লাল ফ্রেমের আয়না

-রুপচর্চা করতে খুব ভালো লাগে। তবে আমার এ ভালোলাগার বিষয়টি নিয়ে কম জলঘোলা হয়নি বটে। আত্মীয় স্বজন সবাই তো আমাকে ফ্যাশন রাজা বলে ডাকে। তবে আমি ওইদিকে কান দিই না।এক ছেলের বাবা এখন আর ফ্যাশন রাজা হলেই কি লাভ? অফিসের প্রচন্ড কাজের চাপে মুখখানা শুকিয়ে গেছে। আয়নায় মুখ দেখতে গিয়ে দেখলাম ভেসিনের সামনের আয়নাটা কেমন জানি ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। বহু দিন হয়েছে বটে। এবার মনে ধরল আয়নাটা বদলাবো। রাজধানী শহড়ে থাকি। ছোট্ট একটা হাসি-খুশি পরিবার। আমি আমার স্ত্রী তারিন আর তিন বছরের ছেলে সাহিল। মুখটা মুছে চেয়ারে বসে চায়ে চুমুক দিতেই
তারিনের বায়না,
– সাহিলের স্কুল তিন দিনের বন্ধ দিয়েছে। এ ফাকে কাল একবার বড় আপার বাসা থেকে ঘুড়ে আসি। আর তুলিকেও দেখতে আসছে কাল বিকেলবেলা।

শুনেও না শুনতে পাওয়ার ভান ধরলাম। তখনই তারিন,

– শুনেছ নাকি। কি-গো কিছু বলছ না যে?

এবার আর কিছু না বলে পারলাম না। অনেকদিন হয়েছে বটে কোথাও যায়নি ওরা। বলেই ফেললাম,
– ঠিক আছে যাও। তবে মাত্র একদিন কিন্তু?
– হুম, পরশুই চলে আসব।

বড়আপার বাসা মোহাম্মদপুরে আর আমরা থাকি ধানমন্ডিতে।
তুলি হলো বড় আপার মেয়ে।কাল ওকেই বরপক্ষ দেখতে আসছে।

সকালবেলা অফিসে চলেগেলাম। এ কয়েকদিন অফিসে ব্যাপক চাপ চলছে। সন্ধ্যেবেলা অফিস থেকে বের হব এমন সময় কি করে যেন মনে পরে গেল আয়না কেনার কথা। ভাবলাম আশেপাশে কোন দোকান থেকে আয়নাটা কিনে পাঠাও ডাকব। রাস্তার পাশেই একটা দোকান। ভূইয়া সিরামিক্স এন্ড সোপিজ। কাছাকাছি যেহেতু তাই আর বেশি না ঘুরে ঢুকে পরলাম এ দোকানে ই। দোকানটা নতুন হয়েছে আগে এ রাস্তায় যাওয়ার সময় দেখিনি। জিজ্ঞেস করতেই জানতে পারলাম দোকানটা দুদিন হলো শুরু হয়েছে। দারুণ ডিসকাউন্ট চলছে। আর ডিসকাউন্ট জিনিসটা কার না ভালো লাগে। শুনে একটু ভালোই লাগল। দেখাতে শুরু করল একের পর একেকটা আয়না। কোনটাই ভালো লাগল না। আমি একটু ইউনিক ডিজাইনের কোনকিছু
চাচ্ছিলাম। এ কথা ভাবতে ভাবতেই চোখে পড়ল সমনের সেলফের এক কোনায় কাগজে মোড়ানো একটা আয়না। বললাম,
– কেন উই সো মি দিস গ্লাস?
– ইয়েস স্যার, সিউর।

লাল টি-শার্ট পরা ছেলেটা আয়নাটা আনতে গেলেই দোকানের মালিক এসে হাজির।বলল,
– স্যার আমরা এটা বিক্রি করব না।

আমি বেশ করে জোর করালাম।অনেক জোরাজোরি করার পর
দোকানদার আমতা-আমতা করে আয়নাটা দেখাল। তাকে দেখে মনে হলো যে সে আমাকে এই আইনাটা দেখাতে চাচ্ছিলনা। যাইহোক আমার অনেক আপত্তির কাছে রিতিমতো হার মেনেই সে আমাকে কাগজটা খুলে দেখাল।
প্রথম দেখতেই আয়নাটা আমাত কাছে ভালো লাগে। লাল ফ্রেম তার উপর আবার নানান ফুলের কারুকাজ। আর অন্যদিকে আয়নাটাও বিশাল। সত্যি বলতে আয়নাটির সবচাইতে বেশি ভালো লেগেছে যে আয়নাটাতে ও চারকোণে কারুকাজ করা আর বেশ মজবুত ও। দাম জানতে চাওয়ার পর লোকটি বলল,
– স্যার এটা আমি নিজের জন্য বিশেষভাবে নেপাল থেকে আনিয়েছি।

