স্বাধীনতা বাঙালী জাতির অবিসংবাদিত অর্জন। কিন্তু এই অর্জনের আকাশে সাংস্কৃতিক প্রেরণার মেঘখন্ড ক্রমে রাজনৈতিক চেতনার বরিষণে দেখা দিয়েছিলো। এ প্রসঙ্গে বাঙালীর ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের ধারাবাহিক সংগ্রাম ও আন্দোলনের দৃশ্যপট স্মরণে এসে দৃষ্টিসীমানাকে নানা অভিপ্রায়ে দেখার দৃশ্যলোক সৃজন করে। বস্তুত বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের সাংস্কৃতিক চেতনাই পরবর্তীকালে সময়ের দাবিতে রাজনৈতিক চেতনায় রূপ নিলে বাঙালী জাতি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক দলিলপত্রে তার স্বীকারোক্তি পাওয়া যায়। অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকভাবে বলতে গেলে, স্বাধীনতার উত্তরকালে বাঙলা নাটকের অভিযাত্রা সম্পর্কেও এরূপ কথা স্বীকার করা যেতে পারে এবং সে অভিপ্রায় আলোচ্য প্রবন্ধের মূলে অন্বিত।
বাঙলা নাটক, বিশেষ করে বাংলাদেশের নাটকের ক্রমোন্নতির কোথা যদি বলা যায়- তবে আমাদের স্বাধীনতার উত্তরকালকেই বিবেচনা করতে হবে এবং তা সঙ্গত কারণেই প্রাসঙ্গিক। বাঙলা নাটকের আদি ও মধ্যযুগ এবং স্বাধীনতা পূর্বকালের নাটক বাঙালী জাতির অস্তিত্বের সাথে খানিক হলেও অস্তিমান। এমনকি মধ্যযুগের বাঙলা নাট্যের নানা আঙ্গিক ও পরিবেশনা দর্শক-শ্রোতাকে বিমুগ্ধ করে। কিন্তু এসব নাটককে প্রায়ই আমরা লোকনাট্যের সীমায় বিবেচনা করে থাকি। তবে বাংলাদেশের নাটক-বাঙালীর অস্তিত্ব ও ধমনীর সঙ্গে তার যোগসূত্র।
বাঙলার স্বাধীনতা পূর্বকালের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এই নাট্যের অস্থিসন্ধির সঙ্গে একান্তে বাঁধা। তাকে অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই। প্রাকৃত বাঙলা নাটকের পূর্বপটভূমি ও অধ্যায়কে স্বীকার করেই আমাদের নাট্য অভিযাত্রা শুরু, বলতে হবে। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলেও স্বীকার করতে হবে, বাঙলা নাটকের উত্তর অধ্যায়ে খানিকটা মধ্যখন্ডণের দায় আমাদের কাঁধে আসে। পাশ্চাত্য প্রভাবিত প্রসেনিয়াম থিয়েটার বাঙলা নাটকের মূল ধারাকে আবছায়া দিয়ে আড়াল করতে সক্ষম হলেও শেষ পর্যন্ত সে ছায়া সরে যায়। রবীন্দ্র মহাভুবনের আলো এসে পড়ে বাঙলা নাটকের মঞ্চে ও আসরে। তবে তার ও আগে কবি-নাট্যকার মধুসূদনকে স্মরণ করতে হয়। পাশ্চাত্য রীতি অনুসরণ করেও তিনি বাঙলা নাটককে স্বকীয় সত্ত্বায় সাধনা করার পথটি খুলে দিয়েছিলেন। এমনকি বাঙলা নাটকে তিনি ব্ল্যাংক ভার্স বা অমিত্র ছন্দ প্রয়োগের সম্ভাবনার কথাও বলেছিলেন। তবে এই মহাকবির নির্দেশিত পথে আমরা চলি নি; সামান্য অনুসরণ করেছি মাত্র! সে প্রসঙ্গ থাকুক। স্বাধীনতার পূর্বকালে তবুও বাঙলা নাটকের উত্তমপুরুষরূপে আমরা জসিমউদ্দিন আসকার ইবনে শাইখ, নূরুল মোমেন, মুনির চৌধুরী, সাইদ আহমেদ প্রমুখের উপস্থিতি বাঙলা নাট্যমঞ্চে প্রবলভাবে প্রত্যক্ষ করি।
