ত্রয়বিংশশতক থেকে উনবিংশ শতকের প্রথমদিক, ভারতবর্ষের শাসনব্যবস্থায় তখন ঘুণ ধরে গেছে। ভারতবর্ষজুড়ে তখন চলছে অরাজকতা এবং বিশৃঙখলা। এসময় ভারতের আনাচে কানাচে দেখা যায় খুনি এবং লুটেরার দল। তাদের হত্যা করার পদ্ধতি যেমন ছিল আলাদা তেমনি তাদের ভাষা ও সংস্কৃতিও ছিল একে অপরের চেয়ে আলাদা। এমনই এক খুনির দল ‘ঠগী‘ যারা একফালি রুমালকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে মানুষ খুন করত।
ঠগী শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ ঠক থেকে যার অর্থ প্রতারক বা ধোঁকাবাজ। বাংলা ভাষায় ঠগী বলতে এমন এক শ্রেণীর খুনিকে বোঝায় যারা রুমাল ব্যবহার করে খুন করত এবং ধন সম্পদ লুট করত। ঠগীরা ছিল অত্যন্ত নিষ্ঠুর ধরণের খুনি। ধারণা করা হয় একবছরেই এই খুনির দল প্রায় ৩০০০০ মানুষ খুন করত।
ঠগীরা বড় বা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে পথে চলত। তাদের কাফেলা তে এসে অন্য পথিকরা যোগ দিত। ঠগীরা নানা গল্পে কথায় পথিকদের বিশ্বাস অর্জন করে তাদের নির্জন প্রান্তরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করত। এবং সব ধনসম্পদ লুট করে লাশ পুঁতে ফেলত মাটিতে। হয়ত পথিকের সাথে সুমধুর গল্প করতে করতেই কোনো এক ফাঁকে রুমালের সাহায্যে খুন করে ফেলত তারা।
তাদের হত্যার উপকরণ ছিল অতি সামান্য। নির্দোষ একফালি হলুদ রুমাল আর একটা পয়সা। এ রুমালকে ওরা বলত পেলহু অথবা সিক্কা। দুভাঁজে ভাঁজ করলে সেটি দৈর্ঘ্যে মাত্র ৩০ইঞ্চি। ১৮ইঞ্চি দূরে থাকত একটি গিঁট আর গিঁটের প্রান্তে রুপার টাকা বা তামার ডাবল পয়সা বাঁধা। এই পয়সায় থাকত সিঁদুর মাখানো। রুমাল খুলে রাখলে পাগড়ী বা কোমরবন্ধনীগোছের কিছু মনে হত সেটিকে অথচ এই রুমাল ই ছিল হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর নিরব সাক্ষী।
অনেকের মতে ইতিহাসের বিচক্ষণতম এই খুনির দল ভারতেরই নিজস্ব সৃষ্টি। হিন্দু পুরাণের নাগপাশ নামক হাতিয়ার এ ধারণার প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। হেরাডেটাস এদের পারসিক বলে মনে করেন। এদের ভাষা, পোশাক আশাক সব পারসিকদের মতো। তার মতে,ঠগীদের আদিপুরুষ সার্গাতি। ভারতের পশ্চিম অংশ যখন মুসলিমদের দখলে চলে যেতে শুরু করে তখন ঠগীরাও পা রেখেছিল ভারতে। দেশে না ফিরে তারা এখানেই অরণ্য প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হয়েছিল। স্বভাবতই তাই ঠগীদের প্রথম খুঁজে পাওয়া