নিঝুমপুরের কাকতাড়ুয়া

দুপুরবেলা বাবলু যখন বের হচ্ছিল তখনই দারোয়ানটা বাধা দিয়ে বলে, এই সুনসান দুফুরে কই যাইতাছেন? 

দুফুরে মান দুপুরে সেটা জানে বাবলু। দারোয়ান লোকটা বেশ সহজ সরল। মাথা ভর্তি কলমি শাকের মত ঝাঁকরা চুল। মুখটা তোম্বা ধরনের, অনেকটা পেঁপের মত। নাকটা প্রয়োজনের তুলনায় বড়। নাকের ভেতর থেকে কালো কালো কুৎসিত লোম বের হয়ে এসেছে। অনেকটা জারুল ফলের মত। নাকের নীচে ইয়া বড় এক জোড়া গোঁফ। গোঁফের দু মাথা খানিকটা উপর দিকে তোলা। টিপু সুলতান স্টাইল। 

পুরো চেহারাতে শুধু চোখ জোড়া বেমানান। শিশুর মত সরস দুই চোখ।

মামার কাছে বেড়াতে এসেছে বাবলু আজ দুই দিন। প্রথম দিনই দারোয়ানটাকে পছন্দ করে ফেলেছে। ওর নাম, কেনারাম। কি অদ্ভুত নাম।  ওর এক ভাই আছে। নাম নাকি বেচারাম। মনে হয় একজন সবকিছু কেনে আরেকজন সবকিছু বিক্রি করে।
বাবলুর মামা ফরেস্ট অফিসার। মাত্র তিনমাস হয়েছে এই নিঝুমপুরে বদলি হয়ে এসেছেন। বাব্লুকে কয়েকবার চিঠি লিখে আর ফোন করে বলেছেন তোর পরীক্ষা শেষ হলেই চলে আসবি। বুঝলি? অমন সুন্দর জায়গা না দেখলে জীবনটাই বৃথা!
তারপর ঘণ্টাখানেক ধরে মামা রসিয়ে রসিয়ে নিঝুমপুরের বর্ণনা দিয়েছেন। শুনতে শুনতে বাবলুর মনে হয়েছে- আহা! নিশ্চয় খুব সুন্দর জায়গা হবে।
নিঝুমপুরের আকাশের রং একদম অপরাজিতা ফুলের মত নীল। ওখানে আছে দেবদারু আর মেহগনি গাছের জঙ্গল। লাল কাকর বিছানো ছোট সরু পথ, পথের দুই ধারে বনতেজপাতা আর আসামলতার ঘন দঙ্গল। ঝোপঝাড়ের ফাঁক দিয়ে হঠাৎ হঠাৎ করে উকি দেয় তুলতুলতে নরম খরগোশ লাল পুতির মত চোখ। খানিক পর পর দমকা বাতাস বয়ে যায় দুরের নীলগিরি পর্বত থেকে। বাদামি রঙের শাল আর মেহগনির পাতা খসখস করে গড়াতে থাকে পথের উপর।
শেষ পরীক্ষা দিয়েই ট্রেনে চেপে বসেছিল বাবলু। ঢাকা থেকে সোজা নিঝুমপুর। ইস্টিশান থেকে নেমেই মনটা ভালো হয়ে গিয়েছিল। আসলে ভুল। ট্রেনের জানালা দিয়ে ইস্টিশানটা দেখেই জায়গাটা সম্পর্কে একটা ধারনা জন্মে গিয়েছিল মনে মনে। ।
অমন সুন্দর ইস্টিশান আগে দেখেনি বাবলু। একদম বইয়ে পড়া বর্ণনার মত। একটা চায়ের দোকান। একটা খবরের কাগজের স্টল। গুমটি ঘর, লাল টালি দেয়া। কয়েকটা অলস কুকুর। কোন হাঁক ডাক নেই।

দারোয়ান কেনারাম  ইস্টিশান থেকে বাবলুকে রিসিভ করে ডাকবাংলোতে নিয়ে এসেছিল। বাবলু ভেবেছিল মামা আসবে। কেনারামের মুখে শুনেছে মামা ফিরবেন সন্ধ্যার পর। দুরের কোন এক জঙ্গলে গাছ গুনতে গেছেন।
বাংলোটা ছোট হলেও সুন্দর। পুরানো দিনের বাড়ি। ইংরেজদের আমলের। আশেপাশের প্রচুর গাছপালা। লান্টাগা আর বাগান বিলাসের অভাব নেই। লান্টাগার ঝোপ ভর্তি হলুদ, কমলা আর গোলাপি রঙের ফুলে। পাতা আর দেখাই যায়না। আর এই ফুলের রঙ কত ধরনের হয় কে বলবে?
বিকেলে মামা ফিরে বাবলুকে দেখে যারপরনাই খুশি হলেন। হাট থেকে বড় বড় মাগুর মাছ এনেছেন। নিঝুমপুরের মাগুরও নাকি বিখ্যাত। রান্না করলো বাংলোর এক ছুটা বুয়া। বাতাসির মা।  অপূর্ব রান্না। মোটা লাল চালের ভাত আর মাগুর মাছের ঝোল দিয়ে প্রচুর ভাত খেল বাবলু। বরাবর ও কম খায়। কিন্তু নিঝুমপুরের জল হাওয়ায় খিদে বেশি লেগে গেছে। রাতে মামর সাথে অনেক গল্প হলো।
মামার জীবনটা খুব ঈর্ষা করে বাবলু। বড় হয়ে ও নিশ্চয় মামার মত ফরেস্ট অফিসার হবে। কত মজার মজার ঘটনা ঘটে মামার জীবনে। কত জায়গাটে ঘুরে বেড়াতে হয় তাকে। বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা মামার। একবার এক জঙ্গলের ধারে এক সাধুর দোকান দেখেছিলেন ওনি। সাধু শুধু বাতাসা বিক্রি করেন। ছোট দোকানে বড় একটা পেতলের থালা ভর্তি রাশি রাশি স্বর্ণমৃডার মত বাতাসা। দোকানে একটা পাল্লা আর অনেকগুলো বাটখাড়ারাখা আছে। খদ্দের এসে নিজের বাতাসা নিজে মেপে পাশে টিনের থালার মধ্যে পয়সা রেখে চলে যায়। সাধু একটু দুরে পথের উলটা দিকে বাঘের ছাল বিছিয়ে ওটার উপর বসে ধ্যান করেন সারাক্ষণ।

