কিউপিড ও সাইকির অমর প্রেম

গ্রিক মিথলজিতে মানব মনের সব অনুভূতি নিয়েই কিছু গল্প ও উপকথা প্রচলিত রয়েছে। মানব মনের সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতি; প্রেম নিয়েও তাই রয়েছে নানা উপকথা। এমনি এক উপকথা প্রচলিত আছে প্রেমের দেবতা কিউপিড ও সাইকিকে নিয়ে।
কিউপিড ছিলেন মানুষ ও দেবতার অদ্ভুত সংমিশ্রণ, দেখতেও ছিলেন অনেক সুদর্শন। তার পিঠে ছিল দুইটি পাখা,ঠিক যেন পরী। আর এ দুই পাখার কারণেই সে এখানে সেখানে উড়ে বেড়াত এবং নানা ধরণের দুষ্টামি করত। তার হাতে ছিল সোনালী তীর ও ধনুক। এ তীরের আঘাতে সকলের মনে জেগে উঠত প্রেমের ভাব। ঐশ্বরিক ক্ষমতা থাকায় যাকে তাকে তার তীরের আঘাতে প্রেমে ফেলত। এটা যেন এক মজার খেলা। কিউপিড এর গ্রীক নাম ছিল ইরোস। ইরোস শব্দের অর্থ প্রেম এবং সাইকি শব্দের অর্থ আত্মা। এরা দুজন একাধারে গ্রীক ও রোমান উপকথার চরিত্র। তাদের প্রেম,তাদের ভালবাসার জন্য লড়াই এক কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছে এখন।

সুদূর অতীতে এক রাজার ছিল তিনটি মেয়ে। সবচেয়ে ছোট মেয়েটি ছিল সবচেয়ে সুন্দর নাম ছিল তার সাইকি। সাইকির রূপে সকলে এতো মন্ত্রমুগ্ধ ছিল যে তাকে আফ্রোদিতির প্রতিদ্বন্দ্বী দেবী ভাবতে শুরু করে। আফ্রোদিতি কে বাদ দিয়ে ওই রাজ্যের লোকেরা সাইকির পূজা করতে শুরু করে। সাইকিই যেন সৌন্দর্যের দেবী। তার রূপ দেখতে দলে দলে লোক ছুটে আসতে লাগল। আর লোকেদের এই কর্মকাণ্ড ই কাল হয়ে দাঁড়াল সাইকির, পরল আফ্রোদিতির রোষে। সৌন্দর্যের দেবী তাই তার প্রতিশোধ নেওয়ার পরিকল্পনা করলেন। আফ্রোদিতির পুত্র কিউপিডকে বললেন সাইকির দিকে ভালবাসার তীর ছুঁড়তে। যেন নিষ্পাপ সাইকির সৌন্দর্যে কলঙ্কের দাগ লাগে। কিন্তু আফ্রোদিতির এ পরিকল্পনা সফল হয়নি। কিউপিড তীর ছুঁড়তে যখন সাইকির কাছে যায় তখন সাইকির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে যায়। একদম প্রথম দর্শনেই প্রেম।
অন্য সংস্করণে বলা হয়, আফ্রোদিতি তার পুত্রকে ঘুমন্ত সাইকির উপর এমন তীর ছুঁড়তে বলেন যেন সাইকি পৃথিবীর সবচেয়ে কুৎসিত প্রাণী শূকরের প্রেমে পরে। কিন্তু কিউপিড যখন তীর ছুঁড়তে যান তখন সাইকির বুকের বদল বাহুতে তীর লাগে। যার ফলে সাইকির ঘুম ভেঙে যায় আর চোখ খুলে কিউপিডকে দেখায় প্রেমে পরে যান। এদিকে কিউপিড ও সাইকির রূপের প্রেমে হাবুডুবু খেতে লাগে।

