আমাদের আদিবাসীদের কথা

আমাদের দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে রয়েছে বিভিন্নরকম ভাষা ও জাতিগত আচার-আচরণের মিশ্রণ। বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে বাঙ্গালীর পাশাপাশি অবস্থান আছে আদিবাসী জাতির। এই দেশ একটি বহু জাতির, বহু ভাষার, বহু সংস্কৃতির বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ। এ দেশে বৃহত্তর বাঙালি জাতি ছাড়াও অর্ধ শতাধিক আদিবাসী জাতি স্মরণাতীত কাল থেকে বসবাস করে আসছে। বাংলাদেশের কৃষ্টি ও সংস্কৃতিতে যেমন রয়েছে সাধারণ বাঙ্গালীর অবদান ঠিক তেমনি বৈচিত্র্যতার রঙ ছড়িয়েছে আদিবাসী সম্প্রদায়। ভিন্নমাত্রার জীবনধারা, বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি আর অনন্য শিল্পশৈলীর অফুরান মিশেলে ঘেরা আদিবাসী জনগোষ্ঠী। আজ খিচুড়ির এই আর্টিক্যাল থাকছে তাঁদের ঘিরেই।

আদিবাসী জনগণকে প্রাথমিক দিকে জাতি, পাহাড়ি জনগোষ্ঠী, আদিম মানুষ, উপজাতি নামে চিহ্নিত করা হতো। আদিবাসী শব্দটির প্রকৃত সংজ্ঞা ও তাদের অধিকার নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিতর্ক প্রচুর। জাতিসংঘের বিভিন্ন পর্যায়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনার পরেও আদিবাসীদের ব্যাপারে সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য কোন সংজ্ঞায় উপনীত হওয়া সম্ভব হয় নি। সাধারণত কোন একটি নির্দিষ্ট এলাকায় অণুপ্রবেশকারী বা দখলদার জনগোষ্ঠীর আগমনের পূর্বে যারা বসবাস করতো এবং এখনও করে; যাদের নিজস্ব আলাদা সংস্কৃতি, রীতিনীতি ও মূল্যবোধ রয়েছে; যারা নিজেদের আলাদা সামষ্টিক সমাজ-সংস্কৃতির অংশ হিসেবে চিহ্নিত করে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যারা সমাজে সংখ্যালঘু হিসেবে পরিগণিত, তারাই আদিবাসী। আদিবাসীদের উপজাতি হিসেবে সম্বোধন করা একেবারেই অনুচিত, কারণ তারা কোন জাতির অংশ নয় যে তাদের উপজাতি বলা যাবে। বরং তারা নিজেরাই এক একটি আলাদা জাতি। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের মতে “বাংলাদেশে কোন আদিবাসী জনগোষ্ঠী নেই”। আমাদের দেশে সাংবিধানিকভাবে সরাসরিভাবে আদিবাসী জাতিসমূহের স্বীকৃতি নেই। সংবিধানে বলা হয়েছে, “রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহন করিবেন।” -(বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৩ ক)। ২০০০ সালে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় বা ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর লোকেরা বাংলাদেশে নিজেদের আদিবাসী দাবি করে বিশ্ব আদিবাসী দিবস পালন শুরু করে। পরবর্তীকালে তারা দেশের সমতলের বিভিন্ন উপজাতীয় ও তফসিলী জনগোষ্ঠীকেও এতে শামিল করে মোট ৪৫টি মতান্তরে ৭৫টি জনগোষ্ঠীকে একত্রে আদিবাসী আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের কাছে স্বীকৃতি দাবি করে। কিন্তু বাংলাদেশের উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর এই আদিবাসী দাবি শুরুতেই দেশের মধ্যে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি করে। প্রখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ মর্গানের সংজ্ঞানুযায়ী আদিবাসী হচ্ছে, ‘কোনো স্থানে স্মরণাতীতকাল থেকে বসবাসকারী আদিমতম জনগোষ্ঠী যাদের উৎপত্তি, ছড়িয়ে পড়া এবং বসতি স্থাপন সম্পর্কে বিশেষ কোনো ইতিহাস জানা নেই।’ আদিবাসী কথাটি এসেছে মূলত সংস্কৃত থেকে। ‘আদি’ অর্থ ‘মূল আর বাসী অর্থ ‘আদিবাসী’। সুতরাং, আদিবাসী কথাটির অর্থ ধরা যায় ‘দেশীয় লোক’ যার ইংরেজি প্রতিশব্দ Indigenous People.

সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা এবং সাঁওতালসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার প্রায় ৩০ লাখ মানুষ বসবাস করেন, যা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২%। এরা বিভিন্নভাবে বাংলাদেশের কৃষ্টি-সংস্কৃতিকে করেছে রঙিন। বাংলাদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর পরতে পরতে লুকিয়ে আছে নতুন রঙের ছটা। একটি স্বতন্ত্র জাতিসত্ত্বার যে সব বৈশিষ্ট্য রয়েছে, আদিবাসী জনগোষ্ঠীরও তা রয়েছে। ভিন্ন জীবনধারা, বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি আর অনন্য শিল্পশৈলীর অফুরান মিশ্রণে ঘেরা আদিবাসী সম্প্রদায়। প্রাচীন ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ভাষারীতি কালের স্রোতে বাহিত হয়ে চলেছে তাদের সমাজে। এদেশের উপজাতিরা কতকগুলো ঐতিহাসিক কারণে সমতলভূমিতে তাঁদের অধিকার হারিয়ে পাহাড়-পর্বত ও অরণ্য এলাকার বাসিন্দা হয়েছে। প্রকৃতির সাথে তাঁদের সম্পর্ক নিবিড়। তাঁদের ধ্যান-ধারণাতেও ওই কারণে ধর্মীয় ফেটিসিজম এর প্রভাব খুব বেশি। আদিবাসী সংস্কৃতির এক বিশেষ দিক ঐন্দ্রজালিক ধ্যান-ধারণায় আস্থা। নাচ-গানের প্রচলনও তাঁদের মধ্যে প্রচুর। তাঁদের নাচ-গানের সাথে শ্রমের সম্পর্ক নিবিড়। প্রাণ-প্রাচূর্য তাঁদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। অধিকাংশ আদিবাসীর ঘর সাধ্যানুযায়ী সাজানো থাকে, মাটির দেয়ালে নানা রকম অংকন দেখতে পাওয়া যায়। তাঁদের এই শিল্পানুভূতি আসে প্রকৃতি থেকে। মৎস্য শিকার, জুম চাষ, পশুপালন, কৃষিকাজ, হস্ত ও তাঁত শিল্পের কাজ মূলত এইসব কাজের মাধ্যমেই তাঁরা জীবিকা নির্বাহ করে। এদের মধ্যে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আদিবাসীরা জুমচাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের আদিবাসীরা মূলত কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। তাছাড়া হস্ত ও তাঁত শিল্পের কাজ করে অনেক আদিবাসীরা। যদিও পরবর্তী সময়ে এরা আধুনিক সমাজে বসবাস করা শুরু করেছে। কিন্তু প্রত্যন্ত এলাকায় এখনো পুরাতন কৃষ্টি ও সংস্কৃতি বিরাজমান।

চাকমাদের প্রধান উৎসবের নাম বিজু

বাংলাদেশে প্রায় ৪৫ ধরনের আদিবাসী জনগোষ্ঠী বসবাস করে। বাংলাদেশের বৃহত্তম আদিবাসী গোষ্ঠী চাকমা গোষ্ঠী। প্রায় দুই লক্ষ ঊনচল্লিশ হাজার চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস করে। যদিও ধারণা করা হচ্ছে তা তিন লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে। চাকমারা মূলত বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। চাকমাদের প্রধান উৎসবের নাম বিজু। বাংলা বছরের শেষ দুই দিন ও নববর্ষের দিন এই উৎসব পালন করা হয়।

বৃহত্তর সিলেট ও ময়মনসিংহের টাঙ্গাইলে গারো আদিগোষ্ঠী বসবাস করে। গারোরা মূলত খ্রীষ্ট ধর্মের অনুসারী। গারোদের প্রধান উৎসবের নাম ওয়ানগালা। জুমচাষ গারোদের ঐতিহ্যবাহী চাষ পদ্ধতি। গারোদের ভাষার স্থানীয় নাম মান্দি ভাষা। গারোদের পারিবারিক কাঠামো মাতৃতান্ত্রিক।

বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম আদিবাসী জনগোষ্ঠী হচ্ছে সাঁওতাল। সাঁওতালরা দিনাজপুর ও রংপুর অঞ্চলে বাস করে। দিনাজপুর জেলার নবাবগঞ্জ,বিরামপুর,ঘোড়াঘাট, ফুলবাড়ি, চিরিরবন্দর, কাহারোল এবং রংপুর জেলার পীরগঞ্জে সাঁওতালরা অধিক সংখ্যায় বাস করে। রাজশাহীএবং বগুড়া অঞ্চলে কিছু সংখ্যক সাঁওতাল আছে। প্রাচীনকাল থেকেই সাঁওতালরা এদেশে বসবাস করে আসছে। সাঁওতালদের প্রধান উৎসবের নাম সোহরাই। সাঁওতালদের কোন লিখিত বর্ণমালা নেই। সাঁওতালী ভাষায় দেবতাকে ‘বোংগা’ বলে। শিল্পকলার প্রতি সাঁওতালিদের আগ্রহ রয়েছে। এরা ঢোল, দোতারা, বাঁশি, মেগো প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র তৈরি করে ও বাজায়। ঘরবাড়ির দেয়ালে ছবি আঁকে। হাঁড়ি কলসির গায়ে চুনকালি দিয়ে ছবি আঁকে।

