টাইটানদের সাথে যুদ্ধের পর জিউস যখন স্বর্গের একচ্ছত্র অধিপতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন তখন তিনি প্রমিথিউসকে মানুষ সৃষ্টি করতে বলেন। এরপর মানুষকে সাহায্য করার জন্য শাস্তিও পান তিনি। এসময় পৃথিবীতে বাস করতেন টাইটান প্রমিথিউস ও ওশেনিড প্রোণোয়ার ছেলে ডিওক্যালিয়ন। পিতা টাইটান এবং মাতা ওশেনিড হলেও ডিওক্যালিয়ন ছিলেন সাধারণ এক মানুষ। তবে আচার নিষ্ঠা ধার্মিকতায় তিনি ছিলেন অনন্য।
জিউস ভেবেছিলেন, মানব সম্প্রদায় যদি সুখে শান্তিতে বসবাস করে তাহলে তারা শ্রেষ্ঠত্বে একদিন দেবতাদেরও ছাড়িয়ে যাবে। আর এই অগ্রযাত্রাকে আটকাতেই জিউস মানবজাতিকে উপহারস্বরূপ পাঠালেন প্যান্ডোরাকে। প্যান্ডোরার ছিল এক বাকশো । প্যান্ডোরা যখন তার বাকশো খুলল তখন বাকসো থেকে মিথ্যা, ভন্ডামি, অপরাধ, রোগ শোক, জরা, লোভসহ সব খারাপ জিনিস ছড়িয়ে পরল পৃথিবীময়। মানুষ একে অপরের সাথে মারামারি, কাটাকাটি, হানাহানি করতে লাগলো। চারদিকে এক অন্ধকার যুগ নেমে এলো। জিউসের মনের ইচ্ছায় যেন বাস্তব রূপ পেতে লাগলো। চূড়ান্ত এক বিশৃঙখলায় রুদ্ধ হয়ে গেল মানবজাতির অগ্রগতি।
এই অন্ধকার যুগের সবচেয়ে অধার্মিক ও অসৎ রাজা ছিলেন লাইকায়ন। আর্কিডিয়ার রাজা লাইকায়ন ও তার পঞ্চাশ পুত্রের মতো অধার্মিক ও অহংকারী, দুশ্চরিত্র, নিষ্ঠুর মানুষ আর কেউ ছিল না তখন। পাপের কালিমায় তাদের অন্তর ছিল পরিপূর্ণ। স্বয়ং জিউসও তাদের এই দুরাচারের খবর জানতেন বেশ ভালভাবেই। একদিন জিউস ভাবলেন তিনি আর্কিডিয়ার রাজা এবং প্রজাদের পরীক্ষা করবেন। আগে থেকেই এই বেপারে সংকেতও দিয়ে রাখলেন আর্কিডিয়ার সবাইকে। অনেকেই এ সংকেতে বেশ ধার্মিক হয়ে উঠল। অসৎ পথ ছেড়ে ভাল কাজ করতে শুরু করল। কিন্তু লাইকায়ন অট্টহাস্য করে বললেন,”কে এই জিউস? সে আসলেই দেবতা কি না তা খুব শীগ্রই বের করে ফেলব আমি। দেখব কেমন তার শক্তি!”
