ভ্যাবলার আডভেঞ্চার

মাঝে কয়েক দিন বৃষ্টি হল। শ্রাবণ মাস। বৃষ্টি হতেই পারে। যে সময়ের যেটা সেটা না হওয়াই খারাপ । আষাঢ় শ্রাবণ এই দুই মাস বৃষ্টি না হলেই ক্ষতি।
আকাশ ভর্তি কালো মেঘ। যখন তখন বৃষ্টি। সস্তা পেয়ে বাবা রোজই পেল্লাই সাইজের ইলিশ মাছ কিনে আনছে। মোড়ের কাছের চায়ের দোকানে বেশ বড় জটলা। রাজ্যের সব বুড়ো মানুষ আদা চা খাওয়ার লোভে হাজির। উনাদের তো আর ইস্কুলে যেতে হয় না। হাতে অফুরন্ত সময়।
আমার কাজ ছিল জানালায় বসে দূরের বিপিন বাবুর বাগান দেখা। বাগান ভর্তি গাছ, অনেক গাছ চিনি না। শুধু আম গাছটা চিনি। এক মৌসুমে সোনালি ফুল ধরে গাছে। আমের মুকুল । বিনবিন করে হলুদ আর কালো ডোরা কাটা দাগওয়ালা মৌমাছি এসে হাজির হয়। আর ফাল্গুন মাসে তো ঝোপড়া ঝোপড়া আম ঝুলে থাকে গাছে।
কে না জানে, বৃষ্টি হলে গাছপালা স্নান করে নেয়। ওরা তো সাবান শ্যাম্পু মেখে আমাদের মত রোজ স্নান করতে পারে না। ওরা অপেক্ষা করে কখন বৃষ্টি নামবে। তো বৃষ্টি মানেই ওদের জম্পেশ এক স্নান। এই জন্যই তো বৃষ্টির পর চকচক করে ওদের পাতা।
বৃষ্টির জন্য বাইরে যেতে পারছি না। বাংলার মাঠের কি অবস্থা কে জানে। হয়তো গিয়ে দেখব সবুজ ঘাসগুলো লকলক করে এক হাত লম্বা হয়ে গেছে। তারপরও ঘাসগুলো ভাল। ভদ্র আর বিনয়ী ঘাস। খেলতে গিয়ে পড়ে গেলে হাত পা ছিলে যায় না। বরফকলের ওখানের ঘাসগুলো একদম ব্লেডের মত ধার । এত ধার মনে হয় দাড়ি গোঁফ কামানো যাবে। এমন বড় ঘাসের জন্য কয়েকদিন বাংলার মাঠে খেলা যাবে না। সপ্তাহখানেক লাগবে রোদে বাতাসে নরম হতে। তারপর সবাই খেলতে পারব।
বসে কি করব ভাবছিলাম। এক বাক্স নতুন ক্রেয়ন রঙ পেনসিল আছে । আরও আছে তুদ্রা অঞ্চলের বরফের মত সাদা কাগজ। অনেক অনেক কাগজ। কয়েকটা ছবি আঁকা যেতে পারে। নীল রঙের আম। হলুদ আকাশ। বেগুনি নদী। সবুজ রঙের হাতি। পাখাওয়ালা মাছ আকাশে উড়ছে , এমন আজগুবি কিছু ছবি।
এমন সময় দেখি ভ্যাবলা আসছে। টানা পাঁচ ছয় দিন দেখা হয়নি ওর সাথে । ভ্যাবলা আমার বন্ধু। ওর সাথে পরিচয় হয়েছিল পাকরাশিদের দোকানের পাশে। দৌড়ে কাঁটা ঘুড়ি ধরতে গিয়ে ড্রেনে পড়ে গিয়েছিল ভ্যাবলা । আমি ওকে তুলতে সাহায়্য করেছি । সেই থেকেই বন্ধু। আরেকবার রাস্তায় একটা কুকুরের বাচ্চা পেয়েছি। নিজেরা পয়সা দিয়ে সেই কুকুরটাকে আটার বিস্কুট কিনে দিয়েছি। বাবুল বিস্কুট । কাজেই আমরা ভাল বন্ধু। নতুন সব খেলা আবিষ্কার করতে পারে ভ্যাবলা। যেমন – গত বার আমরা পোস্টম্যান পোস্টম্যান খেললাম। সহজ আর মজার খেলা। অনেকগুলো শুকনো কাঁঠাল পাতা যোগার করলাম। মনে মনে ভাবলাম ওগুলো পোস্টকার্ড। পাতার রঙ প্রায় পোস্টকার্ডের রঙের মতই। এবার প্রতিবেশী সবার বাড়ি গিয়ে জানালা দিয়ে তিন চারটে করে শুকনো কাঁঠাল পাতা ফেলে দিয়ে গম্ভীর গলায় হাক দিলাম- ‘ চিঠি আছে চিঠি। দারজিলিং থেকে আপনার নাতির চিঠি।’
