর কন্যে, একরাশ সদ্যফোটা শিউলী ফুলের বিছানায় ঘুমোয়।
সওদাগর-পুত্তুর গিয়ে পালজ্কের উপরে বসে।
এমন সময়,_
হঠাৎ কন্যের গায়ে হাত লাগে । আর, হাতের ছোয়া লাগতেই কন্যে ঘুম ভেঙে ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসে। দেখে, পালজ্কে বসে অজানা, অচেনা কে না কে, এক লোক।
আগ দেউডি পাছ দেউড়ি, আশ দেউড়ি পাশ দেউড়ি, আকাশ-্রোয়া পুরী ঘিরে খোলা তরোয়াল হাতে হাজার শান্ত্রি জাগে। সেই-না পুরীতে অচেনা লোক!
দেব, দত্যি না মনিষ্যি?_রাজকন্যে ভয়ে মরে, মুখে বাক সরে না।
সওদাগর-পুত্তুর তখন কন্যেকে অভয় দেয়।
বলে, কন্যে, আমি তোমাদের দেবতা। আমাকে ভয় কী£ আকাশ থেকে এসেছি তোমায় দেখতে।
আকাশের দেবতা, সে এসেছে তাকে দেখতে?
শুনে, কন্যের খুশি উছলে পড়ে। আনন্দ আর ধরে না। হাসির ধারায় মুক্তো ঝরে।
তখন_
তখন আর কী? দুজনে সোনার পালছেক বসে কত কথা বলে, কত রাজ্যির গঞ্পো বলে, সে গপ্পো আর ফুরোয় না।
গঞ্জো করতে করতে রাত ফুরিয়ে বিহান হয় হয়। আর তো থাকা যায় না। সওদাগর-পুতুরকে এখন যেতে হবে।
সওদাগর-পুত্বুর কন্যের রূপে পাগল। ছেড়ে যেতে মন সরে না। বলে, কন্যে,_-তোমার এমন মন-কেড়ে-নেয়া রূপ! সেই রূপ কিনা আকাশ-ছোয়া পাষাণ পুরীতে হাজার সেপাই-এর পাহারায় বন্দী! কন্যে, তোমায় আমি বিয়ে করব।
শুনে, কন্যের আনন্দ আর ধরে না।
আকাশের দেবতা বিয়ে করতে চায় মাটির কন্যেকে ! এত ভাগ্য !
কন্যে বলে, বেশ, করব বিয়ে। কিন্তু আসছে শনিবার তোমায় আবার আসতে হবে আমার এই পুরীতে। সেদিন বাবা-মা আসবেন আমায় দেখতে । আমি বলব তাঁদের সব কথা। আকাশের দেবতার সাথে বিয়ে, সেই বিয়েতে কি অমত করতে পারেন তারা।
মত দিয়ে দেবেন। , একটা কথা-_
তোমাকে কিন্তু একটা খুব মজার গয্পো বলতে হবে । আমার বাবা-মা গঞ্পো শুনতে ভারী ভলোবাসেন। গঙ্পো শুনে যদি তারা খুশি হন, তবেই হবে আমাদের বিয়ে।
শুনে সওদাগর-পুত্ুর বলে, বেশ, তাই হবে। একটা গঞ্পোই হবে আমাদের বিয়ের যৌতুক। সে বেশ মজার হবে !
বলে, সওদাগর-পুত্ুর রাজকন্যের কাছ থেকে বিদায় চায়। দেবতা ফিরে যাবে আকাশে, আপন পুরীতে, কন্যে তাকে কি শুধু হাতে বিদায় দিতে পারে?
কিন্তু দেয় কী? ঘরে আছে সোনায় মোড়া, মণি-মুক্তোর কাজ করা এক তরোয়াল। ভেবেচিন্তে কন্যে তাই এনে দেয়।
সওদাগর-পুত্তুরের আকাশ তো তেপান্তরের মাঠের ধারে যে গহীন বন, সেই বনে। গহীন বনে সওদাগর-পত্বুর একা বাঘভান্ুক, সাপ-খোপের ভয় আছে, একটা বিপদ ঘটতে কতক্ষণ ! তখন সওদাগর-পুত্বুর জান ধাচাবে কী দিয়ে?
তাই তরোয়ালটা পেয়ে সওদাগর-পুতুর’ মনে মনে খুশি হয়ে রাজকন্যের কাছ থেকে বিদায় নিল।
বিদায় নিয়ে, বাকসোতে চেপে ফিরে এল বনে।
বনের মধ্যে বাকসোটা লুকিয়ে রেখে সওদাগর-পুভুর আবার শহরের পানে পা বাড়ায়। শহরে গিয়ে, কেনে চমৎকার একটা আংরাখা। কিনে, সওদাগর-পুতুর আবার বনে ফিরে আসে।
বনে ফিরে সওদাগর-পুত্ুর ভাবতে বসে। শনিবারের মধ্যে একটা মজাদার গঞ্পো তৈরি করতে হবে, কিন্তু, কোনো গ্পোও কি ছাই মনে আসে ! সওদাগর-পুত্তুর বসে বসে ভাবে আর ভাবে। –
ভাবতে ভাবতে, শেষে_
বেশ মজাদার একটা গপ্পো তৈরি হয়ে যায় শনিবার আসবার আগেই। তখন আর কী? সওদাগর-পুত্তুর হাফ ছেড়ে বাচে।
শনিবার আসে। দেবতার আশায় বসে থাকে। দেবতা কখন আসে, কখন আসে।
শেষে, মায়া-তোরঙ চেপে দেবতা আসেন! এ দেবতা কে? না,-সেই সওদাগর-পুত্তুর। দেবতা তো আসেন, আর, সঙ্গে সঙ্গে রাজা-রানি, উজির-নাজির, পাত্রমিত্রের মধ্যে সাড়া পড়ে যায়। কে আগে, কে পরে, দেবতাকে বরণ করবে তাই নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যায়।
তারপর, অভ্যর্থনার ঘটা থামে। সওদাগর-পুন্তুর গঞ্পো শুরু করে।
গল্পো শুনে, সবাই অবাক মানে । এমন মজার গল্পোও আছে নাকি?
