রাইটার্স ব্লক (লেখকের বন্ধ্যাত্ব): মিথ নাকি বাস্তবতা?

আপনি একজন শব্দ জাদুকর – কলমের খোঁচায় জীবন্ত হয়ে ওঠে মৃত নদী, ছলাৎ ছলাৎ নৌকো বয়, সাদা মেঘেরা দৌড়োয়, হাওয়া বয়। বইয়ের পাতায় জীবনকে মূর্ত করে তুলবার এক আশ্চর্য ক্ষমতা আপনার। কিন্তু, হঠাৎ ই একদিন দেখলেন আপনার জাদু আর কাজ করছে না; কলম-কাগজ যেন বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে আপনার বিরুদ্ধে। ঘন্টার পর ঘন্টা চলে যাচ্ছে কিন্তু আপনি লিখতে পারছেন না। নাহ্, কোনভাবে ই মাথায় কিছু আসছে না। এ সমস্যার নাম– রাইটার্স ব্লক(Writer’s Block) বা লেখকের বন্ধ্যাত্ব। জেনে রাখুন, আপনি একা নন; বিশ্বখ্যাত লেখক, স্ক্রিনপ্লে রাইটার, সাংবাদিক, গীতিকার, কবি– সকলেই এই অদ্ভুত অসুখে ভুগেছেন। এ থেকে আরোগ্য লাভ করবার টোটকা ও কেউ কেউ আবিষ্কার করেছেন।

‘রাইটার্স ব্লক’– লেখকের অসুখঃ
এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে ফেলেছেন ‘রাইটার্স ব্লক’ আসলে কি। মূলত, আপনার মাথায় নতুন আইডিয়া না আসা কিংবা লিখতে ও ভাবতে না পারার আকস্মিক অক্ষমতাই রাইটার্স ব্লক। এই ব্লক কয়েক মিনিট থেকে শুরু করে কয়েক মাস কিংবা বছর ও স্থায়ী হতে পারে!

রাইটার্স ব্লক ও সৃষ্টিশীল মানুষেরাঃ

এমন কি হয়েছে আপনার সাথে- একটা অদ্ভুত সুন্দর স্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙ্গলো; কিন্তু ঘুম ভেংগে সে স্বপ্ন আর মনেই করতে পারছেন না। নাহ, এমনটা ঘটবার সাথে রাইটার্স ব্লকের কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু , এমন স্বপ্নস্মৃতি থেকেই লেখা হয় কোলরিজের অনবদ্য সৃষ্টি- ‘কুবলা খান” কবিতাটি। অসুস্থ অবস্থায় ডাক্তারের পরামর্শে একদিন আফিম সেবন করে ইজি চেয়ারে বসে বই পড়ছিলেন। বই পড়তে পড়তেই তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে যান; ঘুমের মাঝেই স্বপ্নে বিনির্মাণ করে চলেন আস্ত একটা কবিতা। ঘুম ভাঙতেই স্বপ্নস্মৃতি থেকে লিখতে শুরু করেন কবিতা “কুবলা খান”। অকস্মাৎ বাড়িতে আগমন ঘটে এক অতিথির। আর তাতেই বাধ সাধে নিয়তি; স্বপ্নে দেখা কবিতা ভুলে বসেন। স্মৃতি থেকে ঝরতি পাতাগুলো আর তুলে আনার চেষ্টা না করে ওই অসমাপ্ত কবিতাই প্রকাশ করেন কোলরিজ। সে যাই হোক, পোরলোক এর সেই অতিথির থেকে “ম্যান ফ্রম পোরলক” শব্দবন্ধটির উদ্ভব হয়; যার অর্থ এমন কোন অযাচিত বাধার অনুপ্রবেশ যা কোন সৃষ্টিশীল কাজ ব্যাহত করে।