এতক্ষনে বুঝতে পারলাম যে সে কেন অই জিনিসটা আমাকে দেখাতে চাচ্ছিল না।
আমি বেশ করে মিনতি করলাম। অনেক আবদারের পর লোকটি রাজি হলো তবে একটা শর্ত দিয়ে বসল। বলল,
– স্যার এটার দাম কিন্তু অনেক।এটা নেপালের রাজপরিবারের ব্যাবহার করা আয়না। আমি এটা অনেক কষ্ট করে এনেছি।

পুরনো জিনিসপত্রে আমার কোন শখ নেই। তবে আগামীকাল আমাদের বিবাহবার্ষিকী তে আমি এ ঐতিহাসিক আয়নাটা তারিনকে সারপ্রাইজ দিব এই ভেবে আমি বললাম,
-আচ্ছা ঠিক আছে। আপনি যত বলবেন তত ই দেওয়ার চেষ্টা করব। তবে ভাই মুনাফা একটু কমিয়ে ধরলে আমার জন্য ভালো হয়। দিনকাল ঠিক যাচ্ছে না চাকরির অবস্থাও ভালো না।

অ আরেকটা কথা বলতে ভূলেই গেছি তারিনের পুরনো জিনিস অনেক পছন্দ। আমাদের ঘরে অনেক পুরনো জিনিস আছে। সবকিছুই তারিনের হাতে কেনা।

অনিচ্ছাসত্ত্বেও সে আমাকে দাম শুনাল তবে সেটা আমার অনুমানের চেয়েও বেশি ছিল।
সে বলল,
-স্যার এটার দাম ৪০,০০০টাকা।

দাম শুনেই কেমন যেন ভয় পেয়ে গেলাম। অন্যদিকে আবার চিন্তা হচ্ছিল যে আয়নাটা যদি নেপালের রাজপরিবারের না হয়। এ ভয় থেকেই জিজ্ঞেস করলাম,
-এটা যে নেপালের রাজপরিবারের সম্পদ ছিল তার প্রমান কি?

লোকটি আমার দিকে খানিকক্ষন তাকিয়ে থেকে বললো,
– মশাই,আপনার পুরনো জিনিস নিয়ে কোন ধারনা ই নেই। যদি থাকত দেখেই চিনে ফেলতেন। সমস্যা নেই আপনার যদি সমস্যা হয় তাহলে অন্য আরেকটা দেখুন দয়া করে।

আমি বললাম,
– ঠিক ধরেছেন দাদা। আমার এ বিষয়ে কোন ধারণা ই নেই। কিন্তু আমার স্ত্রী একবার দেখেই চিনে ফেলবে। যদি দু-নম্বর পরে আমি কিন্তু ফেরত দিব?

ভদ্রলোক বলল,
– তো আপনি আয়নাটা নিচ্ছেন? আচ্ছা যদি কোন সমস্যা হয় ফেরত দিয়ে দিবেন।

আমি আরেকটু বার্গেনিং করার চেষ্টা করলাম কিন্তু দেখেই বুঝলাম যে আর সম্ভব না।
আমি কার্ডটা বের করে দিলাম।
কিন্তু একটু কেমন কেমন লাগছিল। আয়নাটার জন্য পকেট থেকে ৪৫,০০০ টাকা খসে গেল। তবে এটাও ভেবে নিয়েছিলাম যে তারিনকে আয়নাটার সত্যি দাম বলা যাবে না। কারণ সে যদি শুনে যে এত টাকা দিয়ে আমি আয়না কিনেছি আমার খবর আছে।
আধ-ঘন্টা অপেক্ষা করার পর একটি ছেলে খুবই যত্নের হাতে নরমকাগজে মুড়ে বাক্সে পুরে আয়নাটা আমার হাতে তুলে দিল। বাসায় পৌছে প্রথমেই আয়নাটা লাগিয়ে ফ্রেশ হয়ে টিভিতে বসে পরলাম। তবে আয়নাটা কাগজে মুড়ে লুকিয়ে রেখেছিলাম তারিনকে সারপ্রাইজ দিব বলে। সেদিন কিছুই হলো না। যা হবার হয়েছেপরের দিন।

