‘আপনার ছেলের আইকিউ ভীষণ কমে যাচ্ছে। এরকম চললে ওকে আর আমাদের স্কুলে রাখা যাবে না।’, ‘খুকু, তোমার আইকিউ অত্যন্ত কম, মন দিয়ে লেখাপড়া করো।’— কোনো শিক্ষককে অভিভাবকের প্রতি বা অভিভাবককে সন্তানের উদ্দেশে এমন উক্তি করতে আকছার শোনা যায়। বুদ্ধিকেও কি চাল–ডালের মতো মাপা যায়? হাত–পায়ের পেশির মতো বাড়ানো যায়?
বুদ্ধি এলেই ‘আইকিউ’ আসে। অবধারিতভাবে আসেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। কারণ গত একশো বছরে তিনিই সবচেয়ে মেধাবী বলে গণ্য। মাঝে মাঝেই কাগজে বিস্ময় বালকের কথা ফলাও করে ছাপা হয়। যার আইকিউ আইনস্টাইনের থেকে ঢের বেশি! সে পাঁচ বছর বয়সেই অ্যালজেব্রা কষছে, হিমালয়ের উচ্চতা, বাবরের ঠাকুরদার নাম, সূর্যের তাপমাত্রা বলে দিচ্ছে। মিনিটে ৬০ শব্দ টাইপ করে ফেলছে ইত্যাদি ইত্যাদি। ফিরিস্তি শুনে রোমাঞ্চিত হই। ‘বুদ্ধির গোড়াতে জল দাও, বুদ্ধির গোড়াতে সার দাও’ স্বর্ণযুগের গানের কলি। বুদ্ধির গোড়ায় জল–সার দিলে বুদ্ধি কি খোলতাই হয়? সত্যিই কি বুদ্ধির কোনও মাপকাঠি আছে? অনেকেই জোর গলায় বলবেন অবশ্যই আছে।
বিজ্ঞানীরা বুদ্ধি বা ইন্টেলিজেন্সকে এককথায় বলছেন, নতুন তথ্য আহরণের ক্ষমতা, অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো এবং নতুন পরিবেশে মানিয়ে চলার ক্ষমতা। এছাড়াও দক্ষতার সঙ্গে সমস্যার সমাধান, বোঝার এবং বিমূর্ত চিন্তার ক্ষমতা। বুদ্ধির মাপামাপি শুরু সেই ২২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। সে ছিল গোদা পদ্ধতি। যেমন, ১১১৫ খিস্টপূর্বাব্দে চ্যান বংশের রাজত্বকালে ঘোড়ায় চড়া, খেলাধুলো করতে পারে কিনা দেখা হত। এমন লোকও বাছাই করা হত যাকে লিখতে শেখানো যাবে। ১৮৯৬ সালে ফরাসি মনোবিদ আলফ্রেড বিনেই প্রথম সুনির্দিষ্ট বুদ্ধি মাপার পদ্ধতি বের করেন। তাতে প্রকৃত বয়স ও মানসিক বয়সের আনুপাতিক সম্বন্ধই বুদ্ধ্যঙ্ক। যে ছেলে বা মেয়ে যে বয়সের উপযোগী প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে, তাই হবে তার মানসিক বয়স। মানসিক বয়স মানসিক পরিণতি বোঝায়। তাকে প্রকৃত বয়স দিয়ে ভাগ করে ভাগফলকে ১০০ দিয়ে গুণ করলে পাওয়া যাবে বুদ্ধ্যঙ্ক বা আইকিউ। ধরা যাক, একটা ৬ বছরের ছেলে ৬ বছরের উপযোগী সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল। তাহলে ছেলেটির প্রকৃত বয়স ৬ এবং মানসিক বয়স ৬। বুদ্ধ্যঙ্ক ৬ ভাগ ৬, গুণ ১০০, অর্থাৎ ১০০। মানে ছেলেটি সাধারণ বুদ্ধিসম্পন্ন। ছেলেটির বয়স ৮ হলে সে যদি ৬ বছরের উপযুক্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে, তার মানসিক বয়স ৬। বুদ্ধ্যঙ্ক ৭৫। সে স্বল্পবুদ্ধি। একইভাবে ৮ বছরের ছেলে ১২ বছরের উপযুক্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলে বুদ্ধ্যঙ্ক ১৫০। উন্নতবুদ্ধি। ৭০–এর নিচে যাদের আইকিউ, তাদের নানা ভাগ— ২৫–এর নিচে হলে ইডিয়ট। ১৩০ থেকে ১৪০–এর মধ্যে হলেই ভেরি সুপিরিয়র। ১৪০–এর ওপরে হলে জিনিয়াস।
