রাজপুরীর মাঝেই মন্দির, ভিতর থেকে দরজা আটা । চম্পাবতী তাপসী কুমারী । সে দেবীর আরাধনা শেষে রাতে মন্দিরেই ঘুমায় । অনেক বেলা হলো, চম্পাবতী এখনো মন্দিরের দ্বার খোলে নি।
“চম্পা, চম্পা!’ লীলাবতী বেশ কয়েকবার মন্দিরের দরজা টোকা দিলেন। কিন্তু মেয়ের সাড়া পেলেন না। মেয়ে তো তার কখনোই এত দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে না। আজ কেন দেরি করছে? লীলাবতী আরও কয়েকবার দরজায় টোকা দিলেন । কোনও সাড়া পাওয়া গেল না।
“ঠিক আছে, ঘুমোক। একদিন না হয় দেরিতেই উঠল ।’
লীলাবতী কাজে চলে গেলেন। তার রাজ্যের কাজ পড়ে আছে। আসলেই রাজ্যের কাজ। তিনি যে
চম্পাবতী কিন্তু মন্দিরের মাঝে জেগেই ছিল। তার ঘুম ভেঙেছে অনেক আগে । মায়ের ডাকাডাকি, বাইরের কোলাহল সবই সে শুনতে পেয়েছে। কিন্তু দরজা খুলতে তার ইচ্ছে করছে না।
সে ঝিম ধরে বসে আছে, একটুও ভালো লাগছেনা তার। আরাধ্য দেবীর সামনে নিজেকে অশুচি মনে হচ্ছে।
গতরাতে সে এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছে, এমন স্বপ্ন দেখাও যে তার পাপ। আরও অদ্ভুত বিষয়, এটা স্বপ্ন নাকি বাস্তব চম্পাবতী বুঝতে পারছে না। এই স্বপ্নের মধ্যে আবার একটা অন্যধরনের ভালো লাগাও আছে। তবে সেই ভালো লাগাই কি তাকে আভিভূত করে রেখেছে। ছিঃ ছিঃ সে এসব কি ভাবছে! চম্পা অভিশাপ দেয়। এ যে পাপ!
চম্পাবতী আরো অনেক পরে মন্দিরের দ্বার খোলে। দ্বার খুলতেই একঝাক পাখির কিচিরমিচির, ফুলের গন্ধ আর অবাধ্য রোদুর এসে ঘরে ঢোকে। চম্পাবতী দরজার পাল্লায় হেলান দিয়ে চৌকাঠে দাঁড়ায়। মন্দিরের পাশেই ফুলের বাগান। ফুলেরা অবাক হয়ে চম্পাকে দেখছে আর ভাবছে, “ও এত সুন্দর কেন? ও যদি এত সুন্দরই হবে তবে এ বাগানে ফুল না ফুটলেও তো চলে!”
মালিনী ফুলগাছে পানি দিচ্ছে আর বারবার আচল দিয়ে মুখ মুছছে। এই ফুলের বাগানে রাতে পরীরা নেমে আসে। ঝুম্ ঝুমু ঝুম্ তাদের নৃপুরের ধ্বনি শোনা যায়। তারা নাচে, গায়, ফুলদের গলা জড়িয়ে হাসাহাসি করে। তারপর কোথা থেকে এসে আবার কোথায় মিলিয়ে যায়- কে জানে! চম্পাবতী হাত ইশারায় মালিনীকে ডাকে । মালিনী জলের পাত্র রেখে হাত মুছতে-মুছতে এসে দাড়ায়।
বলে, “আমায় ডেকেছেন, মা?”
“শোনো মালিনী, জোরপায়ে চলে যাও সইয়ের বাড়ি। এখনই সইকে আসতে বলবে । বলবে, দেরী আমার সইবে না।”
মালিনী বুদ্ধিমতী, সে ত্বরা বোঝে । জলের পাত্র, নিড়ানি বাগানেই রইলো । জোর পায়ে চলল সইয়ের বাড়ি। চম্পাবতী রাজার কুমারী! মহারাজা মুকুট রায়ের একমাত্র কন্যা । চম্পাবতীর আরও আছে সাত ভাই। সাত ভাই চম্পা। চম্পা সাত ভাইয়ের নয়নের পুত্তলি।
রূপ সে তো বিধাতার দান, চম্পাবতী বিদ্যা-বুদ্ধিতেও সমান পারদর্শী । রাজ্য পরিচালনায় মহারাজার প্রধান উপদেষ্টা তার একমাত্র আদরের কন্যা ।
মহারাজা মুকুট রায় ব্রাহ্মণনগরের রাজা। তার রাজ্যে যবন তো ছাড়, কোনো শৃদ্ররেও স্থান নেই। মুকুট রায়ের রাজ্য শুচিসুন্দর ৷ কোনো নীচু জাত একে অশুচি করবে তা হবে না। তার রাজ্যে ভুলকরেও যদি কখনও কোনো যবন ঢুকে পড়ে তার শিরোচ্ছেদ অবধারিত এটা রাজার বিধান ।
মেয়ে অহংকারী বাবাকে বলে, ‘বাবা, তোমার সবকিছুই আছে। হাতিশালে হাতি আছে, ঘোড়াশালে ঘোড়া আছে, প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী আছে, রাজকোষে অর্থ আছে, সু-সন্তান সন্ততি আছে। শুধু একটা জিনিস নেই।’
মেয়ের মাথায় স্নেহের হাত রেখে মহারাজ বলেন, “আর আমার সর্বগুণে গুণান্থিতা একটা কন্যাও আছে। তবে আর বাকি রইলো কি?’
চম্পা বলে, ‘তোমার একদম সহনশীলতা নেই বাবা! তুমি নৃপতি হয়েও মানুষে-মানুষে বিভেদ করো।’
রাজা বলেন, “আমি নই মা, এটা বিধাতার বিধান। ব্রহ্মার মাথা থেকে
ব্রাহ্মণ, হাত থেকে ক্ষত্রিয়,
উরু থেকে বৈশ্য, আর পা থেকে এসেছে শুদ্র। এই বিভাজন কি আমি করেছি? না স্বয়ং ভগবান করেছেন?”
চম্পা বলে, “কিন্তু বাবা, মাথা, হাত, উরু, পা এসব তো একই শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ মিলেমিশে
একাকার হয়ে আছে। একই সঙ্গে ক্রিয়া করছে। তুমি মাথা, বিধাতা তোমাকে উঁচুতে স্থান দিয়েছে তুমি
নৃপতি কিন্তু পা ছাড়া চলবে কী করে? শুদ্রের গুরুত্বকে খাটো করে দেখা কি নূপতির সাজে?
মহারাজ প্রশ্রয়ের হাসি হাসেন। বলেন, “তুই বিদূষী। ভাষা-তর্কে আমি তোর সঙ্গে পারব না। কিন্তু শক্তিতে আমি সকলকে ছাড়িয়ে যেতে পারি। আমি মুকট রায়! ব্রাম্মননগরের অধিপতি । আমার রাজ্যে ব্রাহ্মণ ছাড়া আর কারও ঠাই নেই, হবেও না। যবন পেলেই তার শিরোচ্ছেদ। আমি তোর সব উপদেশ শুনব। তবে এক্ষেত্রে আমি নাচার। আমি হয়তো অহংকারী, কিন্তু মা, আমি জেনে-শুনেই অহংকারী ।”
বাবার কথা শুনে চম্পাবতী হাসে । অবাধ্য বাবার চুলে বিলি কাটতে-কাটতে বলে, “বাবা, তুমি ছোট মানুষের মতোই দেমাগী ।’
“তোর কাছে আমি ছোট মানুষই, মা।”
মালিনীর মুখে বার্তা পেয়ে সই এল দুপুরের পর। চম্পাবতী অধীর হয়ে বসে ছিল। সইকে দেখে
চম্পাবতী কপট রাগ-দেখিয়ে বলল, “তোর এতক্ষণে আসার সময় হলো? এদিকে আমার যে প্রাণ যাবার
জোগাড়!”
সই বলে, ‘রাজপুরীতে আসার তো একটা বিধান রয়েছে। স্বয়ং রাজকন্যা আমাকে তলব করেছে,
একি চারটিখানি কথা! খালি হাতে আসি কি করে?’
সই আচলের তলা থেকে মিঠাইয়ের হাঁড়ি বের করে। বেছে বেছে সেই মিষ্টিগুলোই এনেছে;
চম্পাবতীর যা পছন্দ ৷ ছোট বেলার সই তারা । চম্পাবতী কিসে খুশি সেটা তার চেয়ে আর কে-ই বা বেশি জানে।
চম্পাবতী মিঠাইয়ের দিকে ফিরেও চাইলো না। এক পাশে সরিয়ে রেখে দিলো ।
সই বলে, “কী হয়েছে, চম্পা? মন কি খুব বেশি খারাপ?
চম্পাবতী বলে, “আমার যে বড় বিপদ, সই।’
চম্পার মুখে এ-কথা শুনে সই হেসেই সারা । হাসতে হাসতে বলে, ‘শোনো কে কোথায় আছ!
রাজকন্যা কি বলছে শুনে যাও, তার নাকি বিপদ! দুর্গতিনাশিনীর আবার দুর্গতি? হাতি সাজো, ঘোড়া
সাজো, চম্পা বিপদে পড়েছে।’
হাসি তামাসার ফাকে সই হঠাৎ তাকিয়ে দেখে চম্পাবতীর চোখে জল সই সাথে সাথে নিজেকে
সম্বরণ করে নেয় । চম্পার আরো কাছে ঘেঁষে বসে বলে, “আমাকে বল্, কী হয়েছে সই?
“সেই কথা বলার জন্যই তো তোকে ডেকেছি। আমাকে বলতে দিলি কই?
সই বলে, “বল চম্পা, আমি শুনছি।’
চম্পাবতী বলতে শুরু করে, “সই, গতরাতে আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি। আমি দেখেছি, মন্দিরে আমার সাথে এক নওল যুবাপুরুষ, তার সূর্যকান্তি রূপ, তার তেজদীপ্ত চেহারা । অথচ কতই না শাস্ত-সৌম্য, কতই না ধ্যানী সে।”
চম্পার মুখে একথা শুনে সই আবার মুখ টিপে হাসে। বলে, ‘সেই তেজদীপ্ত পুরুষকে তোর মনে ধরেনিতো সই?