অতঃপর স্বাধীনতার উত্তরকালে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের নাটক। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, স্বাধীনতার প্রাক্কালে অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধকালে বাঙালির সাংস্কৃতিক আন্দোলন অগ্নিগর্ভে রূপ নিলে সংস্কৃতির অন্যান্য শাখার সঙ্গে নাটক অত্যন্ত গূরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ন হয়েছিল। বলতে দ্বিধা নেই, স্বাধীনতা উত্তরকালে বাঙলা নাটক যেন পূর্বধারারই একান্ত অভিজ্ঞান।
যুদ্ধবিদ্ধস্ত বাংলাদেশকে পুনর্গঠনের কাজে এ দেশের উদ্যমী তরুণদের অংশগ্রহণ সকল কর্মক্ষেত্রেই আমরা প্রত্যক্ষ করি। শিল্পসাহিত্যের অন্যান্য শাখার মতো নাটকেও তার প্রতিফলন স্বাভাবিক ঘটনা। বলা বাহুল্য, এ ক্ষেত্রে খানিক ব্যতিক্রম ঘটেছে। উদ্যম ও আয়োজন এখানেই জেনো প্রবল হয়ে উঠেছে। স্বাধীনতার উত্তরকালে বাঙলা নাটকের অর্জনও তাই অধিক বলতে হবে।
আমাদের স্বাধীনতার উত্তরকালে অনেক নিবেদিত প্রাণ নাট্য সংগঠক, নাট্যকর্মী ও নাট্যকারের আবির্ভাব ঘটেছে। গড়ে উঠেছে বিভিন্ন নাট্যদল। শুরুকালটায় সেই বেইলি রোডের নাটক পাড়ার কথা সবাই স্মরণ করে। শেখায়ের গাইড হাউজ ও মহিলা সমিতি মিলনায়তনে নিয়মিত নাটক মঞ্চায়নের পাশাপাশি সারাদেশেও নাটকের মঞ্চায়ন হয়েছে। অতঃপর ক্রমে গড়ে উঠে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন। এই ফেডারেশনের প্রধান উদ্দেশ্য সমগ্র দেশের নাট্যকর্মীদের সংগঠিত করে সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও ঐক্য গঠন করা। মঞ্চের ভাষায় মানুষের অধিকার ও মানবতার মহৎ বানী বাংলাদেশ ও সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়া। আমরা এই কাজে কতটুকু সফল হয়েছি তা কালের বিচারে একেবারে গৌণ নয়। মহিলা সমিতি ও গাইড হাউজের পুননির্মানের ক্ষণে বাঙ্লাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর জাতীয় নাট্যশালা, এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হল ও স্টুডিও থিয়েটার হলে নাটকের মঞ্চায়ন জেনো এখন নৈমিত্তিক ঘটনা। বাংলাদেশের নাটক এখন এগিয়ে চলছে। কিন্তু শুরুরকালটা অতটা সহজ ছিলোনা। নাটকের পাণ্ডুলিপি ও নাট্যকর্মীর সঙ্কট বরাবরই ছিলো। বিশেষ করে মহিলা নাট্যকর্মীর অভাব বিশেষ ভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে। এখনো আছে। কারণ, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট ও ধর্মীয় বোধে নাটক বা নাট্যাভিনয় এর ভাবনা খুব ইতিবাচক নয়। হয়তো আরো কারো আছে। তবুও নাটক হচ্ছে। বাঙলা নাটকের আদি ঐতিহ্য ঘাঁটলে দেখা যায়, সেকালে নারী চরিত্রে পুরুষ অথবা হিজড়া অভিনয় করতো। এখন সময়ে পরিবর্তন এসেছে। নাটকের অভিনয়ে পুরুষের পাশে এখন নারীগণের উপস্থিতি বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়। বাঙলা নাটক ও নাট্যমঞ্চের উন্নয়নেই তা সম্ভবপর হয়েছে।