আজ আমাদের পঞ্চম বিবাহবার্ষিকী। সকালবেলা ওরা ফিরে এসেছে।
ভালো কিছু খাবারের আয়োজন হলো। অনেক মজা করে ভালো কিছু মুহূর্ত কাটালাম অনেকদিন পর। আরে একটা কথা ভূলেই গিয়েছি বলতে, অফিস থেকে।একদিনের ছুটি নিয়েছিলাম।
ঠিক করলাম কাল শহরের অদূরে কোথাও লং-ড্রাইভে যাব। আজকে থেকেই সব অদ্ভুতুড়ে ঘটানাগুলো ঘটতে থাকে। বাসার সবগুলো ইলেক্ট্রিক বাতি হটাৎ নষ্ট হয়েছে। কোন রকম চার্য লাইট দিয়ে রাতটা কাটানোর চিন্তা করলাম। রাত একটা কি দেড়টা সে ভেসিনের সামনে গিয়ে আয়নায় মুখ পরতেই দেখলাম আমার কপালের বাপাশে গভীর একটা ক্ষত টপটপিয়ে রক্ত পরছে। হটাৎ অনেক ভয় পেয়ে গেলাম। মুখে একটু পানি দিয়ে আবার আয়নায় তাকাতেই দেখলাম কিছুই নেই। সবকিইছুই তো ঠিক আছে। মনে-মনে ভাবলাম হটাৎ ঘুমের ঘুড়ে ভূল দেখেছি। যাইহোক সেদিকে আর মন দিলাম না। বাথরুম থেকে বের হওয়ার সময় দরজাটা পার হওয়ার সময় কেমন করে যেন পরে গেলাম। মাথা গিয়ে লাগল
দেয়ালে। ব্যাথা পেতেই একটু চিৎকার দিয়ে উঠলাম। চিৎকার শুনতেই তারিন এসে হাতে ধরে তুলল। তখন নাকি অজ্ঞ্যান ছিলাম। জ্ঞ্যান ফিরতেই দেখলাম মাথা পাশে তারিন বসা আর পাশের ফ্ল্যাটের কয়েকজন পাশে দাঁড়িয়ে। উঠার চেষ্টা করতেই অনুভব করলাম মাথায় ব্যাথা পাচ্ছি। তারিন বললো,

– একটু রেস্ট কর। এখন উঠার দরকার নেই।
বালিশের পাশ থেকে মোবাইলটা হাতে নিয়ে ক্যামেরা চালু করে মুখটা দেখতেই হটাৎ চমকে উঠলাম। ভয়ে গলা শুকিয়ে গেল। কারণ আমি আয়নায় যা দেখেছিলাম আমার সাথে তাই হলো। আয়নায় দেখা আঘাত এর এই আঘাত ঠিক একই রকম আর একই যায়গায়। সবাইকে ধন্যাবাদ জানিয়ে একে-একে চলে যেতে বললাম। প্রতিবেশীরা বলে গেল,

– যদি আর কোন সমস্যা হয় ডাকবেন।
-জি অবশ্যই।

একথা বলে তারিন সবাইকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিল। সেদিন সারাটাদিন শুয়ে শুয়ে কাটালাম। কিন্তু আয়নার চিন্তাটা মাথা থেকে কোন রকমেই বাদ দিতে পারলাম না। অফিস থেকে বস আর সব কলিগ আর বস ফোন করে খোজখবর নিল। এই ফাকে বস আরো চারদিনের ছুটি দিয়ে দিল। সন্ধার দিকে আমি তারিনকে আয়নার পুরো ব্যাপারটা খুলে বললাম। তারিন বলল,

-আমি বলছি। তুমি যা ভাবছ সবই তোমার ভূল ধারণা। এমন কিছুই হতে পারে না। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।

এখনও একের পর এক আজব কান্ড আমাদের বাসায় ঘটতে থাকে। হটাৎ দরজার সবগুলো লক নষ্ট হয়ে যায়।গভীর রাতে মধ্যবয়সী নারীর কান্না শুনতে পাই। বাথরুমে গোসল করতে গিয়ে একদিন দেখলাম কল দিয়ে রক্তলাল পানি আসছে। কিন্তু তারিনকে ডেকে দেখাতেই দেখি পানি ঠিক আছে। আমি যেন কেমন দিন দিন মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পরছি। পরশু আমার ছুটি শেষ।
শরীর ঠিক হয়ে গেছে। এ বছর কোথাও ঘুড়তে যাওয়া হয়নি। তাই তারিনকে বলতেই যে,

– চলো কাল বের হই লং ড্রাইভে?
-না! তোমার শরীর এখনো ঠিক হয়নি।

তারিনের মত পেলাম না। তবুও অনেক জোর করে মানালাম যে দূরে কোথাও যাব না। মনে হলো গাজীপুরের দিকে গেলে কেমন হয়? রাতে প্রস্তুতি নিলাম যে খুব সকালে বের হয়ে যাব। এদিকে আরেকটা কাজ বাকি আছে। সাহিলের স্কুলে ফোন দিয়ে তো কাল ছুটি নিতে হবে।
দিলাম ফোন, স্যারকে বহু কষ্টে বুঝিয়ে একদিনের ছুটি নিলাম।
ও বাবা, কি কষ্টটা ই না হলো?
সকালবেলা সবাই তৈরি বের হয়ে পরলাম। সাহিল তারিনের কোলে আমার একহাতে ব্যাগ আরেকহাতে গাড়ির চাবি। গাড়িতে উঠলেই তারিন বলে উঠল,
– কিগো?
-হ্যা বল। কোন সমস্যা?
-আমি মনে হয় ঘরে মোবাইলটা ফেলে এসেছি। একটু গিয়ে নিয়ে আস প্লিজ।