চম্পা সইয়ের প্রশ্ন এড়িয়ে বলে, “সেই যুবাপুরুষ কিন্তু যবন। তার নাম গাজী খান।
সই বড় বড় চোখ করে কপট ভয় পাওয়ার ভঙ্গিতে বলে, ‘ভাগ্যিস তাকে স্বপনে দেখেছিস! বাস্তবে হলে তো এতক্ষণে মহারাজ তার গর্দান নিতেন।’
চম্পা বলল, “সই, স্বপ্নটা কিন্তু বাস্তবেরই মতো আবার বাস্তবটাও স্বগ্নেরই মতো ।
“এ কথার অর্থ কী?’ সই কিছু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করে ।
চম্পা বলে, ‘আমি যা দেখেছি, তা স্বপনে নাকি বাস্তবে বুঝতে পারছি না। গত রাতে এ যবন গাজী তার অঙ্গুরীর সাথে বাস্তবেই আমার অঙ্গুরীর বদল হয়েছে, তার পালঙ্কের সাথে বাস্তবেই আমার পালঙ্ক বদল হয়েছে।”
একথা শুনে সই বিস্ময়ে গালে হাত রেখে বলে, ‘এ কী বলছিস, সই দেখি দেখি তোর হাত!”
সই চম্পার হাত টেনে নেয়, “সত্যিই তো! তোর অঙ্গুরী কোথায়? তোর অনামিকায় এ কার অঙ্গুরী? তুই যাকে স্বপ্ন ভাবছিস, সে তো বাস্তব!”
চম্পাবতী বলে, ‘দেখ সই, আমার মন্দিরের আগল ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। দরজায় ছিল সজাগ পাহারাদার। প্রাসাদের সিংহদ্ধারেও ছিল পাহারাদার । এতকিছু টপকে এঁ যবন কী করে তার খাট-পালঙ্ক নিয়ে আমার ঘরে ঢুকল, আর সকাল না হতে গেলই বা কোথায়?”
সই বলে, “তুই চম্পাবতী, তুই বিদ্যামতী। যে উত্তর তুই নিজে জানিস না, সেই উত্তর আমি পাব কোথায়? তবে এটা বুঝতে পেরেছি, তুই বিপদে পড়েছিস। তুই ঘোর বিপদে পড়েছিস। মন থেকে এ যবনকে মুছে ফেল্।”
“তা আর সম্ভব নয়, সই । আমি অনেক চেষ্টা করেছি।”
চম্পাবতী আবার ঝিম ধরে বসে থাকে। কিছুক্ষণ পর ফিস ফিস করে সইকে বলে, “একটা কাজ কিন্ত আমি করতে পারি সই । আমি যা দেখেছি তা স্বপ্ন নাকি বাস্তব, এটা জেনে নিতে পারি । আর আমার ভবিষ্যৎ ভাগ্যেই বা কী আছে এটাও জানার উপায় করতে পারি।”
“কী উপায়?”, সই জিজ্ঞেস করে ।
চম্পা বলে, “আমি এখন যেসব দ্রব্যের নাম বলব, তুই আমার ছল ভেঙে সে-সব দ্রব্য আমাকে এনে দে। দেখব তোর কেমন বুদ্ধি”
“শুনহ প্রাণের সই, দ্রব্যজাতের নাম কই
তাতে তুমি দিয়া যাও মন।
যে দ্ব্যর অমূল যার নাই কোনো তুল
সে দ্রব্য না মিলে সদান্তর
পাথরের সঙ্গে যুদ্ধ, তার রক্তে পুজা শুদ্ধ
যতনে তাহাকে লেহ মূল
শুকল গঙ্গার জল, আকাশের জায়ফল
আর লেহ আকাশের গোটা ।
ফুল ফল নাহি জাত, আন সেহি গাছের পাত
কালিপূজা করিব সর্বথা।
মধু কুণ্ডের পানি লেহ, সত্য কড়ি গনি দেহ .
আর লেহ সাগরের দধি।
অগ্নিজ্বালে ফোটে ফুল, তাহা লেহ করি মূল
তাহা লেহ কেশরী চম্পাবতী ।
হরিতাল বর্ণফল, যাহাতে দেবী ব্যাকুল
সেহি ফল ফলের প্রধান।
অনুলীন কুলীন চিনি, চম্পা নামে লেহ কিনি
যার পিণ্ডে তুষ্ট দেবগণ ।
বসুমতীর ডিম্ব লেহ, সত্য কড়ি গুনে দেহ
আর লেহ কিনি গক্ষীর বাছা।
ব্রহ্মার আহুতি, এহি সব দ্রব্য জাতি
শীঘ্র করি তুমি যাহ হাটে ।
ঘরে আইস শীঘ্র গতি, কহিলাম চম্পাবতী
শুন হের প্রাণের সই।
চম্পাবতীর ফর্দ নিয়ে সখি আচল ঘুরিয়ে কোমরে জড়িয়ে, গ্রীবা বাকিয়ে বাজারে চলে । আর নিজেই নিজের সাথে কথা বলে, “সই লো, তোর এই ছল যদি ভাঙতে না পারি, তবে আমি কিসের প্রাণের সই ।”
হাটে পৌছে সই চম্পাবতীর ছল ভাঙতে শুরু করে, পাথরের সঙ্গে যুদ্ধ তার রক্তে পূজা শুদ্ধ-সখি ভেবেচিন্তে চন্দন কাঠ কিনে নেয়। মধুকুপ্ডের পানি- এ নিশ্চয় চিনি, সই সের চারেক চিনি কিনে নিল । গগনের গোটা আর সাগরের দধি, এ তো খুবই সহজ, সখি সুপারি আর চুন কিনে নিল ।
ফুল ফল নাহি জাত আন সেহি গাছের পাত, সখি ভেবেচিস্তে সাত বেড়ী পান নিলো। অগ্নিজ্বালে ফোটে ফুল, সই কিনে নিল খই । চম্পাবতীর নামে ফল, সে তো চম্পা কলা । এইভাবে সখি হাট থেকে ফর্দ অনুযায়ী সকল দ্রব্য এনে চম্পাবতীকে বুঝিয়ে দিলো । চম্পাবতী ফর্দ মিলিয়ে দেখে আর মিটি মিটি হাসে। বলে, “কিছুটা ওলট-পালট হলেও তুই প্রায় ঠিকমতোই ছল ভেঙেছিস। এই না হলে আমার সই।’ সইকে বলে, “এবার তুই যা, তোর এখন ছুটি । আমি পুজোয় বসব।’
সই চলে যাওয়ার পর চম্পাবতী সকল দ্রব্যের প্রসাদ সাজিয়ে পুজোয় বসে। তার আরাধ্য দেবী কখনোই চম্পাবতীকে বিমুখ করেন নি। আজও বিমুখ করলেন না। মন্দির আলোকিত করে হঠাৎ আরাধ্য দেবী আবির্ভূত হলেন। চম্পার প্রতি স্নেহের হাসি হেসে বললেন, “আমার কাছে তুই কী জানতে চাস তা আমি জানি।
গাজীকে স্বপনে নয়, তুই বাস্তবেই দেখেছিস। গাজীর সাথে সত্যি সত্যিই তোর অঙ্গুরী বদল হয়েছে।’
চম্পা বলে, “কিন্ত মা, মন্দিরের আগল আটা ছিল। সিংহঘ্ধারে ছিল বিনিদ্র প্রহরী । যবন মন্দিরে এসে ঢুকল কী করে, আবার সকালে গেলই বা কোথায়?”
দেবী বলেন, ‘তোর মতো গাজীও এখন সুন্দরবনে বসে একই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে। গাজীও এখন ভাবছে সে এক নিমেষে ব্রাহ্মণনগরের মন্দিরে তোর কাছে পৌছালো কী করে, আবার সুন্দরবনে ফিরে গেলোই বা কী করে? জেনে রাখ এটা পরীদের কারসাজি, আর এটাই তোদের নিয়তি।”
চম্পা শুধায়, ‘নিয়তি রুখে দেয়ার কোনো উপায় কি নেই, মা? শেষ পর্যস্ত এক যবনের সাথে আমার ভাগ্য বাধা পড়ল? আমার বাবার বুকে যে শেল বিধবে!”
দেবী বলেন, “নিয়তি অপ্রতিরোধ্য। নিয়তির বিরুদ্ধে যে যাবে সে-ই নির্মূল হবে। গাজীকে যবন ভেবে তুচ্ছজ্ঞান ঠিক নয়, সে বৈরাটনগরের বাদশা সেকেন্দারের পুত্র। বিশাল তার ক্ষমতা, বিত-বৈভব। গাজী নিজেও আধ্যাত্মিক জ্ঞানে বলীয়ান। সে মুসলমান ফকির, তবে একদিন গাজী তার উদারতা দিয়ে হিন্দু-মুসলমান সকলেরই পূজনীয় হবে”
সব শুনে চম্পাবতী বলে, “এখন আমি কী করব তুমিই বলে দাও, মা।’
দেবী বলেন, “নিয়তির কাছে নিজেকে সপে দাও ।’
দেবীর বাণী শুনে দিশেহারা চম্পাবতী তারপর থেকে দিন-রাত মন্দিরে নিবেদিত হলো । রাজা দরবার থেকে সন্ধ্যায় অন্দরে ফিরে মেয়েকে খোঁজেন, মেয়ে কোথায়? মেয়ে তার মন্দিরে।
চম্পার সাত ভাই চম্পাকে খুঁজে ফেরে, বোন কোথায়? বোন তাদের মন্দিরে।
লীলাবতী মেয়েকে বোঝান, ধর্মাচার ভালো কাজ। তাই বলে বাপ-ভাইদের বিসর্জন দিয়ে তো নয়।
সবাইকে নিয়েই তো জীবন। কোনো উপদেশই চম্পাকে এখন আর স্পর্শ করে না, কারণ সে তো জানে সামনে তার ঘোর অমানিশা।
এমনি করে দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়। সাত ভাই চম্পাকে ডেকে ডেকে ফিরে যায়। অবশেষে সাত ভাই ভেবে ভেবে ঠিক করে, তারা মৃগয়ায় যাবে সুন্দরবনে । সেখান থেকে বোনের জন্য জীবন্ত উপহার নিয়ে আসবে । সাত ভাই মন্দিরে বোনের পাশে বসে।
তারা বলে “বোন, আমরা মৃগয়ায় যাচ্ছি। তোর জন্য হরিণ আনব, না হরিণের ছানা? চাইলে বাঘের ছানাও এনে দিতে পারি।’
চম্পাবতীও স্বাভাবিকভাবে হেসে হেসে ভাইদের সঙ্গ দেয়, গল্পগুজবে মশগুল হয়।
বড় ভাই বলে, “বাঘের বাচ্চা কেন, আমরা ওর জন্য বিশাল এক বাঘই নিয়ে আসব, সুন্দরবনের বাঘ। এ বাঘ হবে ওর বর। ও বাঘের সাথে সংসার করবে, সবাই বলবে বাঘের বউ”
চম্পাবতী বলে, “বাঘের গায়ের গন্ধ তোমাদের সহ্য হবে তো দাদারা?’