আলোচ্য প্রবন্ধের আলোচনায় বাঙলা নাটক ও নাট্যকারগণের অবদানের বিষয়টি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। বিশেষ করে, বাংলাদেশের মৌলিক নাটক রচয়িতাগণের অবদান তো অনস্বিকার্য। এ ক্ষেত্রে নাট্যকার জিয়তা হায়দার, মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ শামসুল হক, মামুনূর রশীদ, আব্দুল্লাহ আল মামুন, সেলিম আল দ্বীন, এস এম সোলায়মান প্রমুখের অবদান ঈর্ষনীয়। উল্লেখ্য, এদের মধ্যে শেষোক্ত চারজন প্রয়াত এবং অবশিষ্ট নাট্যজনেরা জীবন্ত কিংবদন্তী। এরা নাটক রচনার পাশাপাশি প্রায় সকলে নাট্য নির্দেশনা ও নাট্য সংগঠন পরিচালনার ক্ষেত্রে বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। বাংলাদেশের নাটককে কথিত নাট্যকারগণ নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছেন; মঞ্চের গতিকে চলমান ও বহমান রেখেছেন। অভিনেতা ও মঞ্চকর্মী তৈরিতে এদের ভূমিকা আজ বহুজনবিদিত।
নাট্যকার জিয়া হায়দারের শুভ্রাসুন্দর, কল্যাণী, আনন্দ উল্লেখযোগ্য নাটক। নাট্যকার মমতাজউদ্দিন আহমদ রচিত স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম প্রভৃতি মুক্তিযুদ্ধকালের নাটক। অতঃপর স্বাধীনতার পর তিনি রচনা করেন বর্ণচোরা, কী চাহ শঙ্খচিল, স্পার্টাকাস বিষয়ক জটিলতা, হরিণ চিতা চিল প্রভৃতি।
মমতাজউদ্দিন আহমদ কৃত বর্ণচোরা নাটকে যুদ্ধোত্তর বাঙলাদেশে অপরাধীচক্রের আত্মপরিচয় গোপন রাখার কৌশলটি নাট্যগল্পের আধারে বিধৃত হয়েছে। তাঁর কি চাই শঙ্খচিল নাটকে বাঙালী বীরাঙ্গনা নারীর অন্তর্বেদনা এক আশ্চর্য শিল্পভাষায় উপস্থাপিত হয়েছে। এ নাটকে বীরাঙ্গনা রওশান আরার মনঃকষ্ট শুধু তাঁর একার নয়- তিনি যেন মুক্তিযুদ্ধে নিগৃহীত সকল নারীগণের প্রতীক। স্পার্টাকাস বিষয়ক জটিলতা নাটকে ক্রীতদাসের মুক্তি ও প্রতিবাদের কথা প্রবলভাবে উচ্চারিত হয়েছে। পঁচাত্তরের পটভূমিতে লেখা হরিণ চিতা চিল নাটকে রূপকের আবরণে তৎকালীন সময়ের রাজনৈতিক ও সামাজিক চেহারার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এই নাট্যকারের বহুল মঞ্চায়িত ও আলোচিত নাটক হলো সাতঘাটের কানাকড়ি। এ নাটকে সামরিক শাসনামলের নানা অনাচার ও অনিয়মের চিত্রটি উপস্থাপিত হয়েছে এবং এতে স্বৈরতন্ত্রের নেতিবাচক প্রভাবে সমাজ ও মানুষের অস্বাভাবিক পরিবর্তন ও অবক্ষয়ের ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। সমকালীন রাজনৈতিক চেতনার নাটক হিসেবে সাতঘাটের কানাকড়ি নাট্যকারের উল্লেখযোগ্য রচনা।
সৈয়দ শামসুল হক সামন্তবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে রচনা করেন নাটক- নূরুলদীনের সারাজীবন। এ নাটকে ঔপনিবেশ আমলের শাসন, শোষণ ও বঞ্চনার প্রেক্ষাপটে সমকালীন শাসক ও সমাজের কথাও বলতে চেয়েছেন। উক্ত নাটকে প্রতিবাদের তীব্র কণ্ঠ যে কোনো কালের সমাজপতি ও শাসকের জন্য ভীতিকর বলতে হবে। নাটকে আছে-