একটা মানুষের খোঁজ পাওয়া গেলো…

হঠাৎ করেই আলমের সাথে ইলার দেখা হয়ে গেলো। বয়সের ছাপ পরে গিয়েছে চেহারায়। আলম অদ্ভুত দৃষ্টিতে ইলার দিকে তাকিয়ে আছে। ইলা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে পাশে কাপটা রেখে আলমের দিকে তাকাতেই চোখ নামিয়ে নিলো। ইলা কি আলমের চোখে চোখ রাখতে লজ্জা পাচ্ছে!(?) হয়তো তাই। আলমও চোখ ফিরিয়ে নিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিলো।
হঠাৎ নিরতার ঘোর কাটিয়ে ইলা আলমকে জিজ্ঞেস করলো – কি করছো আজকাল?
আলম অন্যমনস্ক ছিলো, ইলার কথা আলম শুনতে পায় নি। ইলা আলমের দিকে একটু ঝুকে এসে আবার জিজ্ঞেস করলো – আজকাল কি করছো?
আলমের অন্যমনস্কতা কেটে যেতে থতমত খেয়ে আলম বললো – হু! না, তেমন কিছু না। তুমি, তুমি কি করছো?
ইলা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লো। এই প্রশ্নটা উত্তর দেয়া মত নয় মনে হচ্ছে ইলাকে দেখে। আলম চায়ের কাপটা তুলে চুমুক দিয়ে ইলার দিকে প্রশ্নের উত্তরের জন্য তাকিয়ে আছে।
ইলা একটু নড়ে চড়ে বসলো। তারা কাঠের টুলে বসেছে। টুলটা নড়বড়ে, তবে তাদের দুজনের ওজন নেয়ার মত এখন শক্ত। ইলা আলমের দিকে তাকালো, তাকিয়ে মুচকি হাসি হেসে বললো – ছোট-মোটো একটা চাকরী আর কি, রিসিপসনিস্ট।
এতক্ষণ পরে ইলার উত্তর পেয়ে আলম যেন শান্তি পেলো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আলম চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে পকেট থেকে সিগারেট বের করে দোকানের দেশলাই দিয়ে সিগারেট ধরালো।
নিরবতা পর্ব চলছে। ইলা চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে কাপটা দোকানির দিকে এগিয়ে দিলো। আলম একমনে সিগারেট টানছে। হঠাৎ ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ইলাকে প্রশ্ন করলো –
বিয়ে করেছো?
ইলা এমন প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলো না মনে হয়। আশ্চর্য দৃষ্টিতে আলমের দিকে ইলা তাকিয়ে আছে।
আলমও তাকিয়ে আছে তবে ইলার চোখের দিকে নয়, তার মাথার চুলের দিকে।
ইলার মাথার অধিকাংশ চুল পেঁকে গেছো। এটা কি বয়সের ছাপ? যেমন ছাপ তার চেহারায় ফুটে ওঠেছে! হয়তো বা হয়তো নয়। কারণ আজকাল শুধু বয়সেই চুল পেঁকে যায় না অতিরিক্ত চিন্তার ফলেও চুল পেঁকে যায়। যা হোক, ইলার সাথে আলমের পরিচয় কলেজের সময়ে। নতুন কলেজে ভর্তি হলো। কলেজে আলমের তেমন বন্ধু জোটে নি তখন। হঠাৎ একদিন আলম ক্লাসে বসে একটা মেয়ে এসে তখন আলমের পাশে বসলো। আলম বিস্মিত হলো এবং মেয়েটার কাছে কিছুটা দূরে সরে গেলো। মেয়েটা হাসিহাসি মুখ করে বললো – আমি ইলা।
আলম হাসতে পারছে না। কিন্তু নিজের পরিচয়টা দিলো – আমি আলম।
ফিক করে ইলা হেসে ফেললো। বোধয় আলমের বোকা সুলভ আচরণে ইলা বেশ মজাই পেয়েছো। ইলা হাসি থামিয়ে আলমকে জিজ্ঞেস করলো –
এরপর কি ক্লাস?
