অবশেষে দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর মুক্তি পেলো বড় বাজেটের চলচ্চিত্র “মুজিব: একটি জাতির রূপকার”। যা ইংরেজিতে “Mujib: The Making of a Nation“. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী নিয়ে নির্মিত এই চলচ্চিত্রটির ট্রেলার প্রকাশিত হয়েছে ৭৫তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে।
গত ১৯ মে ফ্রান্সের স্থানীয় সময় রাত ১০ টায় কান চলচ্চিত্র উৎসবের ৭৫ তম আসরের তৃতীয় দিনে মুক্তি পায় বঙ্গবন্ধুর জীবনী নিয়ে নির্মিত এই চলচ্চিত্রটির ট্রেলার। নির্মাণের দায়িত্বে রয়েছেন ভারতের বিখ্যাত পরিচালক শ্যাম বেনেগাল। ১ মিনিট ৩০ সেকেন্ড দৈর্ঘ্যের এই ট্রেলারটিতে ফুটে উঠেছে বঙ্গবন্ধুর জীবনের এক গুরত্বপূর্ণ ঝলক।
কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রকাশিত হওয়ার পরেরদিনই জনসাধারণের জন্যে ইউটিউবে প্রকাশিত হয় অনেকদিন ধরেই বাঙালির আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠা এই চলচ্চিত্রটির ট্রেলার। বিপত্তি ঘটে তখন। পুরো ট্রেলার জুড়ে ইতিহাসের সাথে মিল না পাওয়া, বঙ্গবন্ধু চরিত্রের দূর্বল উপস্থাপন, ভিএফএক্স সহ আরো নানান অসঙ্গতি নিয়ে সমালোচনার ঝড় তোলেন বাংলার আপামর জনতা। আর তাতেই প্রশ্নের মুখে পড়েছে ” মুজিবঃ একটি জাতির রুপকার” চলচ্চিত্রের নির্মাণ কুশলীরা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালির জাতির জনক। যার হাত ধরেই জন্ম নিয়েছিলো “বাংলাদেশ” নামক একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। বঙ্গবন্ধু শুধু একটি নামই নয়, এটি আপামর বাঙালি জনতার আবেগ অনুভূতির নাম। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময় থেকে শুরু করে স্বাধীনতার পর এখন পর্যন্ত যে অনুভূতি জড়িয়ে ধরে আজও বাঙালি গর্ববোধ করেন, তিনিই বঙ্গবন্ধু। আর তাকে নিয়েই নির্মিতব্য এই চলচ্চিত্রটি বাঙালির আশা ভরসাকে কতটুকু পূরণ করতে পারবে?
৮৩ কোটি টাকা বাজেটের এই চলচ্চিত্রটি নিয়ে বাঙালির প্রত্যাশা ছিলো একটু বেশিই। আর নির্মাতা যদি হয় বিখ্যাত শ্যাম বেনেগাল, তাহলে তো কোনো কথাই নেই। আর এমন আশার পেছনে কারনও আছে বৈকি। বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনী নির্ভর চলচ্চিত্র নির্মাণে শ্যাম বেনেগালের জোড়া মেলা ভার। ১৯৯৬ সালে মহাত্মা গান্ধীকে নিয়ে তিনি তৈরি করেছিলেন “দ্য মেকিং অব দ্য মহাত্মা”। চলচ্চিত্রটি মুক্তির প্রায় ৯ বছর পর ২০০৫ সালে তৈরি করেন আরেক মাস্টারপিস “নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস: দ্য ফরগটেন হিরো”। আর এবার তার ১৭ বছর পর, বঙ্গবন্ধুর জীবনী নিয়ে এই বায়োপিক। চলচ্চিত্র নির্মাণে প্রাপ্তি স্বরুপ পেয়েছেন ভারতের পদ্মশ্রী এবং পদ্ম ভূষণ সহ আরো অনেক জাতীয় পুরষ্কার। আর এমন একজন মানুষের হাতে যখন জাতির পিতার বায়োপিক নির্মাণের দায়িত্ব পড়ে, তখন বাঙালির প্রত্যাশা বেশি হওয়াকে অযৌক্তিক বলে কার সাধ্য!