সন্ধ্যা বেলা দোকান বন্ধ করে পয়সার পুটলি নিয়ে সাধু চলে যায়। পরদিন সকালে এসে দোকান খুলে আবার। সবাই দেখে গত রাতের খালি থালা আবার বাতাসায় ভর্তি।
আরেক জায়গাতে বদলি হয়ে গিয়েছিলেন মামা। ওখানের জঙ্গলে দুর্লভ নিমপ্যাঁচা পাওয়া যেত। জাপান থেকে একদল পাখি গবেষক এসেছিলেন সে প্যাচার খোঁজে। সেই জাপানি সাহেবরা ঘাস দিয়ে সরবত বানাতেন। মামা সরবত খেয়েছিলেন। নিমপ্যাঁচার বাসা  বাসা খোজে দেয়ায় জাপানিরা খুশি হয়ে মামাকে দামি বাইনোকুলার উপহার দিয়েছিল। 

মামার কাছে শুধু গল্প আর গল্প। দেশতরী পাখিদের গল্প। জঙ্গলের গাছপালাদের গল্প। নীলগাই আর চিতল হরিণের গল্প। বাব্লু আশা করে মামা যখন বুড়ো হবেন তখন বিভূতিভূষণ এর আরণ্যক বইয়ের মত কোন বই লিখবেন নিশ্চয়। আরণ্যক বইটা বাব্লু বেশ কয়েকবার পড়েছে।
অপূর্ব একটা বই। মুসম্মৎ কুন্তা নামের মেয়ের গরিব মেয়েটা শীতের রাতে কুয়ার ধারে এসে দাঁড়িয়ে থাকতো এটো ভাত আর উচ্ছিষ্ট খাবার নেয়ার আশায়। বনজঙ্গল থেকে শুধু কুল বড়ই সংগ্রহ করে তিনবেলা তাই খেত ওরা।
গহীন জঙ্গলের ভেতরে তিনটে মহিষ চড়াতো ব্রাহ্মণ রাজু পায়ে। মাঝে মাঝেই আনমনে গান গেয়ে উঠতো – “দয়া হই জি”।

মেবটুলিয়া বইহারের চারিদিকে হলুদ রঙের ফুল ফুটতো। মহালিখার পেন পাহাড়ের উপর আগুন জ্বলত। চাষের জমি বাগানের জন্য শালবনে আগুন দিত আদিবাসীরা। জোসনা রাতে জঙ্গলের বুনো ফুলের ঘ্রাণ যেন জোছনার সাথে মিশে যায়। ফাল্গুনের মাঝামাঝি দুধছি ফুল ফুটে। তখন সেই ফুলের ঘ্রাণ রাতের বেলা যেন পাগল বানিয়ে ফেলে। বিভূতিভূষণ বাবু বলেছেন, সবারই জীবনে একবার হলেও জ্যোৎস্না দেখা উচিৎ। নইলে বিধাতার সৃষ্টির এক অপূর্ব রূপ অপরিচিত থেকে যাবে।
রাতে ঘুমনোর আগে মামা বলতেন, তুই একটু ভালোমত বিশ্রাম নে কয়েকটা দিন। টো টো করে ঘুরে বেরোনোর দরকার নেই। আর যদি বাইরে যেতে চাস, তবে সকালের দিকে যাবি। অথবা বিকেলেও যেতে পারিস। তবে দুপুরবেলা যাবিনা।

‘কেন? দুপুরে বাইরে যেতে সমস্যা কি?’ অবাক হল বাব্লু।

‘ না, সমস্যা নেই।’ কেমন যেন থতমত খেয়ে গেলেন মামা।
‘তাহলে?’
‘ কি  তাহলে?’
‘ আরে তুমিইনা বললে দুপুরে যেন বাইরে টো টো করতে না যাই।’
‘হ্যাঁ তা বলেছি। কারণ আর কিছুনা, জঙ্গলের কাছাকাছি খোলা জায়গাতে রোদটা অনেক বিচ্ছিরি রকমের কড়া হয়। চমাড়া ঝলসে দেখবি দুই দিনেই নাক  আর ঘাড় থেকে বাদামি চামড়া উঠে আসবে।’ সাফাই গাইলেন মামা। 

বাবলুর কেন যেন মনে হল মামা কিছু গোপন করছেন।
কিন্তু ওর তখন কথা বলতে ইচ্ছে করছিলনা। লেপের তলায় ঢুকে পড়েছে। গায়ে দারজিলিংয়ের কম্বল। নিঝুমপুরে শীত ভালোই পরে দেখা যাচ্ছে। জানালার কাঁচগুলো শীতে ঘেমে গেছে। বাগানের গাছের পাতায় পাতায় শিশির জমে টুপটাপ করে পড়ছে। বড় একটা মাটির গামলার মধ্যে কয়লা এনে ঘরের মধ্যে রেখে দিয়েছেন মামা। এতে উম পাওয়া যায়। বহু দুরে শেয়ালের ডাক শুনতে পায় বাবলু। হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লো শেষে।


‘একটু বাইরে থেকে ঘুরে ফিরে আসি’ বললো বাবলু।
দারোয়ান কেনারাম এখনও নিরীহ চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। .