শিল্পির কল্পনায় কিউপিড ও সাইকি

অন্য আরেকটি সংস্করণে বলা হয়, সাইকিকে তীর মারতে গিয়ে সাইকির রূপে মুগ্ধ কিউপিড নিজের উপরেই তীর মারেন। এ ঘটনায় কিউপিড বেশ চিন্তিত হয়ে পরেন এবং আফ্রোদিতিকে সব খুলে বলেন। এতে আফ্রোদিতির ক্রোধ আরো বেড়ে গেল। সে অভিশাপ দিল- “সাইকির প্রেমে সবাই পাগল হবে কিন্তু কেউ তাকে স্ত্রী হিসেবে নিবে না। আর কিউপিড আর সাইকি একে অপরের সাথে দেখা করতে পারবে না। মেলামেশাও করতে পারবে না। ”
এ অভিশাপে কিউপিড বেশ কষ্ট পেলেন। তার চঞ্চলতা হারিয়ে গেল। মনের দুঃখে তিনি প্রেম তীর ছোঁড়াই বন্ধ করে দিলেন। এতে পৃথিবী হয়ে উঠল ভালবাসা শূন্য, বর্বর। মানুষে মানুষে প্রেম কমে গিয়ে হানাহানি কাটাকাটি বেড়ে গিয়েছিল। তাই সূর্যদেবতা এপোলো পৃথিবী ও মানুষ জাতিকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেন। কিউপিডকে তীর ছুঁড়তে বলেন। কিন্তু কিউপিড তার প্রিয়তমার বিচ্ছেদের শোকে কাতর। তাই এপোলো কে এ সমস্যার সমাধান দিতে বলেন। এ সময় অ্যাপোলো সাইকির পিতাকে সাইকিকে বধূবেশে অন্ধকারে নির্জন পাহাড়ের চূড়ায় রেখে আসতে বলেন। সাইকির পিতামাতা এ নির্দেশে খুব কষ্ট পেলেন। তারা ভাবলেন তাদের কন্যা না জানি কোন দৈত্য দানোর বধূ হতে চলেছে। কিন্তু দেবতার আদেশ তাই অমান্য করাও সম্ভব নয়। তাই তারা সাইকিকে পাহাড়ের পাদদেশে রেখে আসলেন।

বিদায়বেলায় পিতামাতাকে বার বার সাইকি এই বলে বোঝালেন যে, “প্রেমের দেবী আফ্রোদিতি সম্ভবত আমার উপর রেগে আছে,তাই আমার আজ এই অবস্থা। এভাবেই হয়তো দেবীর ক্রোধ কমবে। আমার নিয়তি ই এটা। তাই তোমরা চিন্তা না করে বাড়ি ফিরে যাও। ”

সকলে সাইকিকে একা ফেলে রাজ্যে ফিরে গেল, সাইকি একা একা পাহাড় চূড়ায় উঠতে লাগল,নির্জন পাহাড়, যেদিকে চোখ যায় শুধু গাছপালা আর পাথর ই দেখা যায়। সাইকির কষ্ট লাগলেও তিনি কাঁদলেন না। একসময় ক্লান্তিতে ঘুমের কোলে ঢলে পড়লেন তিনি। সাইকির কষ্টে আশপাশের প্রকৃতিও ব্যথিত হল,আর তাই পশ্চিমা বায়ু সাইকিকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে রাখল এক মনোরম উপত্যকায়,নরম ঘাসের সবুজ বিস্তারের উপর। সাইকি জেগে উঠে দেখলেন সবুজ বনে আছেন তিনি। আর আশেপাশে কোনো দৈত্য ও নেই। বনের আরো ভেতরে প্রবেশ করলে সাইকি দেখতে পেল একটি ঝর্ণার পেছনে মনোরম একটি প্রাসাদ। সাইকি আস্তে আস্তে সে প্রাসাদে প্রবেশ করলেন। দেখলেন খাবার টেবিলে নানারকম খাবার,খাবার দেখে এতক্ষণে পেটের ক্ষুধা অনুভব করলেন সাইকি। তাই গোগ্রাসে গিললেন সব কিছু। রাত হয়ে যাওয়ায় একটি কক্ষে ঘুমিয়ে পরলেন। রাতে কারো দৃঢ় আলিঙ্গনে ঘুম ভাঙল তার। ভাবলেন হয়তো এটায় তার দৈত্য স্বামী। কিন্তু আসলে তিনি ছিলেন কিউপিড। কিউপিড জানতেন সাইকি তার মুখ দেখলে তিনি আর কখনোই সাইকিকে দেখতে পারবেন না,সবই তার মায়ের অভিশাপের ফল। তাই এই অন্ধকারে তার প্রিয়তমার কাছে আগমন। কিউপিড দেখা না দিলেও সাইকির খুব যত্ন নিতে লাগল,তার সব চাহিদা পূরণ করতে লাগল আড়াল থেকে। এক রাতে সাইকি তার বোনদের নিজের কাছে আনার আবদার করলে তাতেও রাজি হয়ে গেল কিউপিড।
সাইকির বোনরা এসে প্রথমেই তাকে তার স্বামীর বেপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, “আমি আমার স্বামীকে কখনোই দেখিনি। সে রাতের অন্ধকারে আসে এবং আমার সাথে রাত কাটিয়ে সকাল হওয়ার আগেই চলে যায়। সে আমার খুব খেয়াল রাখে। রাক্ষস হলেও সে আসলে খারাপ না।”