আলম অবাক হলো, এমন প্রশ্ন মেয়েটা করবে তা সে ভাবেই নি বোধয়।চোখ বড় বড় করে আলম ইলার দিকে তাকিয়ে আছে।
ইলা খানিকটা বিরক্ত হলো এবং বললো –
আরে আমার কাছে রুটিন নেই। সংগ্রহ করতে পারি নি। তোমার কাছে থাকলে দাও।
আলম ইলাকে রুটিন পেপার এগিয়ে দিলো।
এরপর নিয়মিত ইলা আলমের সাথে কথা বললেও আলম ইলাকে এড়িয়ে চলতো। অবশ্য কয়েক মাস পর থেকেই আলম ইলার সাথে বন্ধুত্ব করে। কলেজ জীবনটা ইলার শেষ হয় নি, বাবা মারা যাওয়ার পর ইলাকে সংসারের হাল ধরতে হয় পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে। বয়স্ক মা, ছোট ছোট দুই ভাই বোন। সব মিলিয়ে পড়াশুনা ছাড়তে হয় চাকরীর তাগিদে।
তারপর আর ইলার সাথে আলমের যোগাযোগ হয় নি। কেটে গেছে দীর্ঘ সময়, প্রায় দশটা বছর। আলম একটা প্রকাশনীতে চাকরী করে। আলম অনশ্য পড়াশুনা শেষ করেছে কিন্তু তাও অনার্স ভর্তি হওয়ার পর আর মন বসে নি। নিজ ইচ্ছাতেই ছেড়ে দেয় পড়াশুনা। এরপর তার ইচ্ছা জাগলো লেখালেখি করবে। নিজেকে সেভাবে তৈরীও করলো। এর মধ্যে আলম দু খানা বইও বের করেছে। ইলা চাকরী করে, রিসিপসনিস্ট এর। বেতন কেমন? আছে হয়তো মোটামুটি। এসব ভাবতে শুরু করেছে মাত্র এমন সময় ইলা বললো – আজ উঠতে হবে।
আলম ইলার দিকে ফিরে তাকালো, অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ইলা আলমের দিকে তাকালো। মুচকি হেসে বললো – আমাকে আজ উঠতে হবে।
আলমের মুখটা চুপসে গেলো। এত তাড়াতাড়ি ইলাকে হারাতে হবে তা ভাবতেই পারছে না যেন। এত বছর পর দেখা, এত তাড়াতাড়িই চলে যাবে?
আলম করুণ সুরে ইলাকে প্রশ্ন করলো – চলে যাবে!(?)
ইলা শাড়িটা ঠিক করে নিয়ে বললো – হ্যাঁ।
আলম টুল থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে প্রশ্ন করলো – কোথায় যাবে এখন?
ইলা জবাব দিলো না। উঠে দাঁড়িয়ে বললো – তুমি কোথায় যাবে?