‘দুফুর বেলা বাইরে হাঁটাহাঁটি করা ভালা না’ গম্ভীর মুখে বললো কেনারাম। 

‘কেন?’

‘দুফরের বাতাস ভালা হয়না। শুনো নাই? মাইনসে কয়, ঠিক দুফুরবেলা ভূতে মারে ঢেলা।’ 

‘আরে ধ্যাত’ হাসলো বাবলু। ‘কিসব আজগুবি কথা বলেন আপনি? ভূত বলে কিছু আছে নাকি? আর থাকলেও তারা সন্ধ্যার পরে বের হয়। দুপুর বেলা খোলা মাঠে হেটে বেড়ায় না।’

‘বেরোয়’ চোখ পিটপিট করে বলে কেনারাম। ‘বেশি খারাপ জিনিসগুলো তো দুফুরে বাইর হয়। দুফুরে অগো সুবিধা হয়। ’
‘কী সুবিধে?’ 

‘আরে দাদা দুফুরে তো মাইনসের ছায়া পড়েনা, দেহেন না। অন্য সুময়ে তো ছায়া দেইখা চিনতে পারবেন, কুনটা মানুষ আর কুনটা  তেনারা। দুফুরে তো পারবেন না। দুফুরের বাতাসও তো ভালা হয়না। দেখবেন খালি দুফুরেই বাঊকুড়ানি বাতাস বয়। অন্য সুময় বয়না। ’
প্রাণ খুলে হাসলো বাবলু। কেনারামের মত লোকগুলো না থাকলে পৃথীবিটা বড় পানসে হয়ে যেত। কত মজার মজার চিন্তা নিয়ে বেচে থাকে ওরা। 

‘আমি বেশিদূর যাবনা’ বললো বাবলু। ইস্টিশনের আশপাশ থেকেই ফিরে আসবো। 

‘না গেলেই ভালা অইতো। তয় সুনসান নিরালা জায়গাতে যাবেননা। অই উত্তর দিকে খোলা খেতি জমিন আছে। শালগম আর বান্ধাকফির বাগান। ওখানেও যাওনের দরকার নাইক্কা’ 

আরো কি কি বলত কেনারাম কে বলবে। ততখনে পথে নেমে গেছে বাবলু। তাই লোকের ভ্যাজর ভ্যাজর শোনার সময় নেই। যত বেশিক্ষণ দাঁড়াবে ততবেশি বাকোয়াজ গল্প  বলবে অই লোক। এমনিতেও দারোয়ান টাইপের মানুষজন ফালতু গালগল্প করতে পছন্দ করে। 

পথে নেমে মুগ্ধ হল। কি সুন্দর পথঘাট। মনে হয় খানিক আগে কেউ রাস্তা ঝাড়ু দিয়ে গেছে। তারপর যত্ন সহকারে মুঠো মুঠো লাল কাঁকড় বিছিয়ে দিয়েছে। সেই লাল কাঁকড় বিছানো পথে এখানে ওখানে পড়ে আছে হলুদ আর বাদামি রঙের গাছের পাতা। মাথার উপর দিয়ে সুড়ৎ করে উড়ে গেল কয়েকটা বসন্ত বাউরি। 

শহরের বাড়িঘর দেখে ক্লান্ত বাবলু। জুতার বাক্সের মত এক একটা ফ্ল্যাট বাড়ি। শ্যাওলা পড়া দেয়াল, প্রত্যেক গলির মোড়ে ময়লার স্তুপ। ময়লার স্তুপে চিৎ হয়ে হয়ে মরে পড়ে আছে বিড়াল বা কুকুর। খোলা নর্দমা। অসহ্য। অথচ এখানের পরিবেশ একদমই ফুরফুরে।  

গুনগুন হেটে যেতে লাগলো বাবলু। ক্যামেরা থাকলে ভালো হত। নীল রঙের কি একটা পাখি উড়ে গেল। ভিমরাজ নাকি? মনে হয় মারটিনের কাপড় কেটে বানানো হয়েছে ওটাকে। প্রজাপতিরও অভাব নেই। সাড়ে এগারটার মত বাজে। কুয়াশা কেটে গেছে। তারপরও মাটি থেকে ঠাণ্ডা একটা ভাপ উঠছে। দুরের হাট বাজার একটু ঝাপসা যেন। 

