বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তিঃ ঋত্বিক কুমার ঘটক

যদি কোন দিন সিনেমার চেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম আসে সেদিন সিনেমাকে লাথি মেরে সেখানে চলে  যাবো। আই ডোন্ট লাভ ফিল্ম।

-ঋত্বিক কুমার ঘটক

পৃথিবীর ইতিহাসে পারমানবিক আগ্নেয়াস্ত্র আবিষ্কার হয়েছিলো ১৯৪৬ সালের ১৬ই জুলাই আর বাংলা ও বাঙ্গালীর ইতিহাসে একজন ঋত্বিক কুমার ঘটক জন্ম গ্রহন করছিলেন ১৯২৫ সালের ৪ই নভেম্ভর, ঢাকা, বাংলাদেশে। গায়ে পাঞ্জাবি, কাঁধে শান্তিনিকেতনী ঝোলা, সদা খোঁচা দাড়ি, আর কালো ফ্রেমের লেন্সের ঝাপসা চোখের নিম্নমধ্যবিত্ত চাঁদরে আবৃত ঋত্বিক। মদ হাতে প্রায় বলতেন” আমি এক মাতাল, ভাঙ্গা বুদ্ধিজীবী, ব্রোকেন ইন্টেল্যাকচুয়াল। কাটার ঊর্ধ্বে কেবল ফুলই হয় সুন্দর যেমন, তেমন বিচিত্র ছিলেন উনার জীবনযাপন চলাচল আর কাজের মধ্যকার সম্পর্ক। চোখ থেকে চশমার দূরত্ব যতটুকু ঠিক ততোটুকু দূরত্বেই বরাবর জীবকে দেখতে চেয়েছিলেন তিনি। তার প্রতিচ্ছবিও দেখা গিয়েছে উনার সকল সৃষ্টিতে। বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৫০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে এমএ কোর্স শেষ করলেও পরীক্ষাটা আর দেওয়া হয়ে ওঠেনি উনার। উনার বড় ভাই মনীশ ঘটকও ছিলেন খ্যাতনামা লেখক।

উনার বাবাও লিখালিখির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। সেখান থেকেই সাহিত্য চর্চার পোকাদের সাথে মোটামুটি বসবাস করা শুরু উনার। ৪৭ এর ভারত ভাগের পর সপরিবারে কলকাতা যেতে বাধ্য হয়। নিজ মাতৃভূমি ত্যাগ করে শরণার্থী হবার মর্মবেদনা উনি কোনদিনই ভুলতে পারেননি, সেই ছাপ উনার জীবন দর্শন এবং উনার পরবর্তী সৃষ্টিতে ফুটে উঠেছে। কলকাতায় এসে যোগ দেন পিপলস থিয়েটারে। তখন পিপলস থিয়েটারই ছিল ভারতের সবচেয়ে জীবন্ত থিয়েটার। সেই থিয়েটারের পশ্চিমবঙ্গ ভিত্তিক সংগঠনে ছিলেন ঋত্বিক কুমার ঘটক। লিখালিখির পোকাদের সাথে জীবন যাপন আস্তে আস্তে স্ব-বন্ধুবান্ধবে পরিণত হতে শুরু করে। অভিনয়ের পাশাপাশি নাটক লিখা শুরু করলেন। যোগ দিলেন সাম্রাজ্যবাদ এবং ব্রিটিশবিরোধী নাট্য আন্দোলনে। আস্তে আস্তে লিখালিখির চেয়ে নাটকে বেশি ঝুঁকে পরলেন উনি, উনার যুক্তি ছিলো গল্প পড়ার চেয়ে মানুষ নাটক বেশি দেখে।

উনার সৃষ্টিকে জনমানুষের বিশাল গভীরতায় পৌঁছে দেয়ার প্রবণতা উনার বরাবরই ছিলো। লিখেছেন কত ধানে কত চাল, ইস্পাত, জ্বলন্ত এর মত অসাধারণ সব নাটক। নির্দেশনাও দিয়েছেন জ্বলা(১৯৫১),দলিল(১৯৫১) এর মত উল্লেখযোগ্য নাটক। দলিল ছিলো দেশভাগের ফলে বাংলা দু’ভাগ হয়ে যাওয়া সাধারণ মানুষের দুঃখ ভারাক্রান্ত ও বিচলিত হওয়া দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে। জ্বালা ছিল ঋত্বিকের নির্দেশনায় সর্বশেষ নাটক যেটা তিনি পরিচালনা করেন ১৯৫৭ সালে। তার কিছুদিন পরেই চিদানন্দ ও সত্যজিৎ রায়ের সৃষ্ট কলকাতা ফিল্ম সোসাইটির বদৌলতে তিনি ডি সিকার বাইসাইকেল থিভস এবং আকিরা কুরোসাওয়ার জাপানি ফিল্ম রশোমন এর মতো ফিল্মগুলো দেখার সুযোগ পান। এরপর তিনি উপলব্ধি করেন যে হয়তো  নাটকের চেয়ে সিনেমাতে উনি উনার গল্পগুলোকে বেশি মানুষের কাছে পৌছাতে পারবেন। তার ভাষ্য মতে” ছবি মানুষ দেখে। ছবি দেখানোর সুযোগ যতদিন থাকবে ততদিন ছবি দেখানোর জন্য আর নিজের পেটের ভাতের জন্য ছবি করবো। কালকে বা দশ বছর পরে যদি সিনেমার চেয়ে ভালো কোন মিডিয়াম বেরোয় আর দশ বছর পর যদি আমি বেঁচে থাকি, তাহলে সিনেমাকে লাথি মেরে আমি সেখানে চলে যাব।