ভাইয়েরা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে বলে, “তুই সত্যি সত্যি বাঘের সংসার করবি নাকি রে? বাঘের গন্ধ তোর নিজের সহ্য হবে তো? .
চম্পা বলে, ‘শোনো দাদারা, তোমাদের একটা গল্প বলি, খুব মজার গল্প ।’
চম্পাবতী নড়েচড়ে বসে, গল্প বলতে শুরু করে-
“কোনো এক গ্রামে এক গৃহস্থ পরিবার ছিল। গৃহস্থের চার ছেলে-মেয়ে ছিল, তিনটি ছেলে একটি মেয়ে”
‘ও, বুঝেছি তুই যেমন আমাদের একমাত্র বোন, ঠিক তেমন-ই।”
“আহা, গল্পের মধ্যে বাধা দিও না” চম্পাবতী আবার গল্প বলতে শুরু করে,
“ছোট বোন তিন ভাইয়ের আদরের ধন, নয়নের মণি …
গল্পের মধ্যে সাত ভাই আবার বাধা দেয় । বলে, “আচ্ছা, বোনের নাম কী তা যে বললি না? ওর নাম কি কিরণমালা?
চম্পাবতী বলে, “আচ্ছা, ধরে নাও ওর নাম কিরণমালা ।’
“তা, কিরণমালা তিন দাদার কোলে আনন্দে আহ্রাদে বড় হতে থাকে। তারপর একদিন গৃহস্থ আর তার বউ বৃদ্ধ হয়ে মারা গেল। কিরণমালার দাদারাও উপযুক্ত হলো। তারা নিয়ম-মতো বিয়ে করল। তিন পরমাসুন্দরী বউ এল ঘরে। বউদের পেয়ে দাদারা কিরণমালাকে ভুলে গেল।
কিরণমালার খবর এখন আর কেউ রাখে না। বউদিরা তাকে হেঁসেলে, গোয়ালে কাজ করায়। একদিন সন্ধ্যায় কিরণমালা হেসেল থেকে ফিরে দেখে তার বউদিরা ডাঁসা পেয়ারা খাচ্ছে।
কিরণমালা বউদিদের বলল, “আমাকেও একটা দাও না, বউদিমনিরা ।’ ৰ
বউদিরা বলল, “আহা, সখ কত! অতো লোভ করতে নেই। আর বেশি যদি লোভ হয়, গাছ থেকে পেড়ে খাও গিয়ে ।”
কিরণমালার জিদ হলো । একটা পেয়ারাও বউদিরা তাকে দিলো না, আর সে কিনা সারাদিন হেঁসেলে গোয়ালে খেটে মরছে!
কিরণমালা সন্ধ্যায় বাগানে গিয়ে ঢুকল । একটা বড় পেয়ারাগাছ বেছে নিয়ে কিরণমালা গাছে চড়লো। অনেকগুলো ডাসা পেয়ারাও পেয়ে গেল। কিন্ত এমন সময় এক মহা বিপত্তি দেখা দিলো। কোথা থেকে হেলেদুলে এক কেঁদোবাঘ এসে হাজির। এসে দাড়ালো একেবারে সেই গাছটির নিচে, যে গাছে চড়ে কিরণমালা পেয়ারা পাড়ছিল। কিরণমালা তো ভয়েই অস্থির!
বাঘ কিরণমালাকে ডেকে বলল, ‘খুকী, আমাকে একটা পেয়ারা ছুড়ে দাও তো।’
কিরণমালা একটা পেয়ারা ছুঁড়ে দিলো। বাঘ সেই পেয়ারাটা খেয়ে বলে, ‘খুকী আমাকে আরেকটা পেয়ারা ছুঁড়ে দাও ।”
কিরণমালা তাকে আর একটা পেয়ারা ছুঁড়ে দেয়, বাঘ সে পেয়ারাটাও খেয়ে বলে, ‘খুকী আমাকে আরেকটা পেয়ারা দাও।’ এমন করে কিরণমালা গাছের সব পেয়ারা ছুঁড়ে বাঘকে দিয়ে দিলো ।
ওদিকে রাত হয়ে গেছে। কিরণমালা বাড়ি ফিরবে কী করে? বাঘ বলে, ‘থুকী, আমাকে কি ভয় হচ্ছে?’
কিরণমালা ঘাড় নেড়ে বলে, ‘হ্যা।’ তাহলে ভয়ের ঘাড়ে চেপে বসো। দেখবে আর ভয় করবে না।
কিরণমালা গাছ থেকে নেমে বাঘের ঘাড়ে চেপে বসে। বাঘ তাকে বাঘ ঘাড়ে নিয়ে হেলেদুলে চলে
গেল তার গুহায় । সেখানে তাদের বিয়ে হলো।
তিন ভাইয়ের আদরের ছোট বোন এখন বাঘের সাথে ঘর করে, বাঘের সাথে সংসার করে।
একদিন বাঘ তাকে বলল, ‘বউ, আমাকে একটু দূর-বনে যেতে হবে। তিন দিন পরে ফিরে আসব। তুমি এ কদিন সাবধানে থেক। একদম গুহার বাইরে বের হবে না।’
বাঘ চলে গেলো দূর বনে।
কিরণমালা প্রথম দিন গুহাতেই কাটাল। দ্বিতীয় দিন সকালে কিরণমালা শুনতে পেল বনের পশুরা বড়ই অস্থির ।
এদিকে ওদিকে দৌড়ায়। পাখিরা উড়ে পালায়।
কিরণমালা গুহা থেকে উঁকি দিয়ে দেখে, তার আদরের তিন ভাই শিকারে এসেছে।
আনন্দে সে আত্মহারা । ভুলে গেল বাঘের উপদেশ । সে দৌড়ে বাইরে এসে ভাইদের জড়িয়ে ধরল। ভাইদের চোখে আনন্দের জল! (বোন, কত খুঁজেছি তোকে, আর তুই কিনা সুন্দরবনে!
কিরণমালা বলল, “চলো, আমার বাসায় চলো ।’
তিন ভাইকে সে বাঘের গুহায় নিয়ে এল । তিন ভাই তো অবাক, “সর্বনাশ! এ যে দেখি বাঘের গুহা!
কিরণমালা বলে, “হ্যা দাদারা । বাঘই আমার স্বামী ।
“বলিস কী?’ তিন ভাই তো হতবাক, ‘বাঘ তোর স্বামী! গন্ধে যে এখানে টেকা দায়। তুই এক্ষুনি আমাদের সঙ্গে চল।’
কিরণমালা বলে, “আমার যে হাত-পা বাধা । স্বামীর অনুমতি ছাড়া কী করে যাব দাদা? কাল সে আসবে । তার অনুমতি নিয়ে পরে যাবো ।’
“একটা বাঘ আমাদের থেকে তোর কাছে বড় হয়ে গেল?’ ভাইদের কণ্ঠে আক্ষেপের সুর ।
কিরণমালা বলে, “তোমরাও বড়। আমি তোমাদের সাথে যাবো না তা তো বলি নি। কাল এসো, আমি স্বামীর অনুমতি নিয়েই যাব ।”
পরদিন ভাইয়েরা আবার এল । সমস্ত দিন তারা বাঘের অপেক্ষায় রইলো । বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো, বাঘের দেখা নেই।
“নিশ্চয়ই পালিয়েছে” ভাইয়েরা বলে । “আজ তোকে কিন্ত রেখে যাচ্ছি না। চল্ আমাদের সাথে ।’
কী আর করা। কিরণমালা একটা পত্র লিখে গুহায় রেখে ভাইদের সাথে চলে গেল।
বাঘ ফিরে এসে দেখে, গুহা শূন্য । তার ভীষণ মন খারাপ হলো কিন্তু কিছু তো করার নেই, বোন তো তার ভাইদের বাড়ি বেড়াতে যেতেই পারে।
এক দিন যায়, দুই দিন যায়। কিরণমালা আর ফিরে আসে না। বাঘ মনমরা হয়ে ঘুরে বেড়ায় । তার লোকালয়ে যেতেও ইচ্ছে করে না।
এদিকে ভাইয়েরা কিরণমালাকে বলে দিয়েছে, “ও যদি তোকে নিতে আসে তবেই যাবি, আর নয়তো
ফিরে যাবি না, তবে ও আর আসবে না ।’ +
কিরণমালা বলে, “আসবে ।’
বউদিরা বেদম হাসাহাসি করে বলে, “কেমন বেহায়া হয়েছে লো, বলে কিনা ওর বাঘ-বর আসবে!
দেখো দেখো, বাঘের বউ!”
কিরণমালার আবার গোয়ালে আর হেঁসেলে কাজ জুটে গেল ।
অবশেষে বাঘ তিন ভাইকে বার্তা পাঠাল, আগামী পূর্ণিমায় সে কিরণমালাকে নিয়ে যেতে আসছে।
তিন ভাই কিরণমালাকে বলল, “শোন বোন, আগামী পূর্ণিমায় বাঘ আসবে, তার জন্য আপ্যায়নের ব্যবস্থা রাখিস, ভালো-মন্দ রান্নার জোগাড় রাখবি, আমরা মাংস এনে দেবো ।’
কিরণমালার অপেক্ষার দিন যেন আর ফুরায় না। সে পথ চেয়ে থাকে আর বসে বসে দিন গোনে। অবশেষে প্রতীক্ষার পালা শেষ হয়, আজ দিন ফুরালেই পূর্ণিমার রাত।
কিরণমালা নয়নে কাজল আকতে যায়। বউদিরা বলে, “দেখো দেখো, চোখে কাজল দিচ্ছে।’
কিরণমালা কাজলদানি ফেলে দিলো ।
কিরণমালা চুল বাধতে যায় । বউদিরা বলে, ‘দেখো দেখো, চুল বাঁধছে।”
কিরণমালা চুলের কাটা তুলে রাখে।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে আসে। কিরণমালা রান্নার জোগাড় করে, চুলা জ্বালে, বাটনা বাটতে যায়।
বউদিরা বলে, “ওলো দেখো, আবার বাটনাও বাটে।’
কিরণমালা শিল-নোড়া তুলে রাখে । চুলো জ্বলে না, হাড়িও আর চড়ে না। কিরণমালার কেবলই কান্না আসে।
| সন্ধ্যা হতেই মেটে বাসনের মতো একটা বড় টাদ ওঠে দিগন্ত রেখার উপর দিয়ে। রাত বাড়ে, আর
ঘোর হতে থাকে । তিন ভাইয়ের উঠোন এখন জ্যোত্্লায় আলো আলো, যেন বান ডেকেছে।
তার মধ্য দিয়ে ধীরপায়ে বাঘ এসে দাড়ায়। তিন ভাই যায় বাঘের কাছে। বলে, “আমরা তোমাকে বরণ করে নিয়ে যেতে এসেছি।
এই কথা বলেই তিন ভাই যার যার নিজেদের নাক চেপে ধরে বলে, ‘কী বিকট গ্ধ! তোমার মুখে এত গন্ধ কেন? এই জন্যই তো আমাদের বোন তোমার গুহা ছেড়ে চলে এসেছে।
বড় ভাই মেজ ভাইকে বলে, “কী রে মেজ, ওর মুখে গন্ধ না?”
