ক্রমাগত নির্যাতন নিপীড়ন সহ্য করে আসা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ধীরে ধীরে অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে সরব হতে থাকে। ৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান এরপর যখন ৭০এর সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাহার করে পাক সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করতে গড়িমসি শুরু মূলত তখুনি বাঙালীর মনে এই ধারণা দৃঢ় হয়ে যায় যে স্বাধীনতা ছাড়া আর মুক্তির কোন পথ খোলা নেই। আর এরপরেই বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চ এর সেই কাব্যিক ভাষণ উজ্জীবিত করে তুলে সারা বাংলার মানুষজনকে। অনেক ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে সময়। ২৫ মার্চ মধ্য রাতে নেমে আসে ইতিহাসের বর্বরতম নারকীয় হত্যাকাণ্ড। গ্রেপ্তার করা হয় বঙ্গবন্ধুকে। ততকালীন পাকিস্তান সরকার মনে এবার নিশ্চয় বাঙালি চুপ করে যাবে। নিরবে মেনে নিবে তাদের অন্যায় অবিচার। কিন্তু হিতে বিপরীত হয় তাদের জন্য। রুখে দাঁড়ায় বাংলার মানুষজন। এতদিন শান্তভাবে প্রতিবাদ চালিয়ে আসা বাংলার দামাল ছেলেরা অস্ত্র তুলে নেয় হাতে। শুরু হয় স্বাধীনতা সংগ্রাম। আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।
আমাদের গর্বের এই স্বাধীনতা সংগ্রাম আর এর ঘটনা প্রবাহ লেখা হয়েছে প্রচুর বই।স্বাধীনতা সংগ্রামকে জানার, বুঝার এবং উপলদ্ধি করার জন্য সেইসব বইয়ের গুরুত্ব অপরীসীম। আজকের খিচুড়ির আয়োজনে তাই আমরা তুলে ধরছি সেইসব বই থেকে নির্বাচিত ২৬টি বই।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনেড় ঘটনাপ্রবাহ আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসের সাথে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সম্পৃক্ত। ১৯৪৮, ১৯৫৪,১৯৬৬, ১৯৬৯, ১৯৭০ এর সময়ের বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহ নিয়ে লেখা মুনতাসীর মামুন রচিত বইটি বাংলাদেশ জন্মের ইতিহাস নিয়ে লেখা বইগুলোর মধ্যে অন্যতম।
বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী এবং বঙ্গবন্ধুর অবর্তমান মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা ও সংগঠনের অন্যতম প্রধান নেতা তাজউদ্দিন আহমদ। তপন কুমার দে রচিত এই বইটিতে বাংলাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের আগে ও সংগ্রাম চলাকালীন সময়ে তাজউদ্দিন আহমদ এর অবদান ও তার জীবনের বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরা হয়েছে।
প্রথিতযশা কবি ও লেখক সুফিয়া কামাল। একাত্তরের ডায়েরী মূলত ১৯৭০ এর ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ এর ডিসেম্বত অবদি কবি সুফিয়া কামালের ডায়েরিতে লেখা ঐ সময়ে ঘটে চলা বিভিন্ন ঘটনা এবং ঘটনা সম্পর্কে তাঁর নিজের অভিব্যক্তি তুলে ধরা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ঘটে যাওয়ার অসংখ্য ঘটনার অন্যতম দালীলিক প্রমাণ এই বইটি।
মুক্তিযুদ্ধ কোন একক ঘটনা নয়। যুদ্ধকালীন সময়ে পুরো বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে অসংখ্য খন্ড যুদ্ধের মাধ্যেমে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা ছিনিয়ে এনেছিলেন আমাদের স্বাধীনতা। এই বইটিতে এমনি বিশটি ভয়াবহ খন্ড যুদ্ধের ঘটনা প্রবাহ তুলে ধরা হয়েছে।
একদিকে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার শাসন, অন্যদিকে একটি জনগোষ্ঠীর জেগে ওঠা। স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলন, ঊনসত্তরে গণ-অভ্যুত্থান এবং একাত্তরে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। শিকল ছিঁড়ে জন্ম নিল নতুন জাতিরাষ্ট্র, বাংলাদেশ। কিন্তু জন্মলগ্নেই দেশটি পড়ে গেল রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তে। তারুণ্যের স্বপ্ন, আকাশছোঁয়া আকাঙ্ক্ষা এবং সনাতন ধ্যানধারণার সঙ্গে বিরোধ জন্ম দিল সংঘাতময় রাজনীতির।