অচেনা পথ ধরে হাটতে হাটতে কোথায় চলে গেছে বাবলু নিজেও বলতে পারবেনা। যখন খেয়াল করলো তখন দেখলো মস্ত বড় এক শালগমের খেতের মাঝে দাড়িয়ে আছে। সরু পথ, মাঝে। দুই ধারে সবুজ খেত। আগে শালগম খেত দেখেনি বাবলু। তবে বইতে পড়েছে। দার্শনিক প্লিকি শালগমের প্রচুর প্রশংসা করেছেন। তুরস্কে শালগমের দারুন আচার বানায়। বাবলুদের বাড়িতে কখনও কখনও শালগম ভাঁজা আর আটার রুটি সকালে নাস্তা হিসেবে চালানো হত।
শালগম খেতের মাঝে বেঁটে মত একজন লোক আছে সেটা খুব ভালোমত খেয়াল না করলে দেখতেই পেটনা বাবলু। 

লোকটা বেশ মনযোগ দিয়ে কাজ করছিল। বাবলুর পায়ের শব্দ বা নড়াচরা পেয়ে ফিরে তাকালো। একেবারে গোল চেহারা। যেন জ্যামিতি বক্সের কম্পাস দিয়ে এঁকে গোল করা হয়েছে। মার্বেলের মত গোল গোল চোখ। মাথায় একটাও চুল নেই। গলাটা পেন্সিলের মত সরু। হাস্যকর রকমের ঢোলা একটা লাল জামা পড়ে আছে। জামাটা এতবড় যে বুঝার উপায় নেই নীচে প্যান্ট বা লুঙ্গি আছে কীনা।

“কি খোকা? ভাল আছ? নতুন বুঝি?’
হাসি  হাসি মুখে বলল কিম্ভুত লোকটা।
বাবলু ক্লাস সিক্সে পড়ে , আজকাল কেউ খোকা বলেনা। এই লোকটা যে অমন দুম করে খোকা ডেকে বসবে ভাবতেও পারেনি ও। তারপরও রাগ করতে পারলোনা। লোকটাকে দেখে বেশ মজার মানুষ মনে হচ্ছে ওর।  সারাক্ষণই হাসছে লোকটা।
‘হা নতুন এসেছি’  মাথা ঝাকালো ভাবল বাবলু।
‘ফরেস্ট অফিসারের বাংলাতে উঠেছে বুঝি?’
‘কিভাবে বুঝলেন?’  বাবলু অবাক।
‘বারে’  হাসছে লোকটা,  ‘ও ছাড়া আর মেহমান আসবে কোত্থেকে?  কেমন লাগছে নিঝুমপুর?’
‘খুব সুন্দর!’ মাথা নেড়ে তারিফ করলো বাবলু। 

‘তা আপনি কে?’

‘আমি কেউ না মনে করো পাহারাদার’

‘কিসের পাহারাদার ?’

‘কিসের আবার ওই ক্ষেতের ! ক্ষেতের ফসল পাহারা না দিলে পাখি এসে এসে সব খেয়ে যাবে না?’

‘অনেক পাখি আছে নাকি  নিঝুমপুরে ?’

‘খুূঊব!  কত পাখি, বসন্ত বাউরি,  কোয়েল, ডিম রাজ, ধনেশ,  লালগলা বাতাই, ধলা গলা বাতাই,  হলদেচাঁদি কাঠঠোকরা, ঝুটিয়াল,  ঘর বাতাসি, পাহাড়ি নীলকান্ত, মোহন চূড়া, পাঁকড়া…। 

‘ বাপরে!’  আর্তনাদ করে উঠলো বাবলু।

‘ এখানে এত পাখি?’ 

‘ আরে আমি তো সব গুলার নাম শেষ করিনি’  আহত গলায় বলল লোকটা। 

চেহারায় দুঃখের ছাপ।

‘ কিন্তু কই আমি তো তেমন পাখি দেখছি না?’  আশে পাশে চারদিকে নজর বুলিয়ে বলল বাবলু।

‘আমি আছি না!’  হে হে করে হাসতে হাসতে বলল পাহারাদার লোকটা।

‘ সকাল থেকেই তো পাখি তাড়ালাম। ‘

আসলে লোকটা কে খুব পছন্দ হয়েছে  বাবলুর। বয়স বোঝা মুশকিল তবে অনেক কিছু জানে।

‘আপনার পেশাই বোধহয় এই পাখি তাড়ানো?’ বলল বাবলু,

‘পাখি পছন্দ করেন?’

‘করি,  কিন্তু সমস্যা হল ক্ষেত পাহারা দেয়ার সময় একটু ঝিমুনি এলেই ফাজিল কিছু পাখি আছে,  মাথা বাঁ কাঁধের উপর বসে হাগু করে দেয় । তখন মেজাজ খারাপ হয়ে যায় !’

দুঃখী মানুষের মত বলল লোকটা।

লোকটার বলার ভঙ্গি এর মধ্যে এমন কিছু ছিল না হেসে পারল না  বাবলু।  

‘এই যে তুমি আবার দুঃখে হেসে ফেললে!’  অভিযোগ করল লোকটা । 

‘আসলে আমাদের কেউ ভয় পায় না বুঝলে?  অথচ কত কষ্টের কাজ রোদে পোড়ে ফসল পাহারা দেই।  রাতেও পাহারা দিতে হয়। পাকা ফসলের ঘ্রাণে ইঁদুর আসে,  পেঁচা আসে, রাতে বাদুর পর্যন্ত এসে পাকা ফসল খেয়ে যায় ! আর দুপুরে তেষ্টা পেলে এক ঘটি জল পাব সে উপায়ও নেই ! ‘ 

হা ব্যাপারটা আসলে খুবই দুঃখজনক । এবার সত্যিই খারাপ লাগছে বাবলুর। 

‘তা তুমি এই নিরাক পড়া দুপুরে বের হয়েছ কেন ? ‘ অবাক হলো লোকটা। 

‘যাবে কোথায় ?’ 

