গান শোনার একাল-সেকাল

গান মানুষের আত্মার খোঁড়াক।একটা ভাল গান নিমিষে আপনার মন কে যেমন ভাল করে দিতে পারে তেমনই একটি খারাপ গান আপনার মন খারাপ করে দাওয়ার জন্য যথেষ্ট । গান যেমন তার সুরের মাধুর্যে মন জয় করে নেয় – গান তেমনই ভেতরের প্রতিবাদী সত্ত্বা কে জাগিয়ে তুলে । যেমন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান গুলো মুক্তিযোদ্ধা দের উদ্দীপ্ত করত । গান একটি শক্তিশালী হাতিয়ার ও । আজ আর গান নিয়ে কথা বলব না ।কথা বলব গান শুনার কিছু মাধ্যম নিয়ে।

আমার কিছুটা বোধশক্তি হওয়ার আগেই হয়ত গানের সাথে পরিচয় । কারণ পরিবারের সবাই গান করে। কিছুটা বুঝতে শিখার পর একটা জিনিস দেখলাম । জিনিস টার ভিতর থেকে গান বাজে । আমি ভাবছি সে কি কথা জিনিস তার আকার তো একটা হারমনিয়ম এর চে ও ছোট কিন্তু এর ভিতর থেকে মানুষ গান গায় কিভাবে – তাও আবার বিভিন্ন ভাষায় ! যখন কোরাসে গণসংগীত হত তখন ভাবতাম একটু আগে একটা মানুষ গান গাইলো কিন্তু আমি ত এইখানেই বসে ছিলাম তাহলে অন্য রা ঢুকলো কিভাবে। একদিন যন্ত্র টার ভিতরের মানুষ গুলো আর গান গাচ্ছে না। কি হল কি হল!!!!!

মামা এসে বলল আজ ঐ যন্ত্র টা খুলব।কারা গান গায় দেখে নিস।তবে এক শর্ত আছে – আজ দুপুরে শাক -সবজি যা রান্না করবে তকে খেতে হবে। এ আর কি ! স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে আর কি। দাতে দাত চেপে করলা-আলুর ভাজি টাও খেলাম আজ । এরপর এল সেই মহেন্দ্রখন – মামা যন্ত্র টা খুলল।আমার সব খুশি ও উরে চলে গেল । এ মা এর ভেতর যে সুধু বিভিন্ন যন্ত্র – মানুষ কই ! যাদের দেখা পাওয়ার জন্য দাতে দাত চেপে তেঁতো করলা-আলু ভাজি খেলাম তারা কই!!!

মামা বললেন এটা একটা যন্ত্র ।এর এন্টেনা দেখিয়ে বললেন অনেক দূরে রেডিও স্টেশন এ শিল্পী রা গান গায় বা গান বাজানো হয় । সেই তরঙ্গ আকাশে ছরিয়ে দাওয়া হয় আর এই এন্টেনা সেই তরঙ্গ গ্রহন করে ফলে গান বাজে। আর ক্যাসেটের মাধ্যমে ও গান বাজানো যায়। আমি ক্যাসেট টা দেখলাম । দুই দিকে দুটো গোল চাকার মত জিনিস এর উপর কালো ফিতা জড়ানো ।
দিন কাটতে লাগল এই ক্যাসেট প্লেয়ার আর রেডিও তে গান শুনে শুনে। আমি ও কিছুটা বড় হয়েছি । ক্লাস ২ তে পড়ি । ক্যাসেট প্লেয়ার এর একটা বড় সমস্যা ছিল এর ফিতা মাঝে মাঝে প্লেয়ার এর সাথে জড়িয়ে যেত। সেটা আবার ক্যাসেট এর চাকার মত অংশে কলম বা পেঞ্ছিল ঢুকিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঠিক করতে হত।