এটি ওই সময়ের একটি বয়ান। কৈশোর-তারুণ্যের সন্ধিক্ষণে লেখক ওই সময়টিকে দেখেছেন, উজানস্রোতে ভাসিয়ে দিয়েছেন নিজেকে। এই বইয়ে তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর দেখা, শোনা ও জানা ঘটনা ও মানুষের কথা। কালো অক্ষরে এঁকেছেন জীবনের গল্প।
আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গুরুত্ব ছিল অপরীসিম। অত্যন্ত সাহসীকতার সাথে প্রচন্ড ঝুকি মাথায় নিয়ে কিছু বীর বাঙ্গালী অনর্গল প্রচার করে গেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জিবীত রাখার জন্য একের পর এক অনুষ্ঠান। এই বইটিতে সেই সময়ে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্র এবং এর সম্প্রচারের কাজ নিয়োজিত অকুতোভয় মানুষের কথা তুলে ধরা হয়েছে।
৮ নম্বর থিয়েটার রোড, কলকাতা। একদা অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনের বিলাসবহুল বাড়ি। কিন্তু ভবনটি কোনো সরকারের সচিবালয়ের জন্য যথেষ্ট বড় নয় মোটেও। তার পরও ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, অর্থমন্ত্রী এম মনসুর আলী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামারুজ্জামানের কার্যালয় ছিল এই ভবনেই। এখান থেকেই পরিচালিত হয়েছে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার, যা মুজিবনগর সরকার হিসেবে পরিচিত। সেই মুজিবনগর সরকারের কেন্দ্রে থেকে মুক্তিযুদ্ধকে প্রত্যক্ষ করার বিরল অভিজ্ঞতার কিছু দিক তুলে ধরা হয়েছে এ বইয়ে। পাশাপাশি সেদিনের ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহের প্রাসঙ্গিক বিশ্লেষণও করা হয়েছে।
‘দীর্ঘ ছত্রিশ বছর পর মস্তিষ্কের স্মৃতিকোষে লুকিয়ে রাখা পাক সেনাবাহিনী দ্বারা সংঘটিত একটি নির্মম ও অবিশ্বাস্য গণহত্যার প্রত্যক্ষ বিবরণ লিখতে বসেছি….’ এ কথা নির্মলেন্দু গুণ-এর। এ কাহিনী একাত্তরের।
মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত অন্যসব বইগুলোর থেকে এই বিশেষত হচ্ছে এই বইটি যিনি লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠন, সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে যোগদান এগুলোর কোন কিছু সাথেই জড়িত ছিলেন না। একজন সাধারণ মানুষের চোখে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের চালচিত্র পাওয়া যাবে এই বইটিতে।
এই বইটি কোন ইতিহাসের বই নয়। বইটিতে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রথিতযশা লেখকদের গল্প একসাথে সংকলিত করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ ও তখনকার সময়ে মানুষজনের জীবনযাত্রা গভীরভাবে অবলোকের সুযোগ পাওয়া যাবে সেইসব গল্প গুলোতে।
একাত্তরের ঢাকা বইটি মূলত একটি সংকলন গ্রন্থ। বইটিতে মুক্তিযুদ্ধকালী ও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের বিভিন্ন স্মৃতিচারণ তুলে ধরা হয়েছে।
শহীদ জননী জাহানারা ইমাম এর লেখা এই বইটি এ যাবতকালের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে শ্রেষ্ঠ বইগুলোর মধ্যে অন্যতম। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ঘটে চলা বিভিন্ন ঘটনা, মৃত্যু, বিয়োগ, বিষাদ তথা যুদ্ধের ভয়াবহতা এবং সেটাকেও ছাপিয়ে যাওয়া দেশপ্রেম মূর্ত হয়ে উঠেছে এই বইটির প্রতি পাতায় পাতায়।
একাত্তরে রণাঙ্গনে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের লেখা চিঠিসমূহের সংকলন এই বইটি।
মতামত জানান