যায় দিল্লীর আশেপাশে। জিয়া–উদ–বারনি তাঁর তুঘলক কাহিনিতে ১২৯০ সনে জালালউদ্দীনের রাজত্ব কালে প্রায় ১০০০ঠগ ধরা পরার ঘটনা উল্লেখ করেছেন। ওরা সুলতানের এক প্রিয় দাসকে হত্যা করায় এই কোপদৃষ্টির স্বীকার হয়। পরবর্তীতে অবশ্য তাদের ক্ষমা করা হয় এবং নৌকায় বসিয়ে পূর্বভারতের লাখনায় রেখে আসা হয়। এছাড়াও সুলতান ওদের পিছনে তাঁর মুদ্রার ছাপ এঁকে দেন। ঠগীদের বেপারে ইতিহাসে দ্বিতীয়বার উল্লেখ আসে ১৩০৩ সালে সুলতান আলাউদ্দীনের কালে। এসময় রাজত্ব রক্ষা করতে বেপরোয়া সুলতান সাহায্য নেন নিজামউদ্দীনের। বলা হয় নিজামউদ্দীনের শিষ্যরা রুমালের ব্যবহারে এ দূর্যোগ থেকে রক্ষা করেন সুলতানকে। তবে ঠগীদের সাথে নিজামউদ্দীনকে অনেকেই এক সূত্রে গাঁথতে চান না। ঠগীদের সাথে বরং আরো সম্পর্কযুক্ত রূপে দেখা হয় ‘দাদাধীরা‘ এবং ‘ঝোরা নায়েক‘কে। দাদাধীরাকে তারা তাদের নায়ক মানত এবং বিশেষ অনুষ্ঠানে তার আত্মাকে নিজেদের মধ্যে ফিরিয়ে শক্তি ভিক্ষা করত।
মুলতানি ঠগদের নেতা ঝোরা নায়েক ও ছিল তাদের আদর্শ। বলা হয় একবার না কি ঝোরা একাই তার ভৃত্যকে নিয়ে পথে নেমেছিল সাথে সাথে এক সম্পন্ন পথিক (যাকে ঠগীদের ভাষায় বলে চিসা) ধরা পরেছিল। ঝোরা একাই তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং মাল লুঠ করে। এ লুঠের মাল তার দলের প্রত্যেকের মাঝে সমান ভাগে ভাগ করে দেয়। এমন ঠগী আদর্শ না হয়ে পারে?
এরপর ঠগীদের উল্লেখ আবারো পাওয়া যায় আকবরের আমলে;প্রায় ৫০০ ঠগী ধরা পরেছিল সেবার।
সবচেয়ে বিস্ময়কর বেপার হল সাড়া ভারতজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাজার হাজার ঠগীর আদি গোত্র ছিল মাত্র ৭টিঃ
১.বাহলিম
২.ভিন্
৩.ভুজসাত্
৪. কাচুনি
৫.হুত্তার
৬.গানু
৭.তুনদিল্
এদের মধ্যে ৫ টি গোত্রই থাকতে শুরু করে আগ্রায় তাই তাদের ডাকা হত আগুরিয়া বলে। তবে সবচেয়ে বনেদী ঘরানার ঠগীদের পাওয়া যায় দক্ষিণে, আর্কটে। এরা ডোরাকাটা লুঙ্গি পরত, কোম্পানির লোকদের মতো খাটো জ্যাকেট পরে হাতে একগাছা বেতের ছড়ি ঝুলিয়ে পথে বের হত। সাথে থাকত বাবুর্চি হুকোবরদার এবং অন্যান্য চাকর। অন্য অঞ্চলের ঠগীরা অবশ্য এদের নিচু জাত হিসেবেই বিশ্বাস করত।
সর্বশেষ গোষ্ঠী মুলতানিরা, এরা অনেকটা যাযাবর ধরণের জীবনযাপন করত। পথেই ছিল এদের সংসার।
এছাড়াও কিছু স্থানীয় ঘরানার ঠগীও দেখা যেত যাদের মধ্যে মালব, সুসিয়া,জুমালদেহী এবং চিঙ্গুরিয়া অন্যতম।