 

ঋত্বিক ঘটক একজনই

সিনেমার প্রেমে নেশায় আমি পড়িনি। আই ডু নট লাভ ফিল্ম।’এখন প্রশ্ন হতে পারে, তিনি ফিল্ম ভালোবাসেন না কিন্তু শিল্পচর্চার মাধ্যমে অধিক মানুষের কাছে পৌঁছানোর তাঁর এই তাগিদের উদ্দেশ্যটা কি? এই বিষয়ে ঋত্বিকের মতামত ছিলো, ‘প্রতিবাদ করা শিল্পীর প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব। শিল্প ফাজলামি নয়। যারা প্রতিবাদ করছে না তারা অন্যায় করছে। শিল্প দায়িত্ব, আমার অধিকার নেই সে দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার। শিল্পী সমাজের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। সে সমাজের দাস। এই দাসত্ব স্বীকার করে তবে সে ছবি করবে।’ তিনি ছিলেন ছিলেন স্ফটিকের মত স্বচ্ছ আয়না। যে আয়নায় সমাজ জীবনের মানুষ তাদের স্পষ্ট চেহারা দেখতে পেতো। হয়তো  তখনকার সমাজের কিছু মানুষ তাদের ঐ চেহারাকে এতটা পরিষ্কার দেখতে ভয় পেত। তা উনার প্রথম সিনেমা “নাগরিক” থেকেই বোঝা যায়, যদিও উনার জীবদ্দশায় এই সিনেমা মুক্তি পায় নি। মুক্তি পাওয়া উনার প্রথম ছবি ছিলো “অযান্ত্রিক”। অভাব-অনটন ঝোলায় নিয়েও তৈরি করেছেন মেঘে ঢাকা তারা, যুক্তি তক্ক গপ্প, বাড়ি থেকে পালিয়ে, তিতাস একটি নদীর নাম এর মত কালজয়ী সিনেমা।অযান্ত্রিক এর সময় থেকে ঋত্বিকের অল্প অল্প মদ্যপানের শুরু।১৯৬২ সালে বানালেন স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র সিজর্স, ১৯৬৩ সালে ডকুমেন্টরি ওস্তাদ আলাউদ্দীন খান। এই সময় বগলার বঙ্গদর্শন নামে একটি সিনেমার কাজ শুরু করলেও আর শেষ করতে পারেননি। কোমল গান্ধার ফ্লপ হওয়াটা ছিল কফিনের শেষ পেরেক।