এ পর্যন্ত ঠিক মনে হলেও, একদল বিজ্ঞানী এর গোড়ায় গলদ খুঁজে পেয়েছেন। তাঁদের মতে, প্রক্রিয়াটা পুরোপুরি অবৈজ্ঞানিক। সব ছ বছরের ছেলের জন্য এক রকমের প্রশ্ন হওয়া সম্পূর্ণ অবাস্তব। দেশ বা রাজ্য তো দূরের কথা কোনও অঞ্চলের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য হতে পারে না।
বুদ্ধির বিকাশে দুটি জিনিসের ভূমিকা থাকে— বংশগতি (হেরেডিটি) আর পরিবেশ (এনভায়রনমেন্ট)। ইংরেজিতে নেচার আর নারচার। বংশগতি মানে সে কী ধরনের স্নায়ুতন্ত্র ও মস্তিষ্কের গঠন নিয়ে জন্মাবে। এটায় পরে কারিকুরির অবকাশ থাকে না। অন্যটি পরিবেশ। যা বদলানো সম্ভব। তাই পরিবেশের প্রভাবকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। একজনের বুদ্ধি তার আর্থ–সামাজিক ও সমাজ–সাংস্কৃতিক পরিবেশের ওপর অনেকখানি নির্ভরশীল। তাই বিভিন্ন পরিবেশে জন্ম নেওয়া বা বেড়ে–ওঠা ছেলেমেয়ের বুদ্ধি মাপার কোনো সাধারণ মাপকাঠি হওয়া সম্ভব নয়। যেমন, কোনো গরিব ছেলের কাছে চিলি চিকেন বা স্পঞ্জের রসগোল্লা কিংবা গ্রামের ছেলের কাছে ভিডিও গেম বা বিউটি পার্লার অপরিচিত হতে পারে, কোনো শহুরে ছেলের কাছে তা হয় না। সুতরাং যে পদ্ধতি বা তত্ত্ব সকলের জন্য সমানভাবে প্রযুক্ত না হতে পারে, তাকে আদৌ বিজ্ঞানিক পদ্ধতি তকমা দেওয়া যায় না। এছাড়া বয়স বা শিক্ষা অনুযায়ী কঠিন বা সহজ প্রশ্ন করে যে কারো বুদ্ধ্যঙ্ক কম বা বেশি প্রমাণ করা যায়।
আইকিউ নির্ধারণ পদ্ধতি আবিষ্কারের পর সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র বাদ দিয়ে অন্য সব রাষ্ট্রই এর সাহায্যে মানস প্রতিবন্ধী ও তার পরিমাণ নির্ণয় শুরু করে। যদিও সেই ১৯৪৬ সালেই ইউজেনিক্স রিভিউ পত্রিকা অক্টোবর সংখ্যায় বুদ্ধ্যঙ্কের ভিত্তিতে শ্রেণীবিভাগ ও সনাক্তকরণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল।
ব্রিটেন ও আমেরিকায় বুদ্ধ্যঙ্ক নিয়ে মাতামাতির পিছনে অন্য অভিসন্ধি খুঁজে পান অনেক শিক্ষাবিদ ও মনোবিদ। ‘দ্য আন্ডারগ্রাউন্ড অ্যান্ড এডুকেশন’ বইতে মাইক স্মিথ তা সবিস্তার জানিয়েছেন। দেখিয়েছেন, আইকিউকে কীভাবে ওই সব দেশে বর্ণবিদ্বেষের কাজে লাগানো হচ্ছে। ব্রিটেনে আইকিউ পদ্ধতির সাহায্যে পশ্চিম ভারতীয় ছেলেমেয়েদের নর্মাল