নিমের মাজন দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে আরেকবার মিয়া বাড়ির আওতার উপর দিয়ে উঁকি মারে সুজন। উঠোনের অর্ধেকটা চোখে পড়ে। একপাশে চট বিছিয়ে তাতে ধান আর মরিচ রোদে দিয়ে এখনও ঝিমুচ্ছে জাও বুড়ি। বড় মিয়ার কোন দূরসম্পর্কের বোন। বাড়ি ঘর কিছুই নেই। চাকরানীর মত পড়ে থাকে মিয়া বাড়িতে।
বুড়ির দাঁত নেই, ফোকলা দাঁতে ভাত খেতে পারেনা বলে নরম করে ‘জাও’ রেঁধে খায়। সেই থেকে এখন নামই হয়ে গেছে ‘জাও বুড়ি’।
দাঁতমাজতে উশখুশ করে সুজন। আড়চোখে আশপাশটা দেখে দ্বিতীয়বার উঁকি দিতেই ‘হুশ হুশ’ করে উঠে বুড়িটা। ওর কলজে শুকিয়ে যায়। দেখে ফেলল নাকি?
ভয়টা কাটে একটু পরেই।দেখেনি! ধানে মুরগী লেগেছিলো। তাই তাড়িয়েছে।
না! আজকে বোধহয় আর উপায় হবেনা।
দাঁতন করতে করতে পুকুর ঘাটের দিকে এগোয় ও। গেল কোথায় আজ?
কার খোঁজ করে ও? মিয়াবাড়ির আওতার বাইরে বেলীর ঝুপে দাড়িয়ে কাকে দেখার আশায় উঁকি মারে সুজন?
অবৈধ ,নিষিদ্ধ একটা কাজে এত টান কেন ওর?
ভাবে সুজন। জানে বিপদ। তারপরও! নুরু মিয়ার বউকে ভাল লাগলে ও কি করবে?
এক গাদা ছবি লেপটানো ওর মনে। ভেজা চুলে এলোকেশী কিংবা ঘামে ভেজা হাসি হাসি মুখের ছবিগুলো দিনরাত যদি বায়স্কোপের মত ওর চোখের তারায় নাচে কীইবা করবে ও।
ছয়মাস হল নুরু মিয়া দুবাই। এমন বউ রেখে ক্যামনে থাকে কে জানে?
পুকুর ঘাটে এসে মুখ ধোয়ে ওজুটাও সেরে ফেলে।
এ অভ্যাসটা সুজন পেয়েছে তার দাদার কাছ থেকে। তার বয়স তখন কত হবে, ছয় কি সাত।
দাদার সাথে ঘাটে আসত গোসল করতে করতে। দাদাকে ওজু করতে দেখে সুজন প্রশ্ন করত , কি কর দাদা?
দাদা নাকে পানি দিয়ে সাফা করতে করতে বলতেন, এইডারে কয় ওজু দাদু ভাই। হগল কাজের আগে ওজু কইরা নিবা। কু চিন্তা মাথা থেইক্কা বাইর হইয়্যা যাইব।
সুজন ওজু করে। তাও তার তার মাথা থেকে নুরু মিয়ার বউয়ের ছবি যায়না।
‘হালার শয়তান আমারে ছাড়েনা ক্যান?’
বিড়বিড় করে ও। ঘাট থেকে উঠে বাড়ির পথে পা বাড়ায়।
একটা লম্বা মেঠোপথ চলে গেছে সোজা উত্তরে। পথের একপাশে আম জাম ,তেতুল আর বাঁশের ঝাড়ের জঙ্গল। অপর পাশটা খালি। খোলামাঠে কাঁদা পানিতে জাম্বুরা নিয়ে ফুটবল খেলতে নেমেছে ছেলের দল। মাঠের পাশের বড় কদমগাছটার নিচে দাড়িয়ে কিছুক্ষণ খেলা দেখে ও। মাঠের ওপাড়ের ছোট রাস্তাটা পেরোলেই মিয়াবাড়ি। ভাবে আরেকবার দেখে আসবে নাকি?
দুই
মা বলেন , কিরে তোর বাপে কই?
সুজন রা করেনা। চুপচাপ ঘরে ঢুকে বেড়া থেকে শীতলপাটিটা নিয়ে মেঝেতে বিছিয়ে শোয়ে পড়ে। তাঁতে বসে লুঙ্গী বুনতে বুনতে কথা বলছিল মা।
এবার বুনন থামিয়ে বলেন, কিরে তোর বাপে কই গেছে? বাজার করতে গেছে বিয়ান বেলায় ,এহনতো বেইল মাথার উপর। রান্ধুম কহন?
