Site icon খিচুড়ি

স্নোবল ইফেক্ট: বিন্দু থেকেই সিন্ধু

“ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণা ; বিন্দু বিন্দু জল
গড়ে তোলে মহাদেশ, সাগর অতল”

ওপরের লাইনগুলো কম-বেশি সবাই শুনেছেন। মূলভাব মূলত এরকম — ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণার সমন্বয়ে সৃষ্ট মহাদেশ বা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিন্দু জলের সমষ্টিতে গড়ে ওঠা মহাসাগরের মতোই, ক্ষুদ্র চেষ্টায় বৃহৎ পরিবর্তন আনা সম্ভব। ক্ষুদ্রের সমষ্টিতেই বৃহতের সৃষ্টি। স্নোবল ইফেক্ট তত্ত্ব কিছুটা এমন ই। মূলত এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক শব্দ যা ব্যাখ্যা করে যে কীভাবে শুরুতে ছোট কাজগুলি বড় এবং বড় কাজগুলি শেষ পর্যন্ত একটি বিশাল পরিবর্তনের কারণ হতে পারে। এটি অনেকটা এই ধারণার মতো যে একটি ছোট তুষার বল বা নুড়ি পাহাড়ের চূড়া থেকে গড়িয়ে পড়লে তুষারপাত হতে পারে।

“স্নোবল ইফেক্ট” নামকরণের কারণঃ
যে কোন তত্ত্ব বা বিষয় কে বুঝতে গেলে সবার আগে চোখ রাখতে হয় তার নাম বা টাইটেল এ। নাম বা শিরোনাম ধরতে পারলে, পুরো বিষয়টি জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যায়। “স্নোবল” শব্দের অর্থ তুষারগোলক, আর তাই “স্নোবল ইফেক্ট” এর মানে তুষারগোলকের প্রভাব। ধরা যাক, কেউ যদি তুষার পাহাড়ের উপর থেকে ছোট একটি তুষার বল বানিয়ে ছেড়ে দেয়, তাহলে তা পাহাড়ের নিচ অবধি পৌঁছাতে পৌঁছাতে, গায়ে আরো তুষার জড়িয়ে, একটা বিশাল আকৃতির তুষার বল তৈরি করবে এবং এটি তুষার ঝড়ের সৃষ্টি করতে পারে। একটি ছোট্ট তুষার বলের, সময়ের ব্যবধানে, একটি বিরাট পরিবর্তন ঘটানোর এই ঘটনাই হলো স্নোফল ইফেক্ট।

স্নোবল ইফেক্ট ও মনোবিজ্ঞানঃ
“স্নোবল ইফেক্ট” শব্দটি প্রায়শই মনোবিজ্ঞানে ব্যবহৃত হয়। এটি মানুষকে প্রভাবিত করা এবং জনমত তৈরির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়।
ধরা যাক, কোন বিশাল জনগোষ্ঠীর প্রতি নির্দিষ্ট কোন মতামত ছুঁড়ে দেওয়া হলো, সেই বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে একদল হয়তো সেই মতামত পছন্দ করছে, কিন্তু অন্য একদল তার সাথে একমত না। কিংবা কেউ ই সেই আইডিয়া বা মতামত পছন্দ করে নি। তো সেক্ষেত্রে দেখা যায় প্রথমে অল্প কিছু সংখ্যক মানুষকে প্রভাবিত করার মাধ্যমেই একসময় অন্যরাও এক জন আরেকজনের দেখাদেখি প্রভাবিত হয়; এ থেকে বড় কোন আন্দোলন বা সংস্কার আনা সম্ভব হয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের প্রসঙ্গ টানা যাক। রাজধানী ঢাকায় দুইজন শিক্ষার্থীর বাসের চাপায় প্রাণ হারানোর খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়া মাত্রই ঢাকাসহ সারাদেশে নিরাপদ সড়ক পরিবহন আইনের দাবিতে নজিরবিহীন আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। শুরুতে আন্দোলনটি শুধু রাজধানী ঢাকায় সীমাবদ্ধ থাকলেও এটি পরে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। শুধু শিক্ষার্থীরা নয়, আস্তে আস্তে সব স্তরের মানুষ এতে সমর্থন জানায়। এই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে একই বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর তড়িঘড়ি করে জাতীয় সংসদে পাস হয় সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮। এভাবে একটি আন্দোলন সংস্কারের পথ খুলে দেয়।