তবে, আদতে এই “ম্যান ফ্রম পোরলক” আসলে কোন বাস্তবিক অতিথি নাকি লেখকের কল্পনা- তা নিয়ে কিঞ্চিত সন্দেহ করা যায়। বরং, বলা যায়, “ম্যান ফ্রম পোরলক” আদতে কোলরিজের “রাইটার্স ব্লক” ই ! লিখতে গিয়ে হয়তো খেই হারিয়ে আর শেষ করা হয়ে ওঠে নি পুরো কবিতাটি। জানা যায় লেখক তার শেষ জীবন আফিম খেয়েই কাটান; লেখার ধার ও কমে যায়। তাঁর ৩২তম জন্মদিনে লেখেন, “So completely has a whole year passed, with scarcely the fruits of a month.—O Sorrow and Shame. . . . I have done nothing!” লেখকের কাছে তার সবচেয়ে বড় জীবনীশক্তি হলো লিখতে পারা। সেটি শেষ হয়ে গেলে আদতে তাঁর আর কিচ্ছুই থাকে না। ইসরাইলী লেখক ইবাদি খোরাসানের কথাই ধরা যাক না, ‘ট্রাভেলার’ বই এর জন্য বিপুল সাড়া পান এক সময়ে৷ আবার সেই বই ই কাল হলো, এক পাঠক তার বিরুদ্ধে মামলা করলেন এই বলে যে তাঁর বই টির ভাব আলবায়ার কামুর ‘আউটসাইডার’ ও খলিল জিবরানের ‘দ্য প্রফেট’ এর থেকে নকল করা। অভিযোগ গড়ালো আদালত পর্যন্ত ; ইবাদি খোরসান সেটা স্বীকার ও করলেন। সেই থেকে তিনি আর লিখতে পারলেন না। ২০১৫ সালে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন। লেখকের প্রান শক্তি তো তার লেখনীতে; সেটি চলে গেলে বেঁচে থাকা অর্থহীন হয়ে পড়ে।

রাইটার্স ব্লক থেকে মুক্তি পান নি বহু বিখ্যাত লেখক। সিলভিয়া প্লাথ একসময় তাঁর “The Unabridged Journal of Sylvia Plath” এ দুঃখ করে বলেন, “গদ্য লেখা আমার জন্য আতঙ্কে পরিণত হয়েছে”।গাব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেজ ছোট্ট একটা চিঠি (‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লিখে না’) লিখতেই চার বছর লাগিয়েছেন। লিও তলস্তয়ের পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবনের নানা টানাপোড়েন ও সংঘাত তার পেশাগত জীবনে বাধার সৃষ্টি করে। ‘আন্না কারেনিনা’ লিখতে গিয়ে তিনি যে রাইটার্স ব্লকে ভুগেছিলেন তা কারো অজানা নয়। মার্শেল প্রুস্ত টানা ৯ দিন বহুৎ কসরত করেও এক অক্ষরও লিখতে পারেননি। এমনটি ঘটে উনি যখন ‘ইন সার্চ অব লস্ট টাইম’ এর তৃতীয় খন্ড লিখছিলেন। মাত্র ১৭ পৃষ্ঠা লিখে আটকে গেলেন। তখন কনকনে শীত, টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে, একটার পর একটা চুরুট শেষ করেন রিভলভিং চেয়ারে বসে; কিন্তু একটা অক্ষর ও লিখতে পারলেন না। চেয়ার সরিয়ে উঠিয়ে ব্যালকনিতে চলে গেলেন, পাহাড়ের বিশালতার কাছে ভাবানুভূতি ধার করতে চেষ্টা করলেন। এসে মদিরা পান করলেন, একটু শ্বাসকষ্ট বাড়ছে খেয়াল করলেন— একসময় ঘুমিয়ে পড়লেন। সকালে উঠেও আর লিখতে পারলেন না। এভাবে টানা নয়দিন কেটে গেল। জানা যায় দশমদিনে সারা শহর ঘুরে বেড়ান আর এসে সে রাতে আবার লিখতে শুরু করেন।