আলম বললো – শাহবাগের দিকে যাবো।
ইলা হেসে বললো – আমি একটু মিরপুর যাবো। তাহলে তুমি যাও। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।
আলম বললো – ঠিক আছে।
ইলা চায়ের দোকান থেকে বেড়িয়ে হাটতে শুরু করলো। আলম তাকিয়ে আছে সে দিকে। খানিকক্ষণ এক দৃষ্টে তাকিয়ে থেকে আলমও হাটা শুরু করলো।

সপ্তাহখানেক ঘুরতে না ঘুরতেই ইলার সাথে আলমের আবার দেখা হয়ে যায়। আলম পার্কে বসে ছিলো। আজ তার মন তেমন ভাল নেই। সে কারণে আজ আলম প্রকাশনার অফিসেও যায় নি। সকাল থেকেই পার্কে বসে আছে ; মাঝে মাঝে উঠে দাঁড়াচ্ছে, হাটছে। আলমের মন খারাপ হলেই এখানে চলে আসে। এই জায়গাটা তার মন ভাল করার ওষুধ, বিশেষ করে প্রচুর গাছপালা থাকার দরুন এ জায়গাটা বেশ অনুভব করার মত। অবশ্য তার পাশে রাস্তা হওয়ায় গাড়ীর হর্ণে শান্ত নয় তবুও আলমের এ জায়গাটা ভাল লাগে। রাতের বেলায় তার বেইলি রোডের পথ ধরে হাটতেও বেশ লাগে। মন খারাপের দিনগুলো ছাড়াও সে মাঝে মাঝে এ পথে ঘন্টাখানেক হাটেন।
পার্কের ভেতরের পথ দিয়ে উদাসভাবে হেটে যাচ্ছিলো ইলা। যেন এ পৃথিবীতে তিনি নেই; হাটার সময় কোন দিকে তাকাচ্ছে না, দৃষ্টি নিচের দিকে ফেলে কচ্ছপ গতিতে হাটছে। ইলাকে দেখা মাত্র আলমের চোখ খুশিতে হেসে উঠলো। আলম দেরি না করে ইলাকে ডাকলো – ইলা, ইলা দাঁড়াও।
ডাক শুনে ইলা মাথা তুলে তাকালো। তাকিয়েই দেখলো আলম দৌড়ে তার কাছে আসছে। আলম ইলার কাছে এসে আগ্রহ ভরে জিজ্ঞেস করলো – তুমি এদিকে! কোথায় যাচ্ছো?
ইলা আলমের দিকে খানিক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো – কোথাও না, হাটছি।
আলম বললো – ও, আমি বসে আছি। মনটা ভীষণ খারাপ আর মন খারাপ হলে আমি এখানে আসি।
ইলা তাকিয়ে রইলো কিছু বললো না।
খানিক্ষণ নিরবতা, দুজনেই চুপচাপ। হঠাৎ নিরবতা ভেঙে আলম জিজ্ঞেস করলো – তোমার কি মন খারাপ?
ইলা আলমের প্রশ্ন শুনে করুণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে কিছু না বলে হাটা শুরু করলো। আলমও ইলার পিছু পিছু হাটতে লাগলো। হাটতে হাটতে ইলা বললো – চলো একটু বসি। বলেই ইলা বসার জন্য একটা বেঞ্চির কাছে গেলো এবং বসলো। আলমও ইলার থেকে একটু দূরত্ব বজায় রেখে বেঞ্চিটায় বসলো। আলম আঁড়চোখে ইলার দিকে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে। ইলা কেমন যেন উদাস হয়ে তারিদিক দেখছে। হঠাৎ ইলা আলমকে প্রশ্ন করলো – মন খারাপ কে তোমার?
আলম হো হো করে হেসে উঠলো। আলমের এ রকম হাসিতে ইলা আশ্চর্য হলো। পাগল নাকি? ইলা কি এমন প্রশ্ন করেছে যে এমন হাসতে হবে! আলম হাসি থামিয়ে ইলার দিকে তাকালো, ইলা আবার উদাসভাবে চারিদিক দেখছে। আলম একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বললো – আমার মন এমনি খারাপ হয়, কোন কারণের প্রয়োজন হয় না। ইলা উদাসভাবেই বললো – ওহ।
দুজনেই চুপচাপ বসে আছে। ও দিকে বিকেলের আলো তলিয়ে গিয়ে সন্ধ্যার আলো নেমে আসছে। পার্কে আজকাল বৈদ্যুতিক লাইট ব্যবহার করা হয়। সন্ধ্যা নামতে নামতেই পার্কটা আলোয় ভরে উঠলো। ইলা, আলম যে বেঞ্চিটায় বসেছে তার পাশেই একটা ল্যাম্পপোস্ট। তার মাথায় লাগানো বৈদ্যাতিক লাইটটা আলো ছড়াচ্ছে সে দিকে তাকিয়েই ইলা চোখ সরিয়ে নিয়ে হাত দিয়ে কচলাতে লাগলো। আলোর প্রকোপ বেশি, ইলা তা সহ্য করতে পারলো না। চোখ কচলাতে কচলাতে ইলা বললো – আঁধারের মানুষদের আলো সহ্য হয় না। কথাটা শুনে আলম কৌতুহলী দৃষ্টিতে ইলার দিকে তাকালো। ইলা তখনও চোক কচলাচ্ছে।

আলম মনে মনে ইলাকে ভালবাসতো তা আলম বুঝতে পারে। কিন্তু ইলার কাছে প্রকাশ করতে পারে না। কেন জানি ইলার সামনে আসলেই তার সব কিছু গুলিয়ে যায়। অবশ্য আলম কিছুটা লাজুক তবুও তো ইলার সাথে সে মিশেছে। তারা দুজন খুব ভাল বন্ধু। অথচ ইলাকে সে বলতে পারে না, ইলা তোমাকে আমি ভালবাসি। সেই কলেজে থাকার সময়ও বলতে পারে নি এত বছর পর আজও বলতে পারছে না। ইলা কিছু একটা নিয়ে বেশ চিন্তিত আলম বুঝতে পারছে কিন্তু কি নিয়ে তা আলম বুঝতে পারছে না। তার মা অসুস্থ ছিলো আগে থেকেই। ইলাকে কি তার মাকে নিয়ে চিন্তিত?