ক্যাসেট

একদিন আমার নানি যাবেন তার বাবার বাড়ি । বাড়ি পুরান ঢাকা । আমি তার পিছন ছাড়ছি না।অবশেষে তিনি আমাকে সাথে নিয়েই গেলেন। বাড়ি তে গিয়ে ত আমি একটা যন্ত্র দেখে অবাক হয়ে গেলাম – এই মাইকের মত মাথা লাগানো যন্ত্র টা কি? নানি বললেন এটা গ্রামোফোন/কলের গান ।

গ্রামোফোন
এতেও নাকি গান শুনা যায়। গ্রামোফোন এর গান শুনার জন্য এক ধরনের চাতকির মত জিনিস বসিয়ে গান শুনতে হয়। আজ বুঝি ওই চাতকির মত জিনিস টি সিডি বা ডিস্ক । কিন্তু গ্রামোফোন টা ঠিক না থাকায় ওই দিন আমার আর গ্রামোফোন এ একটা গান শুনার ইচ্ছা টা পূরণ হয়েছিল না।

কিছুদিন পর আমাদের ক্যাসেট প্লেয়ার টা নষ্ট হয়ে গেল। এর কিছুদিন পর একদিন রাতে দেখি বাবা কানের কাছে কি যেন একটা ধরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আবার কানের কাছে নিয়ে পরীক্ষা করছে।কাছে গিয়ে বুঝতে পারলাম এটা রেডিও।বাসায় সাদা কালো টিভি থাকা সত্বেও বাবা কেন যেন রাতে রেডিওতে বিবিসি র খবর শুনার জন্য অধীর আগ্রহে থাকতেন!! রেডিও যে এতো ছোট হয়ে গেছে ভেবেই অবাক লাগছিলো তখন।রেডিও এখন আমার প্যান্টের পকেটেই এটে যায়।শুয়ে থাকার সময় বালিশের পাশেই রাখা যায়।দুটো পেন্সিল ব্যাটারিতেই সপ্তাহ চলে যায়।আবা র কারেন্টেও চলে… একদম ঈদের চাঁদ হাতে পাওয়ার মত ব্যাপার।ঈদে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার আগে এই রেডিওকে ঘিরে যে কত ব্যাস্ততা! দুই সেট ব্যাটারি সাথে রাখতাম যদি ফুরিয়ে যায়……….

কিন্তু, এই রেডিও তেও এক অপূর্ণতা ক্যাসেট গুলো তো আর বাজানো যাচ্ছে না.. ক্যাসেটের যে সাইজ রেডিওটার সাইজ এর চেয়ে খুব একটা বড় না।

এই অপূর্ণতাও বেশিদিন থাকলো না যখন জন্মদিনে মামা নিয়ে এলো ছোট রেডিও। না রেডিও নয় এতো দেখি ক্যাসেট প্লেয়ার। কিন্তু আকারে ছোট রেডিওগুলোর সমানই। ক্যাসেট গুলোও আকারে ছোট। মামা বললেন এর নাম ক্যাসেট ওয়াকম্যান। এই ক্যাসেট ওয়াকম্যান প্লেয়ার আমাকে আরেকটা জিনিসের সাথে পরিচয় করালো তা হলো হেডফোন।গান বাজিয়ে হেডফোন কানে দিয়ে আমি শুনছি কিন্তু আর কেউ শুনছে না!
ক্যাসেট ওয়াকম্যানের দু বছর যেন জীবণের সবচেয়ে স্মরণীয় বছর।

ক্যাসেট ওয়াকম্যানের দিন শেষ হয়ে গেলো।ক্যাসেট ওয়াকম্যানের ক্যাসেট পাওয়া যাচ্ছিলো না।দোকান শুধু সিডিতে ছয়লাব। বাজারে নতুন এসেছে ডিভিডি।
প্রযুক্তি এ দিনগুলোতে দৌড়াতে শুরু করেছে…
সিডি/ ডিভিডির ডিস্কগুলো দেখে মনে পড়লো গ্রামোফোনের ডিস্কের কথা। ডিভিডির ডিস্কগুলো ওই গোলই শুধু ছোট।
সিডি/ডিভিডি আর কেনা হচ্ছিলো না।বাবাও কেনার কোন আগ্রহ দেখালেন না। বিবিসি ছেড়ে বাবাও ততদিনে টিভিতে মজে গেছেন।

