সকালের নাস্তার টেবিল থেকে শুরু করে, বন্ধুদের সাথে টঙের দোকানের আড্ডা কিংবা রমজান মাসের ইফতারির পর এক কাপ চা সঙ্গে না থাকলেই নয়। আর এই বিশেষ, সহজলভ্য এবং সঙ্গ দেয়ার মত উষ্ণ পানীয়টির কতো ধরণই না দেখা যায়। দুধচা, রং চা, অপরাজিতা চা, তেতুল চা, সবুজ চা বা গ্রিন টি ইত্যাদি ইত্যাদি।
আজকের লেখা চা প্রেমীদের জন্যই। প্রতিদিন তো চা পান করা হয়। আজকে জেনে নেয়া যাক চায়ের খুঁটিনাটি বিষয়।
যদিও চায়ের আদিভূমি চীন তবুও জানলে অবাক হবেন যে বিশ্বের সর্বোচ্চ চা রপ্তানিকারক দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। চায়ের ইতিহাসে যাওয়ার আগে, “চা” শব্দটি নিয়ে কিছু তথ্য জানিয়ে দেই। ৪০০ খ্রিস্টাব্দে চীনের অভিধানে ” কুয়াং ইয়া ” নামে চায়ের নাম করণ এবং পদ্ধতির বর্ণনা দেয়া হয়। চায়ের ইংরেজি নাম “Tea “, “টি” মূলত এসেছে গ্রীকদেবী, থিয়ার নামানুসারে। চীনে “টি” শব্দটির উচ্চারণ ছিল, “চি”। যা পরবর্তীতে ৭২৫ খ্রিস্টাব্দে চীন সম্রাট সরকারী ভাবে এই পানয়ীর নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম করেন “চা” ।
এক প্রকার চিরহরিৎ বৃক্ষের পাতা শুকিয়ে চা তৈরি করা হয়। ২৭৩৭ খ্রিস্টপূর্বে চীনা সম্রাট শেন নাং তাঁর ভৃত্যের সঙ্গে জঙ্গলে ঘুরতে বের হন। ভৃত্যরা সম্রাটের জন্য খাদ্য প্রস্তুতে ব্যস্ত হয়ে যায়। হঠাৎ এক অচেনা পাতা ফুটন্ত পানির মধ্যে পরে গেলো। সম্রাটকে সেই পানীয় পরিবেশন করা হলো। সম্রাট তার স্বাদ পেয়ে খুশি হয়ে গেলেন। এই পাতা কী বা কিসের? তা কেউ জানতো না। তাই তিনি সেই পাতা সম্পর্কে তদন্ত করার নির্দেশ দেন। এই থেকে জন্ম নিলো এক নতুন পানীয়। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই চা এর ঔষধী গুণাবলীর স্বীকৃতি পেলো যা পরবর্তীতে চীনা পন্ডিত কর্তৃক অমরত্বের স্পর্শমনি হিসাবে বর্ণিত হয়েছিল।
৭২৯ খ্রীষ্টাব্দের দিকে জাপানিরা তৈরী করে গুঁড়ো চা, জাপানি ভাষায় যাকে বলা হয় `হিকি অচ্চা’। এই গুঁড়ো চা বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং জাপান সম্রাটের কাছে অতি প্রিয় পানীয় বলে বিবেচিত হতো। ৭৮০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে চা পুরো চীনে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করে এবং চীন সম্রাট জনগণের উপর চা কর প্রবর্তন করেন।
৭৮০ খ্রিস্টাব্দে তাং রাজবংশের সময়, প্রতি বসন্তে চীনা কৃষক কর্তৃক সম্রাটকে তাদের উৎপাদিত সর্বোৎকৃষ্ট চা উপহার দেয়ার বিশেষ প্রচলন শুরু হলো। সেসময়ে চীনা কবি লু ইউ, চা নিয়ে সর্ব প্রথম একটি প্রবন্ধ লিখেন “চা জিং(চা ক্লাসিক)” নামে।
চায়ের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে তাং রাজবংশের কবি লু তাং লিখেছিলেন :
প্রথম পেয়ালা ভেজায় আমার ওষ্ঠ এবং কণ্ঠ;
দ্বিতীয় পেয়ালা ঘোঁচায় আমার একাকীত্ব;
তৃতীয় পেয়ালা খুঁজে ফিরে আমার অনুর্বর রন্ধ্র আর তুলে আনে সহস্র ভুলে যাওয়া স্মৃতি;
চতুর্থ পেয়ালা করে কিঞ্চিৎ ঘর্মাক্ত আর জীবনের ভুলগুলো বেরিয়ে যায় লোমকূপ দিয়ে;
পঞ্চম পেয়ালায় হয়ে যায় শুদ্ধ আমি;
ষষ্ঠ পেয়ালা আমায় ডেকে নেয় অমরত্বের রাজ্যে।
সপ্তম পেয়ালা – আহ্ !, আর তো পারি না সইতে আমি !