‘আসলে হাঁটতে বের হয়েছি’ 

‘চলো তোমাকে খানিক পথ এগিয়ে দিয়ে আসি।  এমনিতে হাঁটার সুযোগ পাইনা! দুপুরবেলা কাউকে পেলে বেঁচে যাই যেন!’ 

খেক খেক করে হেসে ফেলল লোকটা।  পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো দুজন। লোকটার হাটার ভঙ্গীটা হাস্যকর। দুই পায়ে দুই সাইজের জুতা পড়েছে লোকটা,  যেমন উঁচু নিচু আর টলোমলো ভঙ্গিতে হাটে তেমনি হাঁটছে। 

‘ওটা হচ্ছে ঝুমকা লতা!’ পথের ধারে একটা ঝোপ দেখিয়ে বলল লোকটা ।  

‘ওতে গোল সবুজ ফল হয়,  ভেতরে কাল টক নরম ভেজা দানা পাওয়া যায়!  খেতে দারুন! খেয়েছো কখনো? খাওনি ? একবার খেয়ে দেখবে। আর ওইযে গোলাপি বেগুনি ফুলটা ওটার নাম পয়সা ফুল।   অনেক আগে দশ পয়সার মুদ্রা পাওয়া যেত, দেখতে এরকম তাই নাম পয়সা ফুল। দূরে ওই ফুলটার নাম কনক চাঁপা। নাম শুনেছো বোধহয়।  ময়মনসিংহ গীতে আছে, হাইট্টা না যাইতে কন্যার পায়ে পরে চুল, মুখেতে ফুইটা ওঠে কনক চাপার ফুল! আর ওই যে খরগোশ টা দৌড়ে পালিয়ে গেল যে ঝোপের আড়ালে,  ওটার নাম বন তেজপাতা। 

পাতা গুলো দেখো একদম তেজপাতার মত।  তাই না? হে হে ‘  কি বিচ্ছিরি ভাবে হাসে লোকটা।  ঠিক এই সময় দেখা গেল সামনের দিকে একজন লোক এগিয়ে আসছে। 

এই লোকটা খুবই বেটে মাথাটা শরীরের তুলনায় অনেক বড় ঠিক যেন সরু কাঠি দিয়ে আলোর মতো গেঁথে রাখা হয়েছে চোখ দুটো পান্তুয়ার মতো বড় বড় মুখে ইয়া বড় গোঁফ অমন গ্রুপ থাকলে লোকে দুধের সর বা বেলের শরবত খায় কি করে কে জানে গোঁফ ওয়ালা লোকটা সামনে এসে হাত জোড় করে বলল, 

‘প্রণাম রাঘব!  বাবু হাঁটতে বেরিয়েছেন?’ ও এই গাছপালা আর  পাখি বিশেষজ্ঞ লোকটার নাম তবে রাঘব!  ভাবলো বাবলু। 

‘হ্যাঁ  একটু হাঁটাচলা করলাম ! হে হে’  হাসতে হাসতে বলল বাবলুর নতুন বন্ধু।  আবার হাটতে লাগল দুজনে। গোঁফওয়ালা রোগা আর পাণ্ডুয়ার মত বড় বড় চোখের লোকটা উল্টো দিকে চলে গেল। 

‘তো যা বলছিলাম’  আবার কথার খেই ধরল রাঘব।  

‘আমাদের এই নিঝুমপুর দারুন সুন্দর একটা জায়গা।  সারা দুনিয়া খুঁজে ও এমন জায়গা পাবে না। কি নেই এখানে?  কত পদের ধান হয় খবর রাখো ? রাখ না । কামিনী, অমৃত শালী, কপিলা ভোগ,  কার্তিকা, জলক রাজ , পিঁপড়া বাক, বিরুই , নীলকণ্ঠী , রূপশালি, লীলাবতী,  সন্ধ্যামণি, ময়ূরপঙ্খী আর বাসমতির কথা কে না জানে ? সরু চালের ভাত সাথে যদি লেবু পাতা দিয়ে মৌরালা মাছের ঝোল রান্না করা হয় । তবে তো…’ 

আরো কি কি বলতো রাঘব কে জানে । বাবলু অবাক হয়ে দেখলো সামনের লাল কাঁকর বিছানো পথ দিয়ে হেঁটে একজন লোক আসছে।  লোকটা খুবই বেটে । মাথাটা শরীরের তুলনায় অনেক বড়। ঠিক যেন সরু কাঠি দিয়ে আলুর দম গেঁথে রাখা হয়েছে। চোখ দুটো পান্তুয়ার মত বড় বড় মুখে ইয়া বড় গোঁফ।    বাবলু অবাক হয়েছে কারণ এ লোকটা না একটু আগে হেঁটে চলে গেল? 