যে বাড়িতে অমন হাঁক দিচ্ছি সেই বাড়িতে কারো নাতি থাকতেও পারে। আবার নাও থাকতে পারে। কিন্তু অমন করে বললে ভাল লাগে। তাই বলি। খেলাটা দারুন। আরও মজার যখন বুড়ো শিবশঙ্কর পানিপুরি আমাদের দেখলেই বাতের ব্যাথা নিয়ে ও চেঁচিয়ে উঠে- ‘ আবার এসেছিস তোরা । আমার ঘর দোর ফালতু পাতা ফেলে নষ্ট করতে ? দাড়া দেখাচ্ছি মজা।’
তখন আমরা দম খিঁচে দৌড় দেই। ওটাও বেশ মজার। সিনেমার নায়কদের মত লাগে।

ভ্যাবলা কোন ইস্কুলে ভর্তি হয়নি। সামনের বছর হবে। ও দেখতে বাটুল ধরনের। ঢোলা জামা পড়ে। ওর বড় ভাইয়ের পুরানো জামা।
জানালার বাইরে দাড়িয়ে আমাকে দেখে হাসল। আমি বাইরে যাবার একটা ছুতো পেয়ে গেলাম। বারান্দার সিঁড়িতে বসলাম। ওর হাতে পেল্লাই সাইজের একটা ছাতা। কয়েক জায়গায় তালি দেয়া। জামার পকেটে এক গোছা পেপরমিয়া গাছ। ইংরেজিতে অনেক দেশে এই গাছটাকে – ইঁদুরের কান বলে। পাতাগুলো দেখতে অমন, তাই।
‘কি ব্যাপার কয়েকদিন দেখিনি যে ।’ জানতে চাইলাম।
‘ তিলের নাড়ু থাকলে দাও।’ শুকনো মুখে বলল ভ্যাবলা। ‘ তোমার সাথে যে আবার দেখা হয়েছে সেটাই বড় ভাগ্য।’
‘ সে কি ? কেন ?’
‘ নাড়ু দাও , বলছি।’
ভেতরে গিয়ে সিরামিকের তশতরিতে করে কালো কুচকুচে কয়েকটা তিলের নাড়ু নিয়ে এলাম। সাথে এক লোটা জল।
গাপ গাপ করে খেয়ে লোটার জল শেষ করে বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল -‘ ইস কি কপাল। ভাগ্য ভাল আবার দেখা হল তোমার সাথে।’
‘কি হয়েছে বলবে তো ।’ এইবার খানিক বিরক্ত হলাম। খেয়াল করলাম ওর দুই পায়ের হাঁটুর উপর শুকনো ক্ষত। কনুই খানিক ছয়ে গেছে।
তর্জনী দিয়ে গালের ভেতরে সেঁটে থাকা বাকি নাড়ু বের করে আবার খেয়ে বলতে লাগল ভ্যাবলা- ওর কাহিনি এই রকম-
গত কয়েক দিন আগের কথা। প্রথম যেই বিকেলে ঝড়ো বাতাস বইল মনে আছে ? ছাতা হাতে আমি মুদি দোকানে গিয়েছিলাম চার আনার কালি জিরা কিনতে। মা, কুমড়ার ছক্কা বানাবে। কালি জিরা দিলে স্বাদ ভাল হয়। রাতের বেলা সাদা রুটির সাথে কুমড়ার ছক্কা দিয়ে খেতে বেশ অমায়িক লাগে।
বৃষ্টি কমই ছিল। গুড়ো হয়ে পড়ছিল। ইলিশ মাছের ডিমের মত রেণু বৃষ্টি। কালিজিরা হাতে ফেরার পথে মস্ত এক কাণ্ড হল। কোত্থেকে যেন দমকা এক বাতাস এলো হা হা করে। ছাতা থাকায় একদম প্যারাসুটের মত উপড়ে উঠে গেলাম। ভয়ে চোখ বন্ধ হয়ে গেছে আমার, কালি জিরার পোঁটলা খসে গেছে হাত থেকে। কয়েকটা সবুজ রঙের কাক দেখি সেই কালিজিরা খেয়ে ফেলল। আমি তখন আকাশে উড়ছি। নীচে ওয়ালী সাহাবের বাড়ি দেখাচ্ছিল একদম জুতার বাক্সের মত। বাটা কোম্পানি যেমন বাক্স দেয় তেমন পেল্লাই সাইজের।