আমার দুই বাহু ছুঁয়ে যাওয়া শীতল বাতাসের নিঃস্বাস টের পাই কেবলই।
দিব্যধাম কোথায়? এই মৃদুমন্দ বাতাসে আমাকে উড়িয়ে নাও সেথা আর আর ছিটিয়ে দাও এর শীতলতা।
১৬৫০ খ্রিস্টাব্দে চীনে চায়ের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়। ভারতবর্ষে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে চা উৎপাদন শুরু হয়। ভারতবর্ষের প্রথম দিককার একজন চা পানকারী ছিলেন অতীশ দীপঙ্কর। ১৮৪০ সালের আশে পাশের সময় কলকাতা বোটানিক্যাল গার্ডেন থেকে চীনা চায়ের গাছ এনে চট্টগ্রাম ক্লাবের পাশে রোপণ করা হয়। ইউরোপীয় ব্যাবসায়ীরা ১৮৪০ সালে এই উপমহাদেশে সর্বপ্রথম চা বাগান বন্দর নগরী চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৪৩ সালে প্রথমবারের মতো চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তীরে বাংলার মাটিতে চা তৈরি এবং পান করা হয়। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশরা সিলেটে চায়ের গাছ খুঁজে পায়। পরবর্তীতে ১৮৫৭ সালে সিলেটের মালনীছড়ায় বাণিজ্যিকভাবে চা উৎপাদন শুরু হয়।
চায়ের মধ্যে দুধচা অন্যতম জনপ্রিয় একটি পানীয়। বিশেষ করে অ্যাপায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এবং ভারতে দুধচায়ের কোন জুড়ি নেই। দুধচায়ের উৎপত্তি হয়েছে ভারতে।
ভারতে প্রচুর পরিমাণে জন্মানো চায়ের উদ্ভিদটি ছিল ক্যামেলিয়া সিনেনসিস অসমিকা। গ্রিন টি’র চেয়ে আসাম টি বেশি স্বাদযুক্ত এবং কালো রঙের ছিল। আসাম চায়ের রঙ কড়া থাকায় তার সাথে দুধ সহকারে পান করার জন্য ব্রিটিশরা ভারতের সাধারণ জনগণকে প্ররোচিত করে। বর্তমানে ব্রিটেনে সাধারণ ইংলিশ ব্রেকফাস্টে দুধ চা পান করা হয়। কিন্তু ইউরোপ মহাদেশের অন্যান্য স্থানে চায়ের সঙ্গে দুধ খুব কমই পরিবেশন করা হয়।
বর্তমানে ১৬৭টি বাণিজ্যিক চা এস্টেট আছে বাংলাদেশে। যার মধ্যে কয়েকটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কর্মক্ষম চা বাগান।
চা শুধুই আমাদের অভ্যাস নয়। এর কিছু গুণাবলীও আছে। বেশ কিছু গবেষণা থেকে জানা গেছে যে চা পান স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্যও বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