সওদাগর-পুত্বুর গঞ্পো করে আর, শুনে রাজা-রানি হেসে গড়িয়ে পড়ে।
হ্যা, এমন না হলে গঞ্পো। শুনে সবাই খুশি।
আর রাজকন্যেকে বিয়ে করতে বাধা নেই। পুরীতে, পথে পথে উছি-আনন্দের জোয়ার বয়। পরদিন সাঝের বেলা নগরের পথ-ঘাট, দোকান-পাট, ফুলে-লতায়-পাতায়, সাতরঙা বাতির মালায় হেসে ওঠে।
রাজভাগ্ডার উজাড় করে মণ্তা-মিঠাই বিলি হয়, রাজ্যির প্রজারা, প্রজাদের ছেলে-মেয়েরা পেট ভরে খায়। খেয়ে, ছেলে-মেয়েরা সার বেঁধে দাড়িয়ে বাশের বাশি, আটির ভেঁপু বাজায়।
সওদাগর-পুতুর সব দেখে আর ভাবে, আমার জন্যেই চারদিকে এত আলোর ছটা, নগরে নতুন সাজের ঘটা,_ঘরের মানুষ সব পথে ! আমিই-বা চুপ করে বসে থাকি কেন? আমাকেও এমন কিছু করতে হবে, দেখে যেন সবার তাক লেগে যায়। এই-না ভেবে সওদাগর-পুতুর,__হাউই, পটকা, তুবড়ি_আর যত রাজ্যির আতসবাজি কিনে, বাকসো বোঝাই করে। তারপর সেই বাকসে চেপে হাওয়ার ডানায় ভর করে উড়ে চলে।
উড়ে চলে, আর তাই দেখে, নিচে নগরের লোক ভেঙে পড়ে । ওই তাদের দেবতা যায়! উল্কার চেয়েও জোরে ছোটে দেবতার রথ । দেবতা-বর !
ওদিকে সওদাগর-পুত্তুর উড়ে উড়ে সেই গহীন বনে গিয়ে নাষে। শুকনো লতা-পাতায় মায়া-তোরঙ ঢেকে, শহরের পানে পা বাড়ায়, তার কথা কে কী বলে শুনতে হবে!
সওদাগর-পুত্তুর শহরে যায়। পুরবাসীর কাছে দেবতার কথা পাড়ে। একজন বলে, দেবতার চোখ দুটো সে নিজের চোখে দেখেছে। চোখ তো নয় যেন জ্বলন্ত নক্ষত্ত। আর সমুদ্রের ফেনার মতো সাদা। ধপধপে দাড়ি! এমনি ধারা শতেক কাহিনী শোনে সওদাগর-পুতুর। শোনে আর মনে মনে হাসে।
পরদিন। রাজকন্যের বিয়ে। সওদাগর-পুতুর বনে ফিরে আসে। মায়া তোরঙে চেপে বিয়ে করতে যাবে রাজকন্যেকে।
কিন্ত-_ সব্বোনাশ! কোথায় বাকসো কোথায় কী? কোথ্থেকে আগুনের একটা ফুলকি উড়ে এসে পড়েছিল তোরগুটার মধ্যে। আর, সঙ্গে সঙ্গে আতসবাজিতে আগুন ধরে মায়া-তোরড পুড়ে ছাই !
সওদাগর-পুততুর মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে।
এখন উপায়?
উপায় আর কী? মায়া-তোরঙ পুড়ে ছাই, সওদাগর-পুতুর উড়তে পারে না, রাজকন্যের কাছে যাবে কী করে!
আর, রাজকন্যে-_
সেই আকাশ-ছোয়া পুরীর ছাদে দেবতার পথ চেয়ে বসে থাকে ।
আজো কন্যে, পুরীর ছাদে বসে এক ধ্যানে আকাশের পানে চেয়ে থাকে, যে পথ দিয়ে দেবতা এসেছিল। :
আর সেই সওদাগর-পুত্বুর, সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ায় আর যাকে পায় তাকেই আকাশ-ছোয়া পাষাণ-পুরীর কন্যের গল্প শোনায়। কিন্তু রাজা-রানিকে যে গঞ্পো শুনিয়েছিল, এ গল্পে সেই হাসি নেই। এ গল্পে শুধু কান্না ঝরে।
আজো কন্যে পথ চেয়ে আছে, কে জানে এ পথ চাওয়ার শেষ কবে?