রোগা লোক তার সামনে এসে হাত জোড় করে বলল, 

‘প্রণাম রাঘব! বাবু হাঁটতে বেরিয়েছেন ? ‘ 

লোকটার কণ্ঠস্বর শুনে চমকে গেল বাবলু।  হুবহু আগের লোকটার মত একই কণ্ঠস্বর। হে হে করে হেসে কি সব জবাব দিলো রাঘব বাবু আর প্রশ্ন কর্তা খুশিমনে বিদায় নিল । আবার হাঁটা শুরু করলো রাঘব। 

‘ওই লোকটা কে?’  ফিসফিস করে জানতে চাইলো বাবলু । 

‘কোন লোকটা?’  অবাক হল রাঘব । 

‘আরে মাত্র আপনাকে প্রণাম জানিয়ে বিদায় নিল যে’ 

‘অহ! নাম তো জানি না । প্রতিবেশী আমাকে চেনে হে হে’ 

‘প্রথমে যে লোকটা গেল সেকি দ্বিতীয় লোকটার ভাই টাই হবে মানে দুজনের চেহারা কেমন যেন মিল পেলাম?’   বিড়বিড় করে বলল বাবলু । 

‘আরে না ‘ হাসছে রাঘব।  

‘মিল হতে যাবে কেন ? আসলে সাধারণ মানুষের চেহারা সবারই একই রকম।  একগাদা চাইনিজ বা জাপানিজ দেখে হঠাৎ করে তুমিও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাবে।  রং এর তফাৎ না হলে গাজর বা মুলার মধ্যে পার্থক্য বোঝাঁ বেশ কঠিন! কি বলো তুমি?  ‘ 

বাবলু কিছু বলার আগেই দেখতে পেল সামনের পথ দিয়ে খুবই পেটে একটা লোক হেঁটে আসছে।  মাথা শরীরের তুলনায় অনেক বড়। ঠিক যেন একটা কাঠি দিয়ে আলুর দম গেঁথে রাখা হয়েছে।  চোখ দুটো পানতোয়ার মতো বড় বড়। মুখে ইয়া বড় গোঁফ । বাবলুর বুকটা ধড়াস করে উঠল। এই লোকটা না মাত্র কথা বলে বিদায় নিল?  ঝট করে পিছন ফিরে তাকালো। পিছনে খানিক দূরে আগের লোকটাকে দেখা যাচ্ছে, অলস ভাবে হেটে যাচ্ছে । গুন করে গান গাইছে, ‘হলুদিয়া পাখি সোনারই বরণ ছাড়িলো কে’। 

আপনি ততক্ষণে সামনের লোকটা ওদের একদম কাছে এসে গেছে।  

হাত জোড় করে মিহি গলায় বলল, ‘প্রণাম  রাঘব বাবু ! হাঁটতে  বেরিয়েছেন?’

‘অসম্ভব!’ চিৎকার করে উঠল বাবলু . কারণ ওই লোকটার গলা  আর চেহারা হুবহু আগের দুই জনের মত একই।

বাবলুর চিৎকার শুনে  রাঘব আর রোগা লোক টি দুইজনেই বেশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো।

‘ কি অসম্ভব?’ জানতে চাইলো রাঘব ।

‘ এরা তিনজন একই মানুষ’ ঢোক গিলে বলল বাবলু ।

‘ তা কি করে সম্ভব ?’ বোকা বোকা ভাবে বলল রাঘব।

‘  তিনজন তিন ভাইও হতে পারে’

‘না!’  বিড়বিড় করে বলল বাবলু । ভয়ে পিছিয়ে গেল কয়েক পা । কারণ  রাঘবের গলার স্বরও বাকি তিন জনের মত।

‘ভয় পেয়েছো খোকা ?’ হে হে হাসতে হাসতে বলল রাঘব।  রাঘবের কণ্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল যে লাফ দিয়ে তিন কদম পিছিয়ে গেল বাবলু।

‘ আরে ভয়ের কি আছে বলতো দেখি?’ হাসতে হাসতে বলল রাঘব।  তারপর অন্য লোকটার দিকে ফিরে ধমকে উঠল সে। 

‘ কতদিন বলেছি নিরালা নির্জন দুপুর গুলোতে হাঁটাহাঁটি করবি না।  নতুন লোকজন এলে ভয় পেয়ে যাবে। কেউ না কেউ ঠিকই ধরে ফেলতে পারবে ! যা ভাগ শয়তান!  গমের খেতে পাখি উড়ছে যা!’

ধমক খেয়ে রোগা লোকটা দৌড়ে চলে গেল দূরের গম ক্ষেতের দিকে।  ওখানে পাকা সোনালী গম বাতাসে দুলছে। কচি কলাপাতা রঙের কয়েকটা পাখি উড়ছিল গম ক্ষেতের উপর।  রোগা লোকটা একটা কান্ড করলো হা করে লাফ দিতে লাগলো । কপ করে মুখের ভিতর ঢুকে গেল একটা টিয়া পাখি ।

আরেকটা লাফ  দিতেই মুখে ঢুকে গেলে আরেকটা পাখি।

লাফ দিয়ে এত উপরে কেউ উঠতে পারে ভাবাই যায় না!  মোট পাঁচটা টিয়া পাখি খেয়ে ফেলল লোকটা । বাতাসে করাত চলার মত করে ভাসতে লাগল কয়েকটা কলাপাতা রঙের পালক।  ধীরে ধীরে সেই সবুজ পালকগুলো নেমে এলো নিচে। পড়ে রইল সবুজ ঘাসে। পাখি খাওয়া শেষ করে রোগা লোকটা ফিরে তাকালো ওদের দিকে।  মিটিমিটি হাসছে সে।

ভয়ে বাবলুর কলিজা টা ঠান্ডা হয়ে গেল।  কারণ রোগা লোকটার বদলে ওখানে একটা কাকতাড়ুয়া দাঁড়িয়ে আছে।   কাকতাড়ুয়ার মাথাটা মাটির পাতিল দিয়ে বানানো। কালো রঙ মাখা পাতিলে চুন দিয়ে চোখ আর নাক এঁকে দেয়া হয়েছে।  সরু কঞ্চি দিয়ে বানানো হয়েছে হাত পা আর রং জলা একটা ঢোলা লাল জামা গায়।

