বাবরি মসজিদ – ভারতীয় অসাম্প্রদায়িক চেতনার ভূলুন্ঠিত হওয়ার ইতিহাস

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বলতে আমরা কি বুঝি? সাধারণ ভাষায়, সাম্প্রদায়িক স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে দুপক্ষের মধ্যে যে যুদ্ধের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়, তাকেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বলে। এখানে এক বা একাধিক ধর্মীয় দল কাজ করতে পারে। ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কোনো নতুন বিষয় নয়। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার কারনে আমাদের উপমহাদেশে দেখতে হয়েছে রক্তের খেলা। শুধু তাই নয়, ধর্মীয় দাঙ্গার কারনেই আমাদের এক সময়ের অবিভক্ত বঙ্গ হয়েছে দ্বিখণ্ডিত। একখন্ড গিয়েছে পাকিস্তানে, আর আরেকখন্ড ভারতে। মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা চলে গেলেন পাকিস্তানে, আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা থেকে গেলেন ভারতে। আমাদের বহুল আলোচিত দ্বি-জাতি তত্ত্বটাও ছিলো একধরনের সাম্প্রদায়িক মতবাদ। শেষ পর্যন্ত ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে ছিন্ন করে আমরাও প্রতিষ্ঠা করলাম স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। কিন্তু তাতেও কি সাম্প্রদায়িকতার অবসান ঘটেছে? না ঘটেনি। হিন্দু-মুসলমান এই দুই জাতির মধ্যকার সংগঠিত শুধু সাম্প্রদায়িক চিন্তাভাবনাই বর্তমানে পরিলক্ষিত হচ্ছেনা, পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের ঘটনাও চোখে পড়ে আমাদের।
আর এই দুটি ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের দাঙ্গার ইতিহাসগুলো পর্যালোচনা করলে “বাবরি মসজিদ” এর নামটা অত্যন্ত স্বগৌরবে এসে হাজির হয় সবার সামনেই।
বাবরি মসজিদ ভারতের উত্তর প্রদেশের ফৈজাবাদ জেলার অন্তর্গত অযোধ্যা শহরের রামকোট হিলে অবস্থিত একটি প্রাচীন মসজিদ৷ অনেকেই ধারণা করেন, বাবরি মসজিদ যে স্থানটিতে অবস্থিত সেই স্থানটিই হিন্দু ধর্মের দেবতা রামের জন্মস্থান। বাবরি মসজিদ নিয়ে আঠারো শতক থেকেই হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে বিবাদ তৈরি হয়ে আসছে, যাকে “অযোধ্যা বিবাদ” নামেও জানা হয়। তবে ব্যাপারটি চরম মাত্রায় ধারণ করে ১৯৯২ সালে। সে বছরে ডিসেম্বরের ৬ তারিখে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি), ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এবং শিব সেনা পার্টির সমর্থকরা বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে। শুরু হয় ভারতীয় হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। যে দাঙ্গায় মারা যায় প্রায় ২ হাজারেরও বেশি মানুষ।
এবার আমরা জানবো বাবরি মসজিদের উৎপত্তি থেকে শুরু করে এর গুরত্বপূর্ণ ঘটনাপ্রবাহ।
১. বাবরি মসজিদের নির্মাণঃ
পানিপথের প্রথম যুদ্ধ জিতে নয়াদিল্লির মসনদে বসেন জহিরুদ্দিন মোহাম্মদ বাবর। তবে তখনো আর্যাবর্তের বিশাল একটা অংশ তার নিয়ন্ত্রণে আসেনি। বিস্তীর্ণ এই অংশের নিয়ন্ত্রণের কৌশল আঁকার সময় প্রথম মুঘল সম্রাট তার বিশ্বস্ত সেনাপতি মীর বাকিকে দায়িত্ব দিলেন অওধ আর রোহিলাখণ্ডে সেনা অভিযান পরিচালনা করার। ১৫২৭ সালে দক্ষ মীর বাকি দখল করলেন অওধ। তার পরের বছরেরই সরযূ নদীর পাড়ে তৈরি করলেন তিন গম্বুজ বিশিষ্ট একটি মসজিদ। নাম দিলেন তার মনিবের নামেই। ১৫২৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই মসজিদটিকে সকলে “বাবরি মসজিদ” নামেই চেনেন। অনেকে আবার মনে করেন, গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকের আগে এটি ‘মসজিদ-ই-জন্মস্থান’ নামেও পরিচিত ছিলো।

গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকের আগে এটি ‘মসজিদ-ই-জন্মস্থান’ নামেও পরিচিত ছিলো


২. সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি

বাবরি মসজিদ নিয়ে বারংবার ভারতের হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে সংঘাত তৈরি হলেও একটা সময় এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় ছিলো। ফৈজাবাদ জেলার ১৯০৫ সালে প্রকাশিত গ্যাজেটিয়ার বলছে, ১৮৫২ সাল পর্যন্ত বিতর্কিত এই ভবনটিতে হিন্দু মুসলমান, এই দুই সম্প্রদায়ের লোকজনই প্রার্থনা এবং পূজো করেছে। উনবিংশ শতাব্দীর ব্রিটিশ নথিতে অযোধ্যার এই স্থানটিতে দুই ধর্মাবলম্বীদের বিচরণ সম্পর্কে তথ্য উল্লেখ রয়েছে।

৩. সংঘাতের সূত্রপাতঃ
১৮৫৭ সালের শেষদিকে এসে সিপাহি বিদ্রোহ মেটানোর পর বাবরি মসজিদের এই বিতর্কিত জায়গাটিকে দুটি অংশে ভাগ করে তাতে লোহার বেড়া দিয়ে বেষ্টিত করে দেয় ব্রিটিশ সরকার। ভেতরের অংশ মুসলিমদের জন্যে এবং বাহিরের অংশ হিন্দুদের জন্যে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। বিভক্তিটা মূলত শুরু হয় সে সময়েই।

৪. হিন্দুদের দাবি
হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা অভিযোগ তোলেন, অওধ অঞ্চলের বাবর নিযুক্ত প্রশাসক সেখানকার প্রাচীন একটি মন্দির ভেঙ্গে সেখানে মসজিদ স্থাপন করেন। হনুমানগড়ির পাশের স্থানটি রামের জন্মস্থান বলে চিহ্নিত ছিলো। সেখানে থাকা রামলালার মন্দির ভেঙ্গেই মসজিদ তৈরি করেছিলেন বাবরের নিযুক্ত সেনাপতি। ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের রিপোর্টে মসজিদে দশম শতকে অ-ইসলামিক কিছু স্থাপত্যের কথা বলা হলেও সেখানে মন্দিরের অস্তিত্ব স্পষ্টভাবে বলা হয়নি। হিন্দুদের দাবি, মুঘল আমলে সেই জমি উদ্ধারের কয়েকবার চেষ্টা করা হলেও তা সফল হয়নি। তবে তার সুস্পষ্ট কোনো ঐতিহাসিক তথ্যপ্রমাণ মেলেনি।

৫. বিতর্কিত জমি নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ
১৮৮৫ সালে বাবরি মসজিদের এই বিতর্কিত জমিটি গড়ায় আদালতে। রামলালার প্রধান পূজারি মহন্ত রঘুবীর দাস সেই স্থানটিতে মন্দির স্থাপনের জন্যে আদালতে আবেদন জানালে সেটি খারিজ করে দেওয়া হয়। এরপর রঘুবীর দ্বারস্থ হন, জেলা আদালতে। ১৮৮৬ সালে সেটিতেও স্থিতাবস্থা বজায় রাখার নির্দেশ দেন আদালত।
ফৈজাবাদ জেলা আদালতের সেই রায়ে সন্তুষ্ট হতে না পেরে সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে রঘুবীর দ্বারস্থ হন অওধের বিচারবিভাগীয় কমিশনার ডব্লুই ইয়ংয়ের কাছে। কিন্তু সেটিও শেষমেশ খারিজ হয়ে যায়। তারপর ১৯৩৪ সালে গো-হত্যা অভিযোগকে কেন্দ্র করে হিন্দু মুসলিম সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাবরি মসজিদ। আর সেই ক্ষতির মেরামতের কারনে হিন্দুদের কাছ থেকে ব্রিটিশ প্রশাসন জরিমানা আদায় করে।
এর মাঝে আবার তৈরি হয় নতুন বিতর্ক। বাবরি মসজিদ এবং এর জমির মালিকানা নিয়ে শিয়া এবং সুন্নিদের মধ্যকার বিরোধ গড়ায় আদালত পর্যন্ত। ১৯৪৬ সালে ফৈজাবাদ আদালতে রায় আসে, যেহেতু সম্রাট বাবর সুন্নি ছিলেন, সেহেতু মসজিদটি সুন্নিদের দখলে থাকবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মসজিদ প্রতিষ্ঠাকারী মীর বাকি ছিলেন শিয়া।

