বাঙালি মুসলমানের অনুভূতি

America Got Talent নামে একটা শো আছে, সেখানে ক্রোমা/গ্রিন স্ক্রিন এডিট করে একজন ফেইক প্রতিযোগী আযান দিচ্ছে, সেইসাথে বিভিন্ন জায়গা থেকে কেটে বিচারকরা আবেগি আপ্লুত হয়ে যাচ্ছে এমন ক্লিপ জুড়ে দেয়া হয়েছে। আর নগদে মিলিউন মিলিউন ভিউ এবং অধিকাংশ বাঙ্গালী পারলে সবাইকেই ধরে বেঁধে ঐটা দেখিয়ে নিজে কত ধার্মিক সেটা প্রমাণে লেগে গেছে।
অথচ ইসলাম ধর্মে কোন মিথ্যা ব্যাপারকে প্রচার করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।

ইউটিউবে রেন্ডমলি যেকোন ভিডিওর কমেন্টে গেলেই পাবেন একজন না একজন “আল্লাহকে ভালোবাসলে লাইক দিন”, “বিশ্বনবীর উম্মত হলে লাইক না দিয়ে যাবেন না”, “আলোর পথে আসুন” এই ধরনের কমেন্ট করেছে। আবেগি বাঙালি মুসলিম ধর্ম নাশ হবার ভয়ে সেখানে কোটি কোটি লাইক দিয়ে ভরিয়ে দিচ্ছে।
এফিলিয়েট মার্কেটিং বলে একটা কথা আছে, যেখানে একজন বিক্রেতার হয়ে ঐ প্রোডাক্টটা বিক্রি করে দেয়ার মাধ্যমে একটা কমিশন নেয়ার সিস্টেম আছে। আমরা ধর্মকেও সেরকম বানিয়ে ফেলেছি। নিজে পালন করার নাম নাই, কিন্তু আর পাঁচজনকে দাওয়াত দিয়ে তার কাছ থেকে শেয়ারে সওয়াব কামাই করে বেহেস্তে যাওয়ার ধান্দাবাজি চালিয়ে যাচ্ছি।

সওয়াবের আশায় রাস্তাঘাটে, হাটে মাঠে ময়দানে, গাছের মধ্যে প্যারেক গেঁথে ইদানিং “আলহামদুলিল্লাহ”, “সুবহান আল্লাহ” ইত্যাদি লেখা চোখে পড়ে। যারা কাজটা করেছেন, তাঁরা এইটা লাগিয়ে ভাবছেন যে বিশাল একটা “সদকাতুল জারিয়া” করে ফেলেছেন। এই বোর্ড দেখে যতজন পড়বে, অটো তার কিয়দাংশ সওয়াব আপনার আমল নামায় লেখা হয়ে যাবে। অথচ কয়েকদিন পরে দেখা যায় সেই সাইনবোর্ড ঝড়ে বৃষ্টিতে ছিড়ে পরে মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে। আর যে গাছে প্যারেক গেঁথে লাগানো হয়েছে সে গাছটার কথা না হয় বাদই দিলাম। ধর্মীয় অনুভূতি, এই ধরনের ছোটখাটো সহানুভূতির আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে।
গাছে গাছে প্যারেক গেঁথে এই ধরনের পোস্টার না লাগিয়ে, পারলে গাছ লাগান। ঐ গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিয়ে কোন পথিক যদি নিজের মনে থেকে “আলহামদুলিল্লাহ” বা “সুবাহান আল্লাহ” বলে সেটা প্রকৃত মন থেকে বলা। পোস্টার দেখিয়ে জোর করে পড়িয়ে সওয়াবের চেয়ে সেটা মনে করি অনেকাংশেই শ্রেয়।

ঠিক এই মুহূর্তে যদি কেউ বিশ্বনবী (সাঃ) কে অপমান করে কিছু বলে, লক্ষ লক্ষ লোক রাস্তায় নেমে যাবে। জ্বালাও পুড়াও অবস্থা ঘটাবে। যে লিখেছে তারতো দফারফা করবেই, সাথে বোনাস হিসেবে অনেক নির্দোষ মানুষেরও জীবন যেতে পারে। অথচ এই লক্ষ লক্ষ লোক, নবীর অপমানে যাদের মনে বারুদের আগুন জ্বলে, নিজেদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে নবী (সাঃ) এর আদর্শ মেনে চলতো তাহলে দেশটার চেহারাই পরিবর্তন হয়ে যেতো।
একজন যদি নবী (সাঃ) কে নিয়ে কটুক্তি করে, আর অমনি যদি সবাই গিয়ে হামলা চালিয়ে তাঁকে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দেন, তাহলে কি বাকি সবার মনে নবী(সাঃ) এর উপর অটো শ্রদ্ধাবোধ চলে আসবে? বরং ঐ ব্যক্তির পরিবারের মধ্যে চাপা ক্রোধ থেকে যাবে।
এরচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে, যিনি কটুক্তি করেছেন, তার সাথে দেখা করুন। যুক্তি দিয়ে তার ভুলটা দেখান। তাঁকে মহানবী(সাঃ) এর জীবন সম্পর্কে জানান। হতেও পারে, ঐলোকের মাধ্যমে আরো ৫০ জন লোক নবী(সাঃ) এর জীবন সম্পর্কে জানতে পারবে।
অথচ নবীর অপমানে অতি আবেগে জ্বলে গিয়ে একজনের কথার জের ধরে ৫০ জন মানুষের বাড়িঘর ভেঙ্গে জ্বালিয়ে দিলে, ঐ ব্যক্তি তো দূরে থাক, অন্যদের মনেও মুসলিমদের নামে মাস্তানির একটা তকমা লেগে যাবে।