ভয়ে আমার দম যেন বন্ধ হয়ে যাবে। একবার ভাবলাম গগন শিরীষ গাছের উপর লাফ দিয়ে পড়ব নাকি। আবার মনে পড়লো কালি দাস বাবুর বউ সেই গাছের ডালে ফাঁসি দিয়ে আত্নহত্যা করেছিল। অনেকেই রাতের বেলা উনাকে দেখেছে। কে জানে এখন যদি বসে থাকে।
আমি তো ছাতায় ভাসতে ভাসতে উড়ে চলে যাচ্ছি। ভয় কমে গেছে ততক্ষণে। মজাই লাগছে। কিন্তু নিচের কোন জায়গা চিনতে পারছি না। যেমন ধর বউ বাজারটা বা শীতলক্ষ্যা নদীটা দেখছি না। শুধু ঘাসের বন। সাথে মিষ্টি আলুর মত এবড়ো থেবড়ো জমি। ওখানেই একদম অচেনা এক শহর দেখলাম। বললে বিশ্বাস করবে না-পুরাপুরি বিদেশের মত। ততক্ষণে বাতাসের বেগ অনেক কমে গেছে । ওখানে নেমে পড়লাম ঝুপ করে । অপূর্ব একটা জায়গা। বললে বিশ্বাস করবে না, মানুষগুলো মাত্র বুড়ো আঙুলের সমান। ডিমের খোসা দিয়ে নিজেদের বাসা বানায় । জানালা বানায় বোতাম দিয়ে। কলকারখানা বানায় কনডেন্স মিল্কের বাতিল কৌটা দিয়ে। পুকুরগুলো ছোট ছোট । কাঠ বাদামের খোসা দিয়ে নৌকা বানায় ওরা। অই দেশের নাম পিচ্চিগঞ্জ। ম্যাপে খুঁজলে পাবে না। কারন সরকারী ভাবে নথি করা নেই।
ওরা চাষ বাস করে। চাষবাসই মূল পেশা। কাউনের দানার মত ঘাসের দানা খায়। মাছ মাংস খায় না। পিঁপড়ে পালে। এই পিঁপড়ে মানুষের বাসা থেকে চিনির দানা চুরি করে ওদের কাছে নিয়ে যায়। ওরা চিনির দানা আর শিশিরের জল দিয়ে শরবত বানিয়ে রেখে দেয় গরমের দুপুরে খাবে বলে। এমনিতে ওদের প্রিয় খাবার হাওয়াই মেঠাই। কারখানায় চিনি ঢেলে দিলেই বাতাসে কল কব্জা চলা শুরু হয়। মাকড়সার জালের মত হাওয়াই মেঠাই তৈরি হয়ে যায়। যার যত দরকার লাইন দিয়ে নিয়ে যায়। পিচ্চিগঞ্জের লোকজন পায়ে হেঁটে চলাচল করে। তবে অনেকে এঁটুলি পোকা বা গুবরে পোকার উপর উঠেও চলাচল করে। ওখানে কোন দোকান পাট নেই। সবাই নিজের জিনিস নিজে বানায়। কারো কিছু বেশি হলে বদলা বদলি করে নেয়। ও হ্যা ভাল কথা, ইস্কুল ও নেই। ইস্কুলের মত ফালতু জিনিসের দরকার হয় না।একদম বিন্দাস জীবন ওদের। খাও দাও। খেলা কর। বাচ্চারা প্রজাপতি বা কাচপোকা ধরে সুতা বেধে ঘুড়ির মত উড়ায়। বিদ্যুত নেই। শহরের মেয়র রাতের বেলা কাচের বোতলে করে জোনাকি পোকা রেখে দেয় ওদের শহরের রাস্তায় রাস্তায়। সেই আলোতে সবার কাজ চলে।
‘তোমাকে দেখে ওরা ভয় পায়নি ?’ এতক্ষণে প্রশ্ন করার সুযোগ পেলাম।
‘ আরে নাহ।’ একগাল হেসে জবাব দিল ভ্যাবলা। ‘ মোটেও ভয় পায়নি। বেশ আপ্যায়ন করেছে। আমি ওদের কাজ করে দিলাম।’
‘যেমন ?’