৬. বেআইনিভাবে মূর্তি স্থাপন
ভারত বিভক্তির পর নতুন মাত্রা যোগ হয় বাবরি মসজিদ বিতর্কে। ১৯৪৯ সালের ২২ ডিসেম্বর গভীর রাতে বাবরি মসজিদের গম্বুজের নিচে বেআইনিভাবে রাম-সীতার মূর্তি স্থাপন করা হয়। মন্দিরপন্থীদের দাবী ছিলো, রামলালা দৈবিকভাবে প্রকট হয়েছেন। যদিও এটি একটি পরিকল্পিত ঘটনা ছিলো। এর পরেরদিনই অযোধ্যায় একটি মামলা দায়ের করেন সেখানকার অফিসার ইন চার্জ পণ্ডিত রামদেও দুবে। অভিরাম দাস, রামসকল দাস, সুদর্শন দাস-সহ প্রায় ৬০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় সেই মামলায়।

৭. নেহরুর ঐতিহাসিক পদক্ষেপ
ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদে মূর্তি স্থাপনের পর হিন্দু মুসলমান সমাজে একটা অরাজকতার পরিস্থিতি তৈরি হয়। আর তাই ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী গোবিন্দ বল্লভ পন্থকে বিতর্কিত এই জায়গাটিতে হিন্দুদের এই মূর্তিকে সরানোর নির্দেশ দেন এবং বলেন ওখানে ইচ্ছাকৃতভাবে একটি বিপদজনক পরিস্থিতির তৈরি করা হচ্ছে।

৮. মসজিদের তালা খোলার আন্দোলন
১৯৮৪ সালে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ব্যাপক আন্দোলন শুরু করে। তাদের দাবি ছিলো বাবরি মসজিদের তালা খুলে দেওয়া। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী সরকার নতুন করে আবারো সেই বিতর্কে অশান্তির সূচনা করেন। ১৯৮৬ সালের ২৫ জানুয়ারি আন্দোলনকারী ভক্তদের রামলালা দর্শনের অনুমতি দেওয়ার জন্যে ফৈজাবাদ আদালতে যান আইনজীবী উমেশচন্দ পাণ্ডে। পহেলা ফেব্রুয়ারী বাবরি মসজিদের ভেতরে অবস্থিত রামলালা দর্শনের অনুমতি দেন আদালত। হিন্দুদের জন্যে খোলা হয় নিষিদ্ধ এই বাবরি মসজিদের তালা।

৯. দুই সম্প্রদায় মুখোমুখি অবস্থানে
বাবরি মসজিদের জায়গায় মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্যে কমিটি গঠন করে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। ১৯৮৬ সালে বাবরি মসজিদের তালা খুলে সেখানে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পূজা করার অনুমতি চায় বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। এবং এর প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় মুসলিম সমাজেও। ১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে মুসলমানরা গঠন করে বাবরি মসজিদ একশন কমিটি। মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের বিতর্কিত এই জায়গাটিতে মসজিদ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের জন্যেও প্রস্তুতি নিতে থাকে এই কমিটি।

