ঘাতক

শহর থেকে বেশ খানিক দূরে জঞ্জাল মতো জায়গায় বৃদ্ধাশ্রমটি অবস্থিত। সেখানকার বৃদ্ধদের মতো জায়গাটাও বেশ বৃদ্ধত্ব ধারণ করেছে। চারপাশে বয়স্ক সব গাছ-গাছালী আর জিনিস পত্তর, আপাতদৃষ্টিতে সবকিছুই পুরনো আর বয়স্ক। জং ধরা ঝুলানো গেইট একটা। তাতে লতানো শ্যাওলা আঁকড়ে ধরে আছে। এখন নামেমাত্র গেইট ওটা। চোর-ছ্যাচোর অনায়াসেই আসতে পারবে। কিন্তু এমন জায়গায় চুরি করার মতো কিইবা আছে! কেবল ছুঁড়ে ফেলে দেয়া কজন বৃদ্ধ মা-বাপ ছাড়া। আজ এই বৃদ্ধাশ্রমে একজন বৃদ্ধা মৃত্যুবরণ করেছেন। রোকেয়া বেগম। তার কনিষ্ঠরা সবাই ‘বুজি’ বলে ডাকে আর সমবয়সীরা ‘আপা’। বৃদ্ধা মহিলাটি প্রায় দশ বছরের উপরে হবে এখানে থেকেছেন। সবার সঙ্গে একরকম আত্মিক সম্পর্ক ছিল তার। খোশমেজাজে থাকতেন পুরোটা সময়। গল্প করার মতো কোন মানুষ পেলে তার গল্পগুজবের অন্ত ছিলনা। সবার ছায়ামূর্তী হয়ে থাকতেন যেন। কারো অসুখ-বিসুখে নিজেই ব্যকুল হয়ে যেতেন। তখন অসুস্থ ব্যক্তির যত্ন-আত্তির অন্ত রাখতেন না তিনি। আর কথায় কথায় সবসময় তার ছেলের কথা বলতেন। সর্বোপরি একজন মাটির মানুষ ছিলেন। তাইতো আজ ওনার মৃত্যুর পর সবাই কেমন থমকে যায়। কী যেন হারিয়ে ফেলে ওরা। হৃদয়ের খুব নিকটে ছুঁয়ে যাওয়া কিছু যেন।

রোকেয়া বেগমের একমাত্র ছেলে রফিককে ফোনে মৃত্যুর খবরটি দেয়া হয়। সেই দশ বছর আগে তার মাকে এই বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে গিয়েছিল। তারপর অনেকটা বছর কেটে যায়। মাঝখানে কোন এক মাঘের সকালে দেখতে এসেছিল আবার। কিন্তু এরকম জঞ্জালে একদিনও থাকেনি সে। মাঘের প্রচণ্ড শীতে কষ্ট পাবে ভেবে রোকেয়া বেগমই তাকে থাকতে দেননি। আজ বহুদিন পর মায়ের মৃত্যুর খবরটা শুনতে পেয়ে যেন সম্ভিত ফিরে পায় সে। যেন ভুলেই গেছিল যে তার একটা বৃদ্ধা মা আছে। যাকে পুরনো আসবাবপত্রের মতো বৃদ্ধাশ্রমে ফেলে এসেছিল সে। আরেহ! তার ঝকঝকে ডুপ্লেক্সে এরকম কতো আসবাবপত্রের জায়গা হয়না তার কি হিসেব আছে। এদের জায়গা ডাস্টবিনে নয়তো বৃদ্ধাশ্রমে। এত্তসব মনে থাকবে কী করে তার!

বহুদিন হবে মায়ের খোঁজ নেয়নি সে। অনেকটা অমানবিক হয়ে গেছে বিষয়টা। আজ বোধটা জাগে তার। মৃত মাকে নাহয় শেষবারের মতো দেখতে যেতেই হয়। কিছুটা মানবিকতা দেখাতে হয় শেষমেশ। পারতপক্ষে মা বলে কথা। সঙ্গে পাপমোচনও করা যাবে। মাকে দূরে দূরে সরিয়ে রাখার পাপটা মোছার শেষ সুযোগ এটা। একটু কাঁদলে হয়তো করুণাময় ক্ষমা করে দিবেন তাকে। প্রচণ্ড অনুতাপ জাগে তার। তাই বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে অন্তিম সংস্কারটা করে আসলেই হলো। ঘাড়ের উপর যত দায়-দায়িত্ব আছে সবিই সেরে যাবে।