সবশুনে সাইকির বোনরা বলে, “তোমার অবশ্যই তোমার স্বামীর মুখ দেখা উচিত। রাতে সে ঘুমালে তার উপর প্রদীপের আলো ফেলে তার মুখ দেখবে। না হলে পরে তাকে চিনবে কি করে?”

সাইকির ও অনেক দিন থেকেই স্বামীকে দেখার ইচ্ছা ছিল। তাই সে এতে রাজি হয়ে গেল এবং বোনদের কথা মতো কাজ করল। এবং সে যা দেখল তাতে যারপরনাই অবাক হল। কারণ সে যাকে রাক্ষস ভাবত সে আসলে তার প্রিয়তম কিউপিড ছাড়া আর কেউ নয়। এ সময় কিউপিডের ঘুম ভেঙে যায় এবং তিনি অদৃশ্য হয়ে যান। এছাড়া প্রাসাদ ও হয়ে যায় জনশূন্য।

সাইকি এ ঘটনায় পাগল প্রায় হয়ে যান। চারদিকে তার স্বামীকে খুঁজতে থাকেন। কিন্তু কোথাও খুঁজে পেলেন না। একসময় খুঁজতে খুঁজতে তিনি এক হলঘরে এসে উপস্থিত হলেন, এটি আসলে ছিল ফসলের দেবী ডিমিটারের মন্দির। এ হলঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে ছিল শস্যকণা, গম ও বার্লি, সাইকি এগুলোকে আলাদা আলাদা করে স্তূপে স্তূপে সাজিয়ে রাখল। ডিমিটার সাইকির কাজ দেখে অত্যন্ত খুশি হলেন আর সাইকিকে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নিলেন। দৈব ঘোষণায় বললেন, “সাইকি, তুমি শুধু দেখতেই নও মনের দিক থেকেও অনেক সুন্দর। সুখী তুমি হবেই। দেবী আফ্রোদিতির উপাসনালয়ে যাও, তার কাছে ক্ষমা চাও তিনি তোমাকে পুরস্কৃত করবেন। “এ দৈববাণী শুনে সাইকি যেন শক্তি ফিরে পেল। নতুন উদ্যমে আফ্রোদিতির উপাসনালয়ের দিকে যাত্রা করল। আফ্রোদিতির মন্দিরে পৌঁছালে সে আফ্রোদিতির কাছে ক্ষমা এবং কিউপিডের ভালবাসা ভিক্ষা চাইল।
কিন্তু ক্রোধান্বিত এবং ইর্ষাকাতর আফ্রোদিতি সাইকির দিকে না দেখেই বললেন, তুমি কি সত্যিই অনুতপ্ত?
সাইকি বলল, হ্যাঁ দেবী। আমি অনুতপ্ত। আপনার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।

আফ্রোদিতি: তাহলে আমার কাজ করে দিতে হবে।

সাইকি: যা বলবেন তা-ই করব।

আফ্রোদিতি: ওই যে মেঝেতে শস্যকণা,মসুরের ডাল, মটরশুঁটি এবং আরো কিছু ডাল ছড়িয়ে আছে, তুমি সেগুলোকে আলাদা করে আলাদা আলাদা স্তূপে রাখবে। আর কাজ যেন কাল সকালের আগেই শেষ হয়।

এগুলো ছিল প্রকৃতপক্ষে আফ্রোদিতির প্রতীক, তার প্রিয় ঘুঘুর খাদ্য। তিনি কাজে লেগে পরলে খেয়াল করল দেওয়ালের ফাটল থেকে অনেক পিঁপড়া বেরিয়ে এসে সাইকিকে কাজে সাহায্য করতে লাগল। সকালের আগেই কাজ শেষ হয়ে গেল। আফ্রোদিতি এ ঘটনায় খুশি হওয়ার বদল আরো ক্রোধান্বিত হলেন। তবে তিনি তা প্রকাশ করলেন না। সাইকিকে খাবার খেয়ে ঘুমাতে বললেন আর বললেন পরের দিন আরো অনেক কাজ করে দিতে হবে তার।