ঠগীরা হিন্দু বা মুসলিম যে ধর্মেরই হোক তারা নিজেদের মা ভবানী তথা কালীমায়ের সন্তান বলে ভাবত। তাই তাদের তীর্থ সেই কলকাতার কালীঘাট, দ্বিতীয় তীর্থস্থান বিন্ধ্যাচলের ভবানী মন্দির। তারা বিশ্বাস করত দেবী কালীর আশীর্বাদ এবং পৃষ্ঠপোষকতায়ই তারা ঠগী। এ সম্পর্কেও তাদের মধ্যে এক বিস্ময়কর গল্প চালু ছিল। গল্পটা অনেকটা এরকম–
পৃথিবী তখন দানব রক্তবীজের ত্রাসে তটস্থ,জীবকুলের জীবন হুমকির মুখে তখন রক্তবীজের জীবন ধ্বংসে আবির্ভূত হন জগদম্বা কালী। কিন্তু রক্তবীজের প্রতি বিন্দু রক্ত থেকে তৈরি হত নতুন আরেকটি দানব। লড়াইয়ে ক্লান্ত এবং বিরক্ত কালীর ঘাম থেকে সৃষ্টি হয় দুইটি অনুচর যাদের হাতে রুমাল দিয়ে দেবী শত্রু নিধনে পাঠান। এ দুজন সর্বশেষ শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করে দেবীকে রুমাল ফিরিয়ে দিতে চাইলে তিনি তাদের বলেন, “না বাছা আমি আর এ অস্ত্র ফেরত চাই না, এ রুমাল আমি তোমাদেরই দিলাম,যারা ধর্মে বিপরীত, মানবতার শত্রু এর সাহায্যে তোমরা তাদের বিনাশ করবে, ধরিত্রীকে পরিচ্ছন্ন রাখবে। ” ঠগীরা আরো বিশ্বাস করে প্রথমদিকের প্রতিটা খুনে মা কালী ঠগীদের সাথে থেকে তাদের সাহায্য করত,তখন কবর খোঁড়ার দরকার হত না। মা ভবানীই হত্যাকাণ্ডের পরের পর্বের সমাধান করতেন। কিন্তু এক বেকুব ঠগী পিছন ফিরে মা ভবানীর ভোগ গ্রহণ দেখে ফেলায় দেবী কূপিত হয়ে তাদের ত্যাগ করতে চান। কিন্তু সকল ঠগীর একত্রিত প্রার্থনায় দেবীর ক্রোধ শান্ত হয় এবং নিজের একটি দাঁত তুলে দিয়ে ওদের বলেন, “এই রইল তোমাদের কোদাল” আর বুকের পাঁজরের হাড় খুলে দিয়ে বললেন,”এই রইল তোমাদের ছুড়ি, কোদাল দিয়ে কবর খুঁড়বে,ছুড়ি দিয়ে মৃতদেহ কেটে কবরে রাখবে সব দূর্ভাবনা দূর হবে। “সেই থেকে রুমাল,ছুড়ি এবং কোদাল এই তিনই দেবীর আশীর্বাদপূত হাতিয়ার।
ঠগীরা দেখতে ছিল নীরিহ গোছের। চেহারায় যেন আর দশজন সাধারণ পথিক। তারা গল্প করত নানা বিষয় নিয়ে, গান গাইত, গাছের ছায়ায় বিশ্রাম করত, হাসত কাঁদত,সঙ্গী হিসেবে চমৎকার হওয়ায় কেউ তাদের এড়িয়ে যেত না। আর পথিকের এই সরলতার সুযোগ নিয়েই তারা খুন করত। তারা থাকত গ্রামের প্রান্তের ছোট ছোট কুটিরে। সারাবছর সংসার করত, মাঠে ঘাটে কাজ করত। কেউ কেউ তো ফৌজেও ছিল। তারা ছিল সাধারণ গৃহস্থের মতোই, জমিদারকে খাজনা, ভিক্ষুককে ভিক্ষা সবই তারা দিত। আনন্দ উৎসবেও অংশ নিত। দিনক্ষণ দেখে শরতের এক ভোরে তারা বেড়িয়ে পড়ত পথে। পথে নামলে তারা