রাইটার্স ব্লকঃ মিথ নাকি বাস্তবতাঃ
ইঞ্জিনিয়ারের ব্লক বলতে কিচ্ছু নেই, মিস্ত্রির ব্লক নেই, ডাক্তারও দিব্যি রোজ ডাক্তারি করে যাচ্ছে, তবে লেখক ই কেন শুধু লিখতে না পারার বিলাসিতায় ভুগবে?— টেড টক এ “Writer’s Block: A Myth or not?” নামক শো তে প্রশ্নগুলো ছুড়ে দিয়েছিলেন ইন্ডিয়ান পোয়েট Dr. Santosh Bakaya। সান্তোষ বলেন, ব্লক টা আসলে লেখকের মনে, এই ব্লক পুরোটাই একটা মিথ। ক্রিয়েটিভিটি মিরাকেল না; বরং রোজ চর্চা ও অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান।
তবে রোজকার জীবনের এই ঝুট ঝামেলা লেখকের কাজে বাগড়া দিয়েছে এমন ঘটনা প্রচুর। বিখ্যাত কবি মায়া মায়া এঞ্জেলো বলতে চাইলেন, রাইটার্স ব্লক আদতে রোজকার এই ঝক্কিঝামেলা যেটা মাঝে মাঝে লেখকের মনকে নেতিবাচকতায় বিষিয়ে তোলে এই যা! এই সময় নাকি তিনি লেখা একেবারে বন্ধ না করে যা মনে আসতো তাই লিখতেন। কখনো ছড়া কখনো বা লিমেরিক লিখতেন; যার বেশিরভাগের ই অর্থ থাকতো না। তিনি বলতেন, আমি লিখতাম, “The cat sat on a mat”
কাব্যদেবী আমার লেখার এমন করুণ অবস্থা দেখে লজ্জায় হয়তো আমার কাছে ধরা দিতে বাধ্য হতো। মারিও ভার্গাস বলেছেন, “লিখতে পারছি না, তার জন্য টেবিল ছেড়ে উঠে পড়ব, কখনো না।“ যেমনটি জেমস থানবার বলেছিলেন, “Don’t be obsessed with being right, just write.” কেউ কেউ আবার সমাধান খুঁজতেন ভিন্ন কিছু করে। রবীন্দ্রনাথ যেমন গদ্য বা পদ্য লিখতে সমস্যায় ভুগলেই গান লিখতেন। হুমায়ুন আহমেদ ও তাই করতেন। লেখালেখির একঘেয়েমি কাটাতেন নাটক, বা মুভি বানিয়ে। Marriage Story সিনেমার স্ক্রিনপ্লে রাইটার Noah Baumbach বলেছিলেন, লেখার কাজ তার মতে ১% অনুপ্রেরণা আর ৯৯% শ্রম। রাইটার্স ব্লক কাটিয়ে ওঠাদের পক্ষ নিয়েই হয়তো উইলিয়াম স্ট্যাফোর্ড জোর গলায় বলেছিলেন, “ যাদের কল্পনাশক্তি দুর্বল, মেধা অল্প, যাঁদের লেখার মান যথেষ্ট নিচু তাদের জন্য এ সমস্যা”। তাঁর এই বক্তব্য যেন বিতর্ককে উস্কে দেয়; তবে কি মার্কেজ, লিও তলস্তয়, রবীন্দ্রনাথ উনারা সবাই কম কল্পনাশক্তির লেখক? এই বিতর্ক আপাতত তোলাই থাক।

রাইটার্স ব্লক কাটানোর উপায় কি?
কণদর্প মেহতা “How to Overcome Blocks to Creativity” শিরোনামে TEDx এর শো তে ৩ টি স্ট্র্যাটিজির কথা বলেছেন যেগুলো এই ব্লক কাটাতে কাজে দেবে।
তাঁর ১ম স্ট্র্যাটিজি হলোঃ Show up strategy,যার প্রধান বৈশিষ্ট্য perseverence বা অধ্যবসায়। তিনি Mr. Roald Dahl এর প্রসঙ্গ তুলে বলেন, Dahl ছিলেন রুটিন মেনে চলা মানুষ, প্রত্যুষে নিয়ম করে ঘুম থেকে উঠে লেখা শুরু করতেন আর লিখতেন একেবারে ভোর অবধি ; এ রুটিন ভাঙতেন না কখনো। আর তাই কখনো লিখতে না পারার অসুখে ভুগেন নি। লেখা হচ্ছে না বলে একদম লেখা বন্ধ না করে দিয়ে লিখে যাওয়া উচিত। লেখকের কাজ ই আপনমনে খেলে যাওয়া।