মেজ ভাই বলে, “হ্যা গন্ধই তো!’
ছোট ভাইও সুর মিলিয়ে বলে হ্যা গন্ধই তো!
‘যাও, ওখানে ইদারা আছে, তিন ভাই বলে, ‘এই কয়লা দিয়ে ভালো করে দাত মেজে এসো ।
বাঘ ভাবে, সত্যিই তো। এত দিন তো সে এটা ভেবে দেখে নি। কিরণমালা তাহলে এজন্যই তার সংসার ছেড়ে চলে এসেছে!
ইদারার জলে সে খুব ভালো করে কয়লা ঘষে দাত মেজে মুখ ধুয়ে ফেলে । বাঘ আবার এসে তিন ভাইয়ের সামনে দাড়ায় ।
“উফ্ কী গন্ধ! তোমার গায়েও তো বেজায় গন্ধ!
বড় ভাই মেজ ভাইকে বলে, “কী রে মেজ ওর গায়ে গন্ধ না?
মেজ ভাই বলে, “হ্যা গন্ধই তো!”
ছোট ভাইও সুর মিলিয়ে বলে, “হ্যা গন্ধই তো!”
“এই জন্যেই তো আমাদের বোন তোমার গুহা ছেড়ে চলে এসেছে। যাও, বাগানের আড়ে পুকুর আছে। ভালো করে গায়ে পলিকাদা মেখে স্নান করে এসো।’
বাঘ ভাবে, “সত্যিই তো। এত দিন তো সে এটা ভেবে দেখে নি। কিরণমালা তাহলে এজন্যই তার সংসার ছেড়ে চলে এসেছে!”
বাঘ পুকুরঘাটে গিয়ে সমস্ত শরীরে খুব ভালো করে পলিকাদা মেখে মান করে। যেন আর একটুও গন্ধ না থাকে।
বাঘ আবার এসে তিন ভাইয়ের সামনে দীড়ায়।
তিন ভাই প্রস্তুত হয়েই ছিল। তারা তিনজন একসঙ্গে হঠাৎ বাঘকে জাপটে ধরে বলি দিয়ে দিলো।
তারপর তার চামড়া ছিলে ফেলে দিয়ে, রানে-থানে আলাদা করে মাংস নিয়ে গেল হেঁসেলে। কিরণমালাকে গিয়ে বলে, “নে, এগুলো কুটে-বেছে রান্না কর, তোর বাঘ বর এলে খেতে দিবি ।’
কিরণমালা মাংস কুটতে বসে । তার চোখ দিয়ে জল ঝরে, কেবলই জল ঝরে।
বউদিরা দল ধরে দেখতে আসে, কিরণমালা কী করছে।
কিরণমালা বউদিদের বলে, “বউদিমণিরা, আমার যে আজ কী হয়েছে, কেবলই কান্না আসে। এত
চোখ মুছি তবু জল যে আর ফুরায় না।’
মাংস কাটা-কুটার কাজ শেষ করে কিরণমালা ধুতে বসে। সে মাংসে জল ঢালে আর জল ঢালে।
হঠাৎ মাংসগুলো কথা বলে ওঠে, “বউগো, এখনো কি আমার শরীর থেকে গন্ধ যায় না …?”
চম্পাবতীর এই গল্প শেষ হবার আগেই সাত ভাই উঠে দাড়ায়
সাথে এই রপকের তা দাড়ায়। ওদের কপালে চিন্তার রেখা । বলে, আমাদের সাথে এই রুপকের অর্থ কি?
চম্পাবতী বলে, ‘কোনো অর্থ নেই। এমনিই একটা গল্প বললাম।’
‘তোর মতো বিদৃবী না হতে পারি, তবে আমরা ঠিকই বুঝতে পারছি, তুই বিনা কারণে এই গল্প রচনা
করিস নি।’ সাত ভাই হাসতে হাসতে বলে, ‘তোর যদি এমন কোনো বাঘ থাকে আমাদের বল, তবে
আমরা কিন্ত কখনই তোর বাঘকে বলি দেবো না- এটা মনে রাখিস”
সাত ভাই মৃগয়ায় চলে যায়। চম্পাবতী এখন কী করবে, তার ভীষণ মন খারাপ লাগে। সে যে
দাদাদের খুব ভালোবাসে!
২
রাজা অসময়ে মন্দিরে এলেন । চম্পাবতী তখন ধ্যানে রত ছিল।
রাজা মেয়ের ধ্যান ভাঙালেন না। বসে রইলেন মন্দিরের মাঝখানে ।
তার মন আজ বেজায় খারাপ। যতক্ষণ তিনি দরবারে ছিলেন, ততোক্ষণ মেজাজও ছিল সপ্তমে।
সভাষদ তটস্থ ছিল। রাজার রাগ উঠলে এমনই হয়। একমাত্র কন্যাই তখন পারে তার রাগ ভাঙাতে ।
আর পারে তার প্রধান সেনাপতি দক্ষিণা রায় ।
দক্ষিণা রায় রাজার সেনাপতি হলেও তিনি সিদ্ধপুরুষ, রাজার গুরুদেব । দীর্ঘদেহী সুপুরুষ দক্ষিণা রায় সব ধরনের অস্ত্র চালনায় পারদর্শী । বিশেষ বিশেষ যুদ্ধে সে রাজার পাশে থাকে । এই বীর যোদ্ধা দ্ৰোণাচার্ষের মতোই ব্রাহ্মণ হয়েও সমরবিদ । দরবারে সে কমই আসে । রাজা নিজেই মাঝে মাঝে দক্ষিণা রায়ের ডেরায় যান। আজ যেমন এসেছেন মেয়ের মন্দিরে ।
ধ্যান শেষে মন্দিরে বাবাকে দেখে মেয়ে ব্যস্ত হয়। বাবা বললেন, “ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই, মা। তুমি বসো আমার পাশে ।’
চম্পাবতী বাবার কোলঘেষে বসল ।
রাজা মেয়েকে বলেন, “মা, আজ দরবারে এক যবন এসেছিল।’
চম্পীবতী অবাক হয় । মুকুট রায়ের দরবারে যবন! এত বড় সাহস সে কোথায় পায়! যে দরবারে নীচু জাতের হিন্দুদেরই স্থান নেই, সেই দরবারে কিনা যবন!
চম্পাবতী আবার সংকিত হয়ে ভাবে, রাজা নিশ্চয়ই তাকে এই সামান্য বিষয় জানাতে অসময়ে মন্দিরে আসে, নি। নিশ্চয়ই এর পিছনে অন্য কোনো কারণ আছে। চম্পাবতী মনে মনে খুঁজতে থাকে, কী সেই কারণ?
রাজা আবার বলে, “এ যবনের নাম কালু । যেমন নাম, তেমন তার চেহারা!
চম্পাবতী বলে, “যবন রাজ্যে ঢুকল কী করে? প্রহরীরা কোথায় ছিল?’
মহারাজ উত্তেজিতভাবে বলেন, “ওই নীচুজাত যবন, সে মনিবের ছদ্মবেশে প্রাসাদে ঢুকেছে। প্রহরীরা
প্রথমে তাকে চিনতে পারে নি।”
চম্পাবতী বলে, “এ তো ছলনা, এ জন্য এ যবনের শাস্তি হওয়া উচিত।”
শাস্তি আমি দিয়েছি মা’, রাজা বলেন, প্রথমে তাকে চাবুকে রক্তাক্ত করেছি, তারপর পাতাল
কারাগারে পাঠিয়েছি, তার বুকের উপরে এখন বাইশ মণ পাথর ।’
শাস্তির বর্ণনা শুনে চম্পাবতী বলে, “অপরাধের তুলনায় শাস্তির মাত্রা একটু বেশি হয়ে গেছে মনে হয় বাবা।’
রাজা বলেন ‘তার আসল অপরাধ তুই এখনো কিন্তু শুনিস নি। এ নোংড়া লোকটা তার ভাইয়ের সাথে তোর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। ওর ভাইয়ের নাম গাজী খাঁ। সে পথের ফকির, বনবাসী।
চম্পাবতী চমকে ওঠে, সে নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারে না। মনে মনে ভাবে, নিয়তি তার সাধে লীলা শুরু করে দিয়েছে এখন শুরু হবে মহাপ্রলয়। এর শেষ কোথায় চম্পাবতী জানে। কিন্তু তার
কিছুই করার নেই। নিয়তির কাছে তাকে সঁপে দিতে হবে।
রাজা এবার চম্পাবতীর চোখের দিকে চোখ রেখে বলেন, “সেই যবন, কালু নাম যার, সে আরও
বলেছে, তুই নাকি গাজী খবাকে ভালোবাসিস। এই প্রস্তাবে তুইও নাকি রাজি আছিস। এত সাহস এ যবন
কোথায় পায়? কীরে, তুই চুপ করে আছিস কেন?
চম্পাবতী এবার ধীরে ধীরে উত্তর দেয়, “বাবা, বিয়ের প্রস্তাব যে কেউ দিতে পারে। এটা শাস্তিযোগ্য
অপরাধ নয়। তোমার উচিত যবনকে ছেড়ে দেয়া।
রাজা অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকেন, তারপর বলেন, “ছেড়ে দেওয়া উচিত? একটু আগে
তুই কিন্তু বলেছিস, যবন শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছে।’
চম্পাবতী বলে, “তখন আমি সবটুকু ঘটনা জানতাম না।
‘এখন তো জানলি, এখন তুই বল্ “এ যবনের প্রস্তাবে তুই রাজি আছিস কি না ?