মগ উপজাতি পাহাড়ি এলাকায় মারমা নামে পরিচিত। সমতল এলাকায় পরিচিত রাখাইন নামে। রাখাইন শব্দটির উৎস পলি ভাষা। প্রথমে একে বলা হত রক্ষাইন যার অর্থ রক্ষণশীল জাতি। রাখাইন জাতির আবির্ভাব হয় খৃষ্টপূর্ব ৩৩১৫ বছর আগে। রাখাইনরা মূলত চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, বরগুনা, পটুয়াখালী ও কক্সবাজার এলাকায় বসবাস করে। রাখাইনরা বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। রাখাইনদের আদিনিবাস আরাকান, মায়ানমারে। রাখাইনদের প্রধান উৎসব সাংগ্রাই। জলকেলি রাখাইনদের একটি জনপ্রিয় উৎসব।

ত্রিপুরারা চট্টগ্রাম অঞ্চলে বাস করে। তারা ককবরক বা হিলাম ভাষায় কথা বলে। এদের কোন নিজস্ব বর্ণমালা নেই। পুরুষেরা খবং, ধুতি এবং মেয়েরা থামি, রিং-নাই, খাদি পড়ে। পুরুষ এবং নারীদের জাতীয় পোশাক যথাক্রমে রিমতাই, কুবাই এবং রিনাই, রিসা। নারীরা ভিন্নধর্মী গহনাও পরে। এদের নিজস্ব দেবতার পাশাপাশি অনেকে হিন্দু ধর্মের কিছু দেবতারও আরাধনা করে। এরা চাষের পাশাপাশি অন্য পেশায়ও নিয়োজিত।

মণিপুরী আদিগোষ্ঠী বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে বসবাস করে। এরা মূলত সনাতন ধর্মাবলম্বী। এ আদিগোষ্ঠী মূলত প্রকৃতি পূজারি। এদের প্রধান উৎসব রাস উৎসব। মণিপুরী সংস্কৃতির উজ্জ্বলতম দিক হলো মণিপুরী নৃত্য যা ভারতবর্ষের অন্যান্য শাস্ত্রীয় নৃত্যধারা যেমন কত্থক, ভারতনাট্যম, কথাকলি ইত্যাদির সমপর্যায়ের। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সিলেটের বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী গ্রাম মাছিমপুরে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের পরিবেশিত রাসনৃত্য দেখে বিমোহিত হন এবং শান্তিনিকেতনে মণিপুরী নৃত্য প্রবর্তন করেন। মণিপুরীদের মধ্যে ইসলাম ধর্মের অনুসারী সম্প্রদায়টি ‘পাঙন’ বা ‘পাঙ্গান’ নামে পরিচিত। বাংলাদেশের সিলেট, মৌলবীবাজার, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ জেলার নানান স্থানে প্রায় পঁচিশ হাজার পাঙন নারী-পুরুষ বাস করে।

মুরং শব্দটির একবচন ‘ম্রো’ যার অর্থ মানুষ। ম্রো ভাষায় এরা নিজেদের মারুচা বলে থাকে। মেয়েরা ‘ওয়াংকাই’ এবং পুরুষরা ‘ডং’ পরে। ছেলেরা মাথায় চিরুনি এবং মেয়েরা ফুল গুজে রাখে। একই গোত্রে বিবাহ নিষিদ্ধ। শরীরে রঙের প্রলেপ ব্যবহার করে। প্রকৃতি পূজারী এবং শুধু ইহকালে বিশ্বাসী। এদের নিজস্ব নাচ এবং ক্লং নামক বাঁশির ব্যবহার রয়েছে।

আদিবাসীরা দিন দিন সমতল ভূমিতে চলে আসার কারণে তাঁদের অনেক অবস্থা, চাল-চলন, কথা-বার্তা, কৃষ্টি-সংস্কৃতি সবকিছুতে পরিইবর্তনের ছোঁয়া এসেছে। তাঁরা উন্নত হচ্ছে। তাঁরা বরাবরই আমাদের দেশের সংস্কৃতিকে করে রেখেছে সমৃদ্ধ। তাঁদের শিল্পবোধ কিংবা শিল্পশৈলী যাই বলা হোক না কেনো সেটা প্রচুর পরিমাণে অ্যাস্থেটিকে ভরপুর। তাঁদের এই বিচিত্র্য অনন্যসুন্দর সংস্কৃতি বেঁচে থাকুক আজীবন।