১৯৬৫ সালের দিকে বাংলা মদ ধরলেন, এমনকি গোসল করাও ছেড়ে দিলেন। তাঁর এমন জীবনযাত্রার ফলে অতিষ্ঠ হয়ে তাঁর স্ত্রী ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাবার বাড়ি চলে যেতে বাধ্য হলেন। মদ্যপান নিয়ে একটা মজার ঘটনা প্রচলিত আছে। এক রাত্রে ঋত্বিক ফিরছেন, ঠিক হেঁটে ফেরার অবস্থায় নেই তখন আর। ট্যাক্সি, অগত্যা, পকেটে পয়সা না থাকা সত্ত্বেও।-ভাড়া, স্যার…’‘আমার কাছে টাকা নেই। তুমি এক কাজ কর – এখান থেকে সোজা ১/১ বিশপ লেফ্রয় রোডে চলে যাও। সেখানে গিয়ে দেখবে, একটা ঢ্যাঙা লোক দরজা খুলবে। ওকে বোলো, ঋত্বিক ঘটক ট্যাক্সি করে ফিরেছে, সঙ্গে টাকা ছিল না। ও টাকা দিয়ে দেবে।’সেই দীর্ঘকায় ব্যক্তি, যা শোনা যায়, সেইবার, এবং এরপর বার বার, ভাড়া মিটিয়ে দিয়েছিলেন। ঋত্বিক তাঁকে উত্ত্যক্ত করতেন, কিন্তু মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করতেন, ‘ভারতবর্ষে সব থেকে ঠিকঠাক ক্যামেরা বসাতে জানে ঐ ঢ্যাঙা লোকটাই।’ তারপর অবিশ্যি যোগ করতেন, ‘আর হ্যাঁ, আমি খানিকটা জানি।’দীর্ঘকায় ব্যক্তিটি, যার মতে সিনেমার সম্ভাব্য কোন বিষয় নিয়ে লিখতে বাদ রাখেননি ঋত্বিক, ছিলেন আরেক কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়। অযান্ত্রিক দেখার পর সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন “ ঋত্বিক বাবু সময়মত ছবিটি দেখাতে পারলে উনি হতেন পথিকৃৎ। সমাজ জীবনের যন্ত্রণা চলাকালীন সময়ে উনি কমিউনিস্ট ভিত্তিক রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন।১৯৬৬ সালে ঋত্বিক পুনের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইন্সটিটিউটে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে যোগ দেন এবং পরে ভাইস প্রিন্সিপাল হন। উনি সিনেমা বানানোর চেয়েও উনার শিক্ষকতা পেশাকেই এগিয়ে রাখতেন। কারণ উনার শত শত ছাত্র ছড়িয়ে পরেন দেশ তথা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে।  তিতাস একটি নদীর নাম সিনেমার কাজ চলাকালীন সময়ে উনি যক্ষ্মায় আক্রান্ত হন। চল্লিশের দশক থেকে শুরু করে সত্তর এর দশক পর্যন্ত সমাজ জীবনের দুঃখ দুর্দশার প্রতিফলন পাওয়া যায় উনার সৃষ্টিতে। সেই প্রতিফলন দেখার জন্য দৃষ্টি ক্ষমতা হয়তো তখন আপামর বাঙ্গালীর ছিল না। উনি একবার রাগ করে এক ইন্টার্ভিউতে বলেওছিলেন “ ইদানিং সত্যজিৎ বাবুদের ছবি আর ছবি দেখতে যাওয়া দর্শকদের দেখলে বেশ আনন্দ হয়, একদিন হয়তো বাংলা সিনেমার আরো শিক্ষিত দর্শক হবে হয়তো সেদিন আর ঋত্বিক থাকবে না। “ ভাবো ভাবো ভাবা প্র্যাকটিস করো” এই ইঙ্গিত হয়তো তখন আমাদের বোধের ছিলো না। ব্যক্তিগত জীবনে অভাব-অনটন, ঝড়-ঝঞ্ঝা ছিল, কিন্তু তিনি নিজের দর্শনের সঙ্গে আমৃত্যু আপস করেননি। কাজের স্বীকৃতি সীমিত হলেও তিনি তাঁর সৃষ্টির তাড়না থেকে বিচ্যুত হননি কখনও।

 

স্ত্রী সুরমা ঘটককে তিনি বলতেন, ‘লক্ষ্মী, টাকাটা তো থাকবে না, কাজটা থাকবে। তুমি দেখে নিও আমি মারা যাওয়ার পর সব্বাই আমাকে বুঝবে।’ একবার ইন্টার্ভিউতে অনেক বিরতি দিয়ে ছবি বানানো নিয়ে এক সাংবাদিক উনাকে প্রশ্ন করলে উনি সরাসরি বলেন দেখুন আমি পরিচালক আর স্রষ্টার মধ্যকার একটা পার্থক্য খুব পরিষ্কার চোখে দেখি, একজন পরিচালক যেকোনো একটি বিষয় নির্বাচন করেন বাঁ গল্প নির্বাচন করে সংলাপ চিত্রনাট্য  নির্বাচিত চরিত্রদের মাঝে বিপণন করেন শুটিং করেন, এডিটিং করান তারপর ছবিটিকে সবার সামনে নিয়ে আসেন, আর একজন স্রষ্টা জীবন, সমাজ থেকে বিষয়কে তুলে এনে গল্পে রূপ দেন, আস্তে আস্তে নিজের মধ্যে লালন পালন করতে থাকেন, গল্পের চরিত্রদের নিজের সন্তান সুলভ লালন পালন করতে থাকেন, তাদের আচার আচরণ , পোশাক আবরণ, অভ্যাস দিয়ে বড় করে তোলেন গল্পের জন্য তারপর সংলাপ, শুটিং , এডিটিং করে তার নির্মাণকে সবার সামনে নিয়ে আসেন। একজন পরিচালক অনেক কিছু করতে পারেন কিন্তু একজন স্রষ্টা পারেন না। তাই সময় লাগে। আমাদেরও লেগেছে এমন একজন  নক্ষত্রকে উনার সময়কে ধরতে না পারার কষ্টকে আগলাতে, উনাকে বুঝতে। সত্যই হয়তো বাংলা সিনেমার ক্ষণিক শিক্ষিত দর্শক হয়েছে, হয়তো আরো হবে কেবল একজন ঋত্বিক কুমার ঘটক দেখে যেতে পারেন। কিন্তু বাংলা চলচ্চিত্র বাঁ বিশ্ব চলচ্চিত্র আজন্ম দেখবে, মনে রাখবে আপনার নাম তথা আপনার সৃষ্টি স্বর্ণাক্ষরে। ঋত্বিক বেঁচে থাকবে স্রষ্টা হয়ে তাঁর সৃষ্টির আলোয়।