‘ বড় জমির মাটি কুপিয়ে বেশি ফসল বুনে দিয়ে এলাম। নারকেল গাছে উঠে কয়েক ডজন নারকেল পেড়ে দিলাম। তরমুজ ক্ষেতে গিয়ে কয়েক হালি তরমুজ এনে দিলাম। বিরাট পার্টি হল তিনদিন ধরে। পিচ্চিগঞ্জের সবাই তরমুজের ভেতরে সাঁতার কেটে কেটে তরমুজ খেল। করমচা পচিয়ে অদ্ভুত রকম মদ বানায় ওরা, আমাকে দিল কয়েক বালতি। আমাকে বেশ রাজার সম্মান দিয়ে রাখল। সারাজীবন থাকতে ইচ্ছা করছিল। ’
‘ চলে এলে কেন ? ‘ মনে মনে লোভী হয়ে উঠলাম।
চারিদিকে সতর্ক ভাবে চেয়ে ভ্যাবলা বলল – ‘ আরে বাথরুমের সমস্যা। তিন দিন রোজ দূরের মাঠে গিয়ে ইয়ে করতে হয়েছে আমাকে। তিন দিন পর আবার আচমকা ঝড়ো বাতাস শুরু হল। বাইরে হাঁটছিলাম । শেষে আবার ছাতায় উড়ে চলে এলাম। সাবধানে থাকবে । বাদলার দিনে ঝড়ো বাতাসের মধ্যে ছাতা নিয়ে বের হলেই সমস্যা। ’
হাত পা নেড়ে আরও কি কি বলতো ভ্যাবলা কে জানে ? কোত্থেকে ভ্যাবলার বড় ভাইয়া এসে ঠাস ঠাস করে ভ্যাবলার দুই গালে দুই চড় মেরে বসলো । কান দুটো মুচড়ে অক্সফোরড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিকশনারির মত লাল করে ফেলল। চেঁচিয়ে বলল- ‘ আবার তুই ছাতা নিয়ে বের হয়েছিস?’
‘ ঠিকই বলেছেন ভাইয়া।’ উনাকে সমর্থন করলাম। ‘ আবার যদি উড়ে যায় ?’
‘ ওর গপ্পো বিশ্বাস কর ?’ সিনেমার ভিলেনের মত হাসল বড় ভাইয়া । ‘ কাউকে না বলে দাদুর এই ছাতা নিয়ে বের হয়েছিল বাসা থেকে। ছাতা দিয়ে একতলা বাড়ির ছাদ থেকে লাফ দিয়ে প্যারাসুট প্যারাসুট খেলে শয়তানটা। বাতাসের তোড়ে উলটে পড়ে ছাতার সব শিক ভেঙ্গে ফেলেছে। নিজে ও পড়ে গিয়ে হাত পা ছিলে মোরব্বা বানিয়ে ফেলেছে। শুধু এখন চিনির সিরায় রেখে দিলেই হবে। আর এখন তোমার কাছে বসে গল্পের ঝুড়ি খুলে বসেছে ।’
আচমকা ছাতা বগলে করে বাই বাই করে দৌড় দিল ভ্যাবলা।
পরদিন হাঁটতে গিয়ে দেখি ওদের বাগানের বেড়ায় রঙ দিচ্ছে ভ্যাবলা। জানি এটা ওর শাস্তি । বড় ভাইয়া শাস্তি দিচ্ছে ওকে। আমাকে দেখে রঙ করার গতি আরও বাড়িয়ে দিল। যেন দুনিয়ার সব চেয়ে বড় আর বিশাল বেড়ায় রঙ করছে ও। চেহারা বেশ গম্ভীর। কথা বলার ফুরসত নেই এমন একটা ভাব।