বেনেগালের প্রতিটি সিনেমাতেই চোখে পড়ে তার গভীর গবেষণা এবং অভিনিবেশনের ফলাফল। শুরুর দিকে চলচ্চিত্রটির নাম “বঙ্গবন্ধু” হলেও পরে সেটি পরিবর্তন করে রাখা হয় “মুজিবঃ একটি জাতির রুপকার”। অথবা ইংরেজিতে “Mujib: The Making of a Nation”. বেনেগালের দাবি, একমাত্র মুজিব নামের মাধ্যমেই জাতির এই সূর্য সন্তানকে পূর্ণ রুপে প্রকাশ করা সম্ভব।
গত ১৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০২ তম জন্ম বার্ষিকীতে প্রকাশ করা হয় চলচ্চিত্রটির পোস্টার। যাতে দেখা যায় বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের আদলে তৈরি করা একটি পোস্টার। চলচ্চিত্রটিতে বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে অভিনয় করছেন বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিভাবান একজন অভিনেতা আরিফিন শুভ।
এবার দেখে নিবো “মুজিবঃ একটি জাতির রুপকার” চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্রগুলোতে কাদের কাদের দেখা যাবেঃ
- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানঃ আরিফিন শুভ
- শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবঃ নুসরাত ইমরোজ তিশা
- শেখ হাসিনাঃ নুসরাত ফারিয়া
- শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হকঃ শহীদুল আলম সাচ্চু
- খন্দকার মোশতাক আহমেদঃ ফজলুর রহমান বাবু
- আবদুল হামিদ খান ভাসানীঃ রাইসুল ইসলাম আসাদ
- তাজউদ্দীন আহমদঃ রিয়াজ
- আব্দুল হামিদঃ গাজী রাকায়েত
- বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফুর রহমানঃ চঞ্চল চৌধুরী
- বঙ্গবন্ধু মাতা সায়েরা খাতুনঃ দিলারা জামান
- হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীঃ তৌকির আহমেদ
- মেজর জেনারেল ওসমানীঃ খন্দকার হাফিজ
- জেনারেল আইয়ুব খানঃ মিশা সওদাগর
- শেখ রেহানাঃ সাবিলা নূর
- জেনারেল টিক্কা খানঃ জায়েদ খান
- খালেদা জিয়াঃ এলিনা শাম্মী
এছাড়াও আরো অনেকেই অভিনয় করছেন চলচ্চিত্রটিকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেহেতু বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা, সেহেতু বঙ্গবন্ধুর মর্মার্থ সবচেয়ে বেশি বুঝবেন বাংলার মানুষই। আর সেই চিন্তা করেই বাংলাদেশ-ভারত যৌথ প্রযোজনা হলেও ভারত থেকে কোনো অভিনয় শিল্পী নেওয়া হয়নি এই চলচ্চিত্রটিতে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ লালন যারা করে, তাদেরই দেওয়া হয়েছে বঙ্গবন্ধুর বায়োপিকের মুল দ্বায়ভার।
চলচ্চিত্রটি নিয়ে মানুষের আগ্রহ যেমন ছিলো, তেমনি তা রোষানলেও পরিণত হয় মানুষের৷ ট্রেলার মুক্তির পরপরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুরু হয় তুমুল সমালোচনা। চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট থেকে শুরু করে দেশের আপামর জনতা নিন্দা জানান ট্রেলারের নানান অসঙ্গতি নিয়ে। বড় বাজেটের চলচ্চিত্রে মাত্র ১ টাকা পারিশ্রমিক নিয়ে যেমন প্রসংশা কুড়িয়েছিলেন সময়ের আলোচিত অভিনেতা আরিফিন