ইলার চেহারায় বয়সের ছাপ তার সাথে গভীর চিন্তা ভেসে ওঠে। আলমের চোখ তা এড়াতে পারে নি। শত হলেও আলম একজন লেখক। সমাজের কোন কিছুই লেখকের দৃষ্টির বাইরে নয়, সব কিছুই তাদের চোখে ধরা পরে।
আলম তার টেবিলে বসে আছে, সামনে একটা পাণ্ডুলিপি, নতুন বইয়ের কাজ। বেশ ব্যস্ত থাকার কথা তাকে কিন্তু আলম গা ছেড়ে বসে আছে।
এমন সময় আলমের ফোনের রিং বেজে ওঠলো।
আলম কল রিসিভ করে হ্যালো বললো। ওপাশ থেকেও হয় তো হ্যালো বললে কিছু একটা বললো। আলম তার প্রেক্ষিতে বললো – জ্বি, আমি রাতে আপনাকে মেইল করে দেবো। এবং আর্টিস্টকে দিয়ে কাল বিকেলের ভেতরেই প্রচ্ছদের কাজ করি নেবো। আপনি কোন চিন্তা করবেন না। ওপাশের ব্যক্তিকে আশ্বাস দিয়ে আলম কল কেটে ফোনটা টেবিলের ওপর রাখলো। চেয়ার থেকে উঠে বাইরে আসলো। চায়ের দোকানওয়ালাকে চা বানাতে বলে পকেট হতে সিগারেট বের করে ধরালো। চাওয়ালা চা বানিয়ে আলমের দিকে কাপ বাড়িয়ে দিলো। আলম সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে চায়ের কাপে চুমুক দিলো।

আলম অফিস থেকে বের হয়ে কাঁটাবন থেকে কাওরান বাজারের রোড দিয়ে হাটছিলো। এমন সময় দেখলো আলমের উল্টো পথ দিয়ে ইলা হেটে যাচ্ছে। আলম থমকে দাঁড়িয়ে নিশ্চিত হতে চাইছো যাকে সে ইলা মনে করছে সে সত্যিই ইলা কিনা! কিন্তু হ্যা, ওটা ইলাই। কিন্তু সে কোথায় যাচ্ছে এ পথে?
ইলার শরীর আজ যেন আরও বৃদ্ধ লাগছে। কেমন একটা ক্লান্তি ক্লান্তি ভাব ঝেঁকে বসেছে। আলম কিছুক্ষণ মনযোগ দিয়ে ইলাকে দেখে ইলাকে অনুসরণ করলো। আলম ইলার কাছাকাছি এসে তাকে ডাকলো – ইলা, ইলা! কোথায় যাচ্ছো?
ডাক শুনে ইলা থমকে দাঁড়ালো। আশ্চর্য হয়ে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো আলম তার পিছু আসছে। আলম কাছে এসে দাঁড়াতেই ইলা আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলো – তুমি!(?) তুমি এই দিকে!
