“ফাইনালে প্রতিপক্ষ হিসেবে রিয়াল মাদ্রিদকে চাই, কিয়েভ ফাইনালের প্রতিশোধ নিতে চাই” –
কথাগুলো মোহাম্মদ সালাহর। চলতি মৌসুমে লিভারপুলের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল নিশ্চিত হওয়ার পর এমনটাই বলেছেন লিভারপুলের মিশরীয় ফরোয়ার্ড সালাহ। তার প্রথম কথাটি সত্য হয়েছে। ফাইনালে তিনি প্রতিপক্ষ হিসেবে রিয়াল মাদ্রিদকে পেয়েছেন। কিন্তু ইউরোপের সবচেয়ে মর্যাদাবান আসরে স্প্যানিশ ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদের যে অবস্থান তাতে কি সালাহর হুঙ্কারে ভীত হওয়ার সময় রিয়াল মাদ্রিদ খেলোয়াড়দের হাতে আছে? সালাহর হুঙ্কারে সামিল হয়ে লিভারপুলের খেলোয়াড়েরা কি পারবে রিয়ালকে ডুবিয়ে নিজেদের ইতিহাসে সপ্তম চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিততে? নাকি যে কোন ফাইনালের ফেভারিট রিয়াল মাদ্রিদ আরো একবার স্নায়ুর লড়াইয়ে জয়ী হয়ে ইউরোপে নিজেদের অবস্থান আরো শিখরে নিয়ে যেতে পারবে? সেই অংকের হিসেবে মিলাতেই ২৮ জুন শনিবার রাত ১টায় ফ্রাঞ্চের সেঁত দেনিয়েসের স্তাদ দে ফাঞ্চ স্টেডিয়ামে মুখোমুখি হবে জার্মান বিগম্যান ইয়ের্গুন ক্লপের লিভারপুল ও ইতালিয়ান ডন কার্লো আনচেলত্তির রিয়াল মাদ্রিদ।
প্রতিশোধের পেছনের রহস্য
২০১৮ সালে ইউক্রেনের কিয়েভে বসেছিল চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনাল। ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল বর্তমান দুই ফাইনালিস্ট; রিয়াল মাদ্রিদ ও লিভারপুল।ম্যাচের বয়স তখন ৩১ মিনিট। হঠাৎ করেই রিয়াল ডিফেন্ডার সের্হিও রামোস বল দখলের লড়াই করতে গিয়ে মোহাম্মদ সালাহর হাত ধরে ফেলে দেন। রেফারির চোখে সেটি মারাত্মক ফাউল না হলেও সালাহ তার হাতে মারাত্মক আঘাত পান। মাঠে থাকার মত অবস্থা তাঁর আর ছিল না। কাঁদতে কাঁদতে মাঠ থেকে বের হয়ে যান সালাহ। সেই সাথে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতার স্বপ্নও জলাঞ্জলি দিতে হয় লিভারপুলকে।৩-১ গোলের ব্যবধানে হেরে কিয়েভে বসে মাদ্রিদের ১৩তম চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতার উৎসব দেখতে হয় সালাহ,মিলনার,হেন্ডারসনদের।
প্রতিশোধের কথা রিয়াল মাদ্রিদ কোচ কার্লো আনচেলত্তিও বলছেন। ২০১৮ সালের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল ছাড়াও ১৯৮১ সালের ফাইনালেও মুখোমুখি হয়েছিল এই দুই দল। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের নাম ছিল তখন উয়েফা কাপ।আর উয়েফা কাপের সেই ফাইনালে রিয়ালকে ১-০ গোলে পরাজিত করে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল লিভারপুল। ফাইনালের হিসেবে দুই দলই এখন ১-১ সমতা বজায় রেখেছে।প্যারিসের ফাইনাল দুই দলকেই প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। মঞ্চ প্রস্তুত; এখন দেখা যাক কার প্রতিশোধ কে নেয়?