চম্পাবতী বলে, ‘না, আমি এঁ যবনের প্রস্তাবে রাজি নই ।’
‘এবার বল- তুই কি এঁ যবনকে ভালোবাসিস? রাজা মেয়েকে জিজ্ঞেস করেন ।
চম্পাবতী আস্তে করে উত্তর দেয়,হ্যা।’
“তাহলে তুই তাদের প্রস্তাবে রাজি না কেন?
চম্পাবতী বলে, “তোমার জন্যে, আমার ভাইদের জন্য । আমি রাজি হলে যুদ্ধ শুরু হবে। আর শত
শত মানুষ প্রাণ হারাবে । আমি কোনো যুদ্ধের কারণ হতে চাইনা বাবা ।’
রাজা হাসেন, তাচ্ছিল্যের হাসি! বলেন, “একটা বনবাসী ফকিরের সাথে আবার যুদ্ধ!
চম্পাবতী বলে, “রাজা রামচন্দ্রও বনবাসী ছিলেন। কিন্তু তার পিতা ছিলেন অযোধ্যার রাজাধিরাজ
দশরথ। এই ফকিরকেও তেমন তুচ্ছজ্ঞান করা উচিত নয় বাবা, এর পিতা কিন্তু সেকেন্দার শাহ্। গাজী
স্বেচ্ছায় রাজপাট ছেড়ে ফকির হয়েছে।’
‘কোন্ সেকেন্দার শাহ্? বৈরাট নগরের পরাক্রমশালী বাদশা? রাজা জানতে চান।
“হ্যা বাবা ।’
অচস্পাবতীর উত্তর শুনে রাজার কপালে চিন্তার ভাজ পড়ে। কিছুক্ষণ এভাবে চুপ করে থেকে রাজা জানতে চান,
“তাহলে মা, আমার সুশিক্ষিত সৈন্যবাহিনী, অপরাজেয় সেনাপতি দক্ষিণা রায়
দিলে সে জীবিত হয়ে আবার মার মার রবে রণে ছুটে যায়। এ সবকিছু নিয়ে আমি চুপ করে বসে রইবো আর একটা যবন এসে আমার মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে চলে যাবে!
তাহলে এসব আমি এতদিন কেন লালন করেছি, যদি সময়মতো কাজে না আসে? আমি নিশ্চিত জানি, আমার শক্তির কাছে গাজী তুচ্ছ।’
চম্পাবতী বলে, “আমি জানি বাবা, তুমি মহাশক্তি | লক্ষেশ্বর রাবণও তো শক্তিধর ছিল। সেও
তোমার মত অহংকারী ব্রাম্মন ছিল ৷ তার ছিল অপরাজেয় বীরপুত্র মেঘনাদ, ভাই কুন্তকর্ণ। তার মৃত্যুবাণ ছিল সুরক্ষিত, দুর্জয় কিন্তু বাবা অন্যায় সমরে কখনো জয়লাভ করা যায় না, রাবণের পরাজয় হয়েছিল।”
মহারাজের কণ্ঠ কান্নায় রুদ্ধ হয়ে আসে। রাজা বলেন, ‘মা আমার, তুই বিদৃবী। যা বলিস নিশ্চয়ই কারো মেয়েকে হরণ করিনি বরং সেই
আমার মেয়েক হরণ করতে আসছে। অন্যায় সমরে!”
“বাবা, তোমার মেয়েকে সে হরণ করতে আসছে না। সে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে । আমিও তাকে পছন্দ করি। তুমি বাধা দিচ্ছ, এটা কি অন্যায় নয়?
“বেশ, তা-ই হবে, আমি মুকুট রায়, ব্রাম্মননগরের অধিপতি । যবনের সাথে আমার মেয়ের বিয়ের বাধা দানে আমার পরিণতি যদি রাবণের মতো হয়, আমি ধন্য হবো । তবে মা, এ যবন কালু একথাও বলছিল, তোর হাতে গাজীর অঙ্গুরী, আর মন্দিরে গাজীর পালঙ্ক আছে। তুই তোর দুই হাত আমার সামনেমেলে ধর।
চম্পাবতী তার দুুই হাত রাজার সামনে মেলে ধরে! রাগে-দুঃখে রাজার দুই চোখে জল আসে ।
“শোন মা, এবার আমার বচন। আমার প্রাসাদে তুই গাজীর অঙ্গুরী পরে বসে থাকবি তা হবে না। গাজীর নিবাসে গিয়ে ওটা পরিস। এখন ওটা আমাকে খুলে দে ।’
চম্পাবতী বাবার হাতে গাজির অঙ্গুরী খুলে দেয়।
রাজা বলেন, “আমাকে ভালো করে দেখে নে। এ-ই শেষ দেখা । এরপর তুই যদি আমার দেখা পাস, তবে কেবল বাবার মৃত মুখেরই দেখা পাবি।’
রাজা দরবারে গিয়ে রাজদণ্ড হাতে নিলেন। রাজ্যে যুদ্ধাবস্থা ঘোষণা করলেন। মেয়ের সাথে কথা বলে ভালোই হয়েছে । মহারাজ এবার বুঝতে পেরেছেন তাকে কতটা লড়তে হবে।
গাজী খা ফকির হোক, আর ভিখারীই হোক, তাকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। সে সেকেন্দার শাহের বেটা । চম্পাবতী ভুল বা মিথ্যা বলার মেয়ে নয়।
রাজা সৈন্য তৈরির নির্দেশ দিলেন। মৃতসম্ীবনী কৃপে দিনরাত্রি পাহারা বসানো হলো । দক্ষিণা রায় গৌসাইজীকে প্রণাম জানানো হলো । আর মৃগয়া থেকে সাত ভাইকে ফিরিয়ে আনতে দূত পাঠানো হলো ।
সভাসদ ভেবেই পায় না একটা ফকিরের বিরুদ্ধে কেন এমন সমর আয়োজন।
৩.
সুন্দরবনে গাজীর ধ্যান ভাঙে। সে পায়ে খড়ম পরে, হাতে আসা টেনে নেয়। দ্রন্ত পথ চলতে শুরু করে গাজী । সন্ধ্যার আগেই তাকে মল্পদের আস্তানায় পৌছাতে হবে। মন্নরা সুন্দরবনের বিরাট যোদ্ধা জাতি। একেকটা যোদ্ধা যেন একেকটা বাঘ। এ জন্যে মল্পদেরকে সবাই বাঘ-যোদ্ধা বলে। গাজী খা
মুকুট রায়ের সাথে যুদ্ধে এই মল্পদের সাহায্য চাইবে ।
গাজী ফকির হয়েছে যুদ্ধ করার জন্য নয়, যুদ্ধ থেকে দূরে থাকার জন্য। কিন্তু নিয়তির ফের, তাকে যুদ্ধেই নামতে হচ্ছে। সে নিয়ম-মতো চম্পাবতীর সাথে তার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে তার ভাইকে পাঠিয়েছিল মুকুট রায়ের দরবারে । রাজা তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন, ভালোকথা। তাই বলে তার প্রাণপ্রিয় ভাই কালুকে চাবুক মেরেছে, তাকে বন্দী করে বুকে পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে। এই অপমান গাজী কী করে সহ্য করবে?
ভাইয়ের আজ এই পরিণতির জন্য সে-ই তো দায়ী । কালু তাকে আগেই ভর্সনা করেছিল।
বলেছিল, “ভাই, এই জন্যেই কি আমরা বাবা-মায়ের মনে দাগা দিয়ে রাজ্যের মায়া ছেড়ে ফকির হয়েছি? একটি মেয়ের জন্যে আজ তুমি ব্যাকুল। এমন ব্যাকুলতা গাজীর শোভা পায় না।”
গাজী বলেছিল, “ভাই, সত্যিই আমি ব্যাকুল। একটু ভেবে দেখো ভাই, আমি ঘুমিয়ে ছিলাম সুন্দরবনে । চম্পাবতী ব্রাহ্মণনগরের রাজপ্রাসাদের মধ্যে। উভয়ের দেখা হলো মন্দিরে । কথা হলো, আলাপন হলো, তারপর আংটি বদল হলো । হঠাৎ ভোজবাজি, ঘুমের মাঝে যে যার জায়গায়, আমি
সুন্দরবনে আর চম্পাবতী ব্রা্মণনগরে । এর পিছনে কি কোনো ইশারা নেই?”
গাজীর বিয়ের প্রস্তাব দিতে গিয়ে কালু আজ বিপদে পড়েছে । তাকে উদ্ধার করতে হবে । গাজী চাইলে তার পিতা সেকেন্দার শাহ নিশ্চয়ই তাকে যুদ্ধে সাহায্য করবেন। কিন্তু তার সাহায্য নিয়ে এ যুদ্ধে জিতলে সে বিজয় হবে যে পরাজয়ের সামিল ।
গাজী প্রাসাদ ছাড়বার আগে পিতাকে আস্ফালন করে বলেছিল, “তোমাকে যদি জগৎ মনে রাখে, সে তুমি গাজীর পিতা এ জন্যই মনে রাখবে । তোমার রাজপাটের চেয়ে ফকিরী অনেক বড়।’
গাজীর মা ওসামা বিবি যেদিন জানতে পেরেছেন গাজী ফকির হবে, সেদিন থেকেই তিনি নিদ্রা ছেড়েছেন। না জানি তার ঘুমের ঘোরে কখন গাজী পালিয়ে যায়। ওসামা বিবির বড় ছেলে জুলহাস সেই যে শিকারে গিয়েছিল, আজও ফিরে আসেনি। তার পথের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ওসামার যখন অন্ধ হবার যোগাড়, তখন তার কোল জুড়ে গাজী এসেছে । আর পালকপুত্র কালুকে পেয়েছে । এখন এই দুই ভাইও যদি তাকে ছেড়ে পালায় তো সে কী নিয়ে বাচবে!