বৃদ্ধাশ্রম থেকে ফোন দিয়েছে সবে একঘণ্টা হলো। মিটিংটা শেষ হলেই বেরিয়ে যাবে। বৌ, বাচ্চাদের নেয়ার কোন প্রয়োজন বোধ করেনা সে। একাই যাবে। কেবল লাশটাকে কবরে গেড়ে দিয়ে আসবে এই আরকি! এরকম ছোট্ট কাজে ওদের যাওয়ার দরকার কী! আরো আধঘণ্টা লাগবে রওনা দিতে। সঙ্গে দেড় ঘণ্টার পথ। কিন্তু যানজট বহুল এই শহরটা পাড়ি দিতে আধঘণ্টা বেশি লাগতে পারে। সবমিলিয়ে ঘণ্টা দুয়েকের জার্নি। হিসেব করল সে। তাই সময়টা দেখার জন্য ঘড়িতে চোখ বুলাল। এখন দুপুর একটা বাজছে; কিছুটা কম, বেশি হবে।

রোকেয়া বেগমের লাশটি নিথর পড়ে আছে। আত্মার মুক্তি হয়েছে আজ। তাই নৈঃশব্দ ছেঁকে ধরেছে তার বৃদ্ধ দেহটিতে। আর চারপাশে ন’দশেক বৃদ্ধা বসে বসে চোখের জল মুছবার মতো পণ্ডশ্রম করছেন। একফোঁটা মুছবার জো হলেই আরেক ফোঁটা চোখের ডগায় এসে জমতে শুরু করে। রোকেয়া বেগমের চেহারা দেখতেই কেমন চোখ টলমল করে ওদের। এতদিনের মায়াগুলো যেন মিছিল করে বেরিয়ে আসতে চাইছে। মাঝেমধ্যে একজন আরেকজনকে গুনগুন করে বলছে, ‘বড় ভালা মানুষ ছিল আফায়।’

তারপর ধীরে ধীরে এক-দেড় ঘণ্টা কেটে যায় কিন্তু লাশটিকে দেখতে কেউ এল না; এই ভেবে একজন বৃদ্ধা খিঁচড়ে গিয়ে বললেন,
‘রোকেয়া আফা কৈল দেশের বাইত কবর দিত। সবসময় কৈত কথাডা। কৈ কেউতো এহনো আইল না।’
বৃদ্ধার কথা শুনে বৃদ্ধাশ্রমের কজন তত্ত্বাবধায়ক তার প্রতি নজর দিতেই তিনি তাদের উদ্দেশ্যে বললেন,
‘রোকেয়া আফার পোলাডারে খবর দেছ না তরা?’
তত্ত্বাবধায়কদের মধ্যেই সবচেয়ে জোয়ান লোকটি বলল,
‘এত্ত কথা কৈয়েন না, বুজি। আমরা রফিক সাহেবরে খবর দিয়া দিছি। উনি আসলেই ব্যবস্থা হৈব।’
তারপর বৃদ্ধা মহিলাটি গোমরা হয়ে বসে থাকেন। কেউ পাত্তাই দিল না তাকে। এখন শুধু রফিক সাহেবের আসা বাকি। কখন যে আসবে? এই চিন্তাই করছেন উনি।

