জঙ্গলে মঙ্গল নেই – শেষ পর্ব

চার

ছেলের শোকে একটা সময় রবিতাভ পাগল হয়ে যায়।তারপর থেকে মজিবর ও ভানু দুইজনই নিখোঁজ।শুনেছি কিছুদিন পর মজিবর ও ভানুর মৃতদেহ নদীর ঘাটে আর রবিতাভের লাশ পাওয়া যায় জঙ্গলে।তিনটি লাশের গলায় ছিলো দুইটি ফুটো।তাদের শরীর দবদবে সাদা হয়ে গিয়েছিল।লোকেরা ভয়ে এবার গ্রাম ছেড়েই পালালো।লাশগুলোর সৎকার করা হয়নি।পচেগলে যথার লাশ তথায় মিশে যায়।আমি একজন ভারতীয় ফরেন সাইকোলজিষ্ট। ভুতও প্রেতাত্মা নিয়ে বহু দিন ধরে গবেষণা করছিলাম। বলিগাঁও থেকে অদূরে একটা পাহারে ক্যামপিং ছিলো আমার।ভূত প্রেত নিয়ে গবেষণার সুবাদে জঙ্গল পাহাড় কোন কিছুই ঘেঁটে দেখা বাদ রাখিনি।একদিন, একজন চাকমা মারফত আমার কাছে একটা চিঠি আসে।আমার বন্ধু রিংকি চাকমা লিখেছেন।এখানেই তার গ্রাম।সে আমাকে এই বলিগাঁও চেটার্জী বাড়ির খবর জানায়।তার চিঠি পেয়ে আমি রীতিমতো হকচকিয়ে গেলাম।গত বছর আমার এই বন্ধু নদীতে গোসল করতে গিয়ে ডুবে মারা যান।তিনি শহুরে লোক হওয়ায় সাঁতার জানতেন না।গাঁয়ের লোকেরা বহুচেষ্টা ও কসরত করেও তার লাশ আর খুঁজে পায়নি।তবে তিনি মারা গেছেন।তা না হলে এতোদিন নিখোঁজ থাকার কথা নয়।অন্তত লাশের খবর তো পেতাম।আজ সেই বন্ধু আমাকে চিঠি দিয়েছে।লিখেছে,তোমার চলমান ভূত প্রেত নিয়ে গবেষণার কথা আমি জানতাম।বলিগাঁও চেটার্জী বাড়িতে এসো এবং সেখান আমিও থাকবো।এই বাড়িটি খুব রহস্যময়। তোমার গেবষণার কাজ এখানে জোড়ালো ভাবে চালাতে পারবে।দুই বন্ধু মিলে কাজ দ্রুত আগাতে পারবো।ভেবেছিলে মরে গেছি তাই না..?অতো সহজ নয় একজন বিদেশ ফিরত যুদ্ধবাজ সৈনিকের মৃত্যু।আমি একটু আশ্চর্য হলেও পরে বিষয়টা স্বাভাবিক ভাবেই নেই। কারণ সে হয়তো কোন কারণে নিজে থেকে গোপন হয়েছে আর হঠাৎই আমাকে চমকে দিয়েছে।কিন্তু তার পরিবারেও আমি খোঁজ করেছিলাম।তারা তার মৃত্যুর খবর ছাড়া আর কিছুই আমাকে দিতে পারে নি।তারপর বহু নথিপত্র ঘেটে,আশেপাশের গাঁয়ে খোঁজ খবর নিয়ে এ বাড়ির ইতিহাস জানতে পারি।কিন্তু বন্ধুর নিমন্ত্রণ এতো সহজ ভেবে নেওয়াটাও বোধহয় সহজ ছিলো না।সেই একটি চিঠিই আমার জন্য অমঙ্গল বয়ে আনলো।একদিন রাতে……