শুভ, তেমনি নিন্দার মুখে পড়েন ট্রেলার মুক্তির পর। কারন চলচ্চিত্রটির বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর বায়োপিকের প্রাণ যে বঙ্গবন্ধু, যে মানুষটাকে বুকে লালন করেন বাংলার জনতা, তার চরিত্রের দূর্বল উপস্থাপনা এবং আরিফিন শুভ’র কন্ঠস্বর নিয়ে প্রশ্ন তোলেন নেটিজেনরা। কেনোনা, যেকোনো একটি চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্রের হওয়া উচিত বলিষ্ঠ। আর বিখ্যাত কোনো ব্যক্তির বায়োপিকে তা আরো কঠিনতম হয়ে উঠে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিজ হাতে লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনীর উপর ভর করে তৈরি হচ্ছে এই চলচ্চিত্রটি। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এটিই প্রথম কোনো বড় বাজেটের সিনেমা। কিন্তু সে হিসেবে বঙ্গবন্ধুর চরিত্রকে আরো বাস্তবমুখী দেখতে চেয়েছিলেন নেটিজেনরা। কিন্তু মুক্তি পাওয়া ট্রেলারে সে আশা পূরণ করতে পারেন নি আরেফিন শুভ। তার বঙ্গবন্ধুর আদলে গড়া মেকাপ, বঙ্গবন্ধুর চলনভঙ্গি, বাচনভঙ্গির দূর্বল উপস্থাপনই জনরোষের মূল কারণ।
এরপর রয়েছে দূর্বল ভিএফএক্স। যেকোনো একটি চলচ্চিত্রকে প্রাণ দেয় এই ভিএফএক্স। যা একধরনের কম্পিউটারাইজড গ্রাফিকস। ভিএফএক্স একটি চলচ্চিত্রের দৃশ্যকে করে তোলে অনেক বেশি প্রানবন্ত আর বাস্তবধর্মী। কিন্তু সেই জিনিসটিতেও নেটিজেনদের হতাশ করে সদ্য মুক্তি পাওয়া ট্রেলারটি। তারা মনে করেন, এই বাজেটে আরো ভালো ভিএফএক্স ব্যবহার করা সম্ভব ছিলো।
এরপরের মূখ্যম যে কারণটিতে হতাশ বাংলার মানুষ, তা হলো ইতিহাসের মিল না পাওয়া। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী নানান সময়ের দৃশ্যায়ন উঠে আসে ট্রেলারটিতে। ট্রেলারটির শুরুতেই দেখা যায়, বিশাল জনসমুদ্রের সামনে এসে বঙ্গবন্ধু বলছেন, “আমি বাঙ্গালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান, একবার মরে দুইবার মরেনা”। এই কথাটি বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি, স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন। যেদিন তিনি পাকিস্তান কারাগার হতে মুক্ত হয়ে প্রথম দেশের মাটিতে পা রাখেন। এটি সেই জায়গায়, যেই জায়গায় ১৯৭১ সালের ৭ ই মার্চ বঙ্গবন্ধু দীর্ঘ ১৮ মিনিটের ভাষণ দিয়েছিলেন। ১০ই জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানের সেই জায়গাতেই জাতির উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু ১৭ মিনিটের দীর্ঘ ভাষণে উল্লেখ করেছিলেন এই কথাটি।
পরের দৃশ্যগুলো আরো বেশ কয়েকটি সময়ের আভাস দেওয়া হয়। ট্রেলারটিতে দেখানো হয় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্ররা মিছিল করছে। অনেকেই মনে করছেন, এটি ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির আদলে তৈরি করা যেখানে দেখানো হয় ছাত্রদের মুখোমুখি গুলি করছে পুলিশ। কিন্তু নেটিজেনদের মতে ইতিহাস বলছে, ২১ শে ফেব্রুয়ারী ছাত্ররা প্ল্যাকার্ড বহন করেন নি। প্রথম মিছিল বের হওয়ার অন্তত ৪ ঘন্টা পর রাস্তার বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে ছাত্র জনতার সমাবেশ লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়, সেটা মিছিলে নয়। গুলি চালানোর অন্তত তিন ঘন্টা আগে মিছিল বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো।