সুজন এবারও রা নাই। মায়ের চেঁচামেচিতে খালি একবার ওপাশ ফিরে শোয় ও।
সুজনের মতে ওর বাপটা একটা ‘হারামি’। কাজ কর্ম করেনা ,বউয়ের রোজগারে ফুর্তি আমোদ করে।
সকালের দৃশ্যটা মনে পড়ে ওর। নলী আনতে মহাজন বাড়ি গিয়েছিল। দেখে কিনা মহাজনের বউয়ের সাথে হেসে হেসে পিরিতের আলাপ জুড়ে দিয়েছে ওর বাপ।
‘হ, আইব বাজার নিয়া! দেখ গিয়া মাগীর লাইগ্যা তেল,চুরি আইন্যা টেহ্যা উড়াইয়্যা দিছে এতক্ষণে’ বিড়বিড় করে সুজন।
সুজনের রা নাই দেখে তাতের গর্ত থেকে উঠে আসেন মা।
: কিরে? বিড়বিড়াইয়্যা কি কস? উত্তর দেসনা ক্যারে?
মায়ের কথায় মূহুর্তেই রাগ চড়ে যায় ওর। বাপের রাগ গিয়ে মায়ের উপর। সপাং করে মেঝের এক কোনে রাখা কুপিটা ছুড়ে মারে দরজার বাইরে।
তারপর খেঁকিয়ে উঠে, ঘুমাইতেছি দেহস না? এত প্যাঁর প্যাঁর কিয়ের তোর?
ভয়ে কুকরে হতভম্ব মা তাতের খুঁটিতে ভর দিয়ে পাথর হয়ে দাড়িয়ে থাকেন কেবল।
তিন
: দোস্ত খবর হুনছুনি?
চায়ের স্টলে বসে সুরত্ করে চায়ে চুমুক দিয়ে বলে শাজান।
: কিয়ের খবর?
: নুরু মিয়াতো দেশে আইতাছে। আইজ রাইতেই ফেলাইট।
: কসকি? হেদিন না মাত্র গেল?
ভয়ে মুখ শুকিয়ে যায় সুজনের। হীরাভাবীর ব্যপারটা জেনে গেল নাকি?
: হেদিন কইত্যে। আধা বছরের উপরে হইছে। আর তুমি যেন দোস্ত এহনও দুধের শিশু। এমন বউ রাইখ্যা কেউ বেশিদিন বাইর থাকতে পারেনি?
সুজন চায়ের কাপ তুলতে গিয়ে দেখে তার হাত কাঁপছে। ব্যাপারটা শাজানকে বুঝতে দেয়া যাবেনা।
‘যাই দোস্ত ,বাইতে কাম আছে’ বলে হুট করে চা স্টল থেকে বেড়িয়ে আসে ও।
নুরু মিয়া চইল্যা আসতেছে! ভাবতে এত খারাপ লাগছে কেন তার? মাথা ঘুরাচ্ছে ভন ভন করে। নেশাখোরের মত এলোমেলো পা ফেলে হাঁটতে হাঁটতে বাজার পেড়িয়ে মেঠো সড়কে উঠে পড়ে ও।
চোখের সামনে ভেসে উঠে হীরা ভাবীর ছবি। হীরা ভাবী ওর কে? তার জন্য এত আকুলি কেন তার?
ভাবনা আছে ,কুল নাই। এইযে মেঠো সড়ক এই সড়কের আরেকটু গেলেই মাঠ। মাঠের উপারে মিয়া বাড়ি। আর মিয়া বাড়িতে থাকে হীরাভাবী। সহসা সুজনের ইচ্ছে হয় এক দৌড়ে পৌঁছে যায় সেখানে। হাত ধরে বলে হীরা ভাবীকে জানায় ওর মনের কথা। ওর জন্য তার কতটান ,কত মহব্বত। সব খোলে বলে হালকা করে নেয়ে নিজেকে।
দিকনা ফিরিয়ে , মগজে চেপে রাখা কথার কিলবিল করা তো কমবে!
রাস্তার পাশে প্রকাণ্ড একটা তালগাছ। সেটার মাথায় খিলখিলিয়ে হাসছে একটা মস্ত চাঁদ। সেদিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুজন।
অত উঁচু চাঁদটা ছোঁয়ার সামর্থ্যই তার নেই!