অন্য মানুষ। অন্যরকম তাদের আচার ব্যবহার। ওরা তখন ভিন্ন জগতের মানুষ; খুনি তারা। বাড়ির মেয়েরা সব খবরই জানত। প্রথম প্রথম ৬–৭ দিন তারা প্রতিবেশী এড়িয়ে চলত। অষ্টম দিনে কেউ জিজ্ঞেস বলত বিদেশে গেছে। আর ঠগী ঘরের বউরা স্বামীদের পেশা সম্পর্কে ভালই জানত,তারাও যে ঠগী ঘরের ই মেয়ে। কিন্তু সন্তানরা জানিত বাবা বিদেশে ফিরে আসবে নানা সামগ্রী নিয়ে। অনেক ঠগী বউ তো নরহত্যার সময় ও স্বামীর আশেপাশে থাকত। অবশ্য অনেক স্ত্রী ই স্বামীর এই দ্বৈত জীবন সম্পর্কে ধারণা রাখত না। তবে সেটা তাদের ব্যক্তিগত বেপার ছিল।
পরিবারের ছেলে সন্তানদের ও পথে নিয়ে বের হত। যদিও নিয়ম ছিল প্রাপ্তবয়স্ক সহযাত্রী নিতে হবে তবুও বারো তেরো বছর বয়স হলেই সাধারণত পথে নিয়ে আসা হত। অবশ্য এমন ও না যে প্রথম যাত্রায় ই তারা সব পদ্ধতি শিখে বাড়ি ফিরত। প্রথম যাত্রায় বরং তারা খুন সম্পর্কে কিছুই জানতে পারত না। তাদের শুধু বাইরে ঘোরার নেশা ধরাতেই আনা হত সাথে। প্রথম খুন সম্পর্কে জানতে জানতে তাদের লেগে যেত প্রায় তিনটি যাত্রা। শিখিতে শিখতে লেগে যেত আরো কয়েক যাত্রা। সে খুনের হাতেখড়ির ও ছিল নানা নিয়ম, আচার অনুষ্ঠান। প্রথমত দেবীর অনুমতি প্রার্থনা করা হত। শুভ লক্ষণ দেখা গেলে চলত শপথ পর্ব। এর পর প্রসাদ গ্রহণ। প্রথম শিকার হিসেবে সাধারণত ঠিক করা হত কোনো বৃদ্ধ নিঃসঙ্গ পথিক,যার শক্তি সামর্থ্য নাই বললেই চলে, এভাবেই বংশপরম্পরায় ঠগীদের বিদ্যা এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে হস্তান্তরিত হতে থাকে। দীর্ঘকাল ঠগীদের সম্পর্কে খুব বেশি কেউ জানত না। তবে এক ইংরেজ স্লীম্যান এর জেদের কারণেই দেশ থেকে ঠগী উৎখাত সম্ভব হয়েছে।
আমরা যে সময়ের কথা বলছি তখন বাংলার পথেঘাটে জলে জঙ্গলে ঘুরত নানা ধরণের খুনী। তাদের হত্যার পদ্ধতি ঠগীদের সাথে মিললেও তারা প্রকৃতপক্ষে ঠগী ছিল না। এমন কিছু খুনির দল ছিল ধুতুরিয়া,ভাগিনা,তুসমাবাজ ঠগ,মেকফাঁনসা।
ধুতুরিয়ারাও পথিকের সাথে বন্ধুত্ব পাতাত,তারপর সুযোগ বুঝে অসহায় পথিকের খাবারে অথবা হুঁকোর তামাকে মেশাত ধুতুরার বীজে তৈরি বিশেষ ধরণের বিষ। পথিকদল ছটফট করতে করতে প্রাণ হারাত আর তারা সব সম্পদ লুট করে পালাতো। যদিও ঠগীদের সাথে এদের অনেক মিল তবুও এরা ঠগী নয়। ঠগীরা আরো নিষ্ঠুর আরো নির্মম। ভাগিনারা নৌকায় মানুষ তুলত আর এক ফাঁকে মানুষ মেরে জলেই সলিল সমাধি করে দিত। এ দল মৃতদেহের শিরদাঁড়া ভেঙেই জলে ফেলে