প্রায় দুই ঘণ্টা পর …

‘ঐতো রফিক সাহেব আয়া পড়ছেন।’ তত্ত্বাবধায়কদের মধ্যেই একজন বলে উঠলেন। রফিক সাহেবকে কেবল তারাই চিনেছে। অন্যরা তাকে চিনে কি-না তাই মনে মনে যাচাই করে নিচ্ছে। তবে ঠাওর করতে পারছে না। বেশ হৃষ্টপুষ্ট একজন মানুষ। স্যুট-ট্যুট পরে এসেছেন। সঙ্গে ব্যক্তিগত গাড়ি। তাই চেনা বড় মুশকিল। বড়লোকেরা একটু বর্ণচোরা টাইপের হয়। এইটা বোঝতে পারে তারা। যাকগে, রফিক সাহেব আসা মাত্রই তত্ত্বাবধায়কেরা চাটুকারের মতো বেশ তোড়জোড় শুরু করে। কিন্তু রফিক সাহেব সেসবে ভ্রুক্ষেপই করেন না। তিনি গিয়ে রোকেয়া বেগমের লাশের পাশে গিয়ে দাঁড়ান। তারপর কেমন চোখ কচলাতে কচলাতে জিজ্ঞেস করেন, ‘কোথায় কবর দেয়া হবে; ঠিক হয়েছে?’
তত্ত্বাবধায়কদের একজন এগিয়ে এসে জানাল,
‘বুজি কৈল দেশের বাইত কবর দিত।’
রফিক সাহেবের সাড়া না পেয়ে সেই আবার বলল,
‘এহানে সরকারি জাগায়ও দেওন যাইব, স্যার।’
রফিক সাহেব না শুনার ভনিতা করেন। তারপর লোকটির কথার জের টেনে সোজাসাপ্টা করে বললেন,
‘তবে তাই হোক।’

অতঃপর প্রায় দেড় ঘণ্টায় রোকেয়া বেগমের অন্তিম সংস্কার হয়। রোকেয়া বেগমের শেষ ইচ্ছা ছিল দেশের মাটিতে তার কবর হবে। কিন্তু রফিক সেটাও পূরণ করল না। তাই অনেকে মনে মনে তাকে ধিক্কার দিচ্ছে। মায়ের শেষ ইচ্ছাটাও পূরণ করল না! এ কেমন মানুষ! ভাবতেই কেমন জঘন্য লাগে। অভিশাপ লাগবে তার। এরকম যত অভিযোগ তাদের।

দাফন-কাফন শেষে রফিক সাহেব বেশি দেরী করলেন না। সূর্যাস্ত যাবার উপক্রম। তাই সময়টা দেখার জন্যে ঘড়িতে চোখ বুলান। প্রায় পাঁচটা বাজছে। এখানে আর এক মূহুর্ত সময় ক্ষেপণ করা যাবে না। তাই গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে দ্রুত চালাতে বললেন। আর মনে মনে বলছেন, ‘সময়টা যে কখন উড়ে যায়!’