এই শব্দটার পর থেকে সমানে চলার পথ বন্ধ হয়ে গেলো। জমাট বাঁধা রক্তের পরত পরে আছে প্রতিটি পাতায়।কিছু কিছু লেখার আংশিক বুঝা গেলেও বেশির ভাগ শুকনো রক্তের পরতে চাপা পরে আছে।আসিফ দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ছেড়ে ডায়েরিটা রেখে দিলো।তার মানে ওই সাইকোলজিষ্ট ও আর বেঁচে নেই। আসিফের বুকে দরফর বেড়ে যাচ্ছে।মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছে সে।কপালে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম লাইটের হীন আলোয় চিকমিক করছে।অন্যদিকে মজিবর ও কিছু কালো ছায়ার মতো মানুষগুলো নদী ঘাট থেকে মন্দিরের দিকে আসছে।তাদের পায়ের ঘেঁষ ঘেঁষ শব্দ স্পষ্ট কানে এলো।সিঁড়ির আঁড়াল থেকে আঁড়চোখে তাদের লক্ষ করলো সে।বাহিরে কুয়াশাচ্ছন্ন হলেও বেশ গরম লাগছে তার।ওরা মন্দিরের কাছাকাছি যেতেই ঝেরে একটা দৌড় দিলো আসিফ।লোহার মস্ত বড় দরজাটা একটানে খুলে প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে সে।রাতের অন্ধকার আর কুয়াশায় ঢাকা পথ।নিশাচর থেকে থেকেই ডাকছে।প্যাঁচার হুক হুক সুর যেন ভয়াবহ সময়ের সংকেত দিচ্ছে।প্রাণের বড্ড মায়া আছে তার।নিশ্ছিদ্র অন্ধকার ভেদ করে কোথায় যাচ্ছে ঠিক নেই।বাঁচতে হবে তাকে।দিক ভুল হলে হোক।তবুও দূরে পালিয়ে যেতে হবে।কিন্তু পথ যেন শেষ হবার নয়।
হঠাৎ হোচট খেয়ে পরে গেলো সে।নিশ্বাসের দোলায় খুব দ্রুত ফুসফুস ফুলেফেঁপে উঠছে আবার নামছে।শরীর কেমন ভার হয়ে আসছে।অন্ধকার থেকে বেড়িয়ে আসা একটি হাত সাহায্যের জন্য বাড়িয়ে দিলো।আসিফ শক্ত করে সে হাতটি চেপে ধরে উঠে দাঁড়ালো।যেন এমন কার অপেক্ষায় ছিলো সে।চোখের পাতা নেমে আসছে।সব কিছু কেমন এলোমেলো। দৃষ্টি ঘোলাটে লাগছে।ক্লান্ত কণ্ঠে বলল, কে আপনি? লোকটা খিলখিল হাসিতে মেতে উঠলো।বলল,আমারে চেনো না?সে আবার খিলখিল করে হাসতে লাগলো।হাতে একটা লাঠি উশখুশ চুল,ছেঁড়া কাপড়।আসিফ চোখ মুছে ভালো করে তাকিতেই যেন আকাশ থেকে পরলো।আরে এ তো সেই পাগলটা।আসিফ ভয়ে পিছিয়ে এলো।সে বললো,কইছিলাম না সব মিথ্যা, সব… মিথ্যা। এইহানে মিথ্যারা ভয়ংকর। আমার কথাতো হুলেন না।তায় অহন আর সময় নাই।ওরা আপনেরে প্রাণে বাঁচতে দিবো না।সে আবার খিলখিল করে হাসতে লাগলো।আসিফ কাঁপা কাঁপা গলায় বললো কে আপনি?কি আপনার পরিচয়? লোকটা চলে যাবার সময় বলল,আমি রবিতাভ,রবিতাভ চেটার্জী।অতপর সে আস্তে আস্তে আঁধারে মিলিয়ে গেলো।আচমকা তার পিছনে কেও এসে দাঁড়ালো।শক্ত কিছু একটা দিয়ে মাথায় তীব্র আঘাত করতেই টলতে টলতে মাটিতে পরে গেলো আসিফ।মাথা ফেটে রক্ত পড়ছে।দৃষ্টি ছোট হয়ে আসছে।দেখতে পেলো মজিবর একটা পাথর হাতে দাঁড়িয়ে আছে।মুখে বড়বড় দাঁত, ধারালো হাতের নোখ লম্বা একটা জিহ্বা বের করে হাসছে।মাথা থেকে গড়িয়ে পরা রক্ত চেটেপুটে খাচ্ছে। আসিফ আর টিকতে পারছে না। ধীরেধীরে তার চোখ বন্ধ হয়ে যায়।