এবার জিউস নেমে এলেন মর্ত্যে। আর ছদ্মবেশ ধারণ করে লাইকায়নের প্রাসাদে গিয়ে উঠলেন। রাতের খাবারের সময় জিউসকে পরীক্ষা করার জন্য এক বালককে হত্যা করে সেই বালকের মাংস খেতে দেন জিউসকে। অনেকের মতে এই বালক ছিল লাইকায়ন এর নিজের ছেলে নিকটিমোস। প্রথম গ্রাস মুখে দিতেউ জিউস বুঝে ফেললেন সবকিছু। তারপর আর কি? জিউস তার বজ্র দিয়ে লাইকায়নের মাথায় আঘাত করে তাকে ও তার ছেলেদের নেকড়ে মানবে পরিণত করলেন। বাদ থাকল শুধু নিকটিমোস। অনেকের মতে, জিউস নিকটিমোসকে পুনরায় জীবিত করেছিলেন। যাইহোক পরবর্তীতে আর্কিডিয়ার রাজা হয় নিকটিমোস।
এ ঘটনায় জিউস মানবজাতির উপর যারপরনাই ক্ষেপে যায়। ভাবলেন, “আমার আদেশে তৈরি করা এই চুনোপুঁটির মতো একদল মানুষ আমার ই অবাধ্য হয়? পাপে পূর্ণ হয়ে গেছে এই ধরিত্রী। অহমিকায় অন্ধ মানবজাতি বুঝতেই পারছে না আমার ক্রোধ কতটা ভয়ঙ্কর। না এ জাতিকে আর পৃথিবীতে রাখা যাবে না। আমি সমূলে ধ্বংস করে দেব এই জাতিকে। ”
জিউস তার ভাই সমুদ্রদেবতা পসাইডনকে ডাকলেন। বললেন, “মানব জাতির শঠতা, মিথ্যাচারিতা এবং সীমা লঙ্ঘন মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছে। আমি যেভাবে একটা প্রাসাদকে ধূলোয় মিশিয়ে দিয়েছি ঠিক তেমনি সম্পূর্ণ মানবজাতিকে ধ্বংস করে ফেলব। তুমি এ কাজে আমাকে সাহায্য করবে।”
প্রমিথিউসের ছেলে ডিওক্যালিয়ন প্রতিবছর ককেশাসের চূড়ায় যেতেন বাবাকে দেখতে। এবার যখন ডিওক্যালিয়ন তার বাবার সাথে দেখা করতে গেলেন তখন প্রমিথিউস তাকে মহাপ্লাবনের সংকেত দিলেন। পুত্রকে পরামর্শ দিলেন প্রস্তুতি নিয়ে রাখার। নিজেকে প্রস্তুত করার। বললেন, “কখনোই পাপের পথে পা বাড়াবে না। সর্বদা সত্যের পথে চলবে। দেবতাদের উপাসনা করবে।” পিতার পরামর্শ শুনে ডিওক্যালিয়ন একটি মজবুত নৌকা তৈরি করলেন। ডিওক্যালিয়ন এর স্ত্রীর নাম পীরা। পীরা ও কিন্তু সাধারণ কেউ নন, তিনি ছিলেন এপিমিথিউস ও প্যান্ডোরার কন্যা। তিনিও ছিলেন সৎ, ধার্মিক এবং নিষ্ঠাবান।
পূর্ব পরিকল্পনামতো জিউস ও পসাইডন বৃষ্টি বর্ষণ শুরু করলেন। মুষুলধারে বৃষ্টি নামতে লাগল। সাগর উত্তাল হল। মানুষ উঁচু জায়গার খোঁজে এখান থেকে ওখানে দৌড়ে বেড়াতে লাগল। কিন্তু বৃষ্টির তোড়ে সবকিছু পানির নিচে তলিয়ে গেল। এসময় ডিওক্যালিয়ন ও পীরা তাদের নৌকা ভাসালেন। নয় দিন, নয় রাত ধরে চলল ঝড়ের তান্ডব। একই সাথে ভাসতে থাকলেন পীরা ও ডিওক্যালিয়ন। অবশেষে তাদের নৌকা এসে পৌঁছাল পারন্যাসাস পাহাড়ের চূড়ায়। তারা নৌকা থেকে নেমে কোনো জনপ্রাণীর চিহ্ন দেখতে পারলেন না। পুরো এলাকাজুড়ে তারাই একমাত্র জীবিত প্রাণী। পীরা এবং ডিওক্যালিয়ন দুজনেই ছিলেন সৎ এবং ধার্মিক। তাই তাদের প্রার্থনায় খুশি হয়ে জিউস প্লাবনের পানি নামিয়ে দিলেন।
পাহাড় থেকে নেমে এলে তারা শৈবাল আবৃত একটি মন্দির দেখতে পেলেন। সেটি ছিল দেবী থেমিসের মন্দির। এতো ঝড় ঝাপটায় ও মন্দিরটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়নি। এবার পীরা ও ডিওক্যালিয়ন মন্দিরে প্রবেশ করে থেমিস ও জিউসের কাছে কৃতজ্ঞতা জানালেন। এই শূন্য পৃথিবীতে নতুন সম্প্রদায় সৃষ্টির প্রার্থনাও করলেন। এসময় তারা একটি কন্ঠস্বর শুনতে পায়। পেছনে ঘুরে তারা লম্বা, নীলচুলো সুদর্শন এক ব্যক্তিকে দেখতে পেলেন।তার চুল ছিল হলুদ। আর তার জুতা ও টুপিতে ছিল ডানা লাগানো। ডিওক্যালিয়ন প্রথম দর্শনেই বুঝতে পারলেন এই ব্যক্তিটি আর কেউ নন ; বরং জিউসের বার্তাবাহক হার্মিস।অনেকের মতে থেমিস এসেছিলেন তাদের কাছে।
হার্মিস তাদের জিজ্ঞেস করলেন, বৎস, কি চাও তোমরা?