দিত। কোনো কোনো ভাগিনার সাথে ঠগীরা হয়তো টাকার জন্য যোগ দিত তবুও কেউ জলে স্থায়ী হত না। এ দল ও প্রকৃত ঠগী নয়। আবার তুসমাবাজরা মূলত বাজিকর। দিনে দুপুরে দল বেঁধে সদর রাস্তায় দড়ির খেলা দেখায় তারা। দড়ির ফাঁস তৈরি করে পথিককে দিয়ে লাঠি ধরায় সেখানে। লাঠি যদি ফাঁসে আটকায় তবে বাজিকরের হার আর যদি না আটকায় তবে বাজিকরের জিত। একে ইংরেজীতে বেশ গাল ভরা নামে ডাকা হয় প্রিকিং দ্যা গার্টার। তবে এ বাজিকররা কখনো ঠকে না। দর্শক বার বার হেরে তার সর্বস্ব বাজিতে হারাতে থাকে। তবে কচিৎ কেউ বাজি জিততে থাকলে তার ব্যবস্থা ও রয়েছে। বিষ দিয়ে হত্যা করা হত তাকে। এই অদ্ভুত দলটিতেও লোকসংখ্যা ছিল প্রচুর।
মেকফাঁনসারাও আরেকধরণের খুনি সম্প্রদায়। এরাও ফাঁস দিয়েই মানুষ হত্যা করে তবে তাদের আচার অনুষ্ঠানে রয়েছে বিস্তর তফাৎ। মেক শব্দের আভিধানিক অর্থ পেরেক বা এমন কিছু যা দিয়ে কাউকে ঝুলানো যায়, ফানসা শব্দের অর্থ ফাঁস। এরা হল ছেলেধরা ঠগ অর্থাৎ এরা নির্বিচারে মানুষ খুন করলেও শিশুদের বাঁচিয়ে রাখত যাযাবরদের কাছে বিক্রি করতে। এছাড়া এরা মৃতদেহ লুকানোর চেষ্টা তো দূরেই থাক মৃতদেহের গলা থেকে ফাঁস ও খুলত না।
আমরা বুঝতেই পারছি ঠগী আসলে সকলের চেয়ে সতন্ত্র একদল খুনি যাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি এবং আচার অনুষ্ঠান। ঠগীরা হুঠহাঠ পথে বেরিয়ে পরত না। বরং নানা আচার এবং নিয়ম পালন করে শুভ দিন দেখে পথে নামত।
প্রথমত তারা ঠগী পাঁজির শুভদিন অর্থাৎ মঙ্গল,বুধ,শুক্র এর মধ্যে একদিন কামারের বাড়ি যেতে হয় কোদাল তৈরি করতে। শুধু গেলেই হয় না কামার বাড়ির দরজা জানালা বন্ধ করে নিজের চোখের সামনে বানিয়ে নিতে হয় কোদাল। তবে কামার যদি কোদাল বানাতে বানাতে অন্য কাজে হাত দিত তবে কোদাল আবার বানাতে হত। কোদাল বানানো সম্পন্ন হলে শুরু হত আচারের দ্বিতীয়পর্ব যেখানে শুভ দিনক্ষণ দেখে কোদালকে মন্ত্রপুত করা হত। এজন্য প্রথমে সঙ্গোপনে একটি বদ্ধ ঘরের মেঝেতে গর্ত করে তার উপর কোদাল ধরত একজন আর অন্য জন ধীরে ধীরে যত্ন সহকারে পানি দিয়ে ধুয়ে দিত কোদালটি। জলের পর ধুতো যথাক্রমে চিনি জলে, ঘোলে এবং মদে। এরপর কোদালটিকে ৭বার আগুনে সেঁকে অগ্নিস্নান করানো হত। অনুষ্ঠানের পরের পর্বে ছোবড়া ছাড়ানো একটি নারকেলকে কোদালের গোঁড়ালির এক ঘাঁয়ে দুফাঁক করতে হত। এসময় পুরোহিত সবার অনুমতি নিত। এবং নারকেলের শাঁসটুকু সেখানে বসেই প্রসাদ হিসেবে