রফিক সাহেবের কথা মতো ড্রাইভার গাড়ি দ্রুত দৌড়াচ্ছে। ধীমে যাওয়া বাতাস ডিঙিয়ে শু শু করে এগিয়ে যাচ্ছে গাড়িটা। বাইরে কেমন ভ্যাপসা হাওয়া বইছে। অসহ্য লাগছে তার। তাই জানালাটা লক করে ড্রাইভারকে এসিটা চালু করতে বললেন। শরীরটা প্রায় দুলে পড়ার উপক্রম। সারাদিনের কত ধকল গেল তার উপর দিয়ে। সঙ্গে এসির শু শু আওয়াজে মাথাটা যেন বয়ে আসছে। চোখ দুটি নিভু নিভু করছে। সবকিছুই কেমন দুলছে। ঘুমের রেশ জমে আছে চোখে। আধো ঘুমের রেশটা যেন তাকে সময়ের বিপরীতে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সবকিছুই যেন জিম মেরে আছে। নয়তো উল্ঠো লাগছে। মায়ের মুখটাও দিব্যি চোখের সামনে ভাসছে। ধীরে ধীরে চোখ বুজে আসে তার। তারপর কেমন স্বপ্নের ভেতর নিজেকে আবিষ্কার করে সে। যেখানে মায়ের অস্তিত্ব অনুভব করতে পারছে। তিনি খিলখিলিয়ে হাসছেন। ঠিক আগের মতো। যখন মায়ের আঁচলে সে চৌপরদিন পড়ে থাকত। বড্ড মায়াবী হাসি। কিন্তু একটা পিনপিনে শব্দ কানে আসছে। কারো গলার স্বর যেন। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে কানে আসছে। ঠিক মায়ের কণ্ঠস্বরের মতো লাগছে। কিন্তু বুঝে উঠতে পারছে না কার। অনেকদিন হয়েছে মায়ের কণ্ঠ শুনেনি। সেজন্যই হয়তো আঁচ করতে পারছে না। পিনপিনে স্বরটা যেন সতর্ক করবার চেষ্টা করছে। কিন্তু স্বরটা স্পষ্ট বোঝার কোন সুযোগই নেই। এতটা পিনপিনে যে কান ঝাঁঝরা করে দেয়। তারপর আচমকা বাজ পড়ার মতো আওয়াজ হলো। রফিক সাহেব সামনের সীটের সঙ্গে ধাক্কা খেলেন। ফলে আধো আধো ঘুমটাও ভেঙ্গে যায়। তাই রেগেমেগে ড্রাইভারকে যত খিস্তিখেউড় দিতে থাকেন তিনি,
‘ঐ শুয়ার, হার্ডব্রেক করলি ক্যান? গাড়িটা কি তোর বাপের?’
ড্রাইভারের কান্ডে রফিক সাহেব প্রচণ্ড ফোঁসাচ্ছেন। আরো গালিগালাজ করতে গিয়েও ঠিক পারছেন না। তারপর আশেপাশে তাকিয়ে দেখলেন যে সামনে-পিছনে পুরো রাস্তাটা ফাঁকা। এই দেখে রফিক সাহেবের মাথা আরো বিগড়ে যায়। তিনি ড্রাইভারকে আবারো ঝারতে থাকেন,
‘শালা, খালি রোডে হার্ডব্রেক করলি। দাঁড়া তোকে শিক্ষা দিচ্ছি।’
এই বলে তিনি ড্রাইভারের কাঁধে জোরে ধাক্কা দেন,
‘এক্ষুণি গাড়ি থেকে নাম, শালা ফকির। এই মাঝরাস্তায় তোকে ছেড়ে দেব আজ। দেখি কীভাবে বাড়ি যাস তুই। শালা, শুয়ার …’
অশ্রাব্য যত গালিগালাজ দিয়ে আবারো ড্রাইভারকে ধাক্কা দিতে গেলে আচমকা রফিক সাহেবের হাতটা চেপে ধরে ড্রাইভার। তারপর পেছনে মুখ ফেরায় সে। তার চেমনা মুখটাতে পিটপিটে চোখ দুটি বীভৎস লাগছে। সঙ্গে প্রচণ্ডভাবে গরর গরর করে ফোঁসাচ্ছে সে। যেন রফিক সাহেবকে জ্যান্ত গিলে খাবে। ওদিকে হাতের ব্যথায় কোঁকড়াতে থাকেন তিনি। হাতটা ভেঙ্গে যেন এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যাবার উপক্রম। মধ্য বয়সী কঙ্কালসার অথরবো শরীরটায় এতো জোর এলো কোথা থেকে! রফিক সাহেবের বোঝতে বেশি দেরী হলো না। কোন অশরীরী হবে নিশ্চয়ই। এতদিনের যত অপকৃতির পর তার নিজের মনেই আশংকা ছিল যে এরকম কিছু একটা হবে। তাই সহসায় বুঝে গেলেন সব। সঙ্গে বুকটাও ধ্বড়-ফড় করতে শুরু করে। ড্রাইভারের উপর যত রাগ ছিল মূহুর্তেই সব ধুয়ো হয়ে যায়। কিছুক্ষণ বাদে অশরীরীটা রফিক সাহেবের হাতটা ছেড়ে দেয়। হাতটা ফিরে পাওয়া মাত্রই দরজা খুলে পালাবার চেষ্টা করে সে। কিন্তু দরজা লক করা ছিল। সবিই পণ্ডশ্রম তার! পরিস্থিতির এরকম বিরূপ আচরণ রফিক সাহেবের ধুকপুকানি আরো বাড়িয়ে দেয়। এদিকে অশরীরীটা গরজ করতে করতে আবারো রফিক সাহেবকে আক্রমণ করে বসে। এবারে সোজা গলায় চেপে ধরে। আর ফাঁপরের সুরে জোর গলায় বলে,
‘তোর মতো বেকুবদের জন্যই মায়েদের যত কষ্ট। এজন্যে মৃত্যুই তোদের উপযুক্ত শাস্তি। তাও আমার হাতে …হা হা হা।’
তারপর বীভৎস সুরের একটা বিকট হাসি গাড়ির বদ্ধ আয়না ভেদ করতে ব্যর্থ হয়। কিন্তু তখন গাড়ির পাশ দিয়ে যদি কেউ ঘেঁষত তাহলে রফিক সাহেবের বেঁচে থাকার প্রচণ্ড আকুতি তার কান ঝাঁঝরা করে দিত।