মায়ের সজাগ পাহারায় গাজীর ফকির হবার সব আয়োজন ব্যর্থ হবার যোগাড়। তবু গাজীও তো ছাড়বার পাত্র নয়। –
সে ধ্যানে বসে নিদ্রালীকে স্মরণ করে। গাজীর ডাকে নিদ্রালী, চোখ ঢুলুনি, গা গড়ানি এসে গাজীর মায়ের চোখে বসে। মা ঘুমিয়ে পড়েন। গাজী-কালু দুইভাই মায়ের দুঃখভরা করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে
চোখ মুছতে মুছতে প্রাসাদ ছাড়ে। গাজী জানে না, তার মা এখন কেমন আছেন।
গাজী সন্ধ্যার আগেই মন্দের ডেরায় পৌছালো। তাকে পেয়ে মল্লরাও মহাখুশি। খানদৌড়া, লৌহজঙ্গ, আলম চান্দি বীরযোদ্ধা একেকজন। মুকুট রায়ের অহঙ্কারের কারণে তারা নিজেরাই আগে থেকে রেগে ছিল। তাই মুকুট রায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাদের রাজি করাতে গাজীকে কোনো বেগই পেতে
হলো না। গাজী যোদ্ধাদের রণসাজে সাজিয়ে ব্রাহ্মণ নগরের দিকে অগ্রসর হলো । এদিকে সাত ভাই পিতার জরুরি বার্তা পেয়ে মৃগয়া থেকে ফিরে এল । এসে দেখে, সমস্ত রাজ্য যেন রণসাজে সেজেছে । ঘোড়সওয়ার, হাতিসওয়ার, পদাতিক- সকল সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত । তারা আছে শুধুমাত্র নির্দেশের অপেক্ষায় ।
সাত ভাই অবাক হয়ে বাবার মুখে শোনে চম্পাবতীর মতিভ্রমের কথা । তাদের আদরের বোন পিতার অবাধ্য হয়েছে । সে কোথাকার এক যবন ফকিরকে বিয়ে করতে চায়! সাত ভাই মন্দিরে এল, সকলেই উদ্িগ্ন।
চম্পাবতীকে জিজ্ঞাসা করে, “দিদি, এসব কী শুনছি?
চম্পাবতী বলে, “দাদারা, তোমরা যা শুনেছ সবই সত্যি। এখন শুধু তোমাদের বিবেচনা ।’
‘তুই কোন আশায় একটা যবন ফকিরকে বিয়ে করতে চাস? আমাদের মান-মর্ধাদার কথা কি একবার ভাবলি না? তুই ভালো করেই জানিস বাবা তার রাজ্যে যবন নিষিদ্ধ করেছেন।’
চম্পা বলে, ‘যবনের গায়ে কী এতই গন্ধ দাদা?”
“আচ্ছা! আজ তোর রূপকের অর্থ বুঝেছি। তবে তুই ভুল করেছিস। আমরা কিন্তু তোর যবন বাঘকে বলি দিতে যাচ্ছি না। বরং সে-ই আসছে আমাদের নিধন করতে ।’
চম্পা বলে, “দাদা, আমার নিয়তি কিন্তু নির্ধারিত হয়েই গেছে। গাজীকে বারণ করলে সে বারণ মানবে না। তোমাদের নিষেধ করলে তোমরাও সে নিষেধ শুনবে না। যুদ্ধের পরিণতি যা-ই হোক, ভেবে দেখো, চম্পাবতীর চোখে জল ঝরবে আমৃত্যু ৷
“বেশ, ভালো! তুই সুখী হ’ আমরা এটাই চাই। আমরা পিতার পক্ষ নিচ্ছি। তোর সাথে আর আমাদের দেখা হবে না কখনো ।
চম্পার ছোট ভাই কামদেব, সে বলে, “দাদারা, দিদির কথা বিবেচনা করে যুদ্ধ কি কোনোভাবে এড়ান যায় না?
“তুই একা বসে বসে তোর দিদির কথা বিবেচনা কর।’
ছয় ভাই ছোট ভাইকে ফেলে রেখেই চলে যায়।
চম্পাবতীর এখন আর বাইরের জগতের সাথে কোনো যোগাযোগই নেই। যেন স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়েছে সে।
লীলাবতী চম্পার সইকে খবর দিলো।
সই এলো দুপুরে। গিয়ে চম্পাকে বলে, “একি সই, একি অনাচার! মন্দিরে দুয়ার বন্ধ, আলো জ্বালিসনি, তুই নিজেও আলোর মুখ দেখিসনা বহুদিন”
সইয়ের পীড়াপীড়িতে চম্পাবতী অনেক দিন পর মন্দিরের বাইরে এল । ফুলের বাগান, রোদের আলো, হিমেল হাওয়া মন্দিরের আঙিনা ঘিরে। পাখিরাও গান গাইছে শাখায় শাখায় । সবকিছু আগের মতোই আছে। তবু কিসের যেন আভাস, কিসের যেন অলঙ্ষুণে ইশারা! আশঙ্কায় চম্পাবতীর বুক দুরু দুরু কেপে ওঠে।
দোলা কাধে বেহারা এল। সই চম্পাবতীকে সঙ্গে নিয়ে চলল নদীতে ম্নান করতে । নদীতে সান বীধান ঘাট । পলাশ ফুটেছে নদীর কিনারে গাছে গাছে। কুহুরা গাইছে দ্রুত লয়ে । দেমাগী রাজহাসগুলো মৃদু ঢেউয়ের চূড়ায় চূড়ায় অলস ভাসছে নদীর জলে |
চম্পাবতী আর সই নদীর ঘাটে সবেমাত্র হাটুজলে নেমেছে। এমনই সময় হঠাৎ চম্পা সইয়ের হাত টেনে তার হাত ইশারা করে সইকে দেখায় ধরে বলে, ‘সই দেখ দেখ!” চম্পা নদীর মাঝ বরাবর চম্পার হাতের ইশারা অনুসরণ করে সই তাকিয়ে মাঝ দরিয়া দিয়ে ভেসে চলেছে এক বিশাল বজরা। বজরার গলুইযের উপর এক যুবাপুরুষ। কী তার তেজদীপ্ত রূপ, কি দৃঢ় আত্নবিশ্বাস! সই হা করে তাকিয়ে থাকে বজরার দিকে
সই চম্পাকে বলে, “চম্পা, আমি স্বপ্ন দেখছি নাকি বাস্তব! মানুষ কিরে এত সুন্দর হয়?”
চম্পা বলে, “সে রাতে একেই আমি মন্দিরে দেখেছি, এর নামই গাজি খাঁ। আমার যে অঙ্গুরি বদল হয়েছে এর সাথেই।
সই বলে, ‘এ-ই যদি তোর গাজী হয়, তবে ক্ল-হারা হলে ক্ষতি কী চম্পা, এর জন্যে মরণও হে ভালো।
চম্পাবতী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “তুই বুঝবি না সই। আমার অবস্থা একবার ভেবে দেখ । বাক্ষণ নগরে গাজী চলে এসেছে। এর অর্থ যুদ্ধ সমাগত। চম্পাবতী আর তার সই ত্রা করে প্রাসাদে ফিরে আসে।
৪
গাজী ছদ্মবেশে তার সৈন্যদের নিয়ে নদী পার হলো ।
পরদিন খুব ভোরে সে নগর আক্রমণ করল। তার সৈন্যদের বিশাল মনোবল, অহঙ্কারী রাজাকে
পরাজিত করতেই হবে। কালু খাকে উদ্ধার করতে হবে। এ যুদ্ধে তারা জিতবেই। কারণ তাদের সেনাপতি স্বয়ং গাজী খা।
মহারাজা মুকুট রায় প্রস্তুত হয়েই ছিল। তার বিশাল বাহিনীও প্রস্তুত, সঙ্গে সাত পুত্র । রাজার কাছে বার্তা এল, এই যুদ্ধে সেকেন্দার শাহ্ অংশ নেয়নি। গাজী একাই লড়তে এসেছে। বার্তা শুনে মুকুট রায় হাসে । তার জন্যে এখন এটা-তো এক সহজ যুদ্ধ!
যুদ্ধ চলল সকাল-সন্ধ্যা । প্রথম আক্রমণেই মুকুট রায় বুঝতে পারে সে যতো সহজ ভেবেছিল ততোসহজ নয়। মুকুট রায় হাতির পিঠে বসে দেখতে পায় গাজী লড়ে যাচ্ছে।
যেন জ্লত্ত সূর্য এক,প্রতিপক্ষকে পুড়িয়ে দিতে বাঘের পিঠে সওয়ার হয়ে যুদ্ধে নেমেছে।
মুকুট রায়ের সাত পুত্র অসম সাহসী বীর । তারা লড়ছে মর্যাদার লড়াই। এ লড়াই মাতৃভূমির জন্যে, স্বাধীনতার জন্যে সর্বোপরি নিজেদের মর্যাদা রক্ষার জন্যে । উভয় পক্ষেই অনেক হতাহত হলো । সন্ধ্যায় রণ শেষে উভয় পক্ষ ফিরে গেল নিজ নিজ শিবিরে। পরদিন সকালে আবার উভয় পক্ষ রণে নামল । গাজীর সৈন্যরা অবাক হয়ে দেখে, মুকুট রায়ের সৈন্য গতদিন যা ছিল তা-ই রয়ে গেছে। যেন গতদিনের যুদ্ধে মুকুট রায়ের একটি সৈন্যও মারা যায়নি । অথচ গাজীর সৈন্যরা গতদিনের যুছে প্রতিপক্ষের শত-শত যোদ্ধাদের নিধন করেছিল ।
গাজী বুঝতে পারে না মৃত সৈন্যরা আবার রণে এল কী করে?
আবার দুই পক্ষে প্রাণপণ যুদ্ধ শুরু হলো । অগণিত সৈন্য ক্ষয় হলো উভয় পক্ষের। কিন্তু তৃতীয় দিনও
দেখা গেলো পূর্বের মতো একই অবস্থা। গাজীর সৈন্য কমেছে, কিন্তু মুকুট রায়ের সৈন্য যা ছিল তা-ই রয়ে গেছে!