গ্রহণ করা হত। লক্ষ্য রাখা হত বাকি সব টুকুই যেন সে গর্তেই ফেলা হয়, বাইরে কিছু পরে থাকলে পায়ে মাড়ানোর কারণে দেবীর অসম্মান হওয়ার ভয়ে। যদি নারকেলটি না ভাঙত তবে ত্রুটি আছে বলে ধরে নিয়ে আবারো অন্যদিন করা হত। তবে অনুষ্ঠান সম্পন্ন হলে কোদালটি কাপড়ে জড়িয়ে সবাইকে দেখানো হত এবং দলের বিশেষ একজনের হাতে কোদালটির দায়িত্ব তুলে দেওয়া হত। যার নাম মাহি বা কাসসি। এ কোদালগুলো সাধারণত ৬–৮ ইঞ্চি লম্বা এবং ওজনে ২–২.৫ সের হত। প্রতিবার দরকারে হাতল লাগানো হত এবং কাজ শেষ হলেই হাতল ফেলে দিয়ে আবার মাহির হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হত। যাত্রার আগপর্যন্ত এ কোদাল এমনভাবে লুকিয়ে রাখা হত যেন জন্তু জানোয়ারের ছায়াও না পড়ে। এ কোদাল যে সে কোদাল ছিল না,এ কোদালের ছিল অনেক গুণ। প্রথমত এ কোদাল দলের পথনির্দেশক রূপে ব্যবহৃত হত। রাতে যেদিকে পরদিনের যাত্রা নির্ধারিত হত সেদিক করে কোদালটি মাটির নিচে রাখা হত যদি কোদাল নিজে নিজে দিক পরিবর্তন করত তাহলে ঠগীরাও দিক পরিবর্তন করে ওইদিকেই যাত্রা শুরু করত। দ্বিতীয়ত দলের কেউ মিথ্যা বলছে কি না তা জানার শেষ উপায় হল এই কোদাল। যদি কেউ এই কোদাল ছুঁয়ে মিথ্যা বলে তাহলে পরের ৬ দিনের মধ্যে সে মারা পরবে বা অসুস্থ হবে। তৃতীয়ত এ কোদাল কখনো কাসসির হাত থেকে পরে গেলে বুঝতে হবে তারা সহযাত্রী বা অন্তরঙ্গ বন্ধু হারাতে চলেছে অথবা পুরোদল ই কোনো বিপদে পরতে চলেছে। চতুর্থত এ কোদালে মাটি কোপাতে কোনো শব্দ হত না। এছাড়াও এ কোদাল ছিল যাদুকরী একে যেখানেই রাখা হোক না কেন ডাক দিলেই ব্যবহারকারীর হাতে উঠে আসত।
এছাড়া যাত্রার আগে নিখুঁত সাদা বা কালো পাঁঠা বলি দেওয়া হত। এ পাঁঠাকে গোসল করিয়ে পশ্চিম দিকে মুখ করিয়ে দাঁড় করানো হত। যদি পাঁঠা শরীর কাঁপিয়ে পানি ঝাড়ত তাহলেই একমাত্র দেবী প্রসন্ন আছে মনে করে বলি দেওয়া হত এবং ঐ মাংসেই ভোজ করত। এ পাঁঠাবলির অনুষ্ঠান ও হত রুদ্ধদ্বার কক্ষে। এ অনুষ্ঠানে আবার বিশেষভাবে নির্বাচিত ঠগীরাই শুধু অংশ নিতে পারত। চুন আর হলুদ দিয়ে চৌকা ছক কেটে তাতে মাপে মাপে পরিষ্কার কাপড় বিছিয়ে রান্না করা ভাত স্তূপ করে সাজিয়ে রাখা হত যার পাশে থাকত মন্ত্রপূত কোদাল। এর শীর্ষে থাকত একটি চারশিখাযুক্ত ঘিয়ের প্রদীপ। এ প্রদীপের বিশেষত্ব এই যে দৈবাত যদি কেউ এই প্রদীপ দেখে ফেলত বা চাদরে আগুন লাগত তাহলে বুঝা যেত আগামী একবছরের মধ্যে দলপতির মৃত্যু