জঙ্গলের ভেতর ঘুটঘুটে অন্ধকার।গাছে-গাছে বাদুড়ের ঝাপ।ঝরে পরছে শুকনো পাতা। কঙ্কালের হাড়ের মতো গাছের ডালপালা।স্থির জোনাকির আলো জ্বলছে বোধহয়,ভালো করে তাকাতেই বুঝা গেলো শেয়ালের দৃষ্টি সেটা।অবাক চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।হুঁ হুঁ করে থেকে থেকেই কেঁদে উঠছে।শিরশিরে বাতাসে যেন নরকের অনুভূতি। আসিফ উঠে বসলো।মাথা থেকে প্রচুর রক্ত ঝরছে।গায়ের টি শার্ট খুলে শক্ত করে মাথায় বেধে নিলো।শরীরটা এখন একটু হাল্কা লাগছে।কোন ঢর ভয় লাগে না আর।দূরে কোথাও টিমটিমে আলো জলছে।জঙ্গলে গাছের ফাঁকফোকরে সে আলো গোল গোল বৃত্তাকার হয়ে ভাসছে।পথের এ বাঁক তার চেনা।কাল সকালে ঢাকার উদ্দেশ্যে ট্রেন ধরতে হবে।তার মায়ের অনেক শখ ছিলো পাহাড়ের পাশাপাশি থাকার।নদী ঝর্ণা আর সবুজের মায়াময়রূপ খুব কাছ থেকে দেখার।আকাশের নীল মেঘের আঁড়ালে রোদের লুকোচুরি।এর সব কিছুর সন্ধান পাওয়া গেছে এই বলিগাঁও জঙ্গলে।সে তার মাকেও এখানে আনতে চায়।আসিফ খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে।এক সময় জঙ্গলের মধ্যে অমিতাভের গাড়ি দেখে সে দাঁড়িয়ে গেলো।তার একটু দূরে কিসের যেন উৎসব হচ্ছে।খুড়ো পায়ে ধীরেধীরে এগিয়ে এলো।একটা গাছের সাথে শক্ত করে ধরে দাঁড়ালো সে।অগ্নি মন্ডপ জলছে।মানুষের হাড় দিয়ে তৈরী একটা সিংহাসনে বসে আছে অমিতাভ ও তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে ভানু।মজিবর ভয়ংকর চেহারয় এক দৃষ্টিতে আগুনের ভেতর চেয়ে আছে।একটা লাঠি আগুনের মধ্যে ঘুরছে আর তাতে কিছু একটা গাঁথা। সামনে কিছু লোক বসে আছে। সবাই ক্ষুদার্থ।মুখ থেকে জিব বেড়িয়ে পরেছে।একটা প্লেটে টকটকে লাল হৃদপিণ্ড এনে হাজির করা হলো।অমিতাভ মনান্দে মুখে পুরে চিবুতে লাগলো সেটা।হঠাৎ বুকে হাত পড়লো আসিফের।বুকের মধ্যখানটা কাটা।গরগর করে রক্ত ঝরছে। আসিফ চমকে গিয়ে বলল এটা কি হলো।আসিফ আবার সামনে তাকায়। আগুনের চুল্লীতে তারই দেহ জলছে।সবাই সেই কড়কড়ে চর্বিতে ভাজা দেহটা নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে।অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আসিফ তালুকদার।মনেমনে ব্যথাতুর হয়ে কান্নায় ভেঙে পরে।সে বলে,আমি আর বেঁচে নেই।”জঙ্গলেই মঙ্গল ” এই ওমর বানীকে তাচ্ছিল্যের রসে তেঁতো মুখে থুতু দিয়ে বললো,”জঙ্গলে মঙ্গল নেই “।

—————সমাপ্ত————–