বিনিয়োগ ও অর্থনীতিতেঃ
আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন, “ কম্পাউন্ড ইন্টারেস্ট হলো এই পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য”। একদিনে কেউ রাতারাতি ধনী হয়ে ওঠেনি। জগতের সফল সব মানুষের দিকে তাকালে দেখতে পাবো তারা সবাই শূন্য থেকে শুরু করেছেন। বিল গেটস থেকে শুরু করে আজকের মুকেশ আম্বানী – সবাই ই আস্তে আস্তে এই বিশাল সম্পদের মালিক হয়েছেন। ওয়ারেন বাফেট, যার সম্পদের পরিমাণ ৬০ মিলিয়ন ডলার, তিনিও তাঁর এই বিশাল সম্পদ গড়েছেন বিভিন্ন জায়গায় বিনিয়োগের মাধ্যমে। এই কম্পাউন্ড ইন্টারেস্ট এর দেখা মেলে স্টক মার্কেটে যেখানে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে বার্ষিক বিভিন্ন হারে কম্পাউন্ড মুনাফা পাওয়া যায়।

সাফল্য ও ব্যর্থতাঃ
চ্যানেল আই এ সম্প্রচারিত কোন এক বিউটি প্যাজেন্টে বিচারক এক প্রতিযোগিকে প্রশ্ন করে, “আচ্ছা, ধরো তোমাকে একটা মেশিন দেয়া হলো যা কিনা যতবার ঘোরানো হবে ততবার ই একহাজার টাকা করে বের হবে এবং মেশিনটি সারাজীবন ই ব্যবহার করা যাবে–তাহলে এই মেশিনের দাম কত বা কত টাকা দিয়ে তুমি কিনবে?” উত্তরে প্রতিযোগী কিছু বলতে না পারলে বিচারক নিজেই বলে দেন যে “উত্তর টা এমন হওয়া উচিত যে যে আমি এমন মেশিন কিনতে চাইবো না যা দিয়ে এত সহজে টাকা উপার্জন করা যায়”। জানিনা আজকাল কেউ এমন করে ভাববে কিনা কিন্তু সফল কোন ব্যক্তির জীবন ঘাঁটলে আমরা দেখতে পাবো যে তারা কষ্ট করে আস্তে আস্তে ই সফলতা পেয়েছেন জেফ বেজোস, আলবার্ট আইনস্টাইন, আব্রাহাম লিংকন, বিল গেটস ,ইলন মাস্ক – এঁদের সবাই ই সীমাহীন ব্যর্থতার পরেও নিজ চেষ্টায় নিজেদের সাফল্যের অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন, “সাফল্য মানে উৎসাহ না হারিয়ে এক ব্যর্থতা থেকে আরেক ব্যর্থতায় যাওয়ার যাত্রা”। ইলন মাস্ক টেসলা মটরস ও স্পেস এক্সের প্রতিষ্ঠাতা। এই দুটি প্রতিষ্ঠানের সাফল্য তাকে বিশ্বের ১২ তম ধনী ব্যক্তিতে পরিণত করেছেন। এই সাফল্য তাঁর কাছে রাতারাতি ধরা দেয় নি। পেপাল, SpaceX, টেসলা – এগুলো প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে খুব ধীরে ধীরে আজ তিনি বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী একজন। প্রথম এভারেস্ট বিজয়ী তেনজিং নোরগের কথা সবাই শুনেছেন। আপাত-অসম্ভব পাথুরে রাস্তা, পদে পদে যার মৃত্যু ফাঁদ, সেই সংকটময় পথ পাড়ি দিয়ে তিনি ছুঁয়েছিলেন হিমালয়ের শিখর। আর্থিক অক্ষমতা , সামাজিক বাধা সব পেরিয়ে নেমে পড়েন দুঃসাহসিক সেই অভিযানে নেমে পড়েন। শুরুতে পাহাড়ি অভিযাত্রীদের কুলি হিসেবে পাহাড় চড়তেন। তখন থেকেই আস্তে আস্তে পর্বত জয়ের স্বপ্ন বুনতে থাকেন। ১৯৫২ সালে প্রথমবারের মতো এভারেস্ট বিজয়ের চেষ্টা করেন শেরপা হিসেবে কিন্তু ব্যর্থ হন। অবশেষে ১৯৫৪ সালে এডমন্ড হিলারির সাথে অনেক বাঁধা, ঝড় মোকাবেলা করে পৌঁছেছিলেন পর্বতের শিখরে।
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পদক্ষেপ থেকে যেমন পাহাড় জয় করা যায়, ঠিক তেমনি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভুল থেকে বড় ধরনের বিপর্যয় ও নেমে আসতে পারে। ধরুন, আজ আপনি ভাবলেন কাল থেকে কাজ শুরু করবেন, কাল ভাবলেন পরশু; এভাবে জমতে জমতে কাজের যে পাহাড় জমে যাবে তা আপনাকে বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন করতে পারে। শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে দেখা যায় ছোট খাটো অবহেলার কারনে পরীক্ষার সময়ে বিশাল সিলেবাস শেষ করতে পারে না; আর তার ফলাফল খুবই ভয়াবহ। তাই ক্ষুদ্র ভুল বা অবহেলাকে হালকা করে নেবার কোন সু্যোগ কিন্তু নেই।