অবধারিত। ভোজ শেষে সেই ছক বরাবর গর্ত খুঁড়ে তাতে পাঁঠার নাড়িভুড়ি হাড়গোড় চামড়া সব ফেলে গর্তটিকে বুজিয়ে লেপে দেওয়া হত যেন গর্তের কোনো চিহ্ন আর না থাকে। এরপর তারা যাত্রা শুরু করত। তবে এর আগে অবশ্যই পরিবারের কিছুদিনের খাবারের ব্যবস্থা করে রাখত তারা। অনেকসময় দলের দুএকজনকে রেখেও যেত গ্রামে পরবর্তীতে তাদের ভাগ দেওয়া হত।
ঠগীরা নিজেরা কিছু জিনিসকে শুভ বা অশুভ মানত। টিকটিকির টিক টিক, জ্যান্ত গাছের ডালে বসা কাকের ডাক, ডান দিকে ঘুঘু বা বাঘ দেখলে যাত্রা হত শুভ। সাপ কিংবা খরগোশের রাস্তা পার হওয়া,মরা ডালের কাক বা পেঁচার ডাক ছিল যাত্রার জন্য অশুভ।
ওরা কথা বলত সম্পূর্ণ আলাদা ভাষায়। এই ভাষা শুনেই কে সাচ্চা ঠগ না কি সাচ্চা ঠগ নয় অর্থাৎ কুজ বা বিট্টো। রুমালধারী খুনিদের তারা বলত ভুকোত বা ভুরতোত, খুন করার জায়গা বিয়াল বা বিল, যে খুনের জায়গার রেকি করতে যেত তাকে বলা হত বিলহো, কবরখোদক দের বলা হত লুগহা,লোক বেশি হলে তারা খুড়তো গব্বা বা গোলাকার কবর,আর না হলে চৌকো বা চারকোণা কবর। সোথারা শিকারের সাথে বন্ধুত্ব পাতাত, চান্দুরা এ ক্ষেত্রে সাহায্য করত। মূল্যহীন জিনিসকে বলা হত ফাঙ্ক, লুটকুনিয়া দিয়ে বোঝাত গরীব পথিক,পেছনে পুলিশ বা ডনকি লেগেছে কি না দেখত তিলহাই বা গুপ্তচর। যখন কাউকে ভুলিয়ে ভালিয়ে খুনের আগে বসানো হত তার আগে লোকদের বলা হত চুকা দেনা বা থিবাই দেনা, পানকা রুমাল লাও বললে বুঝতে হত রুমাল ঠিক করতে বলা হচ্ছে। আবার খুনের আদেশ দেওয়াকে বলা হত ঝিরনী দেওয়া, এসময় বলা হত তামাকু লাও। ঠগীদের আবার ঘুমন্ত মানুষকে হত্যা করা নিষেধ ছিল। কেউ ঘুমিয়ে থাকলে সাপ বা বিচ্ছু বলে চিৎকার করে তাকে জাগানো হত।
ভুকোত ফাঁস পরালে চুমিয়া পায়ে ধাক্কা দিয়ে ধরাশায়ী করত শিকারকে, চুমোসিয়া বা সামসিয়া শিকারের হাত চেপে ধরত এসময়। কাজ শেষে ভুকোত বলে ‘বাজিত খান‘। ভোজারা এর পর দেহগুলো কবরে নিয়ে যেত,কুথাওয়া নামের একদল লাশের হাঁটু ভেঙে থুতনির সাথে মিলিয়ে কবরে রাখত, পেটে বুকে ছুরি চালিয়ে পেট ফুলে কবর থেকে বের হয়ে আসা ঠেকানো হত। এরপর সব সাফসুতরো করে কবরের উপরেই চলত গুড়ের ভোজ সভা।
ঠগীদের এসব কাজের চিত্র ইলোরায় পাওয়া যায়। সাচ্চা ঠগী হলেই চিত্রে ঠগীদের জীবন কাহিনী,কর্মপদ্ধতি চোখে ধরা পরত। অন্য কেউ তা দেখলেও কিছু বুঝতে পারবে না বলে ঠগীরা বিশ্বাস করত।
ঠগী: ভারতের বিচক্ষণতম খুনি লুটেরার দল
Loading books...