বাতাসে জামাটা পতপত করে উড়ছে।

‘ সবকটা কাকতাড়ুয়া কে বলেছি দুপুরবেলা লোকজন থাকলে যেন হাটাহাটি না করে!’  বিরক্ত হয়ে বলল রাঘব।

‘কিন্তু হারামজাদা গুলো একদম কথা শোনে না একটু সুযোগ পেলেই,  রোদ টা একটু চনমন করে উঠলেই হাঁটতে বেরিয়ে যায় আহাম্মক গুলো’

চিৎকার দিয়ে পিছিয়ে গেল বাবলু।  আতঙ্কে থর থর করে কাঁপছে। রাঘবের জায়গাতে দাঁড়িয়ে আছে একটা কাকতাড়ুয়া।  হাসি হাসি মুখে চেয়ে আছে বাবলুর দিকে। ঝেড়ে দৌড় দিল বাবলু। হে হে করে হেসে উঠল কাকতাড়ুয়া গুলি।

পাগলের মতো দৌড়াচ্ছে বাবলু।  রাস্তাঘাট কিছুই চেনে না। ফরেস্ট অফিসারের বাংলা থেকে কত দূরে চলে এসেছে বলতে পারবে না।  চারিদিকের সবকিছুই ওর কাছে একই রকম লাগছে। দৌড়াতে গিয়ে কি মনে করে একবার পিছন দিকে তাকালো,   ঘাড়ের কাছের সবগুলো চুল সর সর করে দাঁড়িয়ে গেল। একগাদা কাকতাড়ুয়া ওর পিছন পিছন খরগোশের মত লাফাতে লাফাতে ছুটে আসছে ওকে ধরার জন্য।

দৌড়াচ্ছে বাবলু । মাথার ওপর আস্ত একটা কদম ফুলের মত ঝুলে আছে সূর্যটা।

তাপ ছাড়াচ্ছে ইচ্ছামত দরদর করে ঘামছে ও।  শেয়ালকাঁটার ঝোপে হাত পা ছিড়ে গেল কতোবার।  চোর কাটা বিঁধছে পায়ে পায়ে। পিছনে হে হে শব্দ হচ্ছেই ।

বহুদূর থেকে ফরেস্ট অফিসার দের বাংলা টা দেখতে পেল বাবলু। 

অতদূর যেতে পারবে?  দৌড়ে দম আটকে যাচ্ছে যেন!  দূর থেকে ও কেনারাম কে দেখতে পেল।  দুই হাতের তালুর মধ্যে খানিক সুপোরির কুচি নিয়ে চুন মাখিয়ে আচ্ছা মতো ঢলছে।  অবাক চোখে তাকালো কেনারাম! ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে গেল কেনারামের চেহারা। ধোয়া হয়ে মিলিয়ে গেল কোথায় যেন।

পরদিন জ্ঞান ফিরল বাবলুর।  প্রথমে ভেবেছিল মারা গেছে ও।  বাংলোর মধ্যে নিজের বিছানায় আবিষ্কার করল , গায়ে নরম তুলতুলে কম্বল।  বিছানার পাশে কাঠের টেবিল একটা ঝরিতে কমলা রাখা। বাইরে হলুদ রোদ জানালা ধরে ঝুলে থাকা বাগান বিলাস এর পাতাগুলো থর থর করে কাঁপছে।  পাশে বসেছিল কেনারাম।

চুরি করে একটা কমলা খাচ্ছিল। ধরা পড়তেই পিচিক করে হাসল সে।

‘ কইছিলাম না দুফুর বেলা আঘাটে  বিঘাটে না যাইতে’ , একটা কমলার কোয়া থেকে সাদা রঙের চুল দাড়ি পরিষ্কার করতে করতে বলল কেনারাম।

‘ এখন মজা তো বুঝছেন?’

‘ওগুলো কি ছিল?’ ,  চড়ুই পাখির মত চি চি করে প্রশ্ন করল বাবলু ।

‘আমি ক্যামতে কমু আপনি কি দেখছেন?’   গম্ভীর গলায় বলল কেনারাম ।

টপ করে মুখের ভেতর একটা কমলার কোয়া  পুরে দিল।

‘  মিথ্যা কথা বলছেন কেন?’  বিরক্ত হলো বাবলু।

‘ আপনি নিশ্চয়ই সব জানেন!  মামা ও সব জানেন। কি ছিল ওগুলো?’