তাঁর ২য় স্ট্র‍্যাটিজি টি Shoo off Yourself, অর্থাৎ নিজেকে যা করছেন তা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা স্বেচ্ছায়। কম বেশি প্রায় সব ক্রিয়েটিভ মানুষ ই এটি করে থাকে। বিখ্যাত ডিজাইনার মাইকেল সি লিখেছিলেন, তুমি হঠাৎ চিন্তা করতে না পারলে, সব ছেড়েছুড়ে সোজা বাড়ি যাও, নিজের জন্য ভালো কোন খাবার প্রস্তুত করো, নিজেকে এক গ্লাস রেড ওয়াইন( সম্ভব হলে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের) পেশ করো, খাবার উপভোগ করো এবং শেষে এঁটো বাসনপত্র ও নিজেই ধৌত করো। হঠাৎ খেয়াল করবেন বাসনে লেগে থাকা ময়লা ধোবার সাথে সাথে নিজের মস্তিষ্কের জট ও যেন একটু একটু করে খুলছে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তাঁর খোয়াবনামা উপন্যাস লেখার শুরুর দিকেই কয়েক চ্যাপ্টার লিখে আর লিখতে পারছিলেন না। ঢাকা ছেড়ে তিনি তখন বগুড়া চলে যান; করতোয়া নদী পাড়ে কয়দিন ঘুরে বেড়াতেই আবারো কলমে কালি ঝরে। আমেরিকান ফিল্মমেকার Taylor Sheridan নাকি আইডিয়া না পেলে ড্রাইভ করেন! সিনেমার কোন দৃশ্যে আটকে গেলে লস এঞ্জেলস থেকে মন্টেনা পর্যন্ত ড্রাইভ ও করেছেন। Get Out মুভির ডিরেক্টর জর্ডান পিলের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে তিনি অনুনয় করে বলেছেন, “Don’t accept writer’s block”. তিনি এও বলেন কোন কোন আইডিয়া কাজ না করলে বা ভালো না লাগলে অন্য আইডিয়া নিয়ে কাজ করো। উনি নিজে একাধিক প্রজেক্টে কাজ করেছেন কোন একটা প্রজেক্টে যখন আটকে গেছেন তখন। তবু থেমে যান নি।

৩য় স্ট্র‍্যাটিজি টি Steal Strategy, যাকে তিনি বলছেন To emphasize with someone. প্রথিতযশা ডিরেক্টর Billy Wilder তাঁর অফিসের দেয়ালে বড় করে লিখে রাখতেন, “What would Lubitsch have done?” উনি কোথাও আটকে গেলেই উনার মেন্টর Ernest Lubitsch এর কথা ভাবতেন। একই পরিস্থিতিতে কিংবা একই দৃশ্যে Lubitsch কি করে ভাবতেন, কেমন করে সমাধান দিতেন, কেমন করে চরিত্রকে বুনতেন— এ সব ই তাঁকে ব্লক থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করতো। অন্যের আইডিয়া চুরি করে তার প্রতি সহমর্মিতা দেখিয়ে নিজের মুক্তির পথ খোঁজা— কি অদ্ভুত!
এ ৩টি স্ট্র‍্যাটিজি ছাড়াও কণদার্প অন্য আরেকটি স্ট্র‍্যাটিজি নিয়ে কথা বলেন যা উঠিতি লেখকদের জন্য বেশ কাজে দিবে। এটা মূলত ক্রিয়েটিভিটি বাড়ানোর স্ট্র‍্যাটিজি। এর নাম “ Proactive Strategy: Pre-Creastination” যে টার্ম টি তিনি Adam Grant থেকে ধার করেন। Pre-Crestination এর মানে হলো সময়ের পূর্বেই কোন কাজ শেষ করে ফেলা; যাতে নিজেকে আইডিয়া দেবার জন্য প্রচুর সময় দেওয়া দেয়া যায়। তাছাড়া, সাইকোলজি বলে, আমরা কোন কাজ যখন প্রায় অসম্ভব মনে করি, তখন লুকোনো এক অদৃশ্য হাত আপনা থেকেই উদীয়মান হয় আর প্রায় অসম্ভব কাজকেই সম্ভব করে দেয়। তাই নিজেকে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ এর মুখোমুখি করা আপনার ক্রিয়েটিভিটি বাড়িয়ে দিবে।

‘রাইটার্স ব্লক’ আদতে মিথ নাকি আসলেই এ এক দুরারোগ্য ব্যাধি— তা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। তবে, সৃষ্টিশীল মানুষ্ মাত্রই নিত্য নুতন সৃষ্টির খোঁজে থাকে। সেই শিকারের পথে বাধা-বিপত্তি আসবে ; থেমে যাওয়া মানেই অজানা নতুনকে হারিয়ে ফেলবার সম্ভাবনা।