সকালে আফ্রোদিতি বললেন-“এখন দূরের কুঞ্জবনে যাও- যেখানে দেখবে সোনালি পশমের ভেড়ারা চড়ে বেড়াচ্ছে। ওদের প্রত্যেকের থেকে আমার জন্য স্বর্ণালী এক গুচ্ছ পশম এনে দাও,অথবা তোমার পথে চলে যাও। আর কখনও এখানে এসো না।”

কুঞ্জবনে যেতে একটি ছোট নদী পেরোতে হয়। নদীতে থাকে জলপরী বা নিয়াডস। সাইকি জলে নামতেই নিয়াডস রা বলে উঠল, সাইকি, সাবধান হয়ে যাও,ওই কুঞ্জবনের সোনালী ভেড়ারা দিনের বেলায় মোটেই শান্ত নয়। যতক্ষণ ওই সোনালী সূর্য আকাশে জ্বলজ্বল করে ততক্ষণ ওরাও হয়ে থাকে প্রজ্বলিত শিখার ন্যায় চঞ্চল আর প্রখর। ছায়ারা দীর্ঘ হয়ে উঠলে তখন তারা গাছের ছায়ায় বিশ্রাম করতে যায়, ঘুমায় ও। একমাত্র তখনি তুমি তাদের গা থেকে পশম তুলে নিতে পারবে।

জলপরী বা নিয়াডস

নিয়াডস দের ধন্যবাদ জানিয়ে অপেক্ষা করতে থাকল সাইকি। তারপর সূর্য ডুবলে চুপি চুপি গিয়ে ভেড়াদের পশম তুলে আনলেন এবং ভক্তিভরে দেবীর পায়ে তা নিবেদন করলেন। কিন্তু এতেও দেবীর ক্রোধ কমল না। তিনি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। সাইকিকে ফাঁসানোর জন্য তাকে একটি বাক্স দিয়ে তাতে করে পাতালের রাণী পার্সেফোনের থেকে কিছু রূপ(বিউটি) আনতে বললেন।
সাইকি যেন এবার একটু দমে গেল, কারণ পাতালে যে একবার যায় সে আর কখনো ফিরে আসে না। তার প্রিয় কিউপিডের সাথে দেখা না করেই কি তবে তাকে মরতে হবে?তবুও তিনি পাতালে যাবেন ই। যাত্রাপথে অদৃশ্য এক কণ্ঠস্বর তাকে সাবধানে যেতে বলল আর বলল, “পার্সেফোনের রূপ বাক্সে ভরা হলে কোনো অবস্থাতেই যেন তার মুখ খোলা না হয়।”

 

কিউপিডের সহযোগিতায় সাইকি নিরাপদেই পাতাল থেকে রূপ নিয়ে মর্ত্যে ফিরে এলো। কিন্তু তারপর কি মনে করে বাক্সের ঢাকনাটা খুলে ফেলল, সাথে সাথেই সাইকি তার চেতনা হারিয়ে ফেলল। কিউপিড তার সাথেই ছিল তাই সাইকির জ্ঞান ফিরিয়ে তাকে তার মা আফ্রোদিতির কাছে যেতে বলল। আর নিজে গেল অলিম্পাসে দেবতাদের তুষ্ট করতে। সেখানে দেবতাদের সাইকির গল্প শুনাল এবং সকলকে আফ্রোদিতিকে তুষ্ট করার উওয়ায় বলতে বলল। সকলে মিলে আফ্রোদিতির ষড়যন্ত্রের জন্য তার প্রতি রাগ দেখালেন এবং কিউপিড কে দিয়ে সাইকিকে স্বর্গে আনালেন। আর সাইকিকে অমৃত পান করতে দিলেন। এতে সাইকি আরো অনিন্দ্য সুন্দর হয়ে উঠল।
এরপর কিউপিড ও সাইকি সুখে শান্তিতে বসবাস করতে লাগল। তাদের এ গাঁথা আজও অমর হয়ে আছে।