লালে লাল লিভারপুল
এই লিভারপুল নতুন লিভারপুল। ইয়ের্গুন ক্লপ ২০১৫ সালে লিভারপুলের দায়িত্ব নেওয়া পর থেকেই বদলে যাওয়া এক লিভারপুলকে দেখছে ইউরোপ। লিভারপুলে ডাগ আউটে সাবেক বুরুসিয়া ডর্টমুন্ড বস বসার পর থেকে ইউরোপে এটা তাঁদের চতুর্থ ফাইনাল। একবার ইউরোপা লিগে আর এবারকারটা ধরে ৩ বার চ্যাম্পিয়ন্স লিগে। আগের ৩ বারের মধ্যে ফাইনালে ক্লপ শিষ্যরা শিরোপা স্পর্শ করতে পেরেছে মাত্র একবার। ফাইনাল ভাগ্য কোন ভাবেই ক্লপের অনুকূলে আসতে চায় না। এই ফাইনালে তার দল কেমন করবে সেটা নিয়েও চলছে চুলচেড়া ব্যবচ্ছেদ।
ইংল্যান্ডের কোন ক্লাব যে নজীর গড়ে নি সেই নজীর গড়ার সুযোগ এসেছিল লিভারপুলের সামনে। এক মৌসুমে চার শিরোপা জয়ের সম্ভাবনা তৈরি করলেও লিগ শিরোপা হাতছাড়া হয়ে সেই নজীর আর গড়া হচ্ছে না অল রেডসদের।তবে এখনো সুযোগ আছে ট্রেবল জয়ের। লিগ কাপ যা কার্লং কাপ নামে পরিচিত ও এফএ কাপ জয় ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। স্টিফেন জেরার্ড, কেনি ডালগ্লিশের উত্তরসূরিরা এখন ৭ম বারের মত চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের দ্বারপ্রান্তে।
চ্যাম্পিয়ন্স লিগের রাজা-বাদশাহ রিয়াল মাদ্রিদ
চ্যাম্পিয়ন্স লিগ মানেই যেন রিয়াল মাদ্রিদ আর রিয়াল মাদ্রিদ মানেই যেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। ইউরোপের সবচেয়ে প্রতিযোগিতাময় আসরে সর্বোচ্চ ১৩বারের চ্যাম্পিয়ন স্পনিশ জায়ান্ট রিয়াল মাদ্রিদ। এর মধ্যে বিগত ৭ বছরেই জিতেছে ৪ বার। রিয়ালের বর্তমান কোচ কার্লো আনচেলত্তির হাত ধরেই এসেছিল বহুল কাঙ্ক্ষিত লা দেসিমা। তরপর তার দেখোনো পথ ধরেই রিয়াল কিংবদন্তি জিনেদিন জিদান রিয়াল ডাগ আউটে বসে ২০১৬ সাল থেকে ২০১৮ সালে টানা তিনবার চ্যাম্পিয়ন লিগ জেতেন।
কার্লো আনচেলত্তি চলতি মৌসুমে আবার রিয়ালের ডাগ আউটে হেড কোচ হয়ে ফিরেছেন। তার প্রত্যাবর্তনের মৌসুমেই লা লিগা জিতেছে লস ব্লাংকসরা।এরচেয়ে বড় উপলক্ষের সামনে দাড়িয়ে তার শিষ্যরা।একের পর এক নাটকীয় জয় উপহার দিয়ে ফাইনালে পৌছেছেন করিম বেনজামা, রদ্রিগো, লুকা মড্রিচরা। প্রতিটি ম্যাচেই পিছিয়ে পড়েও শেষ মুহুর্তের গোলে জয় পেয়ে হয়ত বাড়তি আত্মবিশ্বাস পেয়েছে রিয়াল খেলেয়াড়েরা তবে এটা দলের জন্য মোটেও ভালো লক্ষণ নয়। লিভারপুল ডিফেন্ডাররা তাদের ছেড়ে কথা বলবেন না।
লিভারপুলে টিম ফর্মেশন ও ট্যাকটিকস
ক্লপের ফুটবল দর্শন মানেই আক্রমণ। ছন্দময় ও গতিময় ফুটবল উপহার দিয়ে ক্লপ জার্মানি, ইংল্যান্ড তথা ইউরোপকে মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলেছেন। তার লিভারপুল প্রতিটি ম্যাচেই প্রতিপক্ষকে তেড়ে-পুড়ে খেতে প্রস্তুত। তার ফুটবল দর্শনে দর্শক এতটাই মুগ্ধ যে ম্যাঞ্চস্টার সিটি কোচ পেপ গার্দিওয়ালা হিংসা করে বলেছেন-পুরো ইংল্যান্ড লিভারপুলকে সমর্থন করে। গার্দিওয়ালার কথায় সায় দিয়ে চেলসির কোচ টমাস টুখেল বলেন- ক্লপ যখন বুরুসিয়া ডর্টমুন্ডে ছিলেন তখন পুরো জার্মানি বুরুসিয়া ডর্টমুন্ডকে সমর্থন করতো, এখন তিনি লিভারপুলের কোচ আর পুরো ইংল্যান্ড লিভারপুলকে সমর্থন করে।
৪-৩-২-১ ফর্মেশনে দল সাজিয়ে অভ্যস্ত ক্লপ। চারজন ডিফেন্ডার নামিয়ে, মধ্যমাঠের দখল নিয়ে প্রতিপক্ষের জালে বল জড়াতে তটস্থ থাকবে মোহম্মদ সালাহ, সাদিও মানে, লুইস ডিয়াজরা।