আলম হাসি হাসি মুখে বললো – আমার অফিস তো কাঁটাবনেই। মাত্র অফিস থেকে বের হলাম। ভাবলাম খানিকটা সময় হাটি। তাই এই দিকে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ তোমাকে দেখে তোমার পিছু পিছু আসলাম। অনেকটা পথ হেটেছি অবশ্য।
ইলা অপ্রস্তুতের স্বরে জিজ্ঞেস করলো – এতক্ষণ তাহলে ডাকো নি কেন?
আলম ফিক করে হেসে দিয়ে বললো – তুমি একমনে হাটছিলে। বিরক্ত হও কিনা ভেবে দূর থেকে ডাকি নি। ভাবলাম কাছে গিয়েই ডাকি।
ওহ্! হাসার চেষ্টা করেও ইলা হাসতে পারলো না।
আলম এরমধ্যেই বললো -চলো চা খাই।
ইলা কি বলবে ভেবে পাচ্ছিলো না।
– আসলে, আমার একটু কাজ ছিলো। আজ চা না খাই? বলে ইলা হাসির ব্যর্থ চেষ্টা করলো। আলম বললো, ঠিক আছে। কোথাও যাচ্ছো?
ইলা জবাব দিলো – হ্যা।
আলম বললো, ঠিক আছে তাহলে যাও।
ইলা কিছু না বলেই হাটতে শুরু করলো। আলম দাঁড়িয়ে আছে। ইলা কাঁটাবনের মোড় ঘুরে শাহবাগের দিকে চলে গেলো। আলম ইলার চলে যাওয়া পথের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এনে আগের পথ ধরে হাটতে শুরু করলো।

আলম ইলাকে ভালবাসে। ইলাও আলমকে ভালবাসে। কিন্তু সেও আলমের ন্যায় আলমকে বলতে পারছে না। আজ তার আলমকে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে। ইচ্ছে হচ্ছে আলমের হাতটা আঁকড়ে ধরে বলতে – আলম, আমি তোমায় ভীষণ ভালবাসি। আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। তুমি কি চাও আমাকে বিয়ে করতে? কিংবা বলতে চায় – আলম, আমি তোমায় ভীষণ ভালবাসি। চলো? ইলা আলমের হাত ধরে টানবে। আলম আশ্চর্য হবে এবং জিজ্ঞেস করবে – কোথায় যাবো?
ইলা তখন আলমকে বলবে – তুমি আমায় ভালবাসো সে আমি জানি। আমি জানি তুমি সাহস করে বলতে পারো নি সে কথা আমায়। এও জানি তুমি আজীবন আমায় ভালবেসে যাবে কিন্তু কখনও বলবে না।
ইলার এরূপ কথা শুনে আলম মাথা নিচু করে নিবে। লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে আলম। কিন্তু তার ভাল লাগছে। ইলাকে সে যে কথা বলতে পারে নি ইলা তা বুঝে নিয়ে সে কথা বলছে। কিন্তু সে তাকে কোথায় নিতে চাচ্ছে।
তখন ইলা বলবে – চলো, কাজী অফিসে গিয়ে আমরা বিয়ে করি।
আলম রাজি হবে এবং বিয়েও করবে। কিন্তু আলম কি সুখি হবে?
ইলা আজ যে জীবন নিয়ে চলছে সে জীবন তো সুখের নয়। এ জীবনে আছে অসম্মান, দূঃখ আর লাঞ্ছনা। কিন্তু কেন সে আলমকে সে জীবনে টেনে আনবে!(?) আলমকে তো সে ভালবাসে। তাহলে কেন আলমকে এক কষ্টকর জীবনে নিয়ে আসবে। ইলা তো সে ইলা নয়, যে ইলাকে আেম ভালবাসে সে ইলা তো পাঁচ বছর আগেই মারা গেছে। আজ আলমের সামনে যে ইলা সে তো বেশ্যা পাড়ার সবচে দামি একটা মাল!
এ ইলাকে কি আলম গ্রহন করবে?