‘ওগুলো রাঘব রায় আর হের সব কাকতাড়ুয়া’,   ফিসফিস করে বলল কেনারাম।

‘রাঘব রায় কে?’  কেনারাম নতুন আরেকটা কমলার খোসা ছিলতে  ছিলতে অদ্ভুত একটা কাহিনী বলল,

“অনেক আগে এই এলাকায় অম্বিকাচরণ নামে এক বদ রাগি জমিদার ছিলেন।  তার মেজাজ খুব সহজেই গরম হয়ে যেত। বিশেষ করে দুপুরবেলা ভদ্রলোকের গাছপালার খুব শখ ছিল।  সব ধরনের গাছপালা বুনতে আর পরিচর্যা করতে ভালোবাসতেন। একবার বিদেশ থেকে প্রচুর আনারসের চারা এল।  আনারসের একটা বিশাল খেত বানান। কিন্তু সমস্যা হলো পাখি এসে পাকা আনারস ঠুকরে ঠুকরে খেয়ে যেত। রাঘব রায় নামে এক লোক কে ক্ষেত   পাহারার ভার দেয়া হলো। একগাদা কাকতাড়ুয়া বানিয়ে জমিদারবাবুর ফসলের ক্ষেতের নানান জায়গাতে পুতে রাখল রাঘব। দিনের বেলা নিজেই পাহারা দিত,  রাতে কাকতাড়ুয়া দেখে ভয়ে পাখি আসতো না। তবে পাখিদের মতো বুদ্ধিমান প্রাণী আর হয় না, ওরা বুঝে গেল কাকতাড়ুয়াগুলা কিছুই করতে পারবে না। কাকতাড়ুয়া দেখে ভয় পাওয়ার দরকার নেই । “

“এক সকালে জমিদার অম্বিকাচরণ হাঁটতে গিয়ে আবিষ্কার করেন অনেকগুলো আনারস পাখিতে ঠোকরে  খেয়ে ফেলেছে! ভীষণ ক্ষেপে যান তিনি। রাঘব রায় কে ডেকে অনেক মানুষের সামনে অপমান করেন।  মারধর করেছেন এমনও তো বলে লোকজন। করতেই পারেন মুখের কথায় কি উনার মত লোকজন শান্ত হন? 

 শেষে নির্দেশ দেন সেই দিনের মধ্যেই রাঘব রায় কে এই নিঝুম পর ছেড়ে চলে যেতে হবে।  ব্যাপারটা দুঃখজনক! মনে বেশ ব্যথা পায় রাঘব। বারবার জমিদার অম্বিকাচরণ বাবুর কাছে অনুরোধ করে সে,  যাতে আরেকটা সুযোগ দেয়া হয় তাকে। অনেক অনুরোধের পর টা সুযোগ পায় রাঘব । পাগলের মতো দিনরাত ফসলের ক্ষেতের চারিদিকে ঘুরে বেড়ায় সে।  হাতে টিনের একটা কৌটা। গাছ গাছরার শুকনো ডাল দিয়ে ট্যাম ট্যাম শব্দ করে টিনের কৌটায়। নিঝুম পুরের পাখিরা বড় বজ্জাত! ওরা সারাক্ষণই ঝাঁকে ঝাঁকে নেমে আসে ফসলের ক্ষেতে!  আরো একবার ব্যর্থ হয় রাঘব! এবার ফল ভাল হয় না।

জমিদার অম্বিকাচরণ তার পোষা লোক দিয়ে মারধোর করে প্রায় আধমরা করে ফসলের ক্ষেতের ঠিক মাঝখানে কাকতাড়ুয়ার মত বেঁধে রাখে  রাঘব কে। মোট চার দিন বেঁচে ছিল রাঘব। এক ফোটা জল দেয়া হয়নি ওকে। মাঝে মাঝে পাখি এসে ওরে বসতো ওর মাথায় বা কাধে। চিৎকার করে উঠতো রাঘব।

রাঘব মারা যাবার পরের সপ্তাহে ঠিক দুপুরে খেতে কাজ করছিল এক কৃষক।  সে দেখে রাঘব হেঁটে বেড়াচ্ছে। দৌড়ে গিয়ে লোকজনকে খবর দেয় সে। লোকজন এসে অবশ্য কিছুই পায় না। “

 

“এরপর এই অদ্ভুত একটা কিংবদন্তি ছড়িয়ে পড়ে নিঝুমপুরে ।  সবাই দেখেছে দুপুরবেলা এলাকার সব কাকতাড়ুয়া জ্যান্ত হয়ে হেঁটে বেড়ায় পথে ঘাটে।  পাখি দেখলেই দৌড়ে গিয়ে খেয়ে ফেলে।

সেই ভুতুড়ে কাকতাড়ুয়া গুলো আর ওদের সরদার হচ্ছে আমাদের সেই রাঘব।

জমিদার অম্বিকা চরণ মারা গিয়েছিলেন পরের মাসেই।  তাদের অবস্থা পড়ে যেতেই তার পরিবারের সবাই কলকাতা চলে যায়।  সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যায়। তবে রয়ে যায় রাঘবের কথা আর সেই ভৌতিক কাকতাড়ুয়ার কথা।

নতুন  অনেকেই এলে ওদের সাথে দেখা হয়ে যায়।  কারো কোন ক্ষতি করে না অনেকে জানতেই পারে না নিঝুমপুরে একগাদা মানুষ ঘুরে বেড়ায় যারা আসলে মানুষ না কাকতাড়ুয়া । “

কেনারাম এর গল্প  শেষে পরিবেশ টা কেমন যেন থমথমে হয়ে গেল।  কেনারাম নতুন একটা কমলা নিয়ে খোসা ছাড়াতে লাগলো।  বাইরে তখন গাঁদা ফুলের পাপড়ির মতো হলুদ রোদ। সব শুনশান।

চুপ করে বিছানায় শুয়ে রইলো বাবলু।  ভাবছে এই গল্প কাউকে বললে কেউ বিশ্বাস করবে?

এমন সময় বহুদূর থেকে টিনের শব্দ ভেসে এল টেম টেম করে।

‘ ঠিক দুফুর বেলা’  বিড়বিড় করে বলল কেনারাম।

‘রাঘব বেরিয়েছে’ !