বাংলাদেশে প্রচুর মুসলিম। এই নিয়ে প্রচুর বড়াইও চলে। কিন্তু আসল মুসলিমদের সংখ্যা খুবই কম। আসল মুসলিমরা নিজের সর্বক্ষেত্রে ধর্ম মেনে চলবে। ইহলোক এবং পরলোকে আল্লাহর উপর নির্ভর করবে। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে কি ঘটে? আমরা সারাদিন চিন্তা করতে থাকি যে “এই বুঝি ইসলাম মুছে গেলো পৃথীবি থেকে”, “এই বুঝি অমুক ইসলাম ধ্বংস করে দিলো”, “অমুকে অমুক কাজ করে ইসলামকে অপমান করলো”।

আপনি বাহুবলে ইসলামকে টিকিয়ে রাখতে পারবেন না, আর ইসলাম যিনি নাযিল করেছেন, সেটার রক্ষাকর্তাও তিনি। আমরা ওনার বান্দা, আমাদের দায়িত্ব ওনার প্রতি আনুগত্য রেখে, ওনার মনোনিত ধর্মকে পালন করা। ওনি যতদিন চাইবেন ইসলাম কায়েম থাকবে, ওনি চাইলে বিলীন করে দিবেন। এইটা নিয়ে সবসময় একটা “রিস্কি” মাইন্ডে থাকা আদতে ওনার উপর আমাদের “ঠিক বিশ্বাস নেই” এমনটাই প্রমাণ করে।

একটা চমৎকার কোরআন তেলাওয়াত থেকে, প্রিয়াংকা চোপড়া কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে কি বলেছেন, অমুকে আযান নিয়ে কি বলেছে সেইটাতে আমাদের আগ্রহ বেশি। শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর ফেসবুকে একটা সেলফি দিয়ে, বাসায় ফিরে সালমান খানের “জুম্মে কি রাত” গানটা শুনতে শুনতে চিন্তা করি, আহা আমাদের ধর্ম কি মহান, বলিউড পর্যন্ত পৌছে গেছে। অথচ খেয়াল করে দেখিনা, পরে লাইনগুলোই আমাদের ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক।

মুসলিমদের মধ্যে আমি দুইটা শ্রেণী দেখেছি । এক শ্রেণীর মুসলিম ধর্ম পালন নিয়ে ব্যস্ত, কোথায় কি ভুল করে ফেললো সেটা নিয়ে চিন্তিত, কি পাপের জওয়াব কিভাবে দিবে সেটা নিয়েই ভেবে কুল পাচ্ছেনা। আর আরেক শ্রেণীর মুসলিম নিজের ধর্ম পালন করার চেয়ে, ধর্মানুভূতিতে পরমভাবে নিমোগ্ন হয়ে অপরকে দাওয়াত দিয়ে এফিলিয়েট মার্কেটিং এর দ্বারা বিনাশ্রমে সওয়াব কামাতে গিয়ে নিজেই ধর্ম থেকে কখন যে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে সেটাই বুঝতে উঠতে পারছেনা।

বাঙালি মুসলিমদের মধ্যে মুসলিম হিসেবে একটা অহংবোধ আছে। দেশে সংখ্যা গরিষ্ঠ এই নিয়েও একটা “বড় ভাই বড় ভাই” ভাব আছে। যেটা ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক। মুসলিম হিসেবে আমাদের অহংবোধের কোন জায়গা নেই। একজন মানুষ হিসেবে, ইসলাম ধর্মের অনুসারী হিসেবে আমরা অন্য মানুষদের প্রতি কতটা নমনীয়, কতটা শ্রদ্ধাশীল সেটাই হচ্ছে দেখার বিষয়।

সবশেষে মহানবী (সাঃ) এর বিদায় হজ্জ এর ভাষণ থেকে দুটো কথা উল্লেখ্য করব,
“আল্লাহ বলেন.হে মানবজাতি তোমাদেরকে আমি এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি,এবং তোমাদেরকে সমাজ ও গোত্রে ভাগ করে দিয়েছি. যেন তোমরা পরস্পরের পরিচয় জানতে পার,অতএব শুনে রাখো মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ নেই ।আরবের ওপর কোনো অনারবের_অনারবের উপর কোনো আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই । তেমনি সাদার উপর কালোর বা কালোর উপর সাদার কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই । তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বেশী সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী,যে আল্লাহকে ভালবাসে।”
“তোমরা কখনোই ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না- কারন অতীতে বহু জাতি ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ির কারনে ধ্বংস হয়ে গেছে।”