হয়তো করবো, হয়তো সম্মান দিয়ে ঘরে তুলবে কিন্তু! কিন্তু লোকে যখন আঙুল তুলে বলবে – ওই যে দেখো লেখক আলমের বউ। সে তো বেশ্যা পাড়ার সবচে দামি মাল। তখন! তখন আেম কি পারবে তাকে নিয়ে সংসার করতে?
এসব কি ভাবছে ইলা? তার ভেতর হঠাৎ আজ ভালবাসা জেগে উঠলো কেন? তার কি চাই? ভালবাসা মানে কি যা আলমের কাছ থেকে পেতে হবে? রাত গভীর হলে সায়া, ব্লাউজ খুলে ইচ্ছেমত….. সে তো অন্য সব পুরুষও করে তবে আলমকে কেন চায় সে! আলম কি অন্য সব পুরুষের চাইতে আলাদা? সে কি তার সায়া, ব্লাউজ খুলবে না? বুকে হাত দিয়ে শরীরের সমস্ত জোর দিয়ে চেপে ধরবে না?
জোর করে কি সে তার শক্ত লৌহদণ্ডটাকে…… না, সে আলমকে চায় না। আলমও সব পুরুষের মত। সুযোগ পেলে সবার মত মাল ভাববে তাকে। কেন দেখা হলো আলমের সাথে? ভাল-ই তো দিন কেটে যাচ্ছিলো। কুকুরের জিভের মত পুরুষের লকলকানি কমিয়ে দিন তো ভাল-ই কাটছিলো। তবে কেন দেখা হলো হঠাৎ আলমের সাথে?
ইলা আজকাল পুরুষদের হিংস্র জানোয়ার ভাবে। সুযোগ পেলে ই এরা ঝাপিয়ে পরে। খুবলে খুবলে শরীর খায়, খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে আবর্জনার মত ছুঁড়ে ফেলে দেয় নারীদের। আলমও তো পুরুষ, সে কেন আলাদা হবে অন্য সবার থেকে। তারও লৌহদণ্ড আছে হয়তো ইলার শরীরটা খুবলে খেতে তারও ইচ্ছা জাগে। কিন্তু প্রকাশ করতে পারে না। এসব ভাবতে পারছে না ইলা। তার খুব মাথা ধরেছে। এক কাপ কড়া লিকারে আদা চা খাওয়া প্রয়োজন। ইলা রান্না ঘরে চলে গেলো চা বানাতে।

কফি হাউস। আলম ও ইলা মুখোমুখি বসে আছে। আলমের মাথা নিচু, সামনে কফি ভরা একটি কাপ। কফিতে এখনও চুমুক দেয় নি আলম। ইলা একটু পর পর-ই কাপো চুমুক দিয়ে কফি পান করছে। একটা ছমছমে আবহাওয়া বিরাজ করছে উভয়ের মাঝে। হঠাৎ নিরবতা ভেঙে ইলা বললো – আলম তোমাকো কিছু কথা বলার জন্য ডেকেছি।
আলম যেন কিছুই শুনছে না। সে কফি হাউসে ঢুকে সেই যে মাথা নিচু করে বসেছে আর তুলছেই না।
ইলা আলমের এরূপ নিরবতায় বিরক্ত হলো। কিছুটা রেগে গিয়ে বললো – আলম তোমাকে আমি কিছু বলতে চাই। তাই তোমার অফিসে গিয়েছিলাম কাল বিকেলে। তুমি ছিলে না, তোমাদের অফিসে যে ছেলেটা ছিলো ওর কাছ থেকে তোমার ফোন নম্বর নিয়ে তোমায় কল করে এখানে আসতে বলেছি। জরুরী কথা বলার জন্যই ডেকেছি। কিন্তু তুমি চুপচাপ…..
আলম এবার মাথা তুলে তাকালো। ইলার দিকে তাকিয়ে আছে আলম। চোখের পাতা নড়ছে না। আজ ইলাকে কেমন যেন অন্য রকম লাগছে আলমের কাছে। বয়সের ছাপটা থাকলেও ইলাকে আজ কেমন যেন ফুরফুরে মনে হচ্ছে। এটা কি আলমের চোখেই লাগছে? হয়তো তাই, কারণ আলম আজ ইলাকে বলবে, যে কথাটা অনেক আগেই বলা উচিত ছিলো সে কথাটা আজ আলম বলবে।
এমন সময় হঠাৎ ইলা জিজ্ঞেস করলো – কি হলো, এমন করে তাকিয়ে আছো কেন?