১০. ‘রাম রথযাত্রা’
১৯৮৯ সালের নভেম্বর মাসে বিতর্কিত যে স্থানটিতে মন্দির স্থাপিত ছিলো, সেখানে “শিলান্যাস” এর অনুমতি পায় ভিএইচপি। আর সেখান থেকেই রাম মন্দির আন্দোলনের প্রধান একটি চরিত্র হয়ে আবির্ভাব হয় ভারতীয় জনতা পার্টির প্রবীণ একজন নেতা লাল কৃষ্ণ আদভানি। তিনি ভারতের দক্ষিণতম প্রান্ত থেকে প্রায় দশ হাজার কিলোমিটার দুরত্ব থেকে একটি রথ যাত্রা শুরু করেন, যার নাম দেওয়া হয় “রাম রথযাত্রা”। ১৯৯০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর যাত্রা শুরু করে ৩০ অক্টোবর অযোধ্যা পৌঁছে করসেবার মাধ্যমে বাবরি মসজিদের বিতর্কিত জায়গাটিতে মন্দির নির্মানের কাজ শুরু করবেন বলে পরিকল্পনা নেন আদভানি। ২৩ অক্টোবর বিহারে তিনি গ্রেফতার হলে ৩০ অক্টোবর রামভক্তরা বিতর্কিত জমিটিতে করসেবার চেষ্টা করেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মুলায়ম সিংহ যাদবের নির্দেশে সেই চেষ্টা ব্যাহত হয়। সরকারী হিসেব মতে, সেদিন পুলিশের গুলিতে প্রায় ১৬ জন করসেবকের মৃত্যু হয়।
লখনউয়ে বিজেপি সরকার গঠন টা ছিলো করসেবকদের শক্তি তৈরির অন্যতম একটা উৎস। ১৯৯২ সালের ২৭ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টে করসেবার অনুমতি চেয়ে আবেদন করেন কল্যাণ সরকার। আশ্বাস দেওয়া হয়, বাবরি মসজিদের নিরাপত্তার। আদালত বাবরি মসজিদের বিতর্কিত এলাকাটির বাহিরে করসেবার অনুমতি দেন। আর ৬ ডিসেম্বর তাদের উপর নজরদারির জন্যে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয় সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু প্রশাসনের সেই আশ্বাস নিরাপত্তা দিতে পারেনা বাবরি মসজিদকে। সেদিনই আদভানি, বিনয় কাটিয়া, মুরলি মনোহর যোশিসহ অন্যান্য আরো অনেক হিন্দুত্ববাদীরা মসজিদ প্রাঙ্গণে পৌঁছান। শিবসেনা আর ভারতীয় জনতা পার্টি বিজেপির নেতাদের আহবানে প্রায় দেড় লাখ মানুষ বাবরি মসজিদের সেই জায়গাটিতে হামলা চালায়। আর তাতেই ছড়িয়ে পড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা।

১১. সমঝোতার উদ্যোগ
২০০২ সালে হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে সমঝোতার উদ্দেশ্যে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপায়ী একটি বিশেষ সেল গঠন করেন। হিন্দু মুসলমানদের সাথে আলোচনার দায়িত্ব দেওয়া হয় বলিউডের সাবেক অভিনেতা শত্রুঘ্ন সিনহাকে।

১২. বিজেপি দোষী
বিভিন্ন টালবাহানা আর জল্পনা কল্পনার পর বিশেষ কমিশনের দীর্ঘ ১৭ বছরের তদন্তের পর ২০০৯ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের বহুল প্রতীক্ষিত রিপোর্ট জমা দেওয়া হয়। প্রতিবেদনে বাবরি মসজিদ ধ্বংসে ভারতীয় জনতা পার্টি বিজেপিকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।

বাবরি মসজিদ ধ্বংসে ভারতীয় জনতা পার্টি বিজেপিকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়

১৩. এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়
বিতর্কিত জায়গাটি নিয়ে ২০১০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর এলাহাবাদ হাইকোর্ট তার রায়ে বলে, বাবরি মসজিদের এই বিতর্কিত জায়গাটিকে তিন ভাগে ভাগ করে দেওয়া উচিত। এই তিন ভাগের একভাগ মুসলিম, একভাগ হিন্দু এবং বাকি একভাগ নির্মোহী আখড়ায় দেওয়ার রায় ঘোষণা করা হয়। রায়ে আরো একটি উল্লেখযোগ্য কথা বলা হয়। সেটি হলো, বাবরি মসজিদের মূল যে অংশটি নিয়ে বিবাদ সেটি হিন্দুদের দেওয়া হোক।