দরজা খুলে মোবাইটা হাতে নিয়ে ফেরার সময় হটাৎ কেন জানিনা মনে হলো চুল ঠিক নেই। চুলের উপরে যেন কি লেগে আছে।
গেলাম অই আয়নায় দেখতে। আজকের দৃশ্যটা আমার জীবনে দেখা সবচাইতে ভয়ংকর দৃশ্য ছিল। দেখলাম আমার মাথা থেকে প্রচন্ড রক্ত পরছে। মাথার বা পাশে আঘাত এর ক্ষত। গায়ের সাদা শার্ট রক্তে লাল হয়ে গেছে। সাথে-সাথে চোখে মুখ্ব পানি দিয়ে দেখলাম সবই ঠিক ই আছে। গাড়িতে ফিরে গিয়ে তারিনকে এ বিষয়ে কিছু বললাম না। কি জানি সে যদি আবার ভয় পায়। এখনো আমি দৃশ্যটা ভুলতে পারছি। এসি এর শীতল বাতাশের মধ্যেও ঘেমে যাচ্ছি বারেবার। এদিকে হার্টবিট যেন দ্বিগুন হয়ে গেছে। তারিন বলল,

-তুমি এত ঘামছ কেন? কী হয়েছে?

আমি বললাম
-কোথায় ঘামলাম? বাইরে থেকে আসলাম তো হটাৎ তাই মনে হয় একটু ঘেমে গেছি।

এবার তারিন বললো,
-তুমি কি আমার কাছ থেকে কিছু লুকাচ্ছ?

-আরে না। সবকিছু ঠিক আছে। এ নাও তোমার ফোন।

আজকের পরিবেশটা খুব ভালো। সূর্যের তাপটা তেমন বেশি না। আর সবচাইতে বড় কথা ঢাকার রাস্তার চিরচেনা সে ভিড় আজকে মোটামোটি কম।
তাই খুশি মনে নানান কথা বলতে বলে ডানে-বামে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে চলছি।
টঙ্গী জংশন এর কাছে যেতেই সামনে দিক থেকে মালবাহী মস্ত এক ট্রাক হটাৎ ব্রেক ফেইল করে আমাদের গাড়ির দিকে ছুটে আসছে। গাড়িটি এতই কাছাকাছি ছিল আমি সে মুহূর্তে কী করব সেটা ভেবে পাচ্ছিলাম না। আমি গায়ের সারা শক্তি দিয়ে ব্রেক চেপে স্টিয়ারিং টা বামে ঘুড়িয়ে ফেললাম। এর ফলে ট্রাক্টির সাথে আমাদের গাড়ির সংঘর্ষ না হলের আমাদের ডানের গাড়িটি চূর্ন-বিচূর্ণ হয়ে গেছে।
আমাদের গাড়িটি ফুটপাতের উচু দেয়ালের সাথে লেগে উল্টে যায়। সৃষ্টিকর্তার রহমতে আমি এবং আমার পরিবার বেচে যাই। বাবু কোন আঘাত পায়নি। তারিনের পায়ে হলকা মোচড় লেগেছে আর আমার মাথার উপরের অংশ একটু কেটে গেছে আর বাম হাতটা ভেঙে গেছে। আমি এখন হাসপাতালের ষোল নম্বর বিছায়ায় শুয়ে বাম হাতে এবং মাথায় ব্যান্ডিজ। 3B এ কক্ষের কোণায় দেখলাম আমার পরে থাকা সে সাদা কিন্তু রক্তাক্ত শার্ট টা।এবার যেন ভয়ে আমার শরীর শীতল হয়ে আসছে। তারিনকে আমি ডেকে সব খুলে বললাম। এবার তারিন ও বিশ্বাস করল যে অই আয়নাটায় কোন সমস্যা আছে।
জীবনের প্রথমবারেত মতো হাসপাতালের বিছানায়। এদিকে আত্মীয়-স্বজন অনেকেউ এসে পড়েছে। কারো কাছে এবিষয়ে কিছু বলব না। বাড়িয়ে ফিরে আমার প্রথম কাজই হবে আয়নাটা খুলে ফেলা।