উত্তরে ডিওক্যালিয়ন বলেন, আমাদের পরিবার পরিজন, প্রতিবেশি ও অন্য মানুষ ছাড়া খুবই একা লাগছে। পুরো পৃথিবী যেন এক ধূসর মরুতে পরিণত হয়েছে। এই বিশাল পৃথিবীতে একা বেঁচে থাকা আমাদের জন্য একান্তই অসম্ভব।
এ কথা শুনে হার্মিস বললেন, তোমাদের মাথা অবগুন্ঠিত করো, এবং তোমাদের পিছনে নিক্ষেপ করো তোমাদের মায়ের অস্থিসমূহকে।
এ কথা বলেই হার্মিস হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেন। কিন্তু ডিওক্যালিয়ন এবং পীরা এ কথার মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝতে পারলেন না। কারণ তাদের দুজনের মা ছিল আলাদা। এবং দুজনের মা ই গত হয়েছেন বহুবছর আগে। পীরা না পেরে ডিওক্যালিয়নকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি ওনার কথা কিছুই বুঝিনি। কে হোন আমাদের সকলের মা?
ডিওক্যালিয়ন বললেন, এবার আমি বুঝতে পেরেছি। আমাদের সবার মা হলেন ধরীত্রী মা, গায়া। আমরা সবাই গায়ার সন্তান। কিন্তু গায়ার অস্থি কোনটি?
পীরা বললেন, সম্ভবত নদীর ধারের নুড়ি পাথরগুলোকেই মায়ের অস্থি বলা হয়েছে। যেই ভাবা সেই কাজ। পীরা এবং ডিওক্যালিয়ন তাদের সামনে থাকা পাথরগুলো পেছনে ছুঁড়ে মারতে লাগলেন। ডিওক্যালিয়নের ছোঁড়া পাথরগুলো পরিণত হল পাথর মানবে আর পীরার ছোঁড়া পাথরগুলো পাথর মানবীতে। পাথর থেকে তৈরি হওয়ায় তাদের শারীরিক সামর্থ্য ছিল অনেকবেশি। বন্যার পানিতে ধ্বংস হয়ে যাওয়া পৃথিবীকে দাঁড় করাতে, নতুন করে সাজাতে ঠিক এমনই মানুষের দরকার ছিল।
এরপর সূর্য উদয়ের সাথে সাথে অন্য প্রজাতির প্রাণীও তৈরি হতে লাগল।কিছু প্রাণী আগের রূপে ফিরে এল। কিছু প্রাণী ফিরল নতুন রূপে। এই নতুন পৃথিবীতে ডিওক্যালিয়ন এবং পীরা ই কিন্তু একমাত্র পুরাতন দুনিয়ার মানুষ ছিলেন না। মেগারাস নামের জিউসের এক সন্তান আশ্রয় নিয়েছিলেন জেরানিয়া পাহাড়ের চূড়ায়। এই চূড়াটিও পানিতে ডোবেনি। আসলে মেগারাস ঘুমিয়ে ছিলেন প্লাবন শুরু হওয়ার সময়। এক সারস পাখির শব্দে জেগে উঠে আশ্রয় নেন জেরানিয়ার চূড়ায়। এছাড়া পেলিয়নের কেরাম্বাস ও এক নিম্ফের আশীর্বাদে প্রাপ্ত ডানায় ভর করে উড়ে যান এক পাহাড়ের চূড়ায়। অনেকের মতে অবশ্য পারন্যাসাস পাহাড়ের কিছু অধিবাসীও এ বন্যার হাত থেকে রক্ষা পান। আসলে পসাইডনের এক পুত্র পারন্যাসাস এই শহরের গোড়াপত্তন করেছিলেন। তাই ধারণা করা হয় পসাইডনের আশীর্বাদে বেঁচে যান তারা। ডিওক্যালিয়ন এবং পীরা থেকে জন্মানো সন্তানদের মধ্যে একজন ছিলেন হেলেন। হেলেন ছিলেন পুরো হেলেন্সটিক সভ্যতার প্রথম মানুষ।
নতুন পুরাতন মিশেলে তৈরি এই মানবসম্প্রদায় এরপর পুরোদমে বিশ্ব নির্মানে মনোনিবেশ করে। ডিওক্যালিয়নের প্লাবনের সাথে সুমেরীয় পোরাণিক কাহিনিতে পাওয়া মিথের অনেক মিল রয়েছে। যাই হোক লক্ষণীয় বিষয় হল, সব মিথেই বন্যা থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষরা ছিল ধার্মিক এবং সৎ।