১৪. হিন্দু ও মুসলমানদের আবেদন
বাবরি মসজিদের বিতর্কিত জায়গাটি তিন ভাগে ভাগ করার যে রায় হয়, তার বিপক্ষে হিন্দু এবং মুসলমান দুই পক্ষই আবেদন করে সুপ্রিম কোর্টে। ২০১১ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্টের সেই রায় বাতিল করে। সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতির বেঞ্চ সেই রায়ের প্রেক্ষিতে বলেন, বাদী বিবাদী কোনো পক্ষই চান না এই জমিটি ভাগ হোক।

১৫. বাবরি মসজিদ নিয়ে সর্বশেষ আদালতের রায়
২০১১ সালের স্থগিতাদেশের পরে ২০১২ সালের মার্চ মাসে বাবরি মসজিদ ধ্বংসযজ্ঞের সমস্ত মামলার রায় একসাথে হওয়ার জন্যে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করে সিবিআই। এর তিন বছর পর বাবরি মসজিদ ধ্বংসের কারন জানতে চেয়ে আদভানিদের নোটিশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট। এরপর ২০১৭ সালের ১৯ এপ্রিল আদভানিসহ বাদ বাকীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক মামলা করার নির্দেশ দেয় ভারতের সর্বোচ্চ আদালত। পাশাপাশি একথাও বলা হয় যে, সিবিআই আদালত যেনো আগামী দুই বছরের মধ্যে এই মামলার বিচার শেষ করে।
তারই প্রেক্ষীতে সে বছরের ৩০ মে লখনউয়ের বিশেষ সিবিআই আদালতে আদভানিসহ ৩২ জনের বিরুদ্ধে চার্জশীট তৈরি করা হয়। কারন মামলার মোট আসামী ৪৯ জনের মধ্যে ১৭ জনেরই ততদিনে মৃত্যু হয়ে গিয়েছে।
২০১৯ সালের ২০ জুলাই, আগামী ৯ মাসের মধ্যে বাবরি মসজিদ ধ্বংস সংক্রান্ত মামলায় রায় দেওয়ার জন্যে সিবিআই আদালতকে নির্দেশ দেন ভারতের সর্বোচ্চ আদালত। এবং ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর ফৈজাবাদ জেলার অযোধ্যায় অবস্থিত বাবরি মসজিদের এই বিতর্কিত জায়গাটিতে রাম মন্দির স্থাপনের অনুমতি দেন সুপ্রিম কোর্ট। এমনকি ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উপস্থিতিতেই এই করোনাকালীন সময়েই সেখানে ভূমিপূজন এবং শিলান্যাসও হয়ে যায়।
সর্বশেষ ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরে ১৯৯২ সাল থেকে দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে চলতে থাকা এই ঐতিহাসিক মামলার রায় দেন ভারতের বিশেষ আদালত। সেই রায়ে অভিযুক্ত সকলকেই বেকসুর খালাস দেওয়া হয় এবং বলা হয় ওই হামলা পূর্বপরিকল্পিত ছিলোনা। এমনকি সমস্ত তথ্য প্রমাণও পোক্ত ছিলোনা বলে জানায় আদালত।

বাবরি মসজিদের স্থানের রাম মন্দির

শেষকথাঃ
বাবরি মসজিদে হামলা ইতিহাসের কলঙ্কিত একটি অধ্যায়। ভারতের হিন্দু মুসলমানের সম্পর্কের ইতিহাসে এটি অত্যন্ত ঘৃণ্য একটি অধ্যায়। গুটি কয়েক হিন্দু গোষ্ঠী দিনটিকে “সূর্য দিবস” বলে উল্লেখ করলেও ভারতের বেশিরভাগ মানুষই মনে করেন, বাবরি মসজিদে হামলার দিনটি “কালো দিন”। বেশিরভাগ মানুষই মনে করেন, শত বছর ধরে ভারতের হিন্দু মুসলমানের মধ্যে যে সুসম্পর্ক বজায় আসছে, সেই সম্পর্ক এই দিনটির মাধ্যমে একেবারে ভূলুণ্ঠিত হয়েছিল। অসাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তিকে গলাটিপে হত্যা করা হয়েছিলো সেদিনটিতে।