রিয়ালের টিম ফর্মেশন ও ট্যাকটিকস
রিয়াল কোচ কার্লো আনচেলত্তি দল বাছাইতে ও ফর্মেশন সাজাতে একদম খোলামেলা । একম্যাচ শেষ হতেই পরের ম্যাচের পরিকল্পনা তিনি সংবাদ সম্মেলনই প্রকাশ করে দেন। ডাগ আউটে পোঁড় খাওয়া ও ফুটবল জ্ঞানে অভিজ্ঞ আনচেলেত্তিও ৪-৩-২-১ ফর্মেশনে দল সাজিয়ে থাকেন। নবীন ও প্রবীণ খেলোয়াড়ের এক সমাবেশ ঘটেছে রিয়াল স্কোয়াডে। বারবার অঘটন ঘটিয়ে চলতি মৌসুমের ফাইনালে উঠেছে রিয়াল মদ্রিদ, যে কোন নতুন অঘটন ঘটিয়ে দিতে প্রস্তুত মড্রিচ, রদ্রিগো, বেজামারা।
লিভারপুল টিম নিউজ ও ইনজুরি আপডেট
লিভারপুলের অভিজ্ঞ গোলকিপার অলিসন বেকার গোলবার সামলাবেন, এটা অনুমেয়। ট্রেন্ট আলেকজান্ডার আরনল্ড, জোয়েল মাটিপ, ভার্জিল ভ্যান ডাইক আর এ্যান্ডি রবার্টসনের উপর থাকবে রক্ষণের দায়িত্ব। ইব্রাহিম কোনাটে দারুণ ফর্মে আছেন বিধায় জোয়েল মাটিপের পরিবর্তে তাকেও শুরুর একাদশে নামাতে পারেন ক্লপ। এই সময়ে লিভারপুলের জার্সি গায়ে যে খেলোয়াড়টি মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন তার নাম থিয়াগো আলকানতারা। তবে লিভারপুল সমর্থকদের জন্য দুঃসংবাদ কারন ইনজুরির কারনে ফাইনালে তার মাঠে নামার সম্ভাবনা পেন্ডুলামের তাঁরের মত ঝুলছে। লিভারপুলের জন্য আরো একটি দুঃসংবাদ। থিয়োগোর পাশাপাশি ফাবিনহোর ফাইনাল খেলা নিয়েও শঙ্কা তৈরি হয়েছে। দুজনই আনফিট থাকলে হয়ত মধ্যমাঠ সামলাবেন জর্ডান হেন্ডারসন,নেবি কেইটা ও জেমস মিলনার।
রিয়াল ডিফেন্ডারদের ব্যতিব্যস্ত রাখার দায়িত্বে থাকবেন মোহাম্মদ সালাহ, সাদিও মানে ও লুইস ডিয়াজ।তবে রবার্তো ফিরমিনো ও ডিয়াগো জোটাও মাঠে নামবেন এটা বলা যায়। শুরুর একাদশে না হলেও বদলি হিসেবে। দুর্দান্ত ফর্মে থাকা লুইস ডিয়াজ ও ডিয়াগো জোটার মধ্যে কে শুরুর একাদশে প্রবেশ করেন, সেটা অবশ্য দেখবার বিষয়।
রিয়াল মাদ্রিদের টিম নিউজ ও ইনজুরি আপডেট
রিয়াল মাদ্রিদ যেন এক বাজীর ঘোড়া। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ম্যাচ বলেই যেন প্রতিটি ম্যাচেই তারা মনস্তাত্ত্বিক ভাবে এগিয়ে থাকে। রিয়াল কোচ আনচেলত্তি আগেই তার একাদশ বাছাই করে রেখেছেন বলা যায়। অভিজ্ঞ বেলিজিয়ান গোলকিপার থিবো কোর্তুয়া সামলাবেন গোলবার।ডানি কারভাহাল, এডার মিলিতাও, ডেভিড আলাবা ও ফেরলান মেন্দি থাকবেন রক্ষণের দায়িত্বে। তবে ডেভিড আলাবার ইনজুরি শঙ্কা রয়েছে। শেষ মুহূর্তে যদি আলাবা মাঠে নামতে না পাড়েন তবে ন্যাচো ফার্নান্দেস তার যায়গা দখল করতে প্রস্তুত। ম্যাচের অবস্থা বুঝে মাঠে নামতে পারেন রিয়াল অধিনায়ক মার্সেলো। রিয়ালের জার্সি গায়ে এটাই হতে যাচ্ছে তার শেষ ম্যাচ।
রিয়ালের মধ্যমাঠ অভিজ্ঞতায় টইটুম্বুর। ক্যাসেমিরো, টনি ক্রূস ও লুকা মড্রিসের একসাথে ৩টি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল খেলার অভিজ্ঞতার রয়েছে। তাঁরা শুধু ফাইনাল খেলেন নি, প্রতিটি ফাইনাল জয়ী হয়ে শিরোপা ঘরে নেওয়ার অভিজ্ঞতাও তাদের ঝুলিতে। রাইট ইউংয়ে রদ্রিগো নাকি ফেদে ভেলভার্দে এটা নিয়ে বাজি ধরা যায়।তবে লেফট ইউংয়ে ভিনিসিয়াস জুনিয়র আর ফরোয়ার্ড হিসেবে করিম বেনজামার অবস্থান পাঁকা।