আলম নিজেকে সামলে নিলো। এরপর একটু নড়েচড়ে বসে ইলাকে বললো – আমার কিছু জরুরী কথা আছে তোমার সাথে। তোমার কথা বলার আগে আমি আমার কথাগুলো বলতে চাই।
ইলা কিছুটা অবাক হলো। কি বলতে চায় আলম তাকে? কি এমন জরুরী কথা আছে আলমের তার সাথে? না, আলমের কথার চাইতে তার কথা আরও অনেক বেশি জরুরী, তাই আলমের আগেই তাকে কথাগুলো বলতে হবে।
শোন আলম……
আলম ইলাকে থামিয়ে দিয়ে বললো – ইলা আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই।
ইলা এমন কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলো না। আলমের এ কথাটা ইলাকে প্রবল ভাবে ধাক্কা দিলো। ইলা চোখ বড় বড় করে আলমের দিকে তাকিয়ে আছে। আলম ইলাকে কথাটা বলে আবার মাথা নিচু করে রেখেছে। প্রায় মিনিট দশেক দুজনে বাকরুদ্ধ হয়ে রইলে। শেষে ইলা কথা বলে রুদ্ধতা কাটালো।
আলম এটা সম্ভব নয়।
আলম মাথা তুললো। অস্ফুট স্বরে জিজ্ঞেস করলো – কেন সম্ভব নয়?
ইলা এবার মাথা নুইয়ে নিয়ে বললো – সম্ভব নয় এতটুকু জানি। তবে কারণটা জানলে আরও সম্ভব নয়।
আলম বিস্মিত হলো। কি বলছে ইলা!(?) ওর কি মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে? কি এমন কারণ যা শুনলে আরও অসম্ভব?
কারণটা কি আমি জানতে চাই। আলমের কণ্ঠে হুকুমের সুর শোনা গেলো। ইলা মাথা তুলে আলমের চোখে চোখ রাখতে গিয়েও পারলো না। চোখ সরিয়ে নিয়ে ইলা বললো – আমার জীবন আর তোমার জীবন এক হবার নয় তাই সম্ভব না।
এ কথার প্রেক্ষিতে আলম কি বললে ঠিক খুঁজে পেলো না। তবে বেশ রেগে গেলো এবং ইলাকে জিজ্ঞেস করলো – কি এমন জীবন তোমার যে জীবন আমার জীবনের সাথে এক হতে পারবে না?
ইলা আলমের প্রশ্ন শুনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো কেবল। ইলাকে চুপ থাকতে দেখে আলমের রাগ আরও বেড়ে গেলো। তাগাদা দিয়ে আলম ইলাকে প্রশ্নটা আবারও করলো। এবার ইলা আলমের দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকালো। আলমও ইলার চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ ইলার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো – বেশ্যাকে তুমি বিয়ে করতে পারবে?
কথাটা শুনে আলমের মনের পরিস্থিতি বুঝা গেলো না কিন্তু কথাটা বলার কিছুক্ষণ পর আলম চেয়ার ছেড়ে উঠতে যাচ্ছিলো। আলমকে উঠতে দেখে ইলা অট্টহাসি হেসে জিজ্ঞেস করলো – কি ঘেন্না ধরে গেলো?
আলম কিছু বললো না, কিন্তু চেয়ার থেকে পুরোপুরি না উঠে পুনরায় চেয়ারে বসে পরলো।
ইলা টেবিলের উের দিয়েই খানিকটা ঝুঁকে এসে আলমকে প্রশ্ন করলো – এখনই এত ঘেন্না বিয়ের পর যখন লোকজন আঙুল তুলে আমাকে দেখিয়ে বলবে, ওই যে দেখো বেশ্যা যায়। তখন কতটা ঘেন্না হবে?