গাজীর সৈন্যদের মধ্যে দেখা দিলো হতাশা । আর মুকুট রায়ের শিবিরে বিজয়-উল্লাস। গাজী আজও ভেবে পায় না, মুকুট রায়ের যে সৈন্যদের সে দুই দিনে বিনাশ করল তারা আবার কী করে যুদ্ধের ময়দানে এসে দাড়ায়।
গাজী রহস্য উদ্ধারের জন্যে আবার ছদ্মবেশে চর পাঠাল প্রাসাদে।
চর জানাল রহস্য । যুদ্ধের মাঠে যারা মারা পড়ে, মুকুট রায় তাদের জড়ো করে মৃতসঞ্জীবনী কুপের পানি ছিটিয়ে দেয়। মৃত সৈন্যরা আবার জীবিত হয়ে যুদ্ধের মাঠে ফিরে যায়।
রাজার এক মৃতসঞ্জীবনী কুপ রয়েছে। এই কুপের কাছে পৌছানো কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।
গায়ে গা লাগিয়ে দীড়িয়ে আছে ভীম ভয়ানক প্রহরী, কেউ যেন কূপের জল অশুচি করতে না পারে। জল অশুচি হলে কূপের মাঝ থেকে জাগ্রত দেবী চিরতরে বিদায় নেবে। তখন এ জল ছিটালেও আর কোনো মৃতকে জীবিত করা যাবে না।
গাজী চরের মুখে সব শুনল, বুঝল । তারপর কাল বিলম্ব না করে গাজী ধ্যানে মগ্ন হলো।
যুদ্ধ চলছে রণক্ষেত্রে। আর মুকুট রায়ের প্রাসাদে আনন্দ-উল্লাস। গাজীর পরাজয় এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র ।
চম্পাবতী বসে ছিল প্রাসাদের ছাদে। সই বার্তা নিয়ে এল, গাজীর বিপর্যয়ের বার্তাঁ।
‘সই, তোর বাপ-ভাই রইলো। কূলও হারাতে হলো না। অবস্থাদৃষ্টে যা মনে হয়, তুই তোর শ্যামকে হারাচ্ছিস।’
‘উপহাস করিস না সই, চম্পা বলে, ‘একজন মানুষ আমাকে ভালোবেসে কত দূর পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে। এখন সে মহাসঙ্কটে পড়েছে। যুদ্ধে পরাজিত হলে তার মৃত্যু অনিবার্য ।’
সখি বলল, “তুই তবে তার প্রাণ রক্ষার চেষ্টা কর। রাজনের কাছে তার প্রাণভিক্ষা চা’।
চম্পা বলে, ‘না সই, আমি নিয়তির হাতে সবকিছু সঁপে দিয়েছি।’
ছাদের উপরে খোলা আকাশ । ঝাপটা বাতাসে উড়ছে চম্পাবতীর চুল, শাড়ির আচল । দুপুরের রোদ্দুর শক্ত হাতে শাসন করছে পৃথিবীকে ।
আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের ভেলা । তার ফাঁকে ফাকে চক্রাকারে উড়ছে বিবাগী চিল। চিলের বহর থেকে, চম্পাবতী দেখতে পেল, একটা চিল দলছাড়া আলাদা হয়ে গেল। উড়তে উড়তে ধীরগতিতে নেমে এল অনেক নিচে । প্রাসাদের উপর উড়ে এসে দুটো চক্কর দিলো!
চম্পাবতীর মনে শিহরণ জাগে । আহা, এই চিলটাই একটু আগে সে দেখেছে উঁচুতে, বহু উচুতে।
টিলটার নখরে যেন কি ধরে আছে। চিলটা হঠাৎ সোজা গাছপালার নিচে নেমে এল। শৌ শোঁ করে উড়ে গেল মৃতসঞ্জীবনী কূপটার দিকে ।
“আশ্চর্য! ও চায় কী?’
একটা বৌটকা গন্ধ ছড়িয়ে গেল চারদিকে ।
“এ কিসের গন্ধ?”
প্রাসাদজুড়ে শোরগোল উঠল। হৈ চৈ পড়ে গেল। হস্ত শুনে ছাদের সিঁড়ি বেয়ে নিচে ছুটল সই। কী হয়েছে জানা দরকার প্রায় সাথে সাথেই আবার ফিরে এল । চম্পাবতী উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করে, “কী হয়েছে রে সই?
“সর্বনাশ হয়েছে!
“কী হয়েছে বল্ না!”
“কোথা থেকে একটা চিল উড়ে এসে গরুর পচা নাড়ি-ভূঁড়ি ফেলে দিয়ে গেছে মৃতসঞ্জীবনী কৃপের মধ্যে। কূপের জল অশুচি হয়ে গেছে। এখন আর এ জলে কোনো কাজ হবে না।”
চম্পাবতী বিষণ্ন মনে ভাবে, সত্যিই এটা অপূরণীয় ক্ষতি। তার পিতার ক্ষমতা বহুলাংশে শেষ হনে গেল। সহজেই বোঝা যায় চিলকে বশে এনে এ কাজ গাজীই করিয়েছে।
রাজা বলেন, ‘তবে তা-ই হোক গুরুজী । আপনি-ই আমাদের পরিবারের মান-মর্যাদার শেষ ভরসা।’
দক্ষিণী রায়ের বিশাল নৌবাহিনী। তার সমর-নৌকাগুলো জলে এতটাই ক্ষিপ্র আর সাবলীল, যেন জলে ধাবমান কুমির এক একটা । সে তার নৌ-সেনা নিয়ে পরদিনই সমরে রওনা হলো । এই ধরনের বড় যুদ্ধে সাধারণত মুকুট রায় তার পদাতিক সৈন্য নিয়ে মূল-যুদ্ধে অংশ নেন, আর দক্ষিণা রায় জলসীমা। আগলে রাখে। কিন্ত আজ দক্ষিণা রায়ের যে প্রতিপক্ষ গাজী, সে তো রয়েছে ডাঙায়। বাঘের মতোই দুর্ধর্ষ তার পদাতিক বাহিনী । মুকুট রায় তার পদাতিক সৈন্য বাহিনী গাজীর সাথে একাকী লড়তে গিয়ে আগেই খুইয়ে বসে আছেন। গাজীর সাথে লড়তে তাই দক্ষিণা রায়কে বাধ্য হয়েই ভাঙায় নামতে হলো। শুরু হলো মরণপণ লড়াই । সকাল থেকে দুপুর গড়ালো ।
৫.
প্রাসাদে মুকুট রায় স্ত্রী আর সাত পুত্র নিয়ে খাসকক্ষে বসে আছেন। চম্পাবতী রয়েছে মন্দিরে । মুকুট রায় আজ তার পুত্রদের যুদ্ধে যেতে দেননি । দক্ষিণা রায় যদি যুদ্ধে জেতে, তবে সে নিজের যোগ্যতাতেই জিততে পারবে । সাত পুত্রের প্রয়োজন হবে না।
মুকুট রায় সন্তানদের বলতে শুরু করলেন- “শোনো আমার বাছারা, তোমরা জানো না গুরুজী নিজেও একজন রাজার কুমার ৷ তার বাবা প্রভাকর
রায় চব্বিশ পরগনা অঞ্চলের রাজা ছিলেন৷ আমার আমন্ত্রণে দক্ষিণা রায় এই ভাটি অঞ্চলে আসেন ।”
দক্ষিণ অঞ্চল আমি তাকে দিয়ে দিয়েছি। ভাটি অঞ্চলের লোক এখন গুরুজীকে বলে ভাটিশ্বর…।
‘যুদ্ধে তিনি অ-পরাজেয়, তবে এখন গুরুজীর পড়ন্ত বেলা, তিনি বৃদ্ধ হয়েছেন। তাকে রণে পাঠানো আমার অনুচিত কাজ হয়েছে। তবু উপায় ছিল না।’
রাজার কণ্ঠে বিষাদের সুর, তিনি বলতে থাকেন, “গুরুজী যদি জয়লাভ করেন, অতি উত্তম । কিন্তু, যদি পরাজিত হন, গাজী আমার প্রাসাদে এসে উঠবে । আমার জীবিত অবস্থায় আমারই প্রাসাদ সে অশুচি করবে, তা আমার সহ্য হবে না। তোমরা কে কে আমার সঙ্গে সহমরণে যেতে চাও?” ্
লালাবতীর চোখে জল । তিনি স্বামীর আরও কাছে ঘেঁষে বসলেন । স্বামীর ডান হাত দুই হাতে জড়িয়ে ধরে তাকে আশ্বস্ত করলেন। সাত পুত্রও মায়ের একেবারে কোলের কাছে এসে বসল ।
রাজা বললেন, “আমার কন্যাকেও আমার প্রস্তাব জানিয়ে দিও। আমার মৃত্যুর পর তাকে বলবে, সে যদি আমার সাথে যেতে চায়, আসতে পারে ।’
লীলাবতী বললেন, “মহারাজ আপনি শান্ত হোন। অবশ্যই তাকে আপনার বার্তা জানিয়ে দেবো ।’
রাজা বললেন, “আমার কন্যা বিদৃষী, বুদ্ধিমতী। সে কোনো অন্যায় করেনি। সে গাজীকে খুঁজে আনতে সুন্দরবনে যায়নি। নিয়তিই গাজীকে তার কাছে নিয়ে এসেছে। তার ওপর আমার কোনো রাগ নেই- এ কথাও তাকে বলবে ।’
দুপুর গড়িয়ে বিকাল হলো।
দক্ষিণা রায় দেখল তার নৌবাহিনী ডাঙ্ডার যুদ্ধে কতই না অসহায়। এ যেন জলের কুমির ডাঙায় উঠে
বাঘের সাথে অসমযুদ্ধে নেমেছে। দুর্ধর্ষ নৌ-যোদ্ধারা স্থলসমরে প্রায় সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত। দক্ষিণা রায়ের নিজের যে সামান্য সংখ্যক স্থলযোদ্ধা ছিলো, গাজীর সঙ্গে যুদ্ধে মুকুট রায় তাও ধ্বংস করে রেখেছে। এখন উপায় কী?