স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে সাব–নর্মাল স্কুলে ভর্তি হতে বাধ্য করে। বার্নার্ড কোর্ড ‘হাউ দ্য ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান চাইল্ড ইজ মেড এডুকেশনালি সাব–নর্মাল ইন দ্য ব্রিটিশ স্কুল সিস্টেম’ পুস্তিকায় দেখিয়েছেন, আইকিউ পরীক্ষায় শব্দভাণ্ডার (ভোকাবুলারি) এবং রীতি (স্টাইল) পুরোপুরি শ্বেতাঙ্গ মধ্যবিত্ত শ্রেণী নির্ভর। একজন কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্র যেহেতু ওই শ্রেণীর পরিবেশ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়, তার পক্ষে যথেষ্ট বুদ্ধিমান হওয়া সত্ত্বেও উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। কোর্ড তথ্য–প্রমাণ সহ এও দেখিয়েছেন প্রশ্নকর্তা শ্বেতাঙ্গ হলে একজন কৃষ্ণাঙ্গ যে ফলাফল করে কৃষ্ণাঙ্গ শিক্ষক করলে তার থেকে অনেক ভাল করে।
মার্কিনিদের মধ্যে অনেক কুসংস্কারের সঙ্গে বর্ণভেদও আছে। আর তারা তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে নানা কুযুক্তিও হাজির করে। জাতিভেদপন্থীরা মনে করে, একটা জাতি জন্মগতভাবে ও জৈবনিকভাবে (বায়োলজিক্যালি) অন্য জাতিদের থেকে নিম্নতর। কালোরা কখনই সাদাদের সমতুল নয়। আর্থার জেনসনের মতো বিজ্ঞানীরা আইকিউ পরীক্ষাকে হাতিয়ার করে ‘বৈজ্ঞানিক জাতিতত্ত্ব’ খাড়া করতে চেষ্টা করেছেন। তবে বিভিন্ন দিক থেকে চাপ আসার ফলে ব্রিটেন ও আমেরিকায় অবৈজ্ঞানিক এই পদ্ধতির গুরুত্ব কমানো হচ্ছে। নিউ ইয়র্কে কোনো ছাত্রের রেকর্ড বইতে তার আইকিউ লেখা আইনত নিষিদ্ধ। সান ফ্রান্সিকোতে কৃষ্ণাঙ্গ ছেলেমেয়েদের আইকিউ পরীক্ষার ভিত্তিতে মানসিক প্রতিবন্ধীদের শ্রেণীতে ভর্তি করাও বন্ধ। ক্যালিফোর্নিয়াতেও আইনি নজরদারি আছে।
শুরুর কথায় ফিরি। যে সব বিস্ময় বালকের কথা কাগজে পড়ি, টিভিতে দেখি, মজার কথা, বড় হয়ে ওঠার পর তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায় না। একটা উদাহরণ পেশ করি। দক্ষিণ কোরিয়ার কিম উং ইয়ং মাত্র চার বছর আট মাস বয়সেই ইন্টিগ্রাল ক্যালকুলাসের তাবৎ অঙ্ক কষে ফেলতে পারত। ওর ইন্টেলিজেন্ট কৌশন্ট সংক্ষেপে আইকিউ (বুদ্ধ্যঙ্ক) ২১০। সেখানে আইনস্টাইনের নাকি মাত্র ১০৪। যা সাধারণ বুদ্ধির বালকদের থাকে। কিমের জন্ম ১৯৬৩ সালে। তারপরে এতগুলো বছর কেটে গেছে। সেই বহুল ব্যবহৃত ‘অতঃ কিম, ঘোড়ার ডিম!’ ক্রিস্টোফার হিরাটার তো আইকিউ ২২৫! ৮০–৯০–এর দশকে মৌসুমি নামে একটি মেয়েকে নিয়ে ব্যাপক শোরগোল উঠেছিল। তারা সব কোথায়! আইনস্টাইন আছেন স্বমহিমায়।
জল–সার দিলে বুদ্ধি খোলতাই হয়!
Loading books...