এরপরের একটি দৃশ্যে দেখা যায় “ধানমন্ডি” কথাটি উচ্চারণ করে ধানমন্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নাম্বার বাড়িতে প্রবেশ করছেন শেখ কামাল, শেখ জামাল এবং কিশোরী শেখ হাসিনা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে শেখ পরিবার যখন ধানমন্ডির ৩২ নাম্বার বাড়িতে প্রবেশ করে, সেটি তখন দুই কামরার একতলা বাড়ি ছিলো। এরপর ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের তৎপরতায় বাড়িটি ধীরে ধীরে দোতালায় রুপ নেয়।
পরের একটি দৃশ্যে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চে জনতার সামনে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিচ্ছেন। সেখানেও রয়েছে অসামঞ্জস্যতা। ১৯৭১ সালে কর্ডলেস মাইক্রোফোন না থাকলেও সেখানে দেখা যায় কর্ডলেস মাইক্রোফোন।
পুরো ট্রেলারে দেখানো কোনো বক্তব্য নিয়ে যদি সবথেকে বেশি সমালোচনা হয়, সেটি হলো, ট্রেলারের সবার শেষ অংশে বঙ্গবন্ধুর বলা “বাংলাদেশ – ভারত ভাই ভাই”। বঙ্গবন্ধু আসলেই এমন কোনো কথা বলেছিলেন কিনা তা নিয়ে রয়েছে অনেকের সন্দেহ। তাদের দাবি, বঙ্গবন্ধু কখনোই এমন কথা বলেন নি। এটি শুধু ইতিহাস বিকৃত করে ভারতকে তোষামোদি করা।
তাহলে সত্যিটা কি?
সত্যিটা হলো, পাকিস্তান কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু মুক্ত হয়ে যখন দেশে ফেরেন, তখন জাতির উদ্দেশ্যে তিনি ভাষণ দিয়েছিলেন। সেই ভাষণে আরো অনেক কথার সঙ্গে সর্বশেষ একটি কথা যুক্ত করেছিলেন, তা হলো, “বাংলাদেশ – ভারত ভাই ভাই”। যে কেউ চাইলেই বিভিন্ন মাধ্যম থেকে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ১০ই জানুয়ারির ভাষণটি পুরোপুরি শুনে দেখতে পারেন। তাহলেই উত্তরটি পরিষ্কার হয়ে যাবে।
“মুজিবঃ একটি জাতির রুপকার” চলচ্চিত্রের ট্রেলার নিয়ে শুধুই কি সমালোচনা হয়েছে? উত্তর হলো “না”। অনেকেই আছেন যারা মনে করছেন এই ট্রেলারটি তাদের আশা পূরণ করেছেন।
যদিও শুধুমাত্র একটি ট্রেলার দেখেই পুরো চলচ্চিত্র বিবেচনা করা যায়না, তবুও ট্রেলার একটা চলচ্চিত্রের সার্বিক আভাস দেয়। তবে নেটিজেনদের এমন প্রতিক্রিয়ায় মূল চলচ্চিত্রকে এখনো আরো ভালো করা সম্ভব বলে মনে করছেন অনেকেই। নতুন করে কিছু কিছু দৃশ্য ধারণ, ভিএফএক্সে আরো একটু মনোযোগী হওয়া, আরিফিন শুভ’র নতুন করে কন্ঠ ডাব করা ইত্যাদি আরো অনেক বিষয়ে উন্নয়নের সুযোগ রয়েছে মূল চলচ্চিত্রে। তবে আলোচনা সমালোচনা যাই হোক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কে নিয়ে তৈরি করা বায়োপিক দেখার অধীর আগ্রহেই দিন কাটছে সবার। আগামী সেপ্টেম্বরে মুক্তি পাওয়ার কথা রয়েছে চলচ্চিত্রটি।