দক্ষিণা রায় আজ পর্যস্ত কোনো যুদ্ধে পরাজিত হয়নি। যুদ্ধে আজ সে নিজেই সেনাপতি । তার নিজের দেশের মাটিতে এ যুদ্ধ এ স্থাধীনতার যুদ্ধ। ভিনদেশী গাজী এসে এ মাটি জয় করে নেবে, বীরবাহুদক্ষিণা রায় এখনও জীবিত ।
দক্ষিণা রায় তার প্রিয় অস্ত্র গদা তুলে নিল। সে অগ্নি দৃষ্টি হেনে দেখে দূরে গাজী বাঘের পিঠে সওয়ার হয়ে লড়ে যাচ্ছে। যেন এক ঘূর্ণিঝড় প্রতিপক্ষকে তছনছ করে দিতে যুদ্ধে নেমেছে। গাজীকে দক্ষিণা রায় হাতের ইশারায় ঘন্দে আহ্বান করল। গাজী সাড়া দিলো না।
গাজী দক্ষিণাকে ভালো করেই জানে। সে চম্পাবতীর গুরুদেব, দুর্ধ্ঘ যোদ্ধা। এখন সে বৃদ্ধ হয়েছে, তার এই পড়ন্ত বয়সে বাহুর জোরে নয়, সে মনের জোরেই লড়ছে। গাজীকে উচ্চ স্বরে গালি দিতে দিতে দক্ষিণা রায় আবার দ্বন্দে আহ্বান করল। কিন্ত গাজী এবারও
সাড়া দিলো না। গাজীর অনুমান, লড়াই আর বেশিক্ষণ স্থায়ী হবে না। দক্ষিণা রায় এমনিতেই হার মানবে ।
গাজীর ইচ্ছা নেই দক্ষিণা রায়, মুকুট রায় বা চম্পাবতীর সাত ভাইয়ের কেউ এই যুদ্ধে হতাহত হোক। তার উদ্দেশ্য শুধু প্রাণপ্রিয় ভাই কালুকে উদ্ধার করা, আর চম্পাবতী যদি স্বেচ্ছায় রাজি থাকে তবে তাকে বিয়ে করে মুকুট রায়ের রাজ্য তাকে বুঝিয়ে দিয়ে ফিরে চলে যাওয়া ।
গাজী তার রণের অভিজ্ঞতা থেকে আন্দাজ করে নেয়, রণক্ষেত্রে দক্ষিণা রায় আর গাজীর মধ্যে এখন যতটা দূরত্ব, আর মাঝে যে সংখ্যক সৈন্য রয়েছে, তা অতিক্রম করে গাজী পর্যন্ত পৌছানো বৃদ্ধ দক্ষিণা রায়ের পক্ষে অসম্ভব ।
সে মনে মনে আশ্বস্ত হয়। যোদ্ধার বেশভূষা আর অস্ত্র পরিত্যাগ করে গাজী আবার ফকিরের বেশ ধরে। হাতে আসা তুলে নেয়, পায়ে দেয় খড়ম।
কিন্ত এ সময়ে হঠাৎ গাজী তাকিয়ে দেখে, দক্ষিণা রায় মুণ্তর হাতে ধেয়ে আসছে। তার সাথে স্বল্প যে কজন সৈন্য তারা যেন মৃত্যুপণ লড়ছে। দক্ষিণা রায়ের গদার আঘাতে গাজীর সৈন্যরা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। গাজী কল্পনাও করেনি এই বৃদ্ধ এতটা পথ অতিক্রম করে, এত সৈন্য নিধন করে গাজী পর্যন্ত পৌছে যাবে।
দক্ষিণা রায় “মার্ মার্’ বলে গাজীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
এই আক্রমণের জন্য গাজী একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। সে তার হাতের আসা দিয়ে দক্ষিণার ভীমভয়াল মুগতরের আঘাত প্রতিহত করে, তার হাতের আসা ভেঙে যায়। গাজী কোনোমতে দক্ষিণা রায়ের
দিকে পায়ের খড়ম ছুড়ে দিয়ে আত্মরক্ষা করে।
গাজীর সৈন্যরা কালক্ষেপণ না করে গাজীকে ঘিরে ধরে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যায়। গাজী তার সৈন্যদের নির্দেশ দেয়, এ বৃদ্ধকে আটকাও! ওর মরার যখন এত সখ, প্রয়োজনে ওকে হত্যা করো।
দক্ষিণা রায়ের শরীর রক্তরপ্রিত। গাজীর দিকে তাকিয়ে হুঙ্কার দিলো, “দক্ষিণাকে আটকানো অতো সহজ নয় বাছাধন! যে তেষ্টা নিয়ে আমি আজ রণে নেমেছি সে তে্ঠা মিটেনি, রক্ত পান করে সে তেষ্টা আমি মিটাবো । মনে রাখিস গাজী, আজ থেকে তুই যেখানে আমাকে তার বিপরীতে পাবি ।’
ওদিকে সন্ধ্য ঘনিয়ে এল।
সবাই দেখল, বন্য প্রাণীদের মতো দক্ষিণা রায়ের চোখ অন্ধকারেও ভাটার মতো জ্বলছে। যুদ্ধ শেষ হলো।
মুকুট রায়ের অবশিষ্ট যে সৈন্য ছিল তারা পালিয়ে গেল। দক্ষিণা রায়কে কোথাও আর পাওয়া গেল না। সবাই বলল, “দক্ষিণা রায় তান্ত্রিক-কাপালিক সিদ্ধ পুরুষ। ওকে পাওয়ার বৃথা চেষ্টা ।
কেউ আবার বলল, তারা সুন্দরবনের দিকে একটা শার্দুলকে দৌড়ে যেতে দেখেছে। ওটাই দক্ষিণা রায়।
যে যাই বলুক গাজীর কপালে চিন্তার রেখা, গাজী বলে, “দক্ষিণাকে এভাবে ছেড়ে দেওয়া উচিত হয়নি, ও একটা বড় শুল, চিরদিনের শক্র হয়ে বেচে রইল ।’
গাজী দক্ষিণা রায়ের পিছনে আর সময় নষ্ট না করে মুকুট রায়ের প্রাসাদের দিকে রওনা দিলো ।
৬.
মুকুট রায়ের প্রাসাদে ভুলবার্তা পৌছালো, বার্তাবাহক রাজাকে জানাল, বীরবাহু দক্ষিণা রায় আহত অবস্থায় বন্দী হয়েছেন ।
মুকুট রায় প্রাসাদ থেকে সপরিবারে বাইরে বেরিয়ে এলেন। চললেন মৃতসম্্রীবনী কূপের দিকে।
কূপের কাছে পৌছে আস্তে করে লীলাবতীকে বললেন, ‘রানী, আমার মেয়েকে বলো, ও যদি আমার সাথে আসতে চায়, আসতে পারে ।’
রাজা কুপে ঝাপ দিলেন।
লীলাবতী তার ছেলেদের জড়িয়ে ধরে আদর করলেন। বড় ছেলের কপালে চুমু দিয়ে বললেন,
“তোমাদের বোনকে বলো, সে যদি আমাদের সাথে আসতে চায়, আসতে পারে ।’
লীলাবতী কুপে ঝাপ দিলেন।
সাত ভাইয়ের বড় ভাই মেজো ভাইকে বলল, “বোনকে বলো, আমরা চলে যাচ্ছি। সেও আসতে চাইলে আসতে পারে ।”
বড় ভাই কুপে ঝাঁপ দিলো ।
তারা এইভাবে ছোট ভাই কামদেব পর্যস্ত সকলেই কূপের জলে ঝাঁপ দিলো ।
কামদেব দেখে, বাবা-মায়ের আজ্ঞা চম্পাকে পৌছে দেওয়ার মতো আর কেউ অবশিষ্ট নেই। উপায় না দেখে সে-ই চলল মন্দিরে তার দিদির কাছে । দরজায় টোকা দিয়ে বলল, “দিদি দরজা খোল ।’
চম্পাবতী মন্দিরের আগল খুলে বাইরে এল। তার মলিন বসন, উষ্কখুষ্ক চুল। শিথিল অবিনস্ত কাপড় । দেখেই বোঝা যায় এ কদিন তার অনাহারে, অনিদ্রায় কেটেছে।
ছোট ভাই বলে, “দিদি, বাবা-মা আর ছয় ভাই কৃপে ঝাপ দিয়ে পরপারে পৌছে গেছে। আমিও যাচ্ছি। বাবা বলে গিয়েছেন, তোর ইচ্ছে হলে তুইও আমাদের সাথে আসতে পারিস।’
চম্পাবতীর ঠোঁটে ক্রান্তি-বিষাদের হাসি। বলে, “ইচ্ছা হোক আর না-ই হোক পরপারে-তো একদিন যেতেই হবে! দাদা, এজন্য কৃপে বাঁপ দিতে হবে কেন?
চম্পাবতী ছোট ভাইয়ের হাত টেনে ধরে। বলে, “তুই কুপে ঝাঁপ দিসনে। আমরা যুদ্ধে হেরে গিয়েছি। তাই বলে আত্মাহুতি দেবো কেন?
কামদেব বলে, “কিন্তু গাজী খা যে আসছে। একটু পরেই সে আমাদের প্রাসাদে পৌছে যাবে । তোকে জিতে নিয়ে যাবে ।’
“শোন দাদা, আমি যুদ্ধে বিধ্বস্ত। বাবা-মা-ভাইহারা। আমার বুকে হাহাকার, চোখে জল । আমাকে জিতে নিলেই বা কী, আর না নিলেই বা কী? গাজী আসছে আসুক । আমার আর তোর যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি।’
ছোট ভাই জিজ্ঞেস করে, “কোন্ যুদ্ধ দিদি?”
চম্পাবতী তার ছোট ভাইয়ের হাত আরও শক্তভাবে মুঠিবদ্ধ করে বলে, “শোন দাদা, গাজী হিন্দু- মুসলমান সকলেরই পূজনীয়। যুগ-যুগান্তর মানুষ তাকে স্মরণ করবে। কিন্তু চম্পাবতী আর তার ছোট ভাই কামদেব, তাদেরও লোকে ভুলবে না, আমরা সেই ব্যবস্থাই করে রেখে যাবো ।”
চম্পাবতী যেন ঘোরের নেশায় বলতে থাকে, “দেখিস! এক সময় হিন্দু-মুসলিম সকলেই আমাকে “চম্পা মা’ বলে ঠিকই ডাকবে। তুই কৃপে ঝাঁপ দিব কেন দাদা? আমি আশীর্বাদ করছি তুই একশত বছর দীর্ঘায়ু হবি। তোর নামে হিন্দু-মুসলিম শ্রদ্ধায় অবনত হবে। দেখে নিস্, আমার এই বচন বৃথা যাবে না।’
সন্ধ্যা ঘোর হয়ে এল।
শূন্য রাজপ্রাসাদ । দীর্ঘশ্বাস আর কান্না জড়িয়ে আছে প্রতিটি অলিন্দ আর সিঁড়ির চাতালে । শুকনো পাতা ঝরে ঝরে পড়ে আঙিনায়। যে কপ ছিল মৃতসঞ্জীবনী, সেই কৃপ এখন মৃত্যুকূপ। তলদেশ থেকে
গুমরে গুমরে উঠছে হাহাকার আর কান্না । সন্ধ্যায় শঙ্খধ্বনি দেবে এমন কেউ এখন আর প্রাসাদে নেই।
চম্পাবতী ধীরপায়ে আবার মন্দিরে ফিরে যায়। হাতে তুলে নেয় শঙ্খ।
বিউদুর বহদুর থেকে গাজী শুনতে পায় শঙ্জের ধ্বনি। একটু আনমনা হয়ে ভাবে, ‘কে বাজায় এই?’