তাও বাবা ডিভিডি কিনেছিলেন শুধু একটা কথা রাখার জন্য।বাবা বলেছিলেন পঞ্চম শ্রেণীতে ভালো করলে ঘরে ডিভিডি আসবে।তাই অনিচ্ছা সত্বেও বাবা ডিভিডি কিনলেন।ডিভিডিতে ক্যাসেট প্লেয়ারের চেয়ে একটা হলেও সুবিধা – আর যাই হোক ফিতা তো আর পেঁচিয়ে যাবে না……

হঠাৎ, একদিন দেখি মস্কো থেকে খালা সবার জন্য কিছু না কিছু পাঠিয়েছে। দেখি আমার জন্যও একটা প্যাকেট।খুলে দেখি ওয়াকম্যান।এই ওয়াকম্যানে সিডি চলবে ক্যাসেট না।আমার খুশি দেখে কে….. 
কিন্তু সেই খুশি বিষাদে পরিণত হতে সময় নিলো দু ঘন্টা। যখন দেখলাম এই ওয়াকম্যান দুই ঘন্টায়ই দুটি পেন্সিল ব্যাটারির চার্জ সাবাড় করে নিয়েছে।তারপর ওয়াকম্যান টিকে সাজিয়ে রাখা ছাড়া আর কিছু করিনি।
প্রযুক্তির দৌড় ডিভিডিকে যেনো কোমড় সোজা করে দাড়ানোর আগেই ধাক্কা দিলো।বাজারে এলো নতুন ওয়াকম্যান যাতে সিডিও চলবে না – ক্যাসেটও চলবে না।এতে স্টোরেজ দেওয়া আছে এতে কম্পিউটার থেকে গান ভরে চালাতে হবে। পেন্সিল ব্যাটারির যুগ থেকে রিচার্জেবল ব্যাটারির যুগ এলো।এরপর গান শোনার জন্য আরও এলো আরও ওয়াকম্যানের নতুন ভার্সন,এলো MP3 প্লেয়ার,MP4 প্লেয়ার,MP5 প্লেয়ার,MP6 প্লেয়ার, PHP আরও অনেক কিছু।

MP3 প্লেয়ার তো গান শোনার যন্ত্রের আকারের ইতিহাসটাই অন্যরকম করে লিখলো।পরিচয় করালো ইয়ারফোনের সাথে। MP4,MP5,MP6,PHP তে তো ভিডিও গানও চলে।
প্রযুক্তির দৌড়ে ২০১৬ সালে এসে MP4,MP5,PHP দিন ও চলে গেছে স্থান দখল করে নিয়েছে স্মার্টফোন।এক মোবাইলেই সবকিছু।কথা বলা, গান শোনা, ছবি দেখা, ম্যাপ ব্যবহার,ইন্টারনেট ব্যবহার থেকে শুরু করে সবকিছু।
তখনকার ওয়াকম্যান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান সনি তাদের ওয়াকম্যানের যুগের স্মৃতিকে বাচিয়ে রেখেছ তাদের Xperia স্মার্টফোনগুলোর ডিফল্ট মিউজিক প্লেয়ারের নাম ওয়াকম্যান রেখে।
প্রযুক্তি দৌড়ে চলছে।গান শোনার প্রযুক্তির যন্ত্রগুলির একাল সেকালে আরও কিছুদিন পর হয়ত স্মার্টফোনে গান শোনাও সেকেলে হয়ে যাবো।তবুও ফিতে জড়িয়ে যাওয়া ক্যাসেট প্লেয়ারের দিনগুলো স্মৃতিতে জড়িয়েই থাকবে…….