চায়ে রয়েছে `অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট’ যা, মানবদেহকে চির তরুণ রাখে। চায়ে ক্যাফেনের পরিমান অনেক কম আর তাই চা পান আপনার স্নায়ুতন্ত্রে কোনো রকম খারাপ প্রতিক্রিয়া করে না। চা হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, যাঁরা দৈনিক এক থেকে তিন কাপ সবুজ চা অর্থাৎ গ্রিন টি, পানে অভ্যস্ত তাদের হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি প্রায় কুড়ি শতাংশ এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি প্রায় পঁয়ত্রিশ শতাংশ কম থাকে। আর যাঁরা দৈনিক চার কাপ বা তার বেশি সবুজ চা পান করেন তাঁদের হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ছাড়াও কোলেস্টেরল সমস্যা কমিয়ে দেয় প্রায় ত্রিশ থেকে বত্রিশ শতাংশ। সম্প্রতি পশুদের উপর গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে যে, সবুজ চা অর্থাৎ গ্রিন টি হাড়ের ক্ষয় রোধে বেশ কার্যকরি।
শুধু তাই না চা আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে। গবেষণা মতে, চা রোগ প্রতিরোধ করার কোষ সমূহকে দ্রুত প্রস্তুত করে তোলে যেন এরা রোগ প্রতিরোধের লক্ষ্যে কার্যকরী হতে পারে। ভেষজ চা হজম সংক্রান্ত সমস্যা প্রশমিত করে। হজমের সমস্যা থাকলে ভেষজ চা যেমন উপকার করে আবার আদা দিয়ে চা বমি বমি ভাবকে রোধ করে।
চা সত্যিকার অর্থে একটা অনুভূতির নাম। কবিরা কবিতা লেখেন। লেখায় চায়ের উল্লেখ থেকে যায়। গানের লিরিক্স কিংবা গানের আসর জমে, চায়ের এক কাপ সামনে রেখে। ক্লান্তি কাটে এক কাপ চায়ে। দুধচা নাকি রংচা তা নিয়ে বৃদ্ধ জুটির স্মৃতিময় ঝগড়া। বৃষ্টি বিলাসে এক কাপ চা সঙ্গে না থাকলে হয়ই না। প্রেমে বিচ্ছেদ হলে প্রেমিকের বিরহে জায়গা করে নেই সিগারেট আর এক কাপ চা। কাজের চাপে পরে একটু শান্তি খুঁজতেও প্রয়োজন হয় এক কাপ চা। আর যে চা পানে অভ্যস্ত না তাকে নিয়েও মাঝে মাঝে হয় অন্যরকম সমস্যা। প্রতিটা আবেগের সাথেই চায়ের একটা সম্পর্ক কোন না কোন ভাবে থেকেই যায়। চা ছাড়া একটা দিন কল্পনা করা অধিকাংশ মানুষের কাছেই দুষ্কর। এমনও কিছু মানুষ আছে যারা মাথা ব্যাথা করলে ওষুধ না খেয়ে, চা পান করে। চায়ের মর্মার্থ আমাদের জীবনে অনেক। কিন্তু চায়ের উপর আমাদের দৃষ্টি খুব সাধারণভাবেই পরে।
আমাদের আশেপাশে, অভ্যাসে অনেক ক্ষুদ্র সাধারণ কিছু ব্যাপার, বস্তু, জিনিস আছে যাদের পেছনে ইতিহাস, ঐতিহ্য, বিজ্ঞান রয়েছে। হয়তো খুব সাধারণ মনে হয় বলেই আমরা সেসব জিনিস নিয়ে ভাবি না, খুঁজি না, পড়ি না। কিন্তু যখন ঐ জিনিসগুলো নিয়ে আমরা ভাববো, শিখবো, জানবো তখন সেই অভ্যাসগুলো আরো সুন্দর হতে উঠবে। চেষ্টা রাখতে হবে আশেপাশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে জ্ঞান অর্জন করার। খুব সাধারণ দিনও তবে রঙিন, উজ্জ্বল আর সতেজ হয়ে উঠবে চা পান করার মতো।