চলচ্চিত্রে স্নোবল ইফেক্টঃ
চলচ্চিত্রের দু থেকে আড়াই ঘন্টার রানটাইমে ও স্নোবল ইফেক্টের প্রয়োগ দেখা যায়। ৯০ এর দশকের বহু সিনেমায় দেখা যেত কিভাবে নায়ক বা নায়িকা দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেয়া সত্ত্বেও একদিন বিত্তশালী হয়ে ওঠে। সে যাই হোক, আমার মাথায় এ মুহূর্তে খুব পছন্দের একটি সিনেমার নাম মনে পড়ছে, যার নাম ‘মাঝি-দ্য মাউন্টেন ম্যান’। বলিউডের প্রখ্যাত বায়োপিক নির্মাতা দশরথ মাঝিকে নিয়ে তৈরি করেন ‘মাঝি দ্য মাউন্টেন ম্যান’ সিনেমাটি। রুপকথার গল্পে সাত-সমুদ্র-তেরো-নদী পার হওয়ার গল্প বা বিশালাকার দৈত্যকে হারিয়ে আসা রাজপুত্রের বীরত্বের গল্প শুনে ছোটবেলায় হয়তো অনেকেরইচোখ ছানাবড়া হয়ে যেত। দশরথ মাঝি রুপকথা নয়, বাস্তবের বীরপুরুষ ; নিজের ভালোবাসার মানুষটির জন্য লড়েছেন দৈত্যরুপী বিশালাকার পাহাড়ের সাথে। প্রেমিকা ফাগুনিয়ার জন্য টানা ২২ বছর শুধু একটি শাবল আর হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে ফেলে ৩০০ফুট উঁচু পাহাড়! ৩০০ ফুট উঁচু পাহাড় ভেঙে একাই বানিয়ে ফেলেন ৩৬০ ফুট লম্বা এক পথ। এ যেন সেই রুপকথার বীরপুরুষকেও হারিয়ে দেয়। দশরথ মাঝির এ মহৎ কাজের জন্য ৮০ কিলোমিটারের দীর্ঘ পথ কমে দাঁড়ায় ১০ কিলোমিটারের পথ। এমন “Larger than life” গল্প সবাইকে এতই চমকে দেয় যে তাকে নিয়ে পুরো একটা সিনেমাই বানিয়ে ফেলা হয়েছে। দশরথ মাঝি শীর্ণ হাত দিয়ে একটু একটু করে আস্ত একটা পাহাড় কাটার গল্পই বলে দেয় যে জগতে কোন কিছুই অসম্ভব নয়।
সবশেষে, এটুকু বলা যায়, স্নোবল ইফেক্ট এর প্রভাব সর্বত্র দেখতে পাওয়া যায়। এটি আমাদের এটুকু শেখায় যে ক্ষুদ্র একটি পদক্ষেপ বা চেষ্টা থেকে খুব বড় পরিবর্তন আনা সম্ভব। তাই প্রথম পদক্ষেপ, সেটি যতই ছোট হোক না কেন, একসময় গন্তব্যে পৌঁছুতে সাহায্য করে। সেই পাহাড় কেটে ফেলা দশরথ মাঝির একটি উক্তি দিয়ে শেষ করবো, “স্রষ্টার আশায় বসে থেকো না, কে জানে হয়তো স্রষ্টাই আমাদের আশায় বসে আছেন!”

Exit mobile version