আলম মাথ নিচু করে বসে আছে। তার নিঃশ্বাসের শব্দটি পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে না।
ইলা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো – তোমরা পুরুষরা বিয়ে করো কেন জানো? শরীরের জন্য। তোমাদের চাওয়া কেবল শরীর। এখন তোমার বড্ড ইচ্ছা আমার শরীরটা চুকচুক করে শরবতের ন্যায় গিলে খাবে। তারপর….. তারপর তৃষ্ণা মিটে গেলে হয় ছুঁড়ে ফেলবে নয় রেখে দেবে পুনরায় তৃষ্ণা মেটাতে। তোমাদের পুরুষদের আমার চেনা আছে। খুব ভাল করেই চিনি তোমাদের। নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করো আমাদের। স্বার্থ হাসিল হলে ছুঁড়ে ফেলো নয় রেখে দাও যদি আবার কোন স্বার্থ হাসিলের কাজে লাগি।
আলমের কানে ইলার সব কথা স্পষ্ট পৌছাচ্ছে না। কেমন যেন শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছে। আলমের বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না কিন্তু বসে থাকতে হচ্ছে। ইলাকে কোনভাবেই বুঝানো যাচ্ছে না, সে আর দশজন পুরুষের মত নয়। সে অন্য রকম, আলাদা। কলেজে থাকতে ইলার সাথে পরিচয়। ভালওবেসে ফেলে কিন্তু কখনও বলতে পারে নি সাহসের অভাবে। ইলাও তাকে যে ভালবাসে তা সে জানতো। কিন্তু ইলার জীবনে হয়তো এমন কিছু ঘটে গেছে যার ফলে পুরুষের প্রতি তার এত ঘৃণা। কি করবে এখন আলম? আলমের মাথা ঘুরছে, চোখে ঝাপসা দেখছে। ইলা চোখ মুছছে, সে কি কাঁদছে?
আলম নিজেকে সামলে নিয়ে ইলার হাতটা ধরলো। ইলা বিস্মিত হয়ে আলমের দিকে তাকালো কিন্তু কিছু বললো না। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আলম বললো – চলো।
কান্না মাখানো স্বরে ইলা কৌতুহলি চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো – কোথায়?
আলম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো – তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে না একজন বেশ্যাকে বিয়ে করতে পারবো কিনা! আমি একজন বেশ্যাকে বিয়প করতে পারবো। আর আমার শরীরের চাহিদা মেটাতে তোমায় বিয়ে করবো না। আমি যদি শরীরের চাহিদা মেটাতেই চাইতাম তাহলে তোমার জন্য এতটা বছর অপেক্ষা করতাম না। এতদিন যে কথা বলতে পারি নি তা আজ বলছি, আমি তোমাকে ভালবাসি। সে কলেজের জীবন থেকে। কিন্তু কখনও সাহস করে বলতে পারি নি। আমার শরীরের চাহিদা মেটানোর ইচ্ছে থাকলে তোমার অপেক্ষা না করে বিয়ে করে নিতাম অনেক আগে। আর লোকজনের আঙুল! আমি যদি বেশ্যাকে ভালবেসে সুখি হই তবে লোকের আঙুলক ভয় পাওয়ার কি আছে!(?) উঠো, তোমাকে আজই বিয়ে করবো।
ইলা কি বলবে ঠিক ভেবে না পেয়ে বললো – কিন্তু……
আলম ইলাকে থামিয়ে দিয়ে বললো – কোন কিন্তু নেই আর। আমি ইলাকে ভালবাসি। আমি তার ভালবাসাটুকু চাই, অন্য কিছু নয়। এবার চলো।
আলম ইলার হাত ধরে কফি হাউস থেকে বের হলো। বের হয়ে তারা সরাসরি কাজী অফিস গেলো এবং দুজনে বিয়ে করলো।

ছবিসূত্রঃ ROMANTIC MOMENT — PALETTE KNIFE Oil Painting On Canvas By Leonid Afremov