ভৌতিক গল্প: ‘শেওরা গাছ’

ঐশিক । একজন কলেজ ছাত্র । টিউশনি করে পড়া শোনার খরচ চালায় । বাবা দিন মজুর । সেই জন্যে দিনে ও রাতে অনেকগুলো টিউশনি করতে হয় তাকে । এতে নিজের খরচ চালিয়েও কিছু টাকা সংসারে খরচ করতে পারে সে ।

এদিকে আজ একটা নতুন টিউশনিতে যোগ দেয়ার কথা আছে ও পাড়ার মাতবর বাড়িতে । সময়টা রাতের বেলা । ৯ টা থেকে ১০ টা পর্যন্ত । কাজেই নয়টা বাঁজার ২০ মিনিট আগে নিজের পুরণো জরাজীর্ণ সাইকেলে চেপে রওনা দিল ঐশিক । সারাদিন এত খাটা খাটনির পর এ সময়টা একটু জিরুতো সে । কিন্তু এখন থেকে এ সময়টাও বরাদ্ধ হয়ে গেল । কি-ইবা করার আছে ? তার যে টাকার দরকার ! সামনে ফাইনাল পরীক্ষা । বেশ কিছু টাকা খরচ হবে তাতে । তাই ইচ্ছে না থাকলেও টিউশনিটা নিতে হল ।

সাইকেলটা চলিয়ে অনবরত ছুটে চলছে ঐশিক । মাতবর বাড়ি আর বেশি দূর নয় । ঐ যে বড় শেওরা গাছটা দেখা যাচ্ছে সেখানেই । ওটা বহুকাল আগের গাছ । দশ গ্রামে এর মত এত পুরণো গাছ আর একটাও নেই । তবে গাছটিকে নিয়ে একটা গুজব রয়েছে । সেখানে নাকি মরা মানুষের আত্মারা দল বেঁধে বাস করে । যারা নানা কারণে বিভিন্ন সময়ে অপমৃত্যুর শিকার হয়েছে কেবল তাদের আত্মারাই না-কি থাকে ওখানে । তবে সহজে মানুষের কোন ক্ষতি এরা করেনা । তবুও রাতের বেলা এ পথ দিয়ে যেতে লোকেরা ভয় পায় । এইতো গত মাসে মাতবর বাড়ির বছুরে কাজের ছেলেটার লাশ পাওয়া গিয়েছিল গাছের মগডালে বিশ্রীভাবে ঝুঁলা অবস্থায় । যার চোখ দুটো উপড়ানো আর ঘারটা মটকানো ছিল । এ নিয়ে মোট ২০ জন মরল ঐ গাছের ভূতেদের রোষানলে পড়ে ।

বছুরে ছেলেটার কথা মনে হতেই বুকের ভিতরটায় কেমন যেন একটা ধুক ধুকানি আর ফুক ফুকানি শুরু হল ঐশিকের । গলাটা মনে হয় শুকিয়ে গেছে । ঘন ঘন ঢোক গিলছে ও । গাছটার কাছাকাছি আসার পর সাইকেলের পেডেলে যেন কিছুতেই পা পরছেনা আর । খালি মনে হচ্ছে কেউ যেন পিছন থেকে জোর করে টেনে ধরেছে সাইকেলটা । ভয়ে সারা গা ঘামে ভিজে গেল তার । তবুও জোর করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে ও । এমন সময় কেউ একজন বলে উঠল , কে রে তুই ? কথাটা শুনে ধপাস করে সাইকেল থেকে পড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল ও ।

যখন জ্ঞান ফিরল , দেখতে পেল মাতবর সাহেবের ছোট্ট মেয়েটি তার পাশে বসা । কিছুই বুঝতে পারলনা ঐশিক । জিজ্ঞেস করল , আমার কি হয়েছে ? মেয়েটি বলে উঠল , আপনি জ্ঞান হারিয়ে আমাদের শেওরা গাছের তলায় পড়েছিলেন । সেখান থেকে আব্বু আপনাকে ঘরে আনিয়েছেন । বেশ ভয় পেয়েছিলেন ! না ? ছোট্ট মেয়েটির কাছে নিজের ভীরুতাকে আড়াল করতে ঐশিক একটু সাহস সঞ্চয় করে জবাব দিল , ভয় ! কিসের ভয় ? কেন ভয় ? আমি ভয় পাইনিতো ! – তাহলে ওভাবে জ্ঞান হারিয়ে পড়েছিলেন কেন ? – আসলে হঠাত্ করে শরীরটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল কি না ! – বেশ । আপনি এখন বিশ্রাম নিন । আমি এবার যাই । – সে কি ! আমাকে বাড়ি ফিরতে হবেনা ? – কোনই প্রয়োজন নেই । বাবা আপনাদের বাড়িতে খবর পাঠিয়ে দিয়েছেন , আজ আপনি আমাদের এখানেই থাকবেন । ও হ্যা । মা আপনার জন্য টেবিলে খাবার রেখে দিয়েছেন । এখনি খেয়ে শুয়ে পড়ুন । অনেক রাত হয়েছে ।

মেয়েটি চলে গেলে টেবিলের উপর ঢেকে রাখা খাবারের দিকে একবার তাকাল ঐশিক । এরপর মেয়েটির কথাগুলো মনে করে হেসে উঠল সে । বাব্বা ! কত পাকা মেয়েটা ! সবে ক্লাশ ফাইভে পড়ে , আর এখনি এত সুন্দর কথা বলতে পারে ! একে নাকি আবার তাকে পড়াতে হবে ! যাই হোক , আর বেশি দেরি না করে খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়ল ও ।

বাড়ির সবাই অঘোরে ঘুমুচ্ছে এখন । ঐশিকও ঘুমুচ্ছে আপন মনে । হঠাত্ একটা চিকন হাসি আর কান্নার সংমিশ্রিত শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গেল তার । ঘুম চোখে ঘরিটার দিকে তাকাতেই দেখতে পেল সময় এখন তিনটা পাঁচ । এরপর যেই কিসের শব্দ হল তা জানার জন্য মাথাটা একটু উঁচু করে তাকাল । ওমনি হতভম্ব হয়ে গেল ! একি ! এ কোথায় শুয়ে আছি আমি ! এ যে শেউরা গাছের সেই মগডালটা ! যেখানে দুর্ভাগাদের লাশ হয়ে ঝুলে থাকতে হয় ! কাজেই নিজের দশা আঁচ করতে পেরে যত দোয়া দুরুদ জানা ছিল এক এক করে খই ভাঁজার মত সব আওড়াতে লাগল সে ! কিন্তু কিছুতেই মাথায় আসছেনা , সে এখানে কি করে এল !

এদিকে একটু পরে শোঁ শোঁ শব্দ করে মেকি কান্নার সুর তুলে কতগুলো সাদা ছায়া এগিয়ে আসতে দেখল ঐশিক । এই বুঝি এখনি ঘাড় মটকে দেবে তার । আর বুঝি শেষ রক্ষা হল না ! এখনি বুঝি দুনিয়ার মায়া ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমাতে হবে ! ভাবতেই আবার জ্ঞান হারিয়ে মগডাল থেকে ধপ করে পড়ে গেল সে ।

একটু পরে আবার জ্ঞান ফিরে এলে দেখতে পেল মাতবর সাহেব আর তার স্ত্রী পাশে বসা । ঐশিক কিছুই বুঝতে পারলনা এসব কি হচ্ছে তার সাথে । বলে উঠল , আপনারা ? মাতবর সাহেবের বউ জবাব দিল , ভয় পেয়েছ বাবা ? ঐশিক হা করে চেয়ে রইল মুখের দিকে । এর মধ্যে মাতবর সাহেব বলে উঠলেন , ভয়ের কিছু নেই বাবা ! তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমুও । আমরা তোমার পাশেই আছি । কথাটা শোনার পর আপনা আপনিই যেন দুচোখের পাতা ঘুমে ভুঁজে গেল ঐশিকের ।

এদিকে ফজরের আযানের সুমধুর সুর কানে আসতেই ঘুম ভেঙে গেল তার । জেগে দেখে বিছানা ছেড়ে মেঝেতে পড়ে আছে সে । সাথে সাথে মনে পড়তে লাগল ঘটনাগুলো । আসলে ও এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল । গত রাতে মনে হয় দোয়া দরুদ পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে ঘুমানো হয়নি । তাই এমন বাজে স্বপ্ন দেখা হয়েছে । যেদিনই দোয়া পড়তে ভুল হয় , সেদিনই একটা না একটা বাজে স্বপ্ন দেখে ও ।

ফজরের নামায পড়ে নিজের রুমে এসে একটা বই নিয়ে পড়ার চেষ্টা করেও পড়তে পারল না ঐশিক । মনে পড়ে গেল গ্রামের সেই মাতবর ফ্যামিলির কথা । যাদের একমাত্র মেয়েকে প্রাইভেট পড়াতো সে । সত্যিই খুব খারাপ লাগল তার । এভাবে যে একটা ফ্যামিলি একসাথে নৃশংস ভাবে খুন হবে কেউ কখনো ভাবতে পারেনি । তবুও এটাই বাস্তবতা । অবিশ্বাস করার কোন জোঁ নেই ।

অনেকদিন হয় ঐশিক বাড়ি যায়না । আজ তাই ঠিক করল একবার ঘুরে আসবে । দেখে আসবে চির চেনা সেই শেওরা গাছটিকে । তাহলে হয়তো একটু ভাল লাগবে ওর । কিন্তু বাড়ি এসে যা জানতে পারল , তাতে একেবারে নিরাশই হতে হল তাকে । গত কদিন আগে নাকি সরকারি লোকেরা গাছটিকে কেটে দিয়েছে । ওখানে নাকি এখন সরকারি রেস্ট হাউজ তৈরি হয়েছে । তাই আর শেওরা গাছটিকে দেখা হলনা তার